Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যামাজন রূপকথার নেপথ্যের অন্ধকার গল্প

ডন কর্লিয়নি একচ্ছত্রভাবে জলপাই তেলের ব্যবসা করতে চান। প্রতিযোগিদের কারো ক্ষতি হোক, সেটাও তিনি চান না। সেজন্য তিনি তাদেরকে বোঝান, ‘এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ো! সেটাই তোমার জন্য ভালো।’ যারা তার কথা বোঝে, তাদের ব্যবসা তিনি ন্যায্য মূল্যে কিনে নেন। কিন্তু যারা বোঝে না?

ব্রুকলিনের কিছু পাইকারি তেল ব্যবসায়ী কিছুতেই বুঝতে চাচ্ছিল না তার স্বপ্নের কথা। ডন কর্লিয়নি টেসিও নামের একজনকে পাঠালেন এই সমস্যা সমাধানের জন্য। টেসিও সেখানে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ল। একের পর পুড়তে শুরু করল ব্রুকলিনের গুদামগুলো। রাস্তার ওপর টন টন জলপাই তেলের পুকুর তৈরি হতে লাগল। তারপর…। তারপর কী হয়েছিল, সেটা বোধ হয় আর লেখার প্রয়োজন নেই। ডন কর্লিয়নি হয়ে উঠেছিলেন জলপাই তেলের একমাত্র ব্যবসায়ী।

গল্পটা মারিয়ো পুজোর গডফাদার বই থেকে নেয়া। এই বইয়ের নাম শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ১৯৭২ সালে এই বই থেকে বানানো চলচ্চিত্রটিকে সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। ডন ভিটো কর্লিয়নির মাফিয়া সাম্রাজ্যকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সেই বইয়ের গল্প।

না, জেফ বেজোস কারো দোকানে আগুন লাগিয়ে দেননি। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেট প্লেসের মালিক হওয়ার জন্য তিনি যা করেছেন, তার সাথে ডন কর্লিয়নির দর্শনের খুব বেশি পার্থক্য আসলে নেই। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন তাহলে, একটা গল্প শুনে আসা যাক।

জেফ বেজোস; Image Source: biography.com

অ্যামাজন ডট কম। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেট প্লেস। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ৪টি টেক-কোম্পানির একটিও বটে। আর, জেফ বেজোস এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও। তার উঠে আসার গল্পটি রূপকথার মতো। উদ্যোক্তা হিসেবে তার পথচলার গল্প সবার কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।

কিন্তু, আলোর নিচেই থাকে অন্ধকার। না, জেফ বেজোস কখনো অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে কারো দোকানে হামলা করেননি। অস্ত্র হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন অন্যরকম এক ব্যবসায়ীক মডেল ও অর্থনীতি-আইনের ফাঁক। সেজন্যই, অ্যামাজন আদৌ মনোপলি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কি না, তা নিয়ে মতানৈক্য আছে।

গল্পের কথা বলে হঠাৎ এসব টানা কেন? কারণ, গল্প শোনার জন্য দুটো টার্ম আগে একটুখানি জেনে নিতে হবে। টার্মগুলো হলো- এক, মনোপলি আর দুই, অ্যান্টি-ট্রাস্ট ল’।

সহজ করে বলা যাক। মনোপলি মানে, যে বাজারের বিক্রেতা মাত্র একজন। অন্য কোনো বিক্রেতা এই বাজারে ঢুকতে চাইলেও পারবে না। কারণ, একমাত্র বিক্রেতা অন্যদের পণ্যমূল্য, পণ্যের উৎস বা উৎপাদনের খরচ, সাপ্লাই চেইন ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকে বাধা দেবে। এই বাধা পেরিয়ে নতুন কারো জন্য বাজার ধরাটা হয়ে যাবে দুঃসাধ্য। মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসা আবার দুই ধরনের হতে পারে। যদি বাজারে একজন মাত্র বিক্রেতাই থাকে, তাহলে একে বলে বিশুদ্ধ মনোপলি। আর, দুই থেকে তিনজন বিক্রেতা মিলে বাজার দখল করে রাখলে, এটি বিশুদ্ধ মনোপলি না। বোঝাই যাচ্ছে, অ্যামাজন মোটেও বিশুদ্ধ মনোপলি ব্যবসা করছে না। (আসলে, করার কথাও না!) কিন্তু বিশুদ্ধ না হলেও, বাকি প্রতিযোগীরা যে তাদের ধারেকাছেও নেই, সেটা বোঝা যাবে নিচের চার্টে। এই চার্টটা ২০১৮ সালের। দেখাই যাচ্ছে, সে বছর ই-কমার্স বাজারে বিক্রির দিক থেকে অ্যামাজনের দখলে ছিল ৪৯%। যেখানে পরবর্তী প্রতিযোগী ইবে-এর দখলে আছে মাত্র ৬%!

