কিছু খেলোয়াড় গ্রেট হয়েই জন্মায়, কিন্তু গ্রেটনেস অর্জনের জন্য হ্যারি কেইন গত ৭ বছর ধরে লড়াই করে চলেছেন।
যেকোনো বিচারেই কেইন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার এবং এবারের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপেও সেরাদের একজন হিসেবেই ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কেইন নিঃসন্দেহে একজন প্রতিভাসম্পন্ন ফুটবলার; তবে প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তিনি সবসময়ই নিজের প্রতিভাকে মাঠের খেলায় ফুটিয়ে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, প্রতি সিজনেই চেয়েছেন নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে। কিছু টপ খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারের শুরুটা ভালো হলেও তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকেন, কিন্তু কেইন নিজেকে সেরাদের একজন করে তুলতে ধারাবাহিকভাবে পরিশ্রম করে চলেছেন।
বর্তমানে কেইন প্রথম সারির ফুটবলারদের মধ্যে একজন হয়ে উঠেছেন। তিনি এখন রবার্ত লেওয়ানডস্কির সাথে বিশ্বের সেরা নাম্বার নাইন ফুটবলার হওয়ার জন্য লড়াই করছেন। তিনি ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন, প্রিমিয়ার লিগে তার চেয়েও বেশি কিছু করতে চেষ্টা করছেন। তার আদর্শ টম ব্র্যাডির সাথে তার বেশ ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে, এমনকি তিনি টাইগার উডসের সাথে গলফও খেলেছেন। এই গ্রীষ্মে যদি তার ম্যানচেস্টার সিটির জার্সিতে খেলার ইচ্ছা পূরণ হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই নেইমার এবং কিলিয়ান এমবাপের পর তিনিই হবেন সবচেয়ে দামী ফুটবলার।
তবুও একজন ফুটবলার হিসেবে কেইন এখন পর্যন্ত যা অর্জন করেছেন, তা ঠিক নামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একজন খেলোয়াড় হিসেবে হয়তো তার এর চেয়ে বেশি কিছুই করার সুযোগ ছিল না, কিন্তু এখন পর্যন্ত কেইনের অর্জনের ঝুলিতে কোনো দলগত শিরোপাই নেই। তার সকল অর্জন ব্যক্তিগত, তার দল কোনো শিরোপাই জিততে পারেনি।
কেইন মূলত এমন কোনো দলের হয়ে খেলতে চান যারা শিরোপাজয়ের জন্য লড়াই করবে। এজন্যই তিনি টটেনহ্যাম ছাড়তে চান, যেখানে তিনি তার ফুটবল ক্যারিয়ারের দীর্ঘ ২০টি বছর কাটিয়েছেন (যদিও কেইন তার ক্লাবের হয়ে শিরোপাজয় করতে পারবেন কি না সেটা সম্পূর্ণ তার নিজের হাতে নেই)। তবে পরবর্তী সিজনে কেইন কোন ক্লাবের হয়ে খেলবেন, সে রহস্যের সমাধান হওয়ার আগে তাকে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিতে হবে। সেটা তিনি দিয়ে চলেছেন সামনে থেকেই। দেশের হয়ে দীর্ঘদিনের শিরোপা-খরা কাটানোর মিশনে তার বাড়তি চাপ অনুভব করাই স্বাভাবিক। এটিই কি সেই গ্রীষ্ম, যেখানে ২৮ বছরে পা দিতে যাওয়া কেইন তার দলের হয়ে কিছু জিততে পারবেন এবং গ্রেটনেসের দিকে আরেক পা এগিয়ে যাবেন?
