
আমাদের চারপাশে যেসকল কম্পিউটার দেখি (মোবাইল সহ) তার সবই ইলেকট্রনিক ডিভাইস। তবে কম্পিউটার যে সবসময়ই ইলেকট্রনিক ছিল এমনটা নয়। কম্পিউটার বলতে মূলত এমন কোনো ডিভাইসকে বোঝানো হয় যা কিছু নির্দেশনা অনুসারে লজিক অপারেশন ও গাণিতিক প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে। হাজার বছর আগে চাইনিজরা গণনার সুবিধার্থে যে অ্যাবাকাস তৈরি করেছিল তাকেও আদি-কম্পিউটার বলা যায়। তবে আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয় ইংরেজ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজকে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে তিনি ডিফারেন্স ইঞ্জিন নামের একটি মেশিন তৈরি করেন। এটি স্বল্প সময়ে বড়সড় ও জটিল হিসাব-নিকাশ করতে পারতো।
ব্যাবেজের যন্ত্রটি ছিল একটি মেকানিক্যাল ডিভাইস। মেকানিক্যাল ডিভাইস বলতে বোঝানো হচ্ছে, এটি তৈরি হয়েছিল লিভার, গিয়ার ইত্যাদি যন্ত্রাংশ দিয়ে। আজকের কম্পিউটারের মতো ট্রানজিস্টর কিংবা আই.সি দিয়ে নয়। ব্যাবেজের মেশিনের পর কম্পিউটারের ক্ষমতা টের পায় মানুষ। ১৯৩০ এর দশকের শেষদিক নাগাদ গ্রেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি সহ বিভিন্ন দেশে মেকানিক্যাল কম্পিউটারের ব্যবহার যথেষ্ট বিস্তৃতি লাভ করে।

তবে সময় তখন ইলেকট্রনিক্সের। অধিকাংশ প্রযুক্তি খাতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাদি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করছে। কম্পিউটারও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশ শতকের শুরু থেকেই, কম্পিউটারগুলোতে মেকানিক্যাল যন্ত্রাংশের পাশাপাশি বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রাদির ব্যবহার শুরু হয়। সম্পূর্ণ মেকানিক্যাল কম্পিউটারের বদলে তৈরি হতে শুরু করে ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল কম্পিউটার। এ ধরনের কম্পিউটারগুলোর মধ্যে হার্ভার্ডে তৈরি করা মার্ক-১ ছিল সময়ের সবচেয়ে সেরা কম্পিউটার। এখন হয়তো শুনতে হাস্যকর শোনাতে পারে, কিন্তু এটি সেসময় সেকেন্ডে সর্বোচ্চ তিনটি যোগ-বিয়োগ করার রেকর্ড স্থাপন করেছিল।
সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক কম্পিউটার তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় ফ্লিপ-ফ্লপ সার্কিট উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে। ফ্লিপ-ফ্লপ হচ্ছে একটি ইলেকট্রনিক সার্কিট, যার আউটপুটের কেবল দুটি অবস্থা রয়েছে (বাইনারি ০ ও ১)। এটি ব্যবহার করে তথ্য জমা রাখা যায়। ১৯১৯ সালে বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ার ডব্লিউ.এইচ একলস ভ্যাকুয়াম ট্রায়োড ও ক্যাপাসিটর ব্যবহার করে ফ্লিপ-ফ্লপ সার্কিট উদ্ভাবন করেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল যে, এ সার্কিট ব্যবহার করে ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল কম্পিউটারের চেয়ে অনেক দ্রুত, শক্তিশালী ও বৈচিত্রময় কম্পিউটার ডিজাইন করা সম্ভব হবে।
কিন্তু এটি যে সহজসাধ্য কোনো কাজ হবে এমনটি ভাবেননি কেউ। সবাই জানতো, প্রচুর পরিমাণ ভ্যাকুয়াম টিউবের দরকার পড়বে একটি শক্তিশালী কম্পিউটার ডিজাইনের জন্য। এটি আর্থিক দিক থেকে যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জও প্রচুর। পরবর্তীতে যখন রেডিও সহ অন্যান্য খাতে ভ্যাকুয়াম টিউবের ব্যবহার বাড়ে তখন এর দামও কমে আসে কিছুটা। এসময় বেশ কয়েকজন অসাধারণ গবেষক কম্পিউটার নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন, এর মধ্যে একজন ছিলেন বুলগেরিয়ান-আমেরিকান গবেষক জন আটানাসফ। আমেরিকায় সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ ইলেকট্রনিক কম্পিউটার ইনিয়াক উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে আটানাসফের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

