.jpg?w=1200)
নিজেকে সমুদ্র তীরে ছুটি কাটানো অবস্থায় কল্পনা করুন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে ব্যাগ গোছানোর সময় ভেবেছিলেন, সাঁতরানোর মুড না থাকলে নিকোলাস স্পার্কের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসটা পড়ে শেষ করবেন। ব্যাগে করে মোটা বইটা নিয়ে আসলেও আপনি এখন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ পুনরায় পড়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। আপনার খুঁতখুঁতে পড়ার অভ্যাসটা আগেই জানতেন, তাই সেটিও ব্যাগে করে নিয়ে এসেছেন। ছোট বইটি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শেষ করার পর আশেপাশের পেশিবহুল মানুষগুলোকে দেখে আপনি হঠাৎ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠলেন। ভাগ্যিস, এ মাসের ‘ম্যানস হেলথ’ ম্যাগাজিনের সংখ্যাটা সংগ্রহে ছিল।
পূর্বে আপনার ছটফটে পড়ুয়া মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও লম্বা ভ্রমণের প্রস্তুতিলগ্নে আপনি বেশ ভারি ওজনের বইসহ ব্যাগ গুছিয়েছেন। এমনও হয়েছে, বইয়ের জন্য অন্যান্য অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসও বাড়িতে ফেলে যেতে হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষ আপনাকে সাধারণ একটি বইয়ের ওজনের ই-রিডারের মাধ্যমে শত শত বই বহন করার এবং পড়ার সুযোগ দিয়েছে।

যদিও বর্তমানে স্মার্টফোন, ট্যাবের মাধ্যমে পিডিএফ সহ আরো কয়েকটি ফরম্যাটে ই-বুক পড়া যায়, কিন্তু একটি ই-রিডার আপনাকে কাগজে ব্যবহৃত কালিতে চোখ বুলানোর তৃপ্তি দিতে পারে। ই-রিডারে ব্যবহৃত ই-ইঙ্ক প্রযুক্তি সাধারণ কাগজে ব্যবহৃত ফন্টের চেহারা এবং ভাব এনে দেয়। এছাড়াও স্মার্টফোনে ই-বুক পড়ার সময় ই-মেইল, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যাসেজিং অ্যাপগুলোর নোটিফিকেশন, ফোন-কল আপনার বইয়ের প্রতি মনোযোগে ঘাটতি তৈরির জন্য যথেষ্ট. কিন্তু ই-রিডারগুলোর ডিজাইনই যেহেতু শুধুমাত্র বই পড়ার জন্য করা হয়েছে, সেহেতু মনোযোগের কোনোরকম ঘাটতি ছাড়াই আপনি নিরবচ্ছিন্নভাবে পছন্দের বইটি পড়ে যেতে পারবেন। লম্বা ব্যাটারি-লাইফ, অ্যান্টি-গ্লেয়ার স্ক্রিনের ব্যবহারসহ ই-রিডারের আরো অনেক সুবিধা রয়েছে, যেগুলোর কারণে বই পড়ার জন্য স্মার্টফোন এবং ট্যাব জাতীয় ছোট কম্পিউটার ডিভাইসগুলো থেকে এটি বেশি প্রাধান্য পাবে।
নুভমিডিয়ার হাত ধরে ১৯৯৮ সালে বাজারে আসা প্রথম কমার্শিয়াল ই-রিডার ‘রকেট ই-বুক’ এর পর বর্তমান বাজারে অনেকগুলো কোম্পানি মানসম্মত ই-রিডার অফার করে থাকলেও দীর্ঘ ছয় বছর ধরে ‘আমাজন কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট’ পুরো বাজারটি বেশ শক্ত করে ধরে রেখেছে।
২০০৭ সালে আমাজন ই-রিডারের বাজারে প্রবেশ করে। অনলাইন বুক-স্টোর হিসেবে যাত্রা শুরু করা বিশ্বের সবচাইতে বড় অনলাইন শপিং কোম্পানিটির জন্য ই-রিডারের বাজারে বাজিমাত করা তেমন কঠিন কিছু ছিল না। ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত কোম্পানিটি বেশ কয়েকটি ডিভাইস বাজারে ছাড়ে। তবে তাদের কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইটের প্রথম সংস্করণটি ২০১২ সালের অক্টোবরে বাজারে আসার পর আগেরগুলোর চাইতে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তেমন কোনো পরিবর্তন ছাড়া দ্বিতীয় সংস্করণটি, অর্থাৎ কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট-২ আসে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। এবং ২০১৫ সালের জুনের শেষের দিকে তৃতীয় সংস্করণটি, অর্থাৎ কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট-৩ বাজারে আসার পর ই-রিডারের বাজারে ‘আমাজন কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট’ অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।

কিন্ডলের পেপারহ্যোয়াইট সিরিজটির জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ এতে ব্যবহৃত বিল্ট-ইন লাইট। কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট-১ এর পূর্ববর্তী মডেলগুলোর ডিসপ্লেতে কোনো বিল্ট-ইন লাইট ছিল না বিধায় অন্ধকারে যেকোনো বই পড়ার জন্য থার্ড-পার্টি আলোর উৎস ব্যবহার করতে হতো, যেমনটা পেপারব্যাক বই পড়ার সময় করতে হয়। এছাড়াও কিন্ডলের এই মডেলটিতেই আমাজন সর্বপ্রথম ‘ফ্রন্টলিট (Frontlit)’ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।
২১২ ppi, ৭৫৮×১০২৪ রেজুলেশনের ছয় ইঞ্চি ডিসপ্লের ডিভাইসটিতে ব্যবহৃত চারটি এলইডি লাইটকে ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণের করা যায়। ওয়াইফাই এবং পূর্বের কিন্ডেল টাচের মাসে মাত্র ৫০ মেগাবাইট থ্রি-জি ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা মেনে আমাজন স্টোর এবং উইকিপিডিয়া ব্যবহারের সুযোগও রয়েছে এই সংস্করণটিতে। এছাড়া এই সংস্করণটি ওয়াইফাই বন্ধ থাকা অবস্থায় এক চার্জে প্রায় ২৮ ঘণ্টা টানা বই পড়ার সুবিধা দিয়ে থাকে। এতে উল্লেখযোগ্য আরেকটি পরিবর্তন হচ্ছে পাওয়ার বাটন এবং লক বাটন ছাড়া আর কোনো বাটন নেই, অর্থাৎ অন-অফ এবং লক করা ছাড়া এটি পুরোপুরি টাচস্ক্রিন নির্ভর। এছাড়া এতে ব্যবহৃত হল ইফেক্ট সেন্সরের সাহায্যে আমাজনের অফিসিয়াল চামড়ার কভারটি বন্ধ নাকি খোলা, তা শনাক্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইট অফ/অন করতে পারে।
এছাড়াও আমাজন পেপারহ্যোয়াইটের সাথেই কিন্ডলের ‘টাইম টু রিড’ ফিচারটির উন্মোচন করা হয়, যেটি প্রাথমিক অবস্থায় কোনো বইয়ের একটি চ্যাপ্টার শেষ করতে কেমন সময় প্রয়োজন হয়, তা পরিমাপ করে পুরো বইটি শেষ করতে কেমন সময় লাগতে পারে তা জানাতে সক্ষম। বর্তমানে অবশ্য প্রায় প্রত্যেকটি কিন্ডলের মডেলে এই ফিচারটি সাপোর্ট করে। ২০১৩ সালের শুরুতে চার গিগাবাইট স্টোরেজ সহ কিন্ডলের জাপানী সংস্করণ এবং দুই গিগাবাইট স্টোরেজ সহ নন-জাপানী সংস্করণ আন্তর্জাতিক বাজারে মুক্তি পায়।
প্রথম সংস্করণ থেকে ২৫ শতাংশ দ্রুতগতি সম্পন্ন প্রসেসর নিয়ে ‘কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট-২’ বাজারে আসে ২০১৩ সালের শেষের দিকে। আহামরি নতুনত্ব না থাকলেও এই সংস্করণটির ফ্রন্টলিট প্রযুক্তিতে কিছুটা উন্নতি ঘটানো হয়। এমনকি ডিকশনারি, এক্স-রে লুক আপের মতো সফটওয়্যার, উইকিপিডিয়া, গুডরিডস ব্যবহারের সুযোগ এবং পেজ ফ্লিপ ফিচারটির আপডেট এই সংস্করণের সাথেই আসে।