অনেক খেলোয়াড় রয়েছেন, যারা নিজেদের তারকাখ্যাতি দিয়ে পুরো ক্যারিয়ারেই সমর্থকদের কাছে আলোচিত হয়ে থাকেন। তারা নিজের পারফরম্যান্সের চেয়েও সমর্থকদের আলোচনার বিষয়বস্তু হতে মুখিয়ে থাকেন। কিন্তু এদিক থেকে কেইন সম্পূর্ণই আলাদা। বিগত সময়ের অন্যান্য সেরা ফুটবলারদের তুলনায় তার মিডিয়া পরিচিতি অনেকটাই কম। এমনকি গত দুই জেনারেশনের অন্যান্য ইংলিশ তারকাদের তুলনায়ও তার পরিচিতি বেশ কম। তিনি কখনোই কোনো পত্রিকার শিরোনাম ছিলেন না এবং তার খেলার বাইরের জীবন সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। কিন্তু তার প্রোফাইল জনপ্রিয় ইংলিশ ফুটবলার ডেভিড বেকহ্যাম, ওয়েইন রুনি কিংবা স্টিভেন জেরার্ডের প্রায় সমতুল্যই।
কেইন তার ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময়টাই টটেনহ্যাম হটস্পারে কাটিয়েছেন (কয়েক সিজনের লোন স্পেল ব্যতিত)। স্পার্সের হয়ে খেলা এই ৭ বছর কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ ভালোই ছিল। মরিসিও পচেত্তিনোর অধীনে তারা ইংল্যান্ডের সেরা ক্লাবে পরিণত হচ্ছিল, যদিও কোনো শিরোপা জিততে পারেননি। পচেত্তিনোর বিদায়ের পর টটেনহ্যামের খেলার মান খারাপ হতে শুরু করল, এবং কেইন শিরোপা জেতার সামনে থেকে আরো দূরে সরে যেতে শুরু করলেন।
কেইনের ইচ্ছা ছিল তার ব্যক্তিগত জীবনের সব কিছু সাধারণ জনগণের থেকে আড়ালে রাখার। অসংখ্যবার মিডিয়া তার কাছে তার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলেও তিনি মিডিয়ার সামনে থেকে তার পরিবারকে আড়ালেই রেখেছেন।
সতীর্থদের তুলনায় তিনি অরাজনৈতিক মনোভাবসম্পন্ন এবং আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে কম আগ্রহী থাকার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেইনকে মাঝেমাঝেই সমালোচনার স্বীকার হতে হয়। কিন্তু কেইন ইংল্যান্ড দলে নিজের অধিনায়কত্বের ব্যাপারে বরাবরই অটল ছিলেন এবং সতীর্থদের বাজে পারফরম্যান্সের দায়ভার সবসময়ই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
তিনি বেশ কিছু দাতব্য কর্মকাণ্ডের প্রচারকও বটে। বিশেষ করে ‘হ্যাভেন হাউজ’ নামে এসেক্সের একটি অনাথশালা, লন্ডন প্লেয়িং ফিল্ডস ফাউন্ডেশন, ববি মুর ফাউন্ডেশন এবং তাদের ‘ফুটবল শার্ট ফ্রাইডে’ ক্যাম্পেইনের প্রচারক ছিলেন। কেইন প্রবীণদের সাপোর্ট করার মাধ্যম হিসেবে ‘টমি ক্লাব’-এর পক্ষ থেকে তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে লোনে কাটানো ক্লাব লেটন ওরিয়েন্ট-এর শার্ট স্পন্সর করেন।
কিন্তু কেইনের অপ্রকাশিত দিকগুলো জানার চেষ্টা করে খুব একটা লাভ হবে না। যারা কেইনকে কাছ থেকে চেনেন, তাদের মতে কেইন একজন উচ্চাভিলাষী, অকপট এবং নিজের মনমতো চলেন। বলাই বাহুল্য, তার ক্যারিয়ার তার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ; তবে একইসাথে তার পরিবারও তার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। ফুটবল বা পরিবারের বাইরে যদি সময় বের করতে পারেন, তবে গলফটা তিনি বেশ জমিয়ে খেলতে পারেন, বেশ উপভোগও করেন বৈকি।
কেইন আমেরিকান ফুটবল লিগের ‘নিউ ইংল্যান্ড প্যাট্রিয়টস’-এর একজন সমর্থক, তিনি অবসরে তাদের খেলা মিস করেন না বললেই চলে। কেইন তার ক্যারিয়ারের কঠিন সময়ে তার আইডল ব্র্যাডির থেকে অনুপ্রেরণা খোঁজার চেষ্টা করেন, যেভাবে ব্র্যাডি নিজের জীবনের নানা জটিলতা কাটিয়ে উঠে আমেরিকান ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা কোয়ার্টারব্যাক হয়ে উঠেছেন।
কেইন আমাকে ২০১৭ সালের দিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এনএফএল ড্রাফটের উপর ২০০০ সালে তৈরি ‘দ্য ব্র্যাডি সিক্স’ নামের একটি ডকুমেন্টারি তার কতটা পছন্দ ছিল। ডকুমেন্টারিটার মূল উপজীব্য ছিল সেই সময়টা, যখন ছয়জন কোয়ার্টারব্যাকসহ সাকুল্যে ১৯৮ জন খেলোয়াড়কে বাছাই করা দলেও ব্র্যাডির জায়গা হয়নি। সেই সময় ব্র্যাডির অ্যাথলেটিজমও বেশ প্রশ্নবিদ্ধ ছিল, যার মোক্ষম জবাব তিনি দিয়েছিলেন ড্রিউ ব্লেডসোর জায়গায় প্যাট্রিয়টসের প্রথম পছন্দের কোয়ার্টারব্যাক হয়ে দলের পক্ষে ছয়টি ‘সুপার বোল’ জিতে; আর নিজের সাত নম্বর সুপার বোলটা তিনি জিতেছেন এই বছরের শুরুতে, টাম্পা বে বাকানিয়ার্সের হয়ে।