ইনিয়াক উদ্ভাবনের কাহিনীতে পরে আসছি, এর আগে একটি বিষয় বলে রাখা দরকার। এখন যদিও সর্বপ্রথম ইলেকট্রনিক-ডিজিটাল কম্পিউটার হিসেবে আমরা ইনিয়াকের নাম জানি, তবে এ তথ্যটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। সর্বপ্রথম ইলেকট্রনিক কম্পিউটার তৈরির কৃতিত্ব বৃটিশদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে জার্মানদের গোপন বার্তা থেকে তথ্য উদ্ধারের জন্য সেখানে কম্পিউটার গবেষণার কাজ শুরু হয়। কিংবদন্তী গণিতবিদ অ্যালান টুরিং এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন।
১৯৪১ সালে বাইরের জগতের অজ্ঞাতে, সামরিক বাহিনীর কঠোর তত্ত্বাবধানে বৃটিশ ইঞ্জিনিয়ার টমি ফ্লাওয়ারস ও তার দল পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামেবল ইলেকট্রনিক কম্পিউটার তৈরি করেন। এর জন্যে ১৫০০ এরও বেশি ভ্যাকুয়াম ট্রায়োড ব্যবহার করেছিলেন তারা। কলোসাস নামের এ কম্পিউটারটি যুদ্ধের সময় বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থার কাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। যুদ্ধের পর স্বয়ং চার্চিল এটিকে ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দেন, যাতে স্পাইরা কেউ সোভিয়েতের কাছে এ গোপন প্রযুক্তির তথ্য ফাঁস করতে না পারে। পরে ১৯৭০ সালের দিকে এ কম্পিউটারটির ডিজাইন প্রকাশিত হয়েছিল এবং ২০০৭ সালের দিকে কম্পিউটারের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী একটি দল একে পূনঃনির্মাণও করেছিল।
তবে কলোসাস কম্পিউটারটির কাজ খুব গোপনীয়তার মাঝে হওয়ায় এটি কম্পিউটারের ইতিহাসে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। এ প্রভাব ফেলেছিল ইনিয়াক, এজন্যেই ইনিয়াকের নাম এখনো সবার মুখে মুখে। ১৯৪৪ সালের দিকে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মসলি ইনিয়াক তৈরির প্রকল্প হাতে নেন। তিনি সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিয়ে একটি বিশাল কম্পিউটারের ডিজাইন করেন। এটির লজিক অপারেশন, গাণিতিক হিসাব-নিকাশ ও তথ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য ভ্যাকুয়াম ট্রায়োড ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়। মসলি এ কম্পিউটারটির ধারণা পেয়েছিলেন জন আটানসফের কাছ থেকে, যার কথা আগেই বলা হয়েছে।

১৯৪০ সালের দিকের কথা। মসলি তখন ফিলাডেলফিয়ার একটি ছোটখাট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। এসময় একটি কনফারেন্সে তার পরিচয় হয় লোয়া স্টেট কলেজের প্রফেসর জন আটানসফের সাথে। কম্পিউটার বিষয়ে মসলির আগ্রহ দেখে আটানসফ তাকে জানান, তিনি গত তিন বছর ধরে একটি নতুন ধরনের কম্পিউটার ডিভাইস নিয়ে কাজ করে আসছেন। আটানসফ তাকে তার গবেষণাগারে আসার আমন্ত্রণও জানান।
মসলি তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে লোয়ায় আটানসফের গবেষণাগার দেখতে যান। সেখানে আসলে আটানসফ তাকে তার কম্পিউটারের ডিজাইন দেখান ও এর খুঁটিনাটি বিস্তারিত বর্ণনা করেন। আটানসফ তার বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পাওয়া স্বল্প পরিমাণের তহবিল থেকে একটি ছোটখাটো মেশিনও তৈরি করেছিলেন, সেটিও পর্যবেক্ষণ করেন মসলি। এ মেশিনটিতে মাত্র ২৮০টি ভ্যাকুয়াম ট্রায়োড ব্যবহার করা হয়েছিল।
তিনি আটানসফের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন লক্ষ্য করেন। প্রথমত আটানসফ সকল তথ্য কেবল ০ ও ১ এর সমন্বয়ে (বাইনারি পদ্ধতি) তুলে ধরেছিলেন। দ্বিতীয়ত ট্রায়োডের সুইচিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে বুলিয়ান বীজগণিতের নিয়ম অনুসারে তিনি সকল গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করেছেন। অবশ্য এ বিষয়টি কলোসাসে তার আগে ব্যবহার করা হয়েছিল, কিন্তু সে বিষয়ে জানা কোনোভাবেই আটানসফের পক্ষে সম্ভব ছিল না। মসলি প্রায় চারদিন ধরে আটানসফের গবেষণাগারে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে আসেন। এ সফর তার সামনে কম্পিউটার বিষয়ে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে।

