Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাইন্ডগেম ইন ফুটবল: স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ‘আগ্রাসী’ নীতি

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এই মৌসুমেই প্রিমিয়ার লিগের বড় ম্যাচে লিভারপুলের কাছে ২-১ গোলে হেরে বসে টটেনহ্যাম হটস্পার। ম্যাচে পুরো খেলায় আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল লিভারপুল, জয়টাও তারাই পায় শেষ পর্যন্ত। কিন্তু ম্যাচশেষে লিভারপুল বস ইয়ুর্গেন ক্লপের সাথে হাত মেলানোর সময় টটেনহ্যাম ম্যানেজার জোসে মরিনহো বলে বসেন,

“সেরা দলটাই খেলায় হেরেছে।”

‘দ্য স্পেশাল ওয়ান’-খ্যাত জোসে মরিনহোকে গণমাধ্যমের সামনে প্রায়ই বেশ বিতর্কিত মন্তব্য করতে দেখা যায়। কোচিং ক্যারিয়ারের পুরো সময়টিতেই তিনি ম্যাচের আগে কিংবা পরে মিডিয়ার সামনে অসংখ্য মন্তব্য করেছেন, যেগুলো অনেকের কাছে হাস্যকর ঠেকেছে, অনেকের কাছে মনে হয়েছে উদ্ভট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়শই তার বিতর্কিত মন্তব্যগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু একটা বিষয়ে তার কট্টর সমালোচকেরাও একমত হবেন, তিনি দুর্দান্ত একজন কোচ। গণমাধ্যমে দেয়া তার মন্তব্য নিয়ে হাসাহাসি হলেও কোচ হিসেবে তার মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না কেউই। তার একঘেয়ে ‘বাসপার্কিং’ কৌশল অনেকের কাছেই বিরক্তিকর ঠেকে। কিন্তু এই কৌশল অবলম্বন করেই একাধিকবার ইউরোপ সেরা হয়েছেন, সমালোচকদের মুখ কুলুপও এঁটে দিয়েছেন অনেকবার।

এবার ফুটবল ছেড়ে একটু বাইরের দিকে তাকাই। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেট খেলা বেশ জনপ্রিয়। নিয়মিত ক্রিকেট দেখেন কিন্তু ‘স্লেজিং’ (Sledging) শব্দটি শোনেননি, এমন মানুষ বোধহয় পাওয়া যাবে না। প্রতিপক্ষের প্রতি অপ্রাসঙ্গিক বাক্যবাণ ছুঁড়ে দিয়ে তার মনোযোগ নষ্ট করে দিতে খেলোয়াড়েরা প্রায়ই এই ‘ডার্টি ট্রিক’ ব্যবহার করেন। স্লেজিংয়ের জন্য অজি খেলোয়াড়দের আবার আগে থেকেই বিশেষ সুনাম (!) রয়েছে। অ্যাশেজ নামে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের যে পাঁচ ম্যাচের ঐতিহ্যবাহী টেস্ট সিরিজ আয়োজিত হয় প্রতি বছর, সেখানে কিন্তু দর্শকদের একটি বড় স্লেজিংয়ের উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলো অবলোকনের বসে থাকে গ্যালারিতে কিংবা টিভি পর্দার সামনে।

কখনো কি ভেবেছেন, বর্তমান টটেনহাম হটস্পার কোচ জোসে মরিনহো মিডিয়ার সামনে এভাবে যে ‘হাস্যকর’ কিংবা ‘উদ্ভট’ কথাগুলো বলে থাকেন, সেগুলো কি তিনি শখের বশে পাগলামি করে কিংবা নেহায়েত পত্রিকার শিরোনাম হওয়ার জন্য বলেন? নাকি এসবের পেছনে আলাদা কোনো কারণ রয়েছে?