বর্তমান সময়ে সবচাইতে বেশি চাহিদাসম্পন্ন কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইটের মডেলটি তৃতীয় প্রজন্মের কিন্ডল বা কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট-৩ হিসেবে পরিচিত। ২০১৫ সালের জুনের ৩০ তারিখ বাজারে এসে বাজিমাত করা এই মডেলটি পূর্বের মতো ৬ ইঞ্চি, তবে এতে ব্যবহৃত হয়েছে ১৪৪০×১০৮০ রেজুলেশনের ৩০০ ppi ই-ইঙ্ক কার্টা এইসডি ডিসপ্লে, যেটি মূলত আমাজনের পূর্বের মডেলগুলো থেকে এই মডেলটিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার মূল কারণ। কেননা, লম্বা সময় ধরে কোনো বইয়ের ই-রিডার সংস্করণে ডুবে থাকার জন্য ডিসপ্লের উৎকর্ষ বেশ প্রয়োজনীয় একটি ফ্যাক্টর। এছাড়াও, পূর্বের সংস্করণগুলোতে পিক্সেল বেশ দৃশ্যমান হওয়ায় ছোট ফন্টের কোনো লেখা পড়াটা বেশ অস্বাচ্ছন্দ্যকর ছিল। কিন্তু ৩০০ ppi এর ডিসপ্লের কারণে সেই সমস্যাও দূর হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাজন কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট অনেকটা বইয়ের প্রিন্টেড সংস্করণের অনুভূতি দিয়ে থাকে।
অন্যদিকে কিন্ডলের এই মডেলটির সাথেই আমাজনের নিজস্ব টাইপফেইস বুকার্লির (Bookerly) আবির্ভাব হয়। এই ফন্টটি অনেকটা পালাটিনো(Palatino) এবং কাইসেলিয়ার (Caecilia) মতো টাইপফেইস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হলেও ব্যবহারকারীকে ডিজিটাল স্ক্রিনে অল্প আই-স্ট্রেনে দ্রুত বই পড়ার ব্যাপারে সাহায্য করে। যদিও বর্তমানে প্রায় সবগুলো আমাজন ই-রিডারে এর আপডেট রয়েছে, তাই কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট-৩ কেনার ব্যাপারে এটি তেমন কোনো কারণ হতে পারে না।
তিন গিগাবাইট ব্যবহারযোগ্য স্টোরেজ, প্রত্যেকদিন ৩০ মিনিট করে টানা ৬ সপ্তাহ, অর্থাৎ ২১ ঘণ্টা বই পড়ার ব্যাটারি লাইফ সহ ফাংশনালিটির দিক দিয়েও আকর্ষণীয় কিছু পরিবর্তন এসেছে এই মডেলটিতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি হচ্ছে পিডিএফ ফরম্যাটের বইগুলোর টেক্সট সিলেকশন এবং সিলেক্টেড টেক্সটগুলোকে অনুবাদ করার সুবিধা, যা পূর্বে শুধু azw/azw3 ফরম্যাটের বইগুলোর ক্ষেত্রেই সম্ভব ছিল।

বর্তমান বাজারে আমাজন কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইটের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আমাজনের আরো দুটো ই-রিডার, আমাজন ভয়েজ এবং আমাজন ওয়াসিসও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। পেপারহ্যোয়াইট এবং হালকা ওজনের ভয়েজ ৬ ইঞ্চি ডিসপ্লে অফার করে থাকলেও, পাতলা গড়নের ওয়াসিস আকারে ৭ ইঞ্চি এবং তিনটিই ৩০০ ppi রেজুলেশনের। বর্গাকার ডিজাইনের কিন্ডল ওয়াসিস মডেলটি পানিরোধক, অডিও-বই পড়ার সুবিধার্থে হেডফোন এবং স্পিকার সংযুক্ত করার জন্য বিল্ট-ইন ব্লুটুথ সমৃদ্ধ, লম্বা ব্যাটারি লাইফের সাথে সাথে বাজারে আট গিগাবাইট এবং বত্রিশ গিগাবাইট দুটো মডেলের পাওয়া যায় এবং একহাতে ব্যবহারের জন্য এতে পেজ টার্নিং বাটন রয়েছে। তবে বাজারে আমাজন কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইটের জনপ্রিয়তা এর স্বল্প মূল্যের জন্য। আমাজনের অফিসিয়াল স্টোর থেকে ২৩৮ ডলার দামের ওয়াসিসের অর্ধেক দামে কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইট কেনা যায়। ম্যাশাবলের প্রধান সংবাদদাতা ল্যান্স উনলফ আমাজন কিন্ডল পেপারহ্যোয়াইটের রিভিউয়ের বটম-লাইন হিসেবে লিখেছিলেন,
“If you want an e-reader — and who doesn’t — it’s hard to do better than this device.”
ফিচার ছবি: Amazon