একবিংশ শতাব্দীর এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে তাল মিলিয়ে চলতে অবশ্য প্রয়োজনীয় অংশে পরিণত হয়েছে একটি ব্যক্তিগত কম্পিউটার। এরই মাঝে কম্পিউটারের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগুলোরও অনেকখানি উন্নয়ন ঘটে গেছে। কম্পিউটার ব্যবহার করতে গিয়ে মানুষের জ্ঞানের সীমাও ছাড়িয়ে গেছে অনেকটাই।
একটা সময় ছিল, অপারেটিং সিস্টেম বলতে আমরা শুধু মাইক্রোসফটের প্রোডাক্টগুলোই চিনতাম, বিশেষত উইন্ডোজ এক্সপি। উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করার জন্য কম্পিউটারে ইনস্টল করতে হলে এ বিষয়ে দক্ষ কারো সাহায্য গ্রহণ করতে হতো। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় এখন সবই আমাদের হাতের মুঠোয়।
কম্পিউটারে একটি অপারেটিং সিস্টেম ও বিভিন্ন সফটওয়্যার ইনস্টল করতে গিয়ে প্রায়ই আমাদের চোখের সামনে দুটো শব্দ চলে আসে; ‘৩২-বিট’ ও ‘৬৪-বিট’। ‘বিট’ আসলে আমাদের বহুল পরিচিত ‘কিলোবাইট’, ‘মেগাবাইট’, ‘গিগাবাইট’ এ ধরনের সমস্ত ডিজিটাল স্টোরেজ পরিমাপকগুলোর একক।
এখন কথা হলো, যেখানে ১ কিলোবাইট আমাদের কাছে অতি ক্ষুদ্র, তবে কেন কম্পিউটার প্রসেসর কিংবা অপারেটিং সিস্টেমের ক্ষেত্রে এর চেয়েও কম (‘৩২-বিট’ ও ‘৬৪-বিট’) পরিমাণ স্টোরেজ নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হয়! আজকের আলোচনায় এই ব্যাপারটিই সহজ ভাষায় ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হবে।
তবে তার আগে একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন। ‘৩২-বিট’ ও ‘৬৪-বিট’ কম্পিউটার প্রসেসর এবং ‘৩২-বিট’ ও ‘৬৪-বিট’ অপারেটিং সিস্টেম কিংবা কোনো সফটওয়্যার এক জিনিস নয়। প্রসেসর, যা আমরা সিপিউ (সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট) হিসেবেও চিনি; এর ক্ষেত্রে ‘৩২-বিট’ ও ‘৬৪-বিট’ বলতে প্রসেসিং রেজিস্টারের দৈর্ঘ্যকে বোঝায়। অপরদিকে, কোনো অপারেটিং সিস্টেম কিংবা সফটওয়্যারের বর্ণনায় থাকা ‘৩২-বিট’ ও ‘৬৪-বিট’ পরিমাণগুলো দিয়ে প্রসেসিং রেজিস্টার ব্যবহারের অনুমতিকে বোঝায়।
প্রসেসিং রেজিস্টারের আলোচনায় প্রবেশ করলে আসলে পুঁথিগত শব্দমালা চলে আসবে। সহজ ভাষায় একে একটি লোকেশন কিংবা জায়গা ব্যবহারের অনুমতির সাথে তুলনা করতে পারেন। আপনি দুটো বড় সংখ্যা যোগ করতে একটি কাগজে অঙ্কগুলো লিখেছেন, এখানে কাগজটি কিন্তু আপনার হয়ে কাজটি করে দিচ্ছে না। বরং, আপনার মস্তিষ্কেই কাজটি সম্পন্ন হবে, সংখ্যা দুটো বড় হওয়াতে কাগজে একটি জায়গায় অঙ্কগুলো লিখতে হয়েছে মাত্র। এ দৃশ্যে, কাগজটি একটি র্যামের ভূমিকা পালন করছে, আর আপনার মস্তিষ্কটি প্রসেসর হিসেবে। দুটো দশভিত্তিক ডেসিমেল সংখ্যা ৯৮৭ আর ৬৭৩ যোগ করে দেখুন, ধাপে ধাপে আপনি মস্তিষ্কে দুটো করে অঙ্ক প্রসেস করছেন; প্রথমে এককের ঘরে ৭ আর ৩, তারপর দশকের ঘরে ৮ আর ৭, শতকের ঘরে ৯ আর ৬। ঠিক এভাবেই র্যামে থাকা অস্থায়ী দুই-ভিত্তিক বাইনারি অঙ্কগুলো গ্রহণ করে একটি প্রসেসর কম্পিউট বা গণনা করে দেয়।