কেইন ২০১৪ সালের ব্রেকথ্রু সিজনের পূর্বে লোনে অন্যান্য ক্লাবের হয়ে নিজের ফর্ম নিয়ে লড়াই করছিলেন; তখন তিনি সেই ডকুমেন্টারি দেখে কঠোর পরিশ্রম করার অনুপ্রেরণা লাভ করতেন। কেইন বলেছিলেন
” টম ব্র্যাডি আমার আইডল এবং তার থেকে সবসময় আমি অনুপ্রেরণা খোঁজার চেষ্টা করি। তিনি যখন ড্রাফটের পেছনের দিকে ছিলেন তখন তাকে অনেক অবমূল্যায়িত করা হত। কিন্তু তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন এবং নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছিলেন, যেটা আমি আমার ক্যারিয়ারে মেনে চলার চেষ্টা করেছি। এই আত্মবিশ্বাস, অনুপ্রেরণা আমাকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে এসেছে । “
২০১৪-এর গ্রীষ্মে, কেইন যখন টটেনহ্যামের মূল দলে জায়গা পাবার জন্য লড়াই করছিলেন, স্পার্স বোর্ড ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের ড্যানি ওয়েলবেককে দলে ভেড়াতে চেষ্টা করছিল। শেষমেশ আর্সেনাল ওয়েলব্যাককে দলে ভেড়ায় (তাদের ইনজুরি-আক্রান্ত অলিভিয়ের জিরু’র বিকল্প খেলোয়াড়ের প্রয়োজন ছিল), যেটি কেইনকে পঞ্চমবারের মতো অন্য ক্লাবে লোনে খেলতে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি পচেত্তিনোর টটেনহ্যাম মূল দলে জায়গা করে নেন, প্রিমিয়ার লিগে দলের প্রধান স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে নামেন। এরপর থেকে তাকে আর কখনোই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কেইনের ক্যারিয়ারের শুরু নিয়ে অনেক লেখালেখি হয় ইদানিং। কেইন স্পার্সের অন্যান্য স্ট্রাইকারদের সাথে ডাবল সেশন অনুশীলন করে তাদের ফিনিশিং নিয়ে কাজ করেছেন, অন্যান্য স্ট্রাইকারদের ভিডিও দেখে তাদের অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন, অথবা অন্যান্য গোলকিপারদের দুর্বলতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। আমরা সকলেই তার ডায়েট, তার শেফ এবং মদ্যপান না করার অভ্যাস সম্পর্কে জানি। কেইন ভালো ফুটবলার হওয়ার প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সকল কিছু করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন।
কেইন এমন একটা দলে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন যারা তাকে ঘিরেই উন্নতির চেষ্টা করছিল। তিনি এমন একটি তারুণ্যনির্ভর দলের অংশ ছিলেন, যে দলটা পচেত্তিনোর অধীনে উর্ধ্বগতিতে ছুটতে শুরু করেছিল। কেইন তখন টটেনহ্যামের মূল খেলোয়াড় হলেও দলকে জেতানোর জন্য তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় ছিলেন না। তিনি নিজেই একটি সিস্টেমের সর্বেসর্বা হওয়ার পরিবর্তে সেই সিস্টেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন।
কেইন যখন তার প্রথম দু’টি গোল্ডেন বুট জেতেন, তিনি তার চারপাশে সাহায্য পাবার মতো অনেক ফুটবলারকে পাশে পেয়েছিলেন। কারণ তিনি ড্যানি রোজ, মুসা দেম্বেলে, ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের মতো খেলোয়াড়দের সাথে খেলতেন যারা দলে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার অবগত ছিলেন এবং দলকে এগিয়ে নিতে সরাসরি অবদান রাখছিলেন।
স্পার্সের হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল; পচেত্তিনোর সময়ে অর্জিত তাদের শক্তিমত্তা, একতা এবং ধারবাহিকতা বিলুপ্ত হতে শুরু করেছিল। হঠাৎ করে কেইন নিজেকে এমন একটা দলে আবিষ্কার করলেন, যারা দল হিসেবে পারফর্ম করতে পারছিল না, এবং তাদের মধ্যে কেউ কেইনকে গোল করার সুযোগ করে দিতেও পারছিল না। ওয়াকার, ট্রিপিয়ার, দেম্বেলে এবং এরিকসেনকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। রোজ নিজের অফ ফর্মের কারণে ক্লাব থেকে বাদ পড়ে গেলেন, ডেলে আলী তার শুরুর সময়কার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিলেন।
তখন কেইন উভয়সংকটে পড়ে গেলেন। একজন ফুটবলার কীভাবে নিজের ক্রিয়েটিভিটি দেখাবে, যখন তিনি চাইছেন প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে, কিন্তু তার দল বিপরীত দিকে হাঁটছে?