Image Credit: Getty Images

 

বর্তমানে প্রতিটা ক্লাবই অভিজ্ঞ মনস্তত্ত্ববিদ নিয়োগ দেয়, যাদের কাজ হলো খেলোয়াড়দের মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে, কোনো খেলোয়াড় যেন ‘ট্রমা’ কিংবা আত্মবিশ্বাসহীনতায় না ভোগেন। জোসে মরিনহোর মতো বাকপটু কোচেরা খেলার আগে খুব সুনিপুণভাবে বিপরীত টিমের খেলোয়াড় কিংবা কোচের মনোযোগ খেলার পরিকল্পনা থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করেন, মাঠে নেমে শারীরিক খেলাধুলার আগেই একচোট ‘মাইন্ডগেম’ খেলে ফেলেন। এক্ষেত্রে যে খেলোয়াড়কে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য ছোঁড়া হয়, তার জন্য আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি কিংবা অতিরিক্ত চাপ অনুভব করার বিষয়টি খুব স্বাভাবিক। সেই সাথে বাজে পারফর্মেন্সের জন্য নিয়মিত একাদশ থেকে বাদ পড়া, সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ, সামান্য ভুল করলে গণমাধ্যমে সেটি ফুলেফেঁপে আরও বড় করে বর্ণিত হওয়া এবং পরবর্তীতে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া – এসব বিষয় প্রতিটা খেলোয়াড়কে চাপে ফেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই খেলোয়াড়দেরকে অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্তি কিংবা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি পূরণ করার জন্য প্রতিটা ক্লাব অভিজ্ঞ মনস্তত্ত্ববিদদের শরণাপন্ন হয়।

‘স্লেজিং’ বলুন কিংবা প্রেস কনফারেন্সে কোচদের বাক্যবাণ ছোঁড়া — দুটোই কিন্তু মূলত একই উদ্দেশ্যে করা হয়। উদ্দেশ্য থাকে প্রতিপক্ষের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটানো, ম্যাচের আগে চাপে ফেলে দেয়া। অনেকের কাছে এসব কৌশল নোংরা কিংবা খেলাধুলার চেতনাবিরোধী, আবার অনেকের কাছে ম্যাচ জেতার সুকৌশল। অনেকে মনে করেন এসব বিষয় খেলাটিকে যান্ত্রিকতার হাত থেকে রক্ষা করে, খেলাটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। ম্যাচ-পরবর্তী প্রেস কনফারেন্সে কোচেরা যখন হারের দায় নিজের কাঁধে না নিয়ে অন্য কিছুর উপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেন কিংবা অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলে মিডিয়ায় আলোড়ন তুলেন তখন একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে — হেরে যাওয়া খেলোয়াড়েরা যেন মনোবল হারিয়ে না ফেলে, পরবর্তী ম্যাচের জন্য যেন আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায়, এবং হার নিয়ে যেন গণমাধ্যমে বেশি আলোচনা না হয়।

Image Credit: Getty Images

 

লেখাটার শুরুতেই একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করেছিলাম। বাস্তবে কোচ মরিনহোর সেই কথাটার সত্যতা খুব একটা থাকলেও হারের পরও এরকম মন্তব্য করার উদ্দেশ্য ছিল খেলোয়াড়দের মানসিকভাবে শক্ত রাখা, গণমাধ্যমে হারের বিষয়টিকে আড়াল করে দিয়ে তার মন্তব্য নিয়ে মাতিয়ে রাখা। খেলার আগেও লিভারপুলের ইনজুরি ইস্যু নিয়ে পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন। এগুলো হচ্ছে কোচ মরিনহোর মাইন্ডগেমেরই অংশ।

তবে ফুটবলে মাইন্ডগেমের ক্ষেত্রে পর্তুগিজ কোচ মরিনহো একটি অনন্য নাম হলেও তিনিই যে একমাত্র এই কৌশল সফলভাবে প্রয়োগ করে আসছেন, তা কিন্তু নয়। গণমাধ্যমে ‘ভদ্র’ হিসেবে পরিচিত পাওয়া কোচও এই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেছেন, অনেকক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন কোচ সম্পর্কে জানা যাক।

স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন: প্রিমিয়ার লিগের ‘সেরা মাইন্ড গেমার’