বাইনারি সংখ্যায় যোগ-বিয়োগ করে থাকলে ব্যাপারটি আরো ভালো বুঝতে পারবেন, বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের সংখ্যার জন্য ছোট থেকে বড় রেজিস্টার কল্পনা করতে হয় সেখানে।
কম্পিউটার যেহেতু কম্পিউট অর্থাৎ গণনা করবে, একটি লোকেশনে বাইনারি সংখ্যাগুলো (বাইনারি ডিজিট; সংক্ষেপে ‘বিট’) রেখে হিসাব করতেই প্রসেসরকে ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। সহজ ভাষায় বলতে হয়, এই ‘৩২-বিট’ ও ‘৬৪-বিট’ দ্বারা একটি প্রসেসরের গণনা করবার ক্ষমতাকে প্রকাশ করা হয়। আপনি নিশ্চয়ই ১০ পৃষ্ঠার একটি খাতার তুলনায় ২০ পৃষ্ঠার খাতায় বেশি পরিমাণে হিসেব করে নিতে পারবেন। আর যদি হিসেবের পরিমাণকে নির্দিষ্ট করে দিয়ে ২০ পৃষ্ঠা সমান হিসেব ১০ পৃষ্ঠার মাঝে করতে দেওয়া হয়, পেন্সিল দিয়ে পুরো দশ পৃষ্ঠায় গণনার কাজ অর্ধেকটা সেরে পৃষ্ঠাগুলো মুছে বাকি অর্ধেকটুকু করতে হবে। সেক্ষেত্রে সময়ের পরিমাণও বেশি লাগবে আমাদের।
কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তি বাজারের প্রেক্ষাপটে একটি প্রসেসরের প্রসেসিং ক্ষমতা নিয়ে অতটা চিন্তা না করলেও চলে। কারণ প্রসেসরগুলো বানানোই হচ্ছে ৬৪-বিট রেজিস্টার সম্পন্ন করে। নব্বইয়ের দশকে ৩২-বিট প্রসেসরগুলোই ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ইন্টেলের পেন্টিয়াম সিরিজ, এএমডি এর প্রথমদিককার সবগুলো প্রসেসরই ৩২-বিট দীর্ঘ রেজিস্টার ব্যবহার করে কাজ করতো। এসকল প্রসেসরের জন্যও মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে ছিলো উইন্ডোজ ৯৫, ৯৮, এক্সপি; যা ছিল ৩২-বিটের।
আগেই বলা হয়েছে, ৩২-বিট প্রসেসর আর ৩২-বিট অপারেটিং সিস্টেম এক জিনিস নয়। একটি ৩২-বিট প্রসেসরে আপনি কখনোই ৬৪-বিট অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে পারবেন না। আপনি নিশ্চয় পাঁচটি বই রাখা যায় এমন একটি ব্যাগ কারো হাতে দিয়ে বলতে পারেন না যে, “১০০টি বই রেখে দেখান তো আমাকে!” ১৯৬১ সালে আইবিএম একটি সুপার কম্পিউটার প্রস্তুত করে, যার রেজিস্টার ৬৪-বিটের। নামেই উল্লেখ করা আছে- ‘সুপার’ কম্পিউটার। এটি ঘরে ঘরে ব্যবহারের জন্য উপযোগী নয়।