‘২০-‘২১ সিজনের শুরুর দিকে একটা জরুরি প্রশ্ন কেইন এবং টটেনহ্যামকে ঘিরে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল: অনবদ্য পারফরমার কেইন কীভাবে তার খাবি খেতে থাকা টিমমেটদের থেকে দারুণ কিছু বের করে আনতে অবদান রাখবেন? যখন কেইনকে তার ক্যারিয়ারের শুরুতে দলে বাছাই করা হয়, তখন স্পার্সরা চ্যাম্পিয়নস লিগের অংশ ছিল, দুইটি টাইটেল জেতার জন্য লড়াই করছিল, এবং দলটি একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু এখন? তিনি একটা ভাঙাচোরা দলের অংশ হয়ে এমন একটা স্টাইলে ইউরোপা লিগে খেলছেন, যেখানে তাদের পায়ে কম সময় বল থাকে এবং গোল করার মতো সুযোগও খুব কমই তৈরি হয়। কেইন খেলার ধরনের দিক থেকে তার সতীর্থদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। এমন কিছু তিনি কীভাবে মেনে নেবেন?
টটেনহ্যামের সৃজনশীলতায় ধ্বস নামার পর কেইন নিজেই যেন হয়ে উঠলেন সেই সিস্টেমের ক্রিয়েটিভিটির মূল চালিকাশক্তি।
কেইন মাসকয়েক আগে গ্যারি নেভিলকে বলেছিলেন, ২০২০ করোনাভাইরাস লকডাউনের প্রথম দিকে তিনি নেটফ্লিক্সে মাইকেল জর্ডানের উপর নির্মিত ডকুমেন্টরি ‘দ্য লাস্ট ডান্স’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কেইন বরাবরই আমেরিকান স্পোর্টসের স্বনির্মিত গ্রেটদের অনুরাগী, যে তালিকায় ব্র্যাডি কিংবা টাইগার উডসদের পাশাপাশি জর্ডানও স্বমহিমায় বিরাজমান। কেইনের কাছে জর্ডানের যে গুণটি সব থেকে অসাধারণ মনে হয়, সেটা হলো তার ‘কমপ্লিটনেস’, একটা দলগত খেলার প্রতিটি পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার করার সামর্থ্য। দলের জন্য সবকিছু করার অদম্য ইচ্ছে দেখে কেইন নিজেও ফুটবলের জর্ডান হয়ে উঠতে চাইলেন, চাইলেন তাকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতে।
কেইন তাই শুধু একজন ফিনিশার হয়েই থাকতে চাননি, আক্রমণের সূচনাও ঘটাতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে সামগ্রিকভাবে নিজেকে ধাপে ধাপে প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নেন।
২০২০-এর গ্রীষ্মে ঠিক এরকমই এক নতুনভাবে গড়ে ওঠা কেইনকেই টটেনহ্যামের প্রয়োজন ছিল, আর জোসে মরিনহো তাকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। পচেত্তিনো যেখানে কেইনকে স্রেফ আক্রমণভাগের মূল কাণ্ডারি হিসেবে চেয়েছিলেন, সেখানে মরিনহো কেইনকে নিজের পছন্দমতো খেলার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। কেইন এবার সেই সুযোগটা পেলেন, যেভাবে তিনি আধিপত্য বিস্তার করে খেলতে চেয়েছিলেন।
মনে আছে সেই সময়টা, যখন কেইনকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল দলে তার থেকে আন্ডারপারফর্মিং সতীর্থদেরকে নিয়ে তিনি কীভাবে দলের আক্রমণকে নেতৃত্ব দেবেন? এই প্রশ্নের দাঁতভাঙা জবাব কেইন দিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুমটি কাটিয়ে। এই মৌসুমেই কেইন তার ক্যারিয়ারের তৃতীয় প্রিমিয়ার লিগ গোল্ডেন বুট জিতলেন (শুধুমাত্র থিয়েরি অঁরিরই এর চেয়ে বেশি গোল্ডেন বুট রয়েছে), এবং প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টদাতা হিসেবে শেষ করলেন।
কেইনকে গত মৌসুমে চোখের সামনে খেলতে দেখাটাই অসম্ভব সৌভাগ্যের ব্যাপার। ২৭ বছর বয়সী বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলারকে নিজের দক্ষতার আরো বেশি উন্নতির চেষ্টা করতে দেখাটাও দারুণ ব্যাপার। হোক সেটা সাউদাম্পটনের বিপক্ষে সনকে করা তার চারটি দুর্দান্ত অ্যাসিস্ট, কিংবা হোক সেটা ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে টপ কর্নার থেকে করা হুইপড গলফ শট যা আমাদের বোঝায় কেইন প্রতিনিয়ত নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন – নিজের খেলার মাধ্যমে বিশ্বসেরা অ্যাথলেট হওয়ার তাগিদটা কেইন প্রতি ম্যাচেই দেখিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু শেষমেশ এটা স্পার্সদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। কেইনের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পরও তাদের লিগ টেবিলের সপ্তম অবস্থানে থেকে সিজন শেষ করতে হয়েছে। এর মানে দাঁড়ায়, আগামী সিজনে তাদের ইউরোপা কনফারেন্স কাপে অংশ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