ই-কমার্স বাজারের প্রায় অর্ধেকই অ্যামাজনের দখলে; Image Source: techcrunch.com

মনোপলি বা একচেটিয়া বাজারের সমস্যা হচ্ছে, পণ্যের ওপর গণতন্ত্র কাজ করে না। অর্থাৎ, ক্রেতাদের কিছু বলার উপায় থাকে না। মূল্য যথাযথ হোক না হোক, গুণমান ঠিক থাকুক বা না থাকুক, বিক্রেতা যেভাবে বলবে, পণ্য নিতে হলে সেভাবেই নিতে হবে। এদিকে, বিক্রেতার ওপর কোনো চাপ প্রয়োগের উপায় নেই। মূল্য নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা বা গুণমান ঠিক রাখার কোনো বাধ্য-বাধকতা নেই। কারণ, বাজারে আর কোনো প্রতিযোগীই নেই!

এই ব্যাপারটা মাথায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রণয়ন করে অ্যান্টি-ট্রাস্ট ল’। এর মধ্যে মূল আইন তিনটি। শারম্যান অ্যাক্ট (১৮৯০), ক্লেইটন অ্যাক্ট (১৯১৪) এবং ফেডারেল ট্রেড কমিশন অ্যাক্ট (১৯১৪)। এই আইনগুলো বানানো হয়েছে মূলত ক্রেতাদের অধিকার রক্ষার্থে। শারম্যান অ্যাক্টের সেকশন ১ ‘একদাম’-এ বিক্রি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। পাশাপাশি এটি কোনোভাবে যোগসাজশ করে বা কার্টেল তৈরি করে অন্যান্য বিক্রেতাকে সরাসরি ব্যবসায়ে বাধা দেওয়াকেও বেআইনি ঘোষণা করে। শারম্যান অ্যাক্টের সেকশন ২ মনোপলি বা একচেটিয়া বাজার দখল ও অন্যায়ভাবে এই ক্ষমতার প্রয়োগে (যেমন, অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য বিক্রি) নিষেধাজ্ঞা দেয়। এদিকে, ক্লেইটন অ্যাক্টের সেকশন ৭ বড় বড় প্রতিযোগী কোম্পানিদের একজোট হয়ে বাজার দখল করে নেয়া ও এর ফলে বাজারে প্রতিযোগীতা কমে যাওয়াকে বেআইনি দাবি করে।

খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যাবে, আইনগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাজারে ক্রেতাদের অধিকার রক্ষা করা। আর, এই অধিকারের সবচেয়ে বড় পরিমাপক হচ্ছে পণ্য মূল্য। অর্থাৎ, অতিরিক্ত দামে বা একদামে ক্রেতাকে কোনোকিছু কিনতে বাধ্য করা। অ্যামাজন ‘বিশুদ্ধ মনোপলি’ হতে চায়নি। মানে, বাস্তবে যাই হোক, ‘কাগজে-কলমে’ নিজেদের বিশুদ্ধ মনোপলি বিক্রেতা হিসাবে দাঁড় করাতে চায়নি তারা। সেজন্য অ্যামাজন, মানে, আমাদের জেফ বেজোস এমন এক উপায় বেছে নিয়েছেন, যাতে আইনের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিচ্ছু করার উপায় না থাকে!

