১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬। পেনসেলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই। অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল বিশালাকায় এক যান্ত্রিক মস্তিষ্কের দেখা পেতে যাচ্ছেন তারা। অবশেষে আজ প্রায় ১০০ ফুট লম্বা, ৩ ফুট চওড়া আর ১০ ফুট উচ্চতার সেই দৈত্যাকার যন্ত্রের স্বাক্ষাৎ মিলল তাদের। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত কম্পিউটার- এনিয়াক। পৃথিবীর প্রথম জেনারেল-পারপাস, প্রোগ্রামেবল, ডিজিটাল ইলেকট্রনিক কম্পিউটার বলা হয় যাকে।
এনিয়াক দলের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার আর্থার বাকস এনিয়াকের ক্ষমতা দেখাতে শুরু করলেন সাংবাদিকদের। প্রথমেই তিনি পাঁচ হাজারটি সংখ্যা যোগ করতে দিলেন একে। এক সেকেন্ডের মাথায় তা করে ফেলল কম্পিউটারটি। তারপর তিনি দেখালেন এর সামরিক ক্ষমতা। দেখালেন কীভাবে এটি মুহূর্তের মধ্যে বোমার গতিপথ হিসেব করে ফেলতে পারে। সাংবাদিকদের মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। আগে যে কাজ করতে মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি দিনও পেরিয়ে যেত, সে কাজ মুহূর্তের মধ্যেই করে দিচ্ছে এ যন্ত্রটি। স্রেফ কয়েকটি সুইচ টেপো আর চলে আসবে ফলাফল।
স্বাভাবিকভাবেই ফলাও করে প্রচারিত হলো এনিয়াকের কীর্তিগাঁথা। ‘ইলেকট্রিনিক ব্রেইন’, ‘উইজার্ড’, ‘রোবট ব্রেইন’ ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করা হলো এনিয়াককে। সাথে ইতিহাসের পাতায় উঠে গেলেন এর সঙ্গে যুক্ত থাকা বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা। কিন্তু কেউ প্রায় উল্লেখই করলো না একে প্রোগ্রাম করা ছয়জন নারীর একটি দলের কথা। ইতিহাস থেকে যেন আড়ালেই সরিয়ে দেওয়া হলো তাদের।
এর কয়েক দশক পর পর্যন্তও বাইরের খুব কম লোকই জানতেন যে, এনিয়াকের প্রোগ্রামার কারা ছিলেন। এর সাথে যেসকল নারীর ছবি দেখা যায় অনেকেই ভাবতেন তারা হয়তো স্রেফ মডেল। কম্পিউটারটির শোভা বর্ধনের জন্যে তাদের দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হয়েছে। অথচ এনিয়াকের পেছনে তাদের ভূমিকা অন্যদের তুলনায় কোনো অংশে কম ছিল না। কিন্তু কেন তাদের আড়ালে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল? তা জানার জন্যে এনিয়াকের শুরুর সময়টাতে ফিরে যেতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় শতজন গণিতে দক্ষ নারীকে নিয়োগ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। তাদের কাজ ছিল আর্টিলারির গতিপথ হিসেব করা। অর্থাৎ কোনো মিসাইল ছুড়লে তা কোন গতিপথ অনুসরণ করে যাবে তা নির্ণয় করা। কোনো টার্গেটে আঘাত করার জন্য, কোন আবহাওয়ায়, কোন কোণে (angle) মিসাইল ছুঁড়তে হবে এসব হিসাব থেকে তা বুঝতে পারতেন সৈন্যরা।