এ কারণেই কেইন এই গ্রীষ্মে টটেনহ্যাম ছাড়তে ব্যাকুল হয়ে আছেন। তিনি তার হৃদয়ের তাড়নায় ম্যানচেস্টার সিটিতে যেতে আগ্রহী। এর প্রধান কারণ, তিনি যদি এমন কোনো দলের অংশ হওয়ার সুযোগ পান যারা গত চারবারের মধ্যে তিনবারই প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতেছে, তবে তিনিও হয়তো ভবিষ্যতে শিরোপা জিততে শুরু করবেন।
কেইন পরবর্তী ট্রান্সফারে ম্যানচেস্টার সিটিতে যেতে পারবেন কি না, সেটা অন্য বিষয়। তিনি ২০১৮ সালে স্পার্সদের সাথে যে নতুন চুক্তিতে রাজি হয়েছিলেন, তাতে এখনও ৩ বছর বাকি রয়েছে তার। এর মানে, তিনি চাইলেই ক্লাব ছেড়ে যেতে পারবেন না। টটেনহ্যাম বোর্ড যদি তাকে বিক্রি করতে না চায়, তবে তারও খুব বেশি কিছু করার থাকবে না। তবে কেইন বিশ্বাস করেন ডেনিয়েল লেভির সঙ্গে তার একটা ‘জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট’ রয়েছে; যদি ভালো অফার পান, তবে তাকে ক্লাব ছাড়তে বাধা দেবে না। তবে টটেনহ্যামের হয়ে শেষ কিছু ম্যাচে কেইনের ধারাবাহিকতা লেভি তাকে ক্লাবে রেখে দিতে আরো খানিকটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠতেই পারেন।
টটেনহ্যাম বোর্ড আশা করছে, ম্যানচেস্টার সিটি খুব দ্রুতই তাদের কাছে কেইনের জন্য একটি লাভজনক অফার নিয়ে আসবে। পেপ গার্দিওলা কেইনের অনেক বড় সমর্থক, এবং চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পরাজয়ের পর আক্রমণের ধার বাড়াতে সিটি আরো কিছু নতুন অস্ত্র যোগ করতে চায়। তবে ঠিক কত মিলিয়ন পাউন্ড পেলে লেভি কেইনকে সিটির কাছে বিক্রি করবেন, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। কিছুদিন পর ২৮ বছরে পা দেওয়া একজন স্ট্রাইকারের জন্য সিটি যদি ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি খরচ করে, এটি তাদের ট্রান্সফার পলিসিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।
কেইনকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিনে নেওয়াটাই বেশি প্রাসঙ্গিক হওয়ার কথা। প্রতিষ্ঠিত ফুটবলারদেরকে কেনার জন্য কখনোই আটকায়নি তাদের, যদিও তারা এই মুহূর্তে স্ট্রাইকারের চেয়ে অন্যান্য কয়েকটি পজিশনে নতুন খেলোয়াড় কেনার চেষ্টা করছে। সবচেয়ে বড় কথা, কেইন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেললে তার পক্ষে সিটির মতো নিয়মিত ট্রফি জেতার নিশ্চয়তা পাওয়াও সম্ভব নয়।
অতএব, টটেনহ্যাম বোর্ড কেইনকে অন্তত আরেকটি মৌসুম নিজেদের ক্লাবে ধরে রাখার ব্যাপারেই বেশি আত্মবিশ্বাসী। কেইনের কন্ট্রাক্টের বর্তমান পরিস্থিতি তাদের এই আত্মবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে তারা এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে অন্তত কেইনের মতো পেশাদারি মনোভাবসম্পন্ন একজন ফুটবলার ক্লাবকে চাপ প্রয়োগ করবেন না অন্য দশজন দল ছাড়ার জন্য ‘ডেসপারেট’ খেলোয়াড়দের মতো। অতীতে অনেক ফুটবলারই এমন করেছেন বটে, তবে কেইন খুব সম্ভবত সেই দলে ভিড়ছেন না।
কেইন এর জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইংল্যান্ড জাতীয় দল।