ডায়াপারস ডট কম (diapers.com) নামে একটা ই-কমার্স ওয়েবসাইট ছিল। ২০০৫ সালে মার্ক লোরে এবং ভিনিত বাহারা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, বাচ্চাদের ডায়াপার বিক্রি করাই তাদের মূল কাজ। নতুন বাবা-মায়েদের জন্য এভাবে ডায়াপার বিক্রির কথা আগে আর কেউ ভাবেনি। অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ বিখ্যাত হয়ে ওঠে ওয়েবসাইটটি।

ডায়াপারস ডট কম; Image Source: simply-in-control.blogspot.com

তারপর, গল্পের মতো করে বললে বলা উচিৎ- জেফ বেজোসের হঠাৎ ইচ্ছা হলো ওয়েবসাইটটা কিনে নেবেন। ব্যবসা যেহেতু করবেনই, একচ্ছত্রভাবে কেন নয়? তাছাড়া, ওদেরকে যথেষ্ট অর্থ দিতেও তিনি প্রস্তত। না, এই ঘটনা গল্পের মতো করে বলা সম্ভব না। বরং বাস্তবে ফেরা যাক।

২০০৯ সালের কথা। অ্যামাজন ওদের প্রস্তাব দিল সাইটটা কিনে নেয়ার জন্য। অস্বীকৃতি জানাল মালিক পক্ষ। পরবর্তী ৩ মাস যেসব দম্পতির বাচ্চা আছে, তাদের জন্য অ্যামাজন প্রাইম সার্ভিস ফ্রি করে দেয়। বিজ্ঞাপনে লেখা হয়, ‘হয়ে যান অ্যামাজন-মা (Become an amazon-mom)!’ 

অ্যামাজনের বিজ্ঞাপন, হয়ে যান অ্যামাজন-মা; Image Source: amazon.com

না, জেফ বেজোস কোনো টেসিওকে পাঠাননি। পিস্তল হিসাবে ডায়াপারস ডট কমের মাথায় ঠেসে ধরেছিলেন নিজের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। সে যুদ্ধে বিক্ষত হয়েছিল অ্যামাজন। এর একটা নাম আছে, প্রিডেটরি প্রাইসিং। অসম্ভব কম দামে পণ্য ছেড়ে দিয়ে বাজার দখল করে নেওয়া। সমস্যা হচ্ছে, প্রিডেটরি প্রাইসিং করে কেউ যে ব্যবসায় মনোপলি বা একচেটিয়া দখল আনতে চাইছে, সেটা সরাসরি প্রমাণ করাটা কঠিন। কোনো প্রতিষ্ঠান দাবি করতেই পারে, জিনিসটা উৎপাদন করে বাজারজাত করতে তার আসলেই কম খরচ হচ্ছে। ঠিক এই ফাঁকিটাই ব্যবহার করেছে অ্যামাজন। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার গচ্চা দিয়েছে। কিন্তু জিতে নিয়েছে সেই ওয়েবসাইট। 

সিনেমায় যে গল্প শুনলে জেফ বেজোসকে হাউজ অব কার্ডের ফ্র্যাঞ্চিস ‘ফ্র্যাংক’ আন্ডারউড বা গডফাদারের কর্লিয়নি পরিবারের সদস্যদের মতো রোমাঞ্চকর চরিত্র বলে মনে হয়, বাস্তবে তা ভয়ংকর নির্মমতা ছাড়া আর কিছুই না। ডায়াপারস ডট কমের ব্যবসা বন্ধ করে দেয় অ্যামাজন। প্রতিষ্ঠাতা মার্ক লোরে এবং ভিনিত বাহারা বাধ্য হন ওয়েবসাইট বিক্রি করে দিতে। ২০১০ সালের নভেম্বরের ৮ তারিখ ৫৪৫ মিলিয়ন ডলারে ডায়াপারস ডট কম কিনে নেয় অ্যামাজন। তারপর লিঙ্কটা রিডাইরেক্ট করে দেয় অ্যামাজন ডট কম-এ। অর্থাৎ, ডায়াপারস ডট কম লিখে এন্টার প্রেস করলে লিঙ্কটা আপনাকে অ্যামাজনের সাইটেই নিয়ে যাবে।

অবশেষে, ২০১৭ সালে ডায়াপারস ডট কম বন্ধ করে দেয় অ্যামাজন। কারণ হিসাবে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়, সাইটটার ব্যবসা যথেষ্ট লাভজনক নয় দেখে অ্যামাজন এই সাইট (পড়ুন ডোমেইন) আর চালাতে চাচ্ছে না!

এরকমটা কিন্তু শুধু একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হয়নি। বারবার হয়েছে। এর মধ্যে আছে সোপ ডট কম, বিউটিবার ডট কম ইত্যাদি। এরকম সবগুলো সাইট (ডোমেইন) ২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে অ্যামাজন। কারণটা স্বাভাবিক। ততদিনে সেই সাইটগুলোর প্রিমিয়াম প্রোডাক্টগুলো জায়গা করে নিয়েছে অ্যামাজন ডট কম-এ। ব্যবহারকারীরাও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আর, এরকম সাইটগুলোর প্রতিষ্ঠাতাদের রক্ত পানি করা পরিশ্রমের উপর পা দিয়ে অ্যামাজন হয়ে উঠেছে পৃথিবী সেরা অনলাইন মার্কেট প্লেস। অনুপ্রেরণা বটে!