এ কাজের জন্যে গণিতে যথেষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন হতো। নন-লিনিয়ার ডিফারেন্সিয়াল সমীকরণ সমাধান করতে হতো, অপারেট করতে হতো ডিফারেন্সিয়াল এনালাইজার মেশিন, স্লাইড রুলও ব্যবহার করতে হতো। কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও একে গৎবাধা হিসাব-নিকাশের কাজ হিসেবেই দেখা হতো। এজন্যই বিশেষ করে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পুরুষ ইঞ্জিনিয়ারদের এসবে নষ্ট করার মতো সময় নেই বলেই ভাবা হতো তখন। কাজের সাথে মিল রেখে এসকল নারীকে তখন ডাকা হতো ‘কম্পিউটার’ নামে।
যুদ্ধ যখন এগিয়ে চললো তখন এসব হিসাব-নিকাশের প্রয়োজনীয়তার হার বাড়তে লাগলো আরো। এদিকে ১৯৪২ সালে, পদার্থবিজ্ঞানী জন মসলি প্রস্তাব দিয়েছিলেন একটি ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটর তৈরি করার, যেটি এ হিসাব নিকাশের প্রক্রিয়াটিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেক দ্রুতগতিতে করতে পারবে। ১৯৪৩ সালের জুন নাগাদ, মসলি ও তার স্টুডেন্ট একার্ট সেই ক্যালকুলেটর তৈরির জন্যে বিশাল অঙ্কের তহবিলও পেয়ে গিয়েছিলেন। মসলি ও একার্টের তৈরি করা সেই যন্ত্রটির নামই এনিয়াক। অবশ্য এর কতটা তারা নিজে করেছেন আর কতটা অন্য একজন গবেষক, জন আটানসফের আইডিয়া থেকে নিয়েছেন তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। (সে বিষয়ে আলোচনা পাবেন এই লেখায়।)
এনিয়াক মোটামুটি প্রস্তুত হওয়ার পর মসলি ও একার্ট বুঝতে পারলেন, তাদের এ কম্পিউটারটিকে কাজ করার জন্য এর প্রোগ্রাম করার দরকার পড়বে। সেসময়ে হার্ডওয়্যারই যেখানে প্রথম এসেছে, সেখানে প্রোগ্রামিং যে উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয় ছিল না সেটা বোঝাই যায়। ছিলো না আজকের মতো কোনো হাই-লেভেল প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বা কম্পাইলারও।
এনিয়াকের প্রোগ্রামিংয়ের জন্যে বেছে নেওয়া হয় পাঞ্চ কার্ডকে। আইবিএম তাদের মেশিনের জন্য আরো আগে থেকেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতো। পাঞ্চ কার্ড বলতে একধরনের শক্ত কাগজ, যাতে ছিদ্র থাকা-না থাকার মাধ্যমে ওয়ান অথবা জিরো বোঝানো হয়। এই ওয়ান-জিরোর সারি ব্যবহার করে পাঞ্চ কার্ড তথ্য জমা রাখে। আগের কম্পিউটার যেহেতু কোনো ডাটা/প্রোগ্রাম জমা রাখতে পারতো না, তাই পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমেই সেসব ইনপুট দিতেন প্রোগ্রামাররা। এ দিয়ে প্রোগ্রামিং করা ছিল বিস্তর ঝামেলার বিষয়। কখনো একটি ছোট প্রোগ্রামের জন্যে জমে যেত শ’খানেক কার্ড। আবার একটু ভুল থাকলে সম্পূর্ণ নতুন করে পাঞ্চ করতে হতো সেই কার্ড।
যখন প্রশ্ন আসলো, এনিয়াককে প্রোগ্রাম করার এ ক্লান্তিকর কাজটি কে করবে? তখন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসলো নারী-কম্পিউটারদের নাম। কারণ এজন্য গাণিতিক দক্ষতা চাই। নিজেরা গাণিতিক সমাধানটি করে, সেটিকে ভেঙে ভেঙে এমন সব ধাপে আনতে হবে যা এনিয়াক করতে পারবে। তারপর তা করার জন্য তৈরি করতে হবে এনিয়াককে। এজন্য কম্পিউটারদের দল থেকে ছয়জনকে বাছাই করা হয়। তারা হলেন ক্যাথলিন ম্যাকনালটি, ফ্রান্সিস বিলাস, মার্লিন ওয়েস্কফ, রুথ লিচটারম্যান, এলিজাবেথ স্নাইডার এবং বেটি জিন জেনিংস।