তার বেড়ে উঠা চিংফোর্ডের দেশপ্রেমিক এক পরিবারে; বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ইংলিশদের সাফল্য ও ব্যর্থতা তাই সবসময়ই কেইনের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। তিন বছরেরও কম বয়সে ‘৯৬ ইউরোর সময় গোটা ইংল্যান্ডকে বিখ্যাত ক্রস ফেইসপেন্টে রঙিন হতে দেখেছেন, স্বাগতিক হয়েও সেবার অবশ্য শিরোপা জিততে পারেনি ইংল্যান্ড । ২০০২ বিশ্বকাপে ইংলিশ ফ্যানভর্তি বারে বসে আর্জেন্টিনার সাথে ডেভিড বেকহামের পেনাল্টি দেখেছেন। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সোনালী প্রজন্মের খেলা দেখেছেন ২০০৪ ইউরোতে আর ২০০৬ বিশ্বকাপে, দু’বারই ইংল্যান্ডকে নকআউট হতে দেখে কান্নায় ভেসেছেন। তবে এই দুই টুর্নামেন্ট কেইনের শৈশবে খেলাধুলার বিষয়ে অভিজ্ঞতা তৈরি করতে বড়সড় ভূমিকা রাখে। গ্যারি নেভিলকে মাসকয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে কেইন বলেছিলেন,
“আমি আমার দেশের প্রতি খুবই ‘প্যাশনেট’ একজন মানুষমাত্র।”
২০০৬ বিশ্বকাপের ১৫ বছর পর আজ ইংলিশদের নেতৃত্বের ভার তার হাতে। এবং দেশের জন্য কিছু জেতার চেয়ে আর কিছুই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ না; কোনো ব্যক্তিগত রেকর্ড, এমনকি ক্লাবের হয়ে ট্রফি জেতাও না। স্পার্সদের হয়ে গত কয়েক বছরের হতাশা, ফাইনাল হারের বেদনা, সবচেয়ে বড় কথা স্পার্সদের দিনকে দিন বেড়ে চলা এই ভঙ্গুর অবস্থা – সবই ভুলে যেতে পারবেন যদি ইংল্যান্ডের হয়ে কিছু জিততে পারেন। এটি শুধু তার ফুটবল ক্যারিয়ারেই না, ফুটবল ছাপিয়ে তার জীবনেও সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত হবে।
যদিও ইতোমধ্যেই ইংল্যান্ডের সোনালী প্রজন্মের চেয়েও বিশ্বজয়ের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন তার দলকে।
২০১৬ ইউরো অবশ্য হতাশাজনক ছিল। মাত্র এক বছর আগে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়া কেইন দলে আসলে খুব বেশি ‘ইমপ্যাক্ট’ রাখতে পারেননি সেবার। দলটাও আসলে বলতে গেলে ট্র্যানজিশন পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ‘রেড ডেভিল’ লেজেন্ড রুনি যদিও ছিলেন, তবে সেরা সময় বহু আগেই পার করে এসেছেন তিনি। পরবর্তী প্রজন্মের তিন কাণ্ডারি – ডেলে আলী, হ্যারি কেইন, রাহিম স্টার্লিং তখনও পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ইংল্যান্ড দলকে খুবই অগোছালো লাগছিল, আত্মবিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও ছিল না তাদের মধ্যে।
কিন্তু সময় গড়িয়ে আরো দুই বছর যাওয়ার পর দেখা গেল, কেইন হয়ে উঠলেন ইংল্যান্ড দলের প্রতিষ্ঠিত এক খেলোয়াড়। সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবেই বলুন, অধিনায়ক হিসেবেই বলুন, কিংবা তারকাখ্যাতি – প্রায় সবদিকেই তিনি রুনিকে পেরিয়ে গেছেন ততদিনে। কেইনের পারফরম্যান্স দেখে বোঝাই যাচ্ছিল, ইতিহাস গড়তে মুখিয়ে আছেন তিনি। ‘১৮ বিশ্বকাপ ক্যাম্পেইনে ইংল্যান্ডকে দুর্দান্ত সূচনা এনে দিলেন তিউনিশিয়ার সাথে, ট্যাপ-ইন আর অতিরিক্ত সময়ে হেডে জোড়া গোল করে। ১৯৮৬ সালে গ্যারি লিনেকারের পর প্রথম ইংলিশ হিসেবে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড গড়লেন পরের ম্যাচে, পানামার বিপক্ষে। দুই গোল অবশ্য পেনাল্টি থেকে ছিল, আরেকটা সতীর্থ রুবেন লফটাস-চিকের শট দুর্দান্তভাবে জালে জড়িয়ে। মস্কোয় কলম্বিয়ার সাথে রেগুলার টাইমের পেনাল্টি থেকে গোল করে পেনাল্টি শ্যুটআউটে নিয়ে গেলেন দলকে। সেখানেও ঠাণ্ডা মাথায় বল জালে জড়িয়ে ইংল্যান্ডকে টুর্নামেন্টে এগিয়ে নিয়ে গেলেন।