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অ্যান্টি-ট্রাস্ট ল’ অ্যামাজনকে আটকাতে পারেনি। পারবেও না। কারণ, প্রথমত, অ্যামাজন বিশুদ্ধ মনোপলি ব্যবসায় নামেনি। কারো মাথায় সরাসরি ঠেকায়নি পিস্তল। কিংবা কোনো কার্টেল বা প্রতিষ্ঠান করে, কোনোরকম যোগসাজশ করে কাউকে ব্যবসা করতে বাধাও দেয়নি! দ্বিতীয়ত, আইনগুলো করা হয়েছে ক্রেতাদের অধিকার রক্ষার্থে। কিন্তু অ্যামাজনের মিলিয়ন ডলার গচ্চা দেওয়া বা বিনামূল্যে পণ্য সরবরাহ করার ফলে ক্রেতাদের অধিকার সরাসরি ক্ষুণ্ণ হয়নি। শুভঙ্করের এই ফাঁকিটিই ব্যবহার করেছে অ্যামাজন। চড়া মূল্যে লাভ করা পরে, আগে বাজার দখল করতে হবে, সেজন্য লস দেওয়া যাবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার- এই নীতি ব্যবহার করে, আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে দিব্যি।

অ্যামাজনের মাধ্যমে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান নিজেদের বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে। অ্যামাজন থেকে পণ্য কিনেছেন, এরকম সবাই এটা জানেন। প্রতিটা পণ্যের পাশে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা থাকে। বাংলাদেশে দারাজ বা ইভ্যালির মতো ই-কমার্সগুলোও একইভাবে কাজ করে।

সমস্যাটা হচ্ছে, কোনো কোম্পানি যখন অ্যামাজনে পণ্য দেয়, আর সেই পণ্য যখন ভালো বিক্রি হয়, তখন অ্যামাজন চাইলে সহজেই সেই পণ্যের বাজার দখল করে নিতে পারে। সেজন্য তারা কোম্পানি যাদের দিয়ে পণ্য তৈরি করায়, অর্থাৎ ম্যানুফাকচারার, তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে। আবার, চাইলে অন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকেও নিয়োগ দিতে পারে এ কাজে। এই কাজও করেছে অ্যামাজন, করছে আজও।

আধুনিক এই পুঁজিবাদী পৃথিবীতে সবকিছুই পণ্য। ফেসবুকের কাছে তাদের প্রতিজন ব্যবহারকারীই পণ্য। চাকরি করতে গেলে সিভিতে আমরা নিজেদের পণ্য হিসাবেই দেখাই, তারপর সেই পণ্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করার চেষ্টা করি। এরকম এক পৃথিবীতে বসে অ্যামাজন রূপকথার অন্ধকারের গল্প শুনতে শুনতে কারো হয়তো মনে হতে পারে, অ্যামাজন তো আসলেই ক্রেতাদের কোনো ক্ষতি করেনি। কিংবা কোনো মানুষের সরাসরি কোনো ক্ষতি করেনি। টাকা আছে, বুদ্ধি আছে; তা-ই খাটিয়ে ব্যবসা করেছে- এই তো।

এবারে তাহলে অ্যামাজনের ব্যবসায়ীক মডেলের ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক। এই মডেলের ফ্রন্ট-এন্ড বা দৃশ্যমান অবস্থায় আছে ক্রেতা-অ্যামাজন সম্পর্ক। আর ব্যাক-এন্ডে আছে অ্যামাজন-সাপ্লাই চেন সম্পর্ক। এখানে আমরা দুটো সম্পর্কই খতিয়ে দেখব।