“সর্বকালের সেরা কোচ কে?” — এই প্রশ্নের উত্তরে যদি সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের নাম বলা হয়, তাতে দ্বিমত করার মানুষ বোধহয় পাওয়া যাবে না। দীর্ঘ সাতাশ বছর ধরে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডাগ-আউট সামলেছেন, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ট্রফি ক্যাবিনেটে যোগ করেছেন ৩৮টি ট্রফি। প্রিমিয়ার লিগ তো বটেই, পুরো বিশ্বে তার চেয়ে বেশি ট্রফি জিততে পারেননি আর কোনো কোচ! তার হাত ধরে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড লিভারপুলকে ছাড়িয়ে নিজেদেরকে প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ট্রফিজয়ী ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইংল্যান্ডের প্রথম ক্লাব হিসেবে ট্রেবল জেতার কৃতিত্ব অর্জন করেছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ১৯৯৯ সালে। তার পেছনেও মূল কারিগর ছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন।

য়নয়নয়হয়ন
প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে মাইন্ড গেমের প্রথম চালটা দিতে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী; Image source: Manchester Evening News

সম্প্রতি ফ্রান্স ফুটবল ‘ব্যালন ডি’অর ড্রিম টিম’ নামে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে একটি একাদশ প্রকাশ করেছে, যেখানে প্রতিটি পজিশনেই আপনি ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের দেখতে পাবেন। সেই একাদশের ম্যানেজার হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে। ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া স্কোয়াডের দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়টি স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ‘গ্রেটনেস’ বুঝতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে।

শুধু ট্রফি কিংবা অর্জনগুলো নিয়ে আলোচনা করলে হয়তো ফার্গুসনের মাইন্ডগেম, প্রতিপক্ষকে মাঠে খেলার আগেই মানসিকভাবে হারিয়ে দেয়া, ড্রেসিংরুম নিয়ন্ত্রণ, মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি, কিংবা বিপক্ষ দলের মনোযোগ নষ্ট করে দেয়ার মতো বিষয়গুলো আড়ালে থেকে যেতে পারে। তিনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড রেলিগেশন জোনে খাবি খাচ্ছিল, যার পেছনে সে সময়ের খেলোয়াড়দের দায় কোনোভাবেই এড়ানো যায় না। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অনেক খেলোয়াড় অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করেন — এই ধরনের অভিযোগ আসার পর স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন দক্ষভাবে খেলোয়াড়দের মাঝে পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনেন, খেলোয়াড়দের সতর্কবার্তা পাঠান। পরবর্তীতে স্যার ফার্গুসন কোচ থাকাকালীন এরকম অভিযোগ আর পাওয়া যায়নি।

১৯৯৯ সালের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। বার্সেলোনার বিখ্যাত হোমগ্রাউন্ড ন্যু ক্যাম্পে মুখোমুখি ওটমার হিজফেল্ডের বায়ার্ন মিউনিখ ও স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। সাসপেনশনের জন্য ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পল স্কোলস ও রয় কিনের মতো খেলোয়াড়েরা খেলতে পারেননি। জার্মান জায়ান্টরা এর পূর্ণ ফায়দা উসুল করে৷ ছয় মিনিটেই মারিও ব্যাসলারের গোলে এগিয়ে যায় বায়ার্ন মিউনিখ। প্রথমার্ধ এক গোলে পিছিয়ে থেকেই শেষ করে বেকহ্যাম, রায়ান গিগস, নিকি বাটরা।

হাফ-টাইমের সময় ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। খেলোয়াড়দের উদ্দেশ্য করে বলেন,

“খেলাশেষে শিরোপাটি তোমার কাছ থেকে মাত্র ছয় ফুট দূরে থাকবে এবং হেরে গেলে তুমি শিরোপাটি ছুঁয়ে দেখতেও পারবে না। হয়তো এটি তোমাদের অনেকের এই শিরোপার ‘সবচেয়ে কাছাকাছি আসা’র মুহূর্ত হয়ে থাকবে। সর্বোচ্চটা না দিয়ে এখানে ফিরে আসার সাহস করো না।”