তবে এই পারফরম্যান্স যথেষ্ট ছিল না, সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার সাথে চমৎকার শুরুর পরও ২-১ এ হেরে গেল ইংল্যান্ড। প্রথমার্ধে পরপর পাওয়া চমৎকার দুটো সুযোগ হাতছাড়া করেছিলেন কেইন, একটায় সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা স্টার্লিংকে স্কয়ারও করতে পারেননি। এ নিয়ে তার সমালোচনাও হয়েছে মিডিয়ায়, তবে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (VAR) নিশ্চিত করেছিল, আসলে কেইন বা স্টার্লিং যে-ই গোল করতেন না কেন, বাতিলই হয়ে যেত সেটা।
লিনেকারের পর প্রথম ইংলিশ ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট জিতে দেশে ফিরলেন তিনি, কিন্তু সঙ্গী হয়ে ছিল না পাওয়ার যন্ত্রণা; স্পার্সদের হয়ে একই রকম যন্ত্রণায় পুড়েছেন গত কয়েক বছর ধরে। তিনি ভালো খেলছেন, নিয়মিত স্কোর করছেন। কিন্তু দলকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কিছুই যেন যথেষ্ট হচ্ছে না।
এই সামার ট্রান্সফার উইন্ডো কেইনকে তার ক্যারিয়ারের কোনো নতুন মোড়ে পৌঁছে দেবে কি? তার গ্রেটনেসের সন্ধানে অভিযাত্রা কি নতুন কোনো মাত্রা পাবে? গত কয়েক প্রজন্মের কোন কোন ইংলিশ গ্রেটদেরকে তার পথদ্রষ্টা হিসেবে চিন্তা করতে পারি?
সবচেয়ে সুস্পষ্ট তুলনা হতে পারে ওয়েইন রুনির সাথে, ইংল্যান্ডে হয়ে সর্বোচ্চ গোলস্কোরার হওয়ার পথে কেইন যার রেকর্ড ভেঙে ফেলার দিকে এগিয়ে চলছেন। কেইন কখনোই রুনির মতো বিষ্ফোরক পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি (বয়সভিত্তিক দলগুলোতেও রুনির পারফরম্যান্স কেইনের চেয়ে বেশ ভালো ছিল)। ত্রিশের কাছাকাছি এসে রুনি খেই হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন, এর একটা কারণ ছিল তখন তাকে অনেকটা মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে হতো। কিন্তু কেইনের ক্ষেত্রে বেশ ভালো সম্ভাবনা রয়েছে এই ট্র্যানজিশন পিরিয়ডে রুনির চেয়েও ভালো পারফর্ম করার। তিনি যদি ভয়াবহ ইনজুরিগুলো এড়াতে পারেন, তবে তিনি রুনির চেয়েও বেশি সময় ধরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পারফর্ম করে যেতে পারবেন। কিন্তু রুনি তার সেরা সময়ে পাঁচটি প্রিমিয়ার লিগ, একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, একটি ইউরোপা লিগ এবং একটি ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছেন। এদিকে ক্যারিয়ারের প্রথম শিরোপার স্পর্শও কেইন এখনো পাননি।
প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার রেকর্ডটা অ্যালান শিয়েরারের দখলেই ১০ বছর ধরে অক্ষত হয়ে রয়েছে। কেইন যদি ফিট থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পারফর্ম করতে পারেন, তাহলে আর মোটামুটি ৩ বছরের মধ্যেই তিনি ওয়েইন রুনির ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড ভেঙে ফেলতে পারবেন, যা থেকে তিনি কেবল ২০ গোল দূরত্বে রয়েছেন। শিয়েরারের প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার রেকর্ড ভাঙতে কেইনের এখনো আরো ৯৪ গোল প্রয়োজন, যার জন্য হয়তো তাকে আরো বেশ কয়েক সিজন ধারাবাহিক পারফর্ম করে যেতে হবে। নিজের বেড়ে ওঠা ক্লাবের প্রতি আবেগের জায়গায় শিয়েরারের সাথে কেইনের বেশ মিল রয়েছে, যদিও তাদের অর্জনের পাল্লাটা সমান নয়। অর্জনের দিক থেকে শিয়েরারের পাল্লা বেশ ভারী, তিনি তার ক্যারিয়ারের প্রথম প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের হয়ে জিতেছিলেন।
আপনি চাইলে গত প্রজন্মের দুই সেরা ইংলিশ মিডফিল্ডারের সাথে কেইনের তুলনা করতেই পারেন। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে ভেড়ানোর দিক থেকে তাকে জেরার্ডের সাথে তুলনা দেওয়া যেতেই পারে। দলের প্রতি ডেডিকেশন, নিজের খেলার মান বৃদ্ধির চেষ্টা এবং ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়া এবং দলকে নিজের মধ্যে ধারণ করার দিক থেকে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের সাথে কেইনের সাদৃশ্য লক্ষণীয়। মাঠে কেইন অনেকটাই ল্যাম্পার্ডসুলভ মনোভাব ধারণ করেন বললেও ভুল বলা হবেনা। এটা মোটেও কাকতালীয় নয় যে স্পার্স ফুটবলারদের মধ্যে কেইনই জোসে মরিনহোর সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছেন, যে মরিনহো ১৫ বছর আগেই কাছ থেকে ল্যাম্পার্ডের সেরাটা দেখেছিলেন।