ঘরে ঘরে ব্যক্তিগত কম্পিউটারে ৬৪-বিট প্রসেসর আসতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় অনেকগুলো বছর। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই শক্তিশালী প্রসেসরটির আকার ছোট করে ঘরে ঘরে পৌঁছানোর কাজ শুরু হয়। আর এর সাথে তাল মেলাতেই মাইক্রোসফটও প্রযুক্তি বাজারে হাজির হয় উইন্ডোজ এক্সপি-র ৬৪-বিট অপারেটিং সিস্টেমটি নিয়ে। পরবর্তীকালে উইন্ডোজ ভিস্তা, ৭, ৮, ১০ সবগুলো অপারেটিং সিস্টেম ৩২-বিট ও ৬৪-বিট যুগলবন্দী হয়ে উন্মোচিত হতে থাকে।
একটি ৬৪-বিট দীর্ঘ রেজিস্টার সম্পন্ন প্রসেসরে আপনি ৩২-বিট ও ৬৪-বিট উভয় অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে পারবেন। ১০০টি বই রাখা যায় এমন একটি ব্যাগে ১০০টি বই রাখবেন নাকি ৫০টি, তা আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। তবে আপনি যদি সিদ্ধান্ত নিন, পঞ্চাশটি বই রাখবেন, অর্ধেক জায়গাই কিন্তু অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। একটি ৬৪-বিট প্রসেসরে যদি ৩২-বিট অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করেন, প্রসেসরটির ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করছেন না আপনি।
কোনো ওয়েবসাইট থেকে সফটওয়্যার ডাউনলোড করার সময় অবশ্যই দেখেছেন, সফটওয়্যারটি ৩২-বিট ও ৬৪-বিট দুই ভার্সনই রয়েছে। আপনার প্রসেসর ও অপারেটিং সিস্টেম অনুযায়ী ডাউনলোড করতে হবে। যেমন: অ্যাডোবি-র ক্রিয়েটিভ ক্লাউডের সফটওয়্যারগুলোর জন্য আপনার প্রসেসর ও অপারেটিং সিস্টেম দু’টোই ৬৪-বিট প্রয়োজন। এসমস্ত সফটওয়্যারে প্রচুর কম্পিউটিং স্টোরেজ প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে ৩২-বিট অপারেটিং সিস্টেমে ব্যবহার করতে গেলেও প্রচুর স্লো হবে, ল্যাগিং করবে, সময় নষ্ট করবে।
আপনি খুব সহজেই জেনে নিতে পারবেন, আপনার ব্যক্তিগত ব্যবহৃত কম্পিউটারটিতে ঠিক কত বিটের প্রসেসর ও অপারেটিং সিস্টেম রয়েছে।
অপারেটিং সিস্টেমের সাথে প্রসেসরের সম্পর্ক আলোচনায় র্যামের কার্যকারিতা নিয়েও কিছু বলা যাক। আগেই বলা হয়েছে, একটি অপারেটিং সিস্টেম কিংবা কোনো সফটওয়্যারে ৩২-বিট ও ৬৪-বিট নির্ধারণের মাধ্যমে, আপনি সফটওয়্যারটিকে অনুমতি প্রদান করছেন; সফটওয়্যারটি চালু হতে অর্থাৎ কম্পিউট করতে গিয়ে আপনার প্রসেসরের কতটুকু লোকেশন ব্যবহারে সক্ষম। সে অনুমতি অনুযায়ী প্রসেসর র্যামের লোকেশন বরাদ্দ করবে।
একটি রেজিস্টারের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী কয়টি লোকেশন ব্যবহারের অনুমতি সে পাবে, তা নির্ভর করে ২-এর উপর সেই দৈর্ঘ্যের পাওয়ারের উপর। অর্থাৎ ১-বিটের প্রসেসর একটি র্যামের ২ বাইট লোকেশনে (২^১= ২ বাইট) বাইনারি সংখ্যা রেখে গণনা করতে সক্ষম হবে। একই নিয়মে-
২^২ = ৪ বাইট
২^৩ = ৮ বাইট
২^৪ = ১৬ বাইট