প্রথমেই, ক্রেতা-অ্যামাজন সম্পর্কের দিকে আসি। এখানে, শুরুতেই যে তথ্যটা জানা দরকার, অ্যামাজনের রিটেইলিং সার্ভিস বা অ্যামাজন ডট কম কিন্তু অ্যামাজনের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা না। তাদের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসার নাম অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস (AWS)। এটি অ্যামাজনের ক্লাউড হোস্টিং সার্ভিস। ২০১৯ সালে এই সার্ভিস থেকে অ্যামাজনের রেভিনিউ ছিল ৩৫.৩ বিলিয়ন ডলার! এর আগের বছর, ২০১৮ সালে রেভিনিউ ছিল ২৫.৬৫৫ বিলিয়ন ডলার। এক বছরে, এক লাফে রেভিনিউ বেড়ে গেছে ১০ বিলিয়ন ডলার! স্বাভাবিক। এয়ারবিএনবি থেকে শুরু করে অ্যাডোবি, স্পটিফাই, নেটফ্লিক্স এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং সিআইএ পর্যন্ত অ্যামাজনের সার্ভিস ব্যবহার করেছে বা করছে।

২০১৩-২০১৯ পর্যন্ত অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস-এর রেভিনিউ; Image Source: statista.com
অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস ক্লাউড হোস্টিংয়েও এগিয়ে আছে সবার চেয়ে; Image Source: statista.com

বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিসটা তাই আপনাতেই চলে এসেছে অ্যামাজনের হাতে- তথ্য। ফেসবুক বা গুগলকে যেখানে মানুষের তথ্য চেয়ে নিতে হয়, অ্যামাজন সেখানে সব ধরনের তথ্য পেয়ে যাচ্ছে না চাইতেই। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সে জানে। জানে, একজন মানুষ কোন ধরনের পণ্য পছন্দ করেন, কী খেতে চান, কী পরতে চান কিংবা অবসরে কী দেখতে পছন্দ করেন। শুধু অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও-ই না, বিখ্যাত মুভি ডাটাবেজ আইএমডিবিও অ্যামাজনের! ১৯৯৮ সালে ৫৫ মিলিয়ন ডলারে আইএমডিবি কিনে নেয় অ্যামাজন। সেজন্যই, যারা অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও ব্যবহার করেছেন, তারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, ভিডিও পজ করলে ওপরের বাম কোনায় আইএমডিবি থেকে বিভিন্ন তথ্য সরাসরি দেখা যায়।

এভাবে ব্যক্তিগত তথ্য একটা প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে গেলে এবং সেদিকে কড়া নজরদারি না রাখলে কী হয়, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফেসবুক-ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা তথ্য কেলেংকারি। যে তথ্য ব্যবহার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়ে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট! তারপরের গল্প সবারই জানা।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেট প্লেস হয়ে ওঠার পেছনে অ্যামাজন যে এসব তথ্যের সহায়তা পাচ্ছে, তা নিশ্চয়ই আলাদা করে আর বলে দেয়ার প্রয়োজন নেই।

এবারে আসা যাক অ্যামাজন-সাপ্লাই চেন কর্মীদের কথায়। আমাজন প্রাইম ক্রেতারা যে ঘরে বসে এক-ক্লিকে দ্রুততম সময়ে পণ্য হাতে পেয়ে যান, এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী সাপ্লাই চেন কর্মীরা। বিশেষ করে যারা ড্রাইভার বা ডেলিভারি ম্যান। দ্রুততম সময়ে ক্রেতাদের হাতে পণ্য পৌঁছে দেয়ার জন্য গাধার খাটুনি খাটতে হয় তাদের। ওভারটাইম করলেও সেভাবে টাকা পাওয়া যায় না। এক তদন্তে জানা যায়, ড্রাইভাররা প্রস্রাব করার জন্যে বাথরুমে যাওয়ার মতো সময় পর্যন্ত পান না। বোতলে কাজ সেরে ফেলেন। শুনতে বা পড়তে হাস্যকর লাগলেও, যারা ভুক্তভোগী, তাদের জন্য বিষয়টা অবশ্যই হাসির না। স্বাভাবিকভাবেই, অ্যামাজন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

অ্যামাজন কর্মীদের গাধার খাটুনি খাটতে হয়; Image Source: nypost.com

কর্মীদের এ ধরনের গুরুতর অভিযোগ থাকলে, সেগুলো সাধারণত কর্মী ইউনিয়ন সমাধান করে। ২০০১ সালে কর্মীদের একটি ইউনিয়ন এরকম একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। অ্যামাজন সেবার ৮৫০-এর মতো কর্মী ছাঁটাই করে দেয়। এবং, স্বাভাবিকভাবেই, এর সঙ্গে ইউনিয়নের কাজের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে। ২০১৮ সালে অ্যামাজনে কর্মীদের প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও লিক হয়ে যায়। তাতে অ্যামাজনের পক্ষ থেকে একটি বক্তব্যে জানা যায়,

