প্রযুক্তি বেশ মজার ব্যাপার। ধাতব কলকব্জা দিয়ে তৈরি যন্ত্রগুলো ঠিক সেভাবেই কাজ করবে যেভাবে আপনি তাকে নির্দেশ দেবেন। কিন্তু সবসময়েই কি হিসেব একদম ঠিকঠাক মিলে যায়? কখনো কখনো কি বিগড়ে যায় না যান্ত্রিক এই জিনিসগুলো?
মানুষের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেই হয়তো ইতিমধ্যে মাঝেমাঝেই বিগড়ে গিয়েছে ধাতব যন্ত্রপাতি। কখনো ইচ্ছেমতন কাজ করেছে, কখনো কথা বলেছে, কখনো আবার ডেকে এনেছে মানুষের মৃত্যুও। যন্ত্রের কি আলাদা করে চিন্তা-ভাবনা করার মতো ক্ষমতা আছে? সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র আর বইয়ে প্রায় এমন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বাস্তবেও যে যন্ত্রপাতির স্বাধীনভাবে চলাফেরার ও কাজ করার অনেক উদাহরণ আছে, সেগুলোর কথাই আজ বলা হবে আপনাকে।
রোবটের হাতে মৃত্যু
রোবটের হাতে প্রাণহানীর ঘটনা নতুন কিছু না। ধাতব এই যন্ত্রমানব অনেকবার বিগড়ে গিয়েছে আর নানারকম ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে। তবে এর শুরুটা হয় ১৯৭৯ সালে। ফোর্ড প্ল্যান্টে কাজ করছিলেন রবার্ট উইলিয়াম। পাশে সাহায্যের জন্য ছিল রোবট। হঠাৎ কাজের জন্যেই একটু জোরে নড়াচড়া করে যন্ত্রমানব। আর তার এই কাজে আঘাত পায় উইলিয়াম। উইলিয়াম যে মরে গিয়েছে সেটা কিন্তু একেবারেই টের পায় নি রোবট। তাই এই ঘটনার পর আবার নিজের স্বাভাবিক কাজে ফিরে আসে সে। মৃত্যুর আধ ঘন্টা পর উইলিয়ামের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর রোবটরা যাতে কাজ করার সময় আশেপাশের কাউকে আঘাত না করে বসে সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে তাতেও খুব একটা লাভ হয়নি। পরবর্তীতেও এমন ঘটনা আরো অনেক ঘটেছে।
২০১৫ সালের ঘটনা। ওয়ান্ডা হলব্রুক কাজ করছিলেন নষ্ট রোবট সারিয়ে তোলার কারখানায়। সেখানে হুট করে একটি রোবট নড়ে ওঠে আর যন্ত্র ফেলে দেয় ওয়ান্ডার মাথায়। মারা যান ওয়ান্ডা।
ফেসবুক যখন কথা বলে
ঘটনাটি এ বছরের। ২০১৭ সালে ফেসবুকে যোগাযোগ ও কাজ করার ক্ষেত্রে সুবিধা তৈরি করতে চালু করা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বেশ ভালোই কাজ করছিলো এটি। তবে খুব বেশিদিনের জন্য নয়। হঠাৎ একদিন সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ফেসবুক নিজর মতো করে কথা বলে যাচ্ছে, যেন সেখানে দুজন মানুষ উপস্থিত আছে।
না, তাদের পরিচালনা করার মতন কেউ ছিলো না সেখানে। তবে একা একাই নিজেদের মতো করে ইংরেজিতেই সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে কথা বলে যাচ্ছিলো তারা। নির্মাতারা প্রথমে কোনো ব্যবস্থা নেননি। তবে অনেকে ধারণা করেন, এটা হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো অন্ধকার দিক। ভবিষ্যতে কোনো খারাপ কিছু হতে পারে এমন আশঙ্কা করছিলেন তারা। তাই দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয় পুরো বিষয়টি।
সরকারবিরোধী মন্তব্য
নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো কথাই শুনতে রাজী না চীনের সমাজতান্ত্রিক শাসকেরা। আর তাই ২০১৭ সালে টেনসেন্ট কিউকিউ নামে একটি মেসেঞ্জার অ্যাপ যখন নিজেদের মতন করে সমাজতান্ত্রিক শাসন নিয়ে কথা বলতে শুরু করল, পুরো ব্যাপারটাই বাজে দিকে মোড় নিল। টেনসেন্ট কিউকিউয়ে বেবি কিউ ও লিটল বিং নামে দুটো অসম্ভব সুন্দর চ্যাটবট রাখা হয়। একটি মানবশিশুর, অন্যটি শিশু ডলফিনের।
অ্যাপসে এমন ব্যবস্থা রাখা হয় যাতে করে চ্যাটবটেরা অ্যাপসের মাধ্যমে কথা বলা মানুষের কথা পড়ে শিখতে পারে। আর নিজেদের এই শিক্ষা দিয়েই চ্যাটবটেরা সমাজতান্ত্রিক শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দেয়। কেউ একজন পোস্ট করেছিলো “সমাজতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক”। তার এই কথার কমেন্টে চ্যাটবটেরা লেখে- “তোমার কি মনে হয় এমন একটি দুর্নীতিগ্রস্থ আর পিছিয়ে পড়া সরকার কিছু করতে পারবে?” অন্য একটি পোস্টে কমেন্ট করে তারা- “গণতন্ত্র প্রণয়ন দরকার”। প্রশ্ন ছিলো- কাকে শাস্তি দেবে সরকার? ফলাফল হিসেবে এই টেনসেন্ট কিউকিউকেই বন্ধ করে দেয়া হয়।