এত অঙ্ক রেখে ২ এর উপরই কেন পাওয়ার হতে হবে? তার কারণ, কম্পিউটার বোঝে শুধু বাইনারি সংখ্যা, বাইনারিতে অঙ্ক আছে কেবল দুটো- ০ আর ১। যদি দশমিক অথবা অন্য কোনো সংখ্যারীতি ব্যবহৃত হতো, তাহলে রেজিস্টারের গঠন আরো জটিল হয়ে যেত। সবদিক বিবেচনায় রেখেই আমাদের কম্পিউটারগুলোকে বাইনারি ভাষায় দীক্ষিত করা হয়েছে।
এবার আসা যাক আমাদের ব্যবহৃত প্রসেসরে। একটি ৩২-বিট প্রসেসর মানে হলো, এর মাঝে র্যামের লোকেশন ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে ২^৩২ = ৪,২৯৪,৯৬৭,২৯৬ বাইট/৪,১৯৪,৩০৪ কিলোটবাইট/৪,০৯৬ মেগাবাইট/৪ গিগাবাইট। আপনি যদি ৩২-বিট একটি অপারেটিং সিস্টেমে ১৬ গিগাবাইট র্যামও ব্যবহার করেন, আপনার কোনো উপকারে আসবে না তা। কেননা, র্যামের কেবল মাত্র ৪ গিগাবাইট জায়গা আপনার প্রসেসরটি ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে।
৬৪-বিটের হিসেবগুলোও একইভাবে, এটি স্টোরেজ ব্যবহারের ক্ষমতা হলো ২^৬৪ = ২০ অঙ্কের বিশাল একটি সংখ্যা, গিগাবাইটের হিসেবেও বিশাল সংখ্যা। একে সুন্দরমতো প্রকাশ করতে ব্যবহার করতে হয় এক্সাবাইট এককটির মাধ্যমে; ১ এক্সাবাইট = ১,০৭৩,৭৪১,৮২৪ গিগাবাইট। হিসেবে দাঁড়ায় ১৬ এক্সাবাইট; যা কেবলমাত্র তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করা যায়। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ৮ টেরাবাইট/৮,১৯২ গিগাবাইট পর্যন্ত র্যামের ব্যবহার প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। সহজভাবে ধরে নিন, একটি ৬৪-বিট অপারেটিং সিস্টেমে আপনি ৪ গিগাবাইটের উপরে প্রযুক্তি বাজারে প্রাপ্ত যেকোনো র্যাম ব্যবহার করতে পারবেন।
আপনার কম্পিউটারে র্যাম যদি ৪ গিগাবাইট অথবা এর কম হয়ে থাকে তাহলেই কেবল ৩২-বিট অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করুন। একটি ৬৪-বিট অপারেটিং সিস্টেমে পর্যাপ্ত র্যাম ব্যবহার করে আপনি একই সময়ে একাধিক কাজ করতে পারবেন কম্পিউটারে, প্রোগ্রাম চালু করতে পারবেন, ওয়েব ব্রাউজারে অনেকগুলো ট্যাব খুলতে পারবেন। একই কাজ ৩২-বিট অপারেটিং সিস্টেমে করতে গেলে কাজগুলো ধীরগতির হয়ে যাবে।
নিশ্চয়ই একটি ৬৪-বিট প্রসেসর কিংবা অপারেটিং সিস্টেমকে পূর্ণ ব্যবহার করতে একজন মানুষ সাধ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ র্যাম সংকুলান করবেন। তা না হলে এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রসেসর, মানবমস্তিষ্ককে কেন অলস বসিয়ে রাখা হয়?
কখনো কি ভেবেছেন, নাসা থেকে ১৯৭৭ সালে পাঠানো ভয়েজার-১ স্পেস প্রোবটির জন্য নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটারটি থেকেও অধিক শক্তিশালী একটি কম্পিউটার আপনার বাসায় রয়েছে, আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে? ব্যক্তিগত এই কম্পিউটারটির ক্ষমতা অসীম, যদি আপনার মস্তিষ্কের দক্ষতায় সঠিকভাবে তা ব্যবহার করতে পারেন।