এই তিনটি কথাই খেলোয়াড়দের মাঝে জেতার আকাঙ্ক্ষা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ক্লান্ত হয়ে পড়া খেলোয়াড়েরা দ্বিতীয়ার্ধে জেতার ক্ষুধা নিয়ে মাঠে নামেন, যার ফলাফল দেখা যায় মাঠেই। দ্বিতীয়ার্ধে ম্যানচেস্টার কোনো গোল হজম করেনি, কিন্তু ছয় মিনিটে খাওয়া গোলটি শোধও দিতে পারছিল না। নব্বই মিনিটেও স্কোরলাইন ছিল ১–০, বায়ার্নের শিরোপা জেতা তখন সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ভাগ্যবিধাতা অন্য কিছু লেখে রেখেছিলেন সেদিনের জন্য।

বদলি হিসেবে নেমে ‘সুপার সাব’ হয়ে গেলেন টেডি শেরিংহ্যাম-ওলে গানার সলশায়েররা। ৯০ মিনিটে বেকহ্যামের কর্নার থেকে স্কোরলাইনে সমতা নিয়ে আসেন টেডি শেরিংহ্যাম। আর তিরানব্বই মিনিটে গিগসের পা থেকে বল পেয়ে শেষ গোলটি করে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পক্ষে শিরোপা নিশ্চিত করেন ওলে গানার সলশায়ের। জার্মান জায়ান্টদের মুখ থেকে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা কেড়ে নিয়ে প্রথম ইংলিশ ক্লাব হিসেবে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগসহ ট্রেবল জেতার কৃতিত্ব অর্জন করে অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

কোচিং ক্যারিয়ারের পুরো সময়টিতেই ইউনাইটেডের ডাগআউটের মতো গণমাধ্যমকেও চমৎকারভাবে সামলেছেন। রেফারি, কোচ কিংবা প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের নিয়ে করা মন্তব্যগুলো নিয়ে পত্রিকাগুলো সরব থাকত। তিনি চাইতেন তার করা মন্তব্যগুলো নিয়ে ভেবে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় কিংবা কোচ অতিরিক্ত চাপ অনুভব করুক, তাতে করে মাঠে তাদের সেরাটা দেওয়া আর সম্ভব হবে না। তার মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন খ্যাতিমান কোচের মন্তব্য কিংবা শুধু উপস্থিতিই বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের চাপে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিল।

য়নসনসহসহ
ড্রেসিংরুম কন্ট্রোল করতেও স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ছিলেন বেশ দক্ষ; Image source: The Mirror

একজন ইংলিশ মনোবিদ কোনো এক প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে একবার বলেছিলেন,

“স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন মনোবিদ নন, কিন্তু তিনি খেলোয়াড়দের মাথায় কী চলছে তা মুহূর্তেই পড়ে ফেলতে পারতেন।”

শুধু সঠিক একাদশ নির্বাচন করা, বাছাই করে ভালো খেলোয়াড়দের সাইন করানো, কিংবা ট্যাকটিকাল মেধাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো বাদেও মাইন্ডগেম খেলেই যে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করা যায়, ইংলিশ ফুটবলে তা একেবারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন।

২০০৮-০৯ সিজনে প্রিমিয়ার লিগে দুর্দান্ত শুরু করেছিল লিভারপুল। একসময় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে সাত পয়েন্ট ব্যবধান তৈরি করে ফেলেছিল তারা। লিভারপুল বস রাফা বেনিতেজের অধীনে ফার্নান্দো তোরেস-স্টিফেন জেরার্ডরা তখন রীতিমতো বিপরীত দলের জন্য যমদূত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের মাইন্ডগেমের চূড়ান্ত খেলটা তখনও বাকি ছিল।