১৯৪২ সালের দিকে যখন আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, আরো অনেকের মতো আটানসফেরও ডাক আসে সামরিক বাহিনী থেকে। লোয়া ছাড়ার আগে আটানসফ তার প্রতিষ্ঠানকে বলে গিয়েছিলেন, তার উদ্ভাবনগুলোর পেটেন্ট করে রাখতে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা সেটি করেনি। এদিকে মসলি যোগ দেন পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মুর স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। সেখানে তার পরিচয় হয় গ্র্যাজুয়েট ছাত্র প্রেসপার একার্টের সাথে। একার্ট সার্কিট ও সিস্টেম ডিজাইনে অসাধারণ দক্ষ ছিলেন। তার মাঝেই মসলি তার আকাঙ্ক্ষিত সহযোগীকে দেখতে পান।
তারা দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নেন একটি পূর্ণাঙ্গ ইলেকট্রনিক কম্পিউটার তৈরি করার, যা কর্মদক্ষতায় আগের সকল কম্পিউটারকে ছাপিয়ে যাবে। পরবর্তী এক বছর ধরে তারা এটির ডিজাইন সম্পন্ন করেন। এবার এর বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল তহবিলের। মসলি এর জন্যে ধর্ণা দেন-যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার ডিপার্টমেন্টে। আসলে সেসময়ের প্রেক্ষাপটে তহবিল চাওয়ার জন্যে এর চেয়ে উপযুক্ত কোনো জায়গা হতে পারতো না।
সামরিক বাহিনীর নতুন প্রযুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে অনেক জটিল হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন হত। বিভিন্ন রকম আবহাওয়ায়, কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে কখন কীভাবে আর্টিলারি ব্যবহার করতে হবে এটি নির্ণয় করা ছিল এসব জটিল হিসাব-নিকাশের লক্ষ্য। এসব নির্ণয়ের জন্য সামরিক বাহিনীতে তখন ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল কম্পিউটার ব্যবহার করা হতো। প্রয়োজনের তুলনায় এদের দক্ষতা যথেষ্ট ছিল না। মসলির প্রস্তাব দেখে তাই সামরিক বাহিনী তার কম্পিউটার তৈরি করতে পাঁচ লক্ষ ডলারের তহবিল দিতে সম্মত হয়।

আর্থিক নিশ্চয়তা পাওয়ার পর ১৯৪৪ সালের দিকে এসে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন তারা। এ মেশিনটির নাম দেওয়া হয় ইলেকট্রনিক নিউম্যারিকাল ইন্টিগ্রেটর এন্ড কম্পিউটার, সংক্ষেপে ইনিয়াক (ENIAC)। পরবর্তী দুই বছর ধরে মসলি, একার্ট ও তাদের দল লেগে থাকেন ইনিয়াক তৈরির কাজে। মসলি এসময় মাঝে মাঝেই নৌবাহিনীর গবেষণাগারে কর্মরত আটানসফের সাথে দেখা করতে যেতেন। মূল ডিজাইনের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত জটিলতার বিষয়ে আলোচনা করতেন। তবে তিনি কখনোই আটানসফকে ইনিয়াক সম্পর্কে কিছু বলেননি। উপরন্তু মসলি এর মধ্যে কম্পিউটার বিষয়ক বেশ কয়েকটি পেটেন্টের আবেদন করেন, যার মধ্যে কয়েকটি ছিল আটানসফের আইডিয়া। মসলি লোয়ায় তার গবেষণাগারে দেখে এসেছিলেন সেগুলো। তিনি কোনো জায়গায় আটানসফকে কোনো কৃতিত্ব দেননি।
১৯৪৬ সাল নাগাদ ইনিয়াক তৈরি সম্পন্ন হয়। এটি সে সময়ের অন্যান্য কম্পিউটারের তুলনায় যথেষ্ট দ্রুত ছিল। মার্ক-১ এর চেয়ে ১০০০ গুণ দ্রুত কাজ করতে পারতো। তবুও সবদিক বিবেচনা করে একে ভালো কম্পিউটার বলা চলে না। এতে প্রায় আঠারো হাজার ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হয়েছিল, একটি ভ্যাকুয়াম টিউবের গড় আয়ু তিন হাজার ঘণ্টা। তাহলে একটু হিসেব করলেই বুঝতে পারবেন, কত স্বল্প সময় এটি চলতে পারতো কোনো টিউব নষ্ট হওয়া ছাড়া।
এছাড়া এর জন্য প্রায় দুইশো কিলোওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হতো, যা ছিল একটি পাওয়ার প্ল্যান্টে তৈরি হওয়া বিদ্যুতের চেয় বেশি। জানা যায়, যখন এটি প্রথম চালু করা হয় তখন গোটা পশ্চিম ফিলাডেলফিয়ার বাতিগুলো টিমটিমে হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া এর বিশাল আকৃতি, মেমোরির দুর্বলতা ও প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত জটিলতা তো ছিলই। তবে এসব দুর্বলতা বা প্রযুক্তি হিসেবে ইনিয়াক কতটা ভালো ছিল, সেটি হিসেব করলে এর মাহাত্ম্য বোঝা যাবে না।

ইনিয়াকের মাহাত্ম্য হচ্ছে এক নতুন যুগ শুরু করার ক্ষেত্রে। ইনিয়াক প্রথম প্রমাণ করেছে, সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব। দেখিয়েছে যে, এটিকে উন্নত করতে পারলে এতেই আছে কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ। এছাড়া ভ্যাকুয়াম প্রযুক্তির দুর্বলতাও ইনিয়াক দেখিয়ে দিয়েছিল চোখে আঙ্গুল দিয়ে। এর ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেই এরপর ইলেকট্রনিক্সের জাদুকররা মেতে উঠেছিলেন কম্পিউটার নিয়ে। আর সম্ভব করেছেন বর্তমান পৃথিবীর কম্পিউটারের জয়জয়কার।