আমরা ইউনিয়নের বিপক্ষে নই, কিন্তু নিরপেক্ষও নই। আমাদের ক্রেতা, শেয়ারহোল্ডার বা সহযোগীদের জন্য ইউনিয়ন খুব ভাল কিছু বলে আমরা মনে করি না।

২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স (যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন ২০২০-এ জো বাইডেনের পাশাপাশি এই সিনেটরও ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন, পরে সরে যান) এবং রিপ্রেজেন্টেটিভ রো খান্না কর্মীদের সঠিক আয় নিশ্চিত করার জন্য একটি ক্যাম্পেইন করেছিলেন। এর নাম ছিল, স্টপ ব্যাড এমপ্লয়ারস বাই জিরোয়িং আউট সাবসিডিজ (Stop Bad Employers by Zeroing Out Subsidies)। সংক্ষেপে, স্টপ বেজোস! নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এর মূল লক্ষ্য ছিল অ্যামাজন এবং জেফ বেজোস। সেই ক্যাম্পেইনের পরে অ্যামাজন কর্মীদের বেতন ঘণ্টায় ১৫ ডলার করে বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়। ভয়ংকর নির্মম ব্যাপার হচ্ছে, বেতন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মাসিক বোনাস দেয়ার নিয়ম বাতিল করে দেয় অ্যামাজন!

এই করোনাভাইরাসের সময়েও কর্মীদের দিয়ে প্রচণ্ডভাবে কাজ করিয়ে নিয়েছে তারা। এ সময় তারা কর্মীদের বেতন ঘণ্টায় ২ ডলার করে বাড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দেয়। মার্চের মাঝামাঝির দিকে অ্যামাজনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানা যায়, স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের এক ওয়্যারহাউজের ২ জন কোম্পানি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সেই ওয়্যারহাউজের একাধিক কর্মীর বিবৃতিতে জানা যায়, আক্রান্তের সংখ্যা ১০ জন। মার্চের ৩০ তারিখ ১৫-৬০ জনের মতো কর্মী ওয়্যারহাউজ বন্ধ করে পুরোপুরি পরিষ্কার করা ও ডিসইনফেক্ট করার দাবিতে কাজ ছেড়ে সাময়িকভাবে বেরিয়ে যায়। এই কর্মীদের যিনি সংগঠিত করেছিলেন, ক্রিস স্মলস, তাকে বরখাস্ত করে অ্যামাজন। আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানানো হয়, তিনি নাকি সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের নিয়ম মানেননি!

অ্যামাজন রূপকথার নেপথ্যের অন্ধকারের গল্প অনেক বড়। যুক্তরাষ্ট্রের বইয়ের বাজারের প্রায় সবটাই এখন অ্যামাজনের দখলে চলে এসেছে। অফলাইন স্টোর বা সাধারণ অনেক দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে অ্যামাজনের চাপে। তথ্য ও ইন্টারেনেটের ওপর তাদের আধিপত্যের কথা তো বলেছিই। এছাড়াও খাবার ও প্রায় সব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের বাজারের দিকেও ধীরে ধীরে হাত বাড়াচ্ছে অ্যামাজন। ক্রেতারা আপাত সুবিধা পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এক সময় প্রায় সব বাজার যখন অ্যামাজনের হাতে চলে যাবে, তখন কী হবে, তা চিন্তা করতে রকেট বিজ্ঞানী হওয়ার দরকার পড়ে না। কর্মী ও প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অ্যামাজনের ব্যবহার দেখলেই এটা বোঝা যায়।

টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে পার্সন অব দ্য ইয়ার জেফ বেজোস; Image Source: time.com

১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন জেফ বেজোসকে পার্সন অব দ্য ইয়ার হিসাবে ঘোষণা দেয়। এ প্রসঙ্গে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলা একটি উক্তির কথা মনে পড়ে যায়। ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লীতে, এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’

This article is in Bangla language. It is about Amazon.com: the largest e-commerce in the world - behind the story. The article is influenced by the Patriot Act with Hasan Minhaj. Necessary references have been hyperlinked inside. 

Featured Image: geekwire.com

Related Articles