তবে আমরা যদি আরেকটু পেছন ফিরে তাকাই, তাহলে এমন আরেকজনকে পাওয়া যেতে পারে যার সাথে কেইনকে তুলনা করা যায়। তিনি আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন ইংল্যান্ড ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম গ্রেট স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার। কিন্তু তিনি ক্লাব পর্যায়ে শিরোপা জেতার জন্য যতটা পরিচিতি পেয়েছেন (বার্সেলোনার হয়ে কোপা দেল রে এবং কাপ উইনার্স’ কাপ, টটেনহ্যামের হয়ে এফএ কাপ শিরোপা), তার চেয়েও বেশি পরিচিতি লাভ করেছেন তার গোল করার সামর্থ্যের জন্য। প্রথম ইংলিশ ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপে গোল্ডেন বুট জেতার পর তার কদরটা তো বেড়ে গেছে আরো বহুগুণ। এছাড়াও জাতীয় দলের হয়ে ৪৮ গোল করার পাশাপাশি লেস্টার সিটি, এভারটন এবং টটেনহ্যামের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে সিজন শেষ করার মতো বিরল কৃতিত্ব রয়েছে লিনেকারের।
লিনেকার কেইনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু তিনি এটাও জানেন যে কেইনের মূল শক্তিমত্তা হচ্ছে তার গোলসংখ্যা – যার মাহাত্ম্য কেইনের কাছে অনেক। লিনেকার বলেন,
“অন্য যেকোনো পজিশনের তুলনায় একজন স্ট্রাইকারকেই গোলসংখ্যা দিয়ে বেশি বিচার করা হয়। আপনি অবশ্যই আপনার দলকে শিরোপা জেতাতে চাইবেন। কিন্তু ফলাফল সবসময় আপনার পক্ষে না-ও থাকতে পারে, ঠিক যেমনটি ঘটছে হ্যারির সাথে। টটেনহ্যামের হয়ে শিরোপা জেতার জন্য সে সম্ভবত তার সবটুকুই নিংড়ে দিয়েছে, যেমনটা আমিও টটেনহ্যামের খেলোয়াড় থাকা অবস্থায় করতাম। তাদের স্কোয়াডে বরাবরই শিরোপাজয়ের লড়াইয়ে টিকে থাকার মতো খেলোয়াড়ের অভাব থাকে না, এটা প্রমাণিত এবং তবুও কেন যেন আর শিরোপাটা জেতা হয়ে ওঠে না।”
স্রেফ এই একটা পরিমাপকটাই আবার স্ট্রাইকারদের অন্যান্য পজিশনে খেলা সতীর্থদের তুলনায় সাফল্যের পথে আরেকটু এগিয়ে দেয়। লিনেকার প্রায়ই ‘৮৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতি রোমন্থন করেন, যখন তিনি জিমি হিল এবং টেরি ভেনাবলসের সাথে বিবিসির ধারাভাষ্যকার হিসেবে ছিলেন, মনে মনে চাইছিলেন যেন ডিয়াগো ম্যারাডোনা গোল না করেন; যাতে করে তিনিও ম্যারাডোনার সাথে গোল্ডেন বুট ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ পান। তিনি এটাও জানেন, ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে কেইনও গ্রিজমানকে নিয়ে ঠিক এমনটাই অনুভব করছিলেন, এবং কাকতালীয়ভাবে কেইনও লিনেকারের মতো গোল্ডেন বুট অর্জন করেন।
লিনেকার আরও বলেন,
“এটি আসলেই বিশেষ কিছু ছিল। আপনি যদি গ্রেট ব্রিটেনের হয়ে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেন, তবে দিনশেষে দলের মেডেলের সংখ্যা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে আপনি যদি যদি ১০০ মিটার স্প্রিন্টে জেতেন, এটাই নিঃসন্দেহে সবকিছু থেকে সেরা। ফুটবলে গোলস্কোরার হওয়াটা অন্য যেকোনো ব্যাপার থেকেই আলাদা, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে অর্জনের একটা বিষয় থাকে। টপ স্কোরার হওয়াটা অনেকটা ১০০ মিটার দৌড়ে জেতার মতো, অনেকটা তর্কাতীতভাবেই। এটা অনেকটা অলিম্পিকে গিয়ে দেশের জন্য নিজের সেরাটা ঢেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার। গোলস্কোরারদের জন্য এই ব্যাপারটাই অনন্য: তাদের একটা লিগ টেবিল থাকে – একদম নিজস্ব।”