সেই সিজনে হঠাৎ করে স্যার ফার্গুসন প্রেস কনফারেন্সের মাত্রা বাড়িয়ে ফেলেন। সময়ে-অসময়ে প্রেস কনফারেন্স ডেকে লিভারপুলের খেলার ধরন, কোচ রাফা বেনিতেজ ইত্যাদি নিয়ে মন্তব্য করতেন। তার সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল সেই সিজনের সময়সূচি নিয়ে। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, শিডিউল ইচ্ছা করেই লিভারপুলের অনুকূলে তৈরি করা হয়েছে। এর পাল্টা জবাবে লিভারপুল বস রাফা বেনিতেজও প্রেস কনফারেন্সে একটি কাগজ নিয়ে হাজির হন এবং স্যার ফার্গুসনের অভিযোগের বিপরীতে নিজের বক্তব্য পেশ করেন। দুই বিখ্যাত কোচের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ে ইংলিশ মিডিয়া সরগরম হয়ে ওঠে।

তবে দিনশেষে শেষ হাসি হেসেছিলেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। লিভারপুল বস রাফা বেনিতেজকে দর্শক বানিয়ে নিজের কোচিং ক্যারিয়ারের একাদশতম প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিতে নেন তিনি। সেই মৌসুমে একসময় ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে ওঠা লিভারপুলের জয়রথ থামাতে কোচ রাফা বেনিতেজ ও তার খেলোয়াড়দের উপর চাপ সৃষ্টি করতে তার প্রেস কনফারেন্সগুলো বিশাল ভূমিকা পালন করেছিল।

য়নবসসগসহ
অ্যালেক্স ফার্গুসন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের উপর চাপ সৃষ্টি করতে মিডিয়াকে একেবারে সঠিক উপায়ে ব্যবহার করতে জানতেন; Image Credit: FIFA

পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেখানো যাবে, যেখানে তিনি প্রতিপক্ষের দিকে বাক্যবাণ ছুড়ে দিয়ে মানসিকভাবে আগেই ম্যাচ জিতে নিয়েছেন। তিনি যেভাবে প্রতিপক্ষকে চিন্তায় ফেলে দিতে পারতেন, একইভাবে নিজের খেলোয়াড়দের মাঝেও জেতার উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারতেন। অতিরিক্ত সময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলোয়াড়েরা অসংখ্য ম্যাচ বের করে এনেছে, প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের মুখ থেকে জয় ছিনিয়ে এনেছে। অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচ বের করে আনার সক্ষমতার জন্য নব্বই মিনিটের পর যোগ করা অতিরিক্ত সময়ের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ফার্গি টাইম’, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ট্রেডমার্ক।

স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন একই সাথে ছিলেন মাস্টার ট্যাকটিশিয়ান ও একজন দক্ষ মাইন্ডগেমার। খেলার মাঠে তিনি বরাবরই একেবারে সঠিক একাদশ নির্বাচন করতেন, প্রতিপক্ষকে হারাতে সঠিক কৌশল প্রয়োগ করতেন। খেলার মাঠের বাইরেও প্রতিপক্ষের উপর মিডিয়াকে ব্যবহার করে আলাদা চাপ সৃষ্টি করতে তার জুড়ি ছিল মেলা ভার। তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলোয়াড়দের মধ্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল না ছাড়ার মানসিকতা তৈরি করেছিলেন, যেটি তাদেরকে সবসময় প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে। লিভারপুলের একাধিপত্য ভেঙে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে তিনি পরিণত করেছিলেন সর্বোচ্চ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপাজয়ী ক্লাবে। তার অধীনেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড শতাব্দীর দ্বিতীয় সেরা ক্লাব হিসেবে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করে।

তার ছেড়ে যাওয়ার পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এখনও কোনো প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জিততে পারেনি, গত কয়েক মৌসুমে শীর্ষ চারে থাকতেই রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ডাগ-আউটে চুইংগাম চিবোতে থাকা লালমুখো মানুষটির অনুপস্থিতি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সমর্থকদের সবসময় অনুভব করাবে; মনে করাবে, তাদের একজন ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিলেন!

Related Articles