মৃত্যু যখন গাড়িতে
গাড়ি একা একা চলবে- এমন স্বপ্ন অনেকের। টেসলা অবশ্য নিজেদের গাড়িতে এমন একটি ব্যবস্থা রেখেছিল, যার মাধ্যমে আপনি গাড়ি চালানোর দায়িত্বটা গাড়ির কাঁধেই দিয়ে দিতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে গাড়ির হুইলে হাত রাখার কথা বলা ছিল, যাতে করে কোনো বিপদ এলে মানুষ গাড়ির কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জোশুয়া ব্রাউন সেটা পারেননি। ফলে ২০১৬ সালে এক ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
শেষ সময়ে গাড়ি নির্ধারণ করতে পারেনি সে কী করবে। ফলে মরতে হয়েছে ব্রাউনকে। প্রশ্ন হলো, যদি গাড়ি ঠিকভাবে ব্রাউনকে বাঁচিয়েও নিত তাহলেও বা কতটুকু নিরাপদ হত সেটা? হতেই তো পারে যে, গাড়ির ভেতরের মানুষটাকে বাঁচাতে ফুটপাতের কোনো মানুষের উপরে উঠে গেল গাড়ি! মানবিক এই ব্যাপারগুলো, ঝুঁকি কোথায় বেশি আর কোথায় কম সেটা বোঝার ক্ষমতা কম থাকে যন্ত্রের ভেতরে। আর তাই গাড়িকেই সব দায়িত্ব সঁপে দেওয়াকে এখনই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে করছেন না কেউ।
ঝামেলা যখন উইকিপিডিয়ায়
উইকিপিডিয়ায় বেশ ভালো ব্যাপার হলো আপনি এখানে ইচ্ছে করলেই তথ্য যোগ বা পরিবর্তন করতে পারবেন। আর এই ব্যাপারটিই তৈরি করে কিছু ঝামেলার। কিছু সফটওয়্যার আছে যেগুলো উইকিপিডিয়ায় কোনো তথ্য উইকিপিডিয়ার কাজের বিরুদ্ধে বা তথ্যের বিরুদ্ধে হলে সেটাকে বাদ দিয়ে দেয়। আবার এর বিরুদ্ধে আছে আরেকটি সফটওয়্যার যেটা কিনা উইকিপিডিয়ার বাদ দিয়ে দেয়া অংশগুলোকে আবার নিয়ে আসে।
২০১৭ সালের এক অনুসন্ধানে পাওয়া যায় যে, এক্সকিউবোট এবং ডার্কনেসবোট– এরা দুজন প্রতিনিয়ত নিজেদের ভেতরে তথ্য মুছে দেওয়া ও তথ্য ফিরিয়ে আনা নিয়ে লড়াই করছে। এখন পর্যন্ত মোট ৩,৬০০টি আর্টিকেল নিয়ে এমন লড়াই করেছে তারা।
ওরা নিজেকে মানুষ ভাবে
গুগল হোমের নাম শুনেছেন? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি গুগল হোম আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু যত কিছুই করুক না কেন, গুগল হোম তো যন্ত্র ছাড়া কিছু না, তাই না? তবে একবার দুটো গুগল হোমকে একসাথে পাশাপাশি বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর কী হলো?
কী আবার! দুটো গুগল হোম এমনভাবে কথা বলা শুরু করলো যেন তারা দুজন আলাদা দুজন মানুষ। আলাপ পরিচয়ের পর এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটি হলো দুজনের মধ্যে। একজনের দাবি সে মানুষ। অন্যজন তাকে বলছে, সে যন্ত্র। থাপ্পড় দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল তারা একে অন্যকে। ভাগ্যিস, গুগল হোমের কোনো হাত নেই!
ড্রোন যখন বুদ্ধি ধরে
“টার্মিনেটর” চলচ্চিত্রের কথা মনে আছে তো? একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র ধ্বংস করতে শুরু করে সবকিছু। ঠিক তেমনটাই হতে যাচ্ছিল ২০১০ সালে একটি ড্রোনের ক্ষেত্রে। হঠাৎ করেই এমকিউ-৮বি ফায়ার স্কাউট আনম্যান্ড এরিয়াল ভেহিকল (ইউএভি) এর সাথে তার অপারেটরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নিজে নিজেই তখন সিদ্ধান্ত নেয় ড্রোন। রওনা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীর দিকে।
সাধারণত, এমন সময়ে ড্রোন যাতে নিজের ঘাঁটিতে ফিরে আসে তেমনটাই নির্দেশনা দেয়া থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতেই হামলা করতে চলে যায় ড্রোন। ভাগ্য ভালো যে, সেখানে পৌঁছানোর আধা ঘন্টা আগে ড্রোনের উপরে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় এর পরিচালক!