Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আইবিএম সাইমন: পৃথিবীর প্রথম স্মার্টফোনের উত্থান-পতন

গত কয়েকদশক ধরে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এক জয়যাত্রা ঘটে চলেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। প্রযুক্তির সবথেকে যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটেছে আমাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে। ঠিক কতটা উন্নয়ন ঘটেছে তা পরিমাপ করা কঠিন।

তবে দিনকে দিন এই উন্নয়ন যেন বেড়েই চলেছে। বর্তমানের প্রায় সব বয়সী মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোনই প্রমাণ করে যে, যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রভাব পড়েছে কতটা। তবে স্মার্টফোন কেবল যোগাযোগই নয়, বরং অনলাইন-অফলাইনসহ আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে বৃহৎ পরিবর্তন, জীবনকে করেছে সহজ থেকে সহজতর।

মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোনই প্রমাণ করে যোগাযোগ ক্ষেত্রের উন্নয়ন; Source: inc.com

এখন মানুষ নিজেদের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে যতটা চিন্তা করে, বলতে গেলে ঠিক ততটাই চিন্তা করে নিজেদের স্মার্টফোন নিয়ে। অথচ তিন দশক আগেও মানুষের কাছে ফিচার ফোন বা সাধারণ বাটন ফোনই ছিল যোগাযোগের এক বিস্ময়। সেই বিস্ময়েরও বিস্ময় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে আজকের ফুলস্ক্রিন স্মার্টফোন। তবে আজকে যতটা উন্নত এবং অধিক সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ স্মার্টফোন আমরা হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছি, এর শুরুটা মোটেই এমন ছিল না।

এখন স্মার্টফোনের জগতে নানা পরিবর্তনের পাশাপাশি আছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের তুমুল প্রতিযোগিতা। সকল ব্র্যান্ডই তুলনামূলক দামে অধিক বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ স্মার্টফোন গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছে। বর্তমানে অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন নির্মাতা কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে স্যামসাং, ওয়ান প্লাস, শাওমি, রিয়েলমিসহ আরো কয়েকটি কোম্পানি। অন্যদিকে অ্যাপল তাদের নিজস্ব ‘iOS’ সমৃদ্ধ আইফোন তৈরি করে চলেছে।

অসংখ্য কোম্পানি প্রতিনিয়ত বাজারে ছাড়ছে স্মার্টফোন; Source: independent.co.uk

এছাড়া সম্প্রতি গুগল হুয়াওয়েকে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারের অনুমতি বাতিল করায় হুয়াওয়ে ‘হারমোনি ওএস’ নামে তাদের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম চালু করেছে। নোকিয়া প্রথমদিকে মাইক্রোসফট-এর অপারেটিং সিস্টেম পরিচালিত ফোন তৈরি করলেও অ্যান্ড্রয়েডের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। তারা বর্তমানে তাদের স্মার্টফোনগুলোতে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার শুরু করেছে।

তো। বোঝাই যাচ্ছে যে বর্তমানে স্মার্টফোনের বাজার ধরে রাখতে নির্মাতা কোম্পানিগুলো অপারেটিং সিস্টেম, ফোনের কারিগরি দক্ষতা নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত রয়েছে। নতুন নতুন অপারেটিং সিস্টেমেরও জন্ম হচ্ছে। কিন্তু মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক নয় কি যে, এই যে আজকের প্রতিযোগিতা, এর শুরু হলো কীভাবে? কীভাবে তৈরি হলো বিশ্বের প্রথম স্মার্টফোন? কী কী সুবিধা ছিল সেই ফোনে? আজ আমরা জানব সেই প্রথম স্মার্টফোন সম্বন্ধেই।

প্রথম মোবাইল ফোন তৈরি হয় ১৯৪০ এর দশকে। যদিও সেই আবিষ্কারকে সঠিক অর্থে মোবাইল ফোন বলা যায় না। বরং সেগুলোকে টু-ওয়ে রেডিওই বলা যায়। অর্থাৎ এখনকার ওয়াকিটকি বা ওয়্যারলেসের মতো ছিলো প্রথমদিকের মোবাইল ফোন। মূলত ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং জরুরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই এই ধরনের ডিভাইসগুলো ব্যবহার করত।