প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে তাদের প্রথম কাজ হয় এনিয়াক সম্পর্কে জানা। গোটা মেশিনটি কীভাবে কাজ করে তা জেনে যাতে নিজেদের প্রয়োজন মতো সেটিকে দিয়ে কাজ করাতে পারেন তারা। তাদের হাতে এনিয়াকের ব্লু প্রিন্ট ধরিয়ে দেওয়া হলো, যা থেকে এর সার্কিট, লজিক, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারেন তারা। জানার ছিল অনেক কিছুই। প্রায় ১৮,০০০ ভ্যাকুয়াম টিউব, ৭০,০০০ রেজিস্টর, ১৫,০০ রিলে এবং ৬,০০০ সুইচ নিয়ে গঠিত ছিল এ মেশিনটি। বেশ ভালোভাবেই তারা বুঝেছিলেন ইনিয়াককে। কখনো ভুলভাল হলে ঠিক বের করে ফেলতেন এই আঠারো হাজারের মধ্যে কোন ভ্যাকুয়াম টিউবটি নষ্ট হয়ছে। তারপর বদলে দিতেন সেটিকে।
আর প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষেত্রে তাদের মূল কাজ ছিল ডিফারেন্সিয়াল সমীকরণগুলোকে বিশ্লেষণ করা। এরপর এনিয়াককে দিয়ে সেসব সমাধান করানোর জন্যে ঠিকঠাক সার্কিট জুড়ে দেওয়া। এনিয়াকের এ প্রোগ্রামিং করতে গিয়ে তারা উদ্ভাবন করেন সাব-রুটিন, নেস্টেড সাব-রুটিন (গোটা প্রোগ্রামকে পুনরায় না চালিয়ে কোনো একটা অংশকে পুনরায় চালানো) ইত্যাদি প্রক্রিয়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্যে ইনিয়াকের কাজ শুরু হলেও এটি সেসময় ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। তবে এর কিছুদিন পরেই নিউক্লিয়ার ফিউশনের হিসাব-নিকাশ করার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছিল এটি, যার জন্যে প্রয়োজন হয়েছিল প্রায় এক মিলিয়ন পাঞ্চ কার্ডের। এটি সম্পন্ন করার জন্যে লস আলমোসের পদার্থবিদদের নির্ভর করতে হয়েছিল এ নারীদের প্রোগ্রামিং দক্ষতার উপরই। তবুও সেসময়কার ইতিহাসে তারা স্বীকৃতি পেয়েছেন সামান্যই।
কারণ প্রোগ্রামিংয়ের মাহাত্ম্য বুঝতে পারেননি তৎকালীন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ও গবেষকরা। যেহেতু এনিয়াককে প্রোগ্রাম করার সাথে হিসাব-নিকাশের প্রচুর সম্পর্ক ছিল, তাই তারা একে ‘নারীদের’ জন্যই উপযুক্ত বলে মনে করতেন। কোনো প্রয়োজনও বোধ করেননি এজন্যে তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার। কম্পিউটারের ভবিষ্যতের জন্য স্রেফ নিত্যনতুন হার্ডওয়্যার ডিজাইনকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন। কোনো গুরুত্ব পায়নি প্রোগ্রামিং। একদিক থেকে একে শাপে বরও বলা যায়। কারণটা সেই ছয়জনের একজন জেনিংসের কাছ থেকেই শুনুন। তার ভাষ্যে,
ইনিয়াক কর্তৃপক্ষ যদি জানতো, ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের ক্ষেত্রে প্রোগ্রামিং কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে কিংবা কাজটা কতটা জটিল, তাহলে হয়তো তারা এ দায়িত্ব নারীদের হাতে দিতে প্রচণ্ড দ্বিধাবোধ করতো