টেলিফোনের ক্ষেত্রে দেখা যেত যে, যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেস স্টেশনের উপরে নির্ভর করতে হতো। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির সাথে যোগাযোগের জন্য বেস স্টেশনের নির্দিষ্ট সেলের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। টেলিফোনে লাইনের তার সংক্রান্ত ঝামেলাও ছিল বেশ। কিন্তু মোবাইল ফোন তৈরির পর একটি নির্দিষ্ট বেস থেকে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় থাকা অন্যান্য ফোনে যোগাযোগ করা আরও সহজ হয়ে উঠল। তখন আর নির্দিষ্ট সেলের যোগাযোগের জন্য অপেক্ষা করে থাকার প্রয়োজন থাকল না।

পৃথিবীর প্রথম স্মার্টফোনের স্বীকৃতি দেয়া হয় আইবিএম কোম্পানির তৈরি একটি ডিভাইসকে। এর নাম আইবিএম সাইমন (IBM Simon)। ‘স্মার্টফোন’ শব্দের প্রচলন মূলত ১৯৯৫ সাল থেকে। এর পূর্বে এই ধরনের ডিভাইসকে বলা হতো পিডিএ (Personal Digital Assistant)। তবে আইবিএম সাইমন ছিল একইসাথে একটি সেলফোন এবং পিডিএ ডিভাইস।

আইবিএম সাইমন, বিশ্বের প্রথম স্মার্টফোন; Source: indiatimes.com

আইবিএম কোম্পানি তাদের স্মার্টফোনটি তৈরি করে ১৯৯২ সালের শুরুর দিকে এবং বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে আসে ১৯৯৪ সালে। তখন এর নাম ছিল সাইমন পার্সোনাল কমিউনিকেটর। বেশ মোটাসোটা এবং ওজনে ভারি এই ডিভাইসে মনোক্রোমিক, অর্থাৎ সাদা-কালো এলসিডি টাচস্ক্রিন সিস্টেম যুক্ত করা হয়। এই ডিসপ্লে দৈর্ঘ্যে ৪.৫ সে.মি. এবং প্রস্থে ১.৪ সে.মি.। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ডিভাইস পরিচালনার জন্য এর সাথে একটি স্টাইলাসও দিয়ে দেয়া হয়।

আইবিএম সাইমন ডিভাইসটি ফিচার ফোনের জগৎ থেকে নতুন জগতের সূচনা করল। তবে প্রথম স্মার্টফোন হলেও এতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি যুক্ত ছিল। প্রথমত, ফোনকলের সুবিধার পাশাপাশি এতে ছিল ইমেইলের ব্যবস্থা। সেই সাথে ফ্যাক্সের সুবিধাও ছিল।

এছাড়া আরো যেসব প্রযুক্তি যুক্ত ছিল সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিল্ট-ইন নোট যেখানে লেখালেখি করা যায়, অ্যাড্রেসবুক, ক্যালেন্ডার, ওয়ার্ল্ড ক্লক এবং একটি শিডিউল ম্যানেজার যার সাহায্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিডিউলিংয়ের কাজ করা যেত খুব সহজে।

Source: sudonull.com

বিল্ট-ইন সফটওয়্যারের পাশাপাশি এতে আরো কিছু থার্ড-পার্টি সফটওয়্যার ব্যবহারের সুযোগও ছিল। তবে সেক্ষেত্রে হয় অভ্যন্তরীণ মেমোরিকে মোটামুটি ফাঁকা রাখতে হতো, নয়তো বিশেষ ধরনের পিসি কার্ড সংযুক্ত করে মেমরি বৃদ্ধি করে নেয়া যেত।

প্রথম স্মার্টফোন হিসেবে আধুনিক স্মার্টফোনের কাছে আইবিএম সাইমন অবশ্য খুব একটা বিখ্যাত হতে পারেনি। কারণ নতুন প্রযুক্তির দিকে মানুষের অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় লাগে। তবুও ব্লুমবার্গ বিজনেসউইক-এর হিসেব মতে, আইবিএম তাদের ফোনটির প্রায় ৫০,০০০ ইউনিট বিক্রি করতে পেরেছিল। এই ফোনের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৯৯ ডলার এবং সেই সাথে প্রায় ১,৪৩৫ ডলারের সার্ভিস কন্ট্রাক্ট। বলাই যায় যে, সেসময়ে সেলফোনের বাজারে সাইমন পার্সোনাল কমিউনিকেটর তার সময় থেকে বেশ এগিয়ে ছিল।

মনোক্রোমিক টাচস্ক্রিন যুক্ত করা হয় আইবিএম সাইমন ফোনে; Source: ultimatehistoryvideogames.jimdofree.com

কিন্তু সবকিছুরই শেষ আছে। আইবিএম সাইমন বাজারে আসার পর এবং ব্যবহারকারীদের সংখ্যা দেখে আস্তে আস্তে অন্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোও স্মার্টফোনের দিকে ঝুকতে শুরু করে। কেউ একজন পথ দেখায়, হয়তো সফল হয়, নয়তো একসময় হারিয়ে যায়। কিন্তু বাকিরা সেই দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করে। আইবিএম সাইমনের বেলায়ও সেরকম হলো।

সাইমনের পরে তখনকার অন্যতম প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকবেরি তাদের স্মার্টফোন বাজারে নিয়ে আসে। যদিও ব্ল্যাকবেরি কোম্পানির প্রথম বাজারজাতকৃত ফোনটি একটি বহনযোগ্য ইমেইল ডিভাইস ছাড়া আর কিছু নয়। বাস্তবে স্মার্টফোন জগতে ব্ল্যাকবেরি প্রবেশ করে ২০০২ সালে। তাদের প্রথম স্মার্টফোনটি ছিলো ‘ব্ল্যাকবেরি ৫৮১০’।

এই স্মার্টফোনে তখনকার অনেক প্রয়োজনীয় সুবিধা যুক্ত ছিল। যেমন- ক্যালেন্ডার, মিউজিক সিস্টেম, ফুল ফাংশনিং কিবোর্ড সিস্টেম, অ্যাডভান্স সিকিউরিটি সিস্টেম এবং ইন্টারনেট। কিন্তু এর একটি অসুবিধা ছিল যে, আপনি কল করে কারো সাথে কথা বলতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই হেডফোনের সাহায্য নিতে হবে। ব্ল্যাকবেরি মূলত ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাদের এই স্মার্টফোন বাজারে নিয়ে আসে। একের পর এক তারা নতুন নতুন সুবিধা যুক্ত করতে থাকে তাদের স্মার্টফোনে।

কিন্তু ব্ল্যাকবেরিও একসময় বাজার হারাতে শুরু করে। কারণ ততদিনে অ্যাপল স্মার্টফোনের বাজারে আমূল পরিবর্তন নিয়ে হাজির হয়েছে। আধুনিক স্মার্টফোনের যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে ততদিনে। অ্যাপল তাদের প্রথম বছরে প্রায় ১.৪ মিলিয়ন স্মার্টফোন বিক্রি করে।

এখনকার আধুনিক স্মার্টফোনগুলো একটি ছোটখাট কম্পিউটারের থেকে কোনো অংশে কম নয়। এখন প্রায় প্রত্যেকের হাতে স্মার্টফোন ফোন পাওয়া যায়। সেসব ফোনে যেমন ব্যাটারি ব্যাকআপ নিয়ে থাকে না কোনো চিন্তা, তেমনি কত শত অ্যাপ, কত প্রযুক্তি যে যুক্ত আছে, সেটা ভাবতেই অবাক লাগে।

কিন্তু এসব তো একদিনেই তৈরি হয়নি। বিশ্বের প্রথম স্মার্টফোন হিসেবে আইবিএম সাইমন টিকে না থাকলেও, এর ধারাবাহিকতায় আজকের স্মার্টফোন জগতের এত বিশাল পরিবর্তন হয়েছে, হচ্ছে প্রতিনিয়িত। পাঠক, আপনি কোন স্মার্টফোনটি ব্যবহার করছেন?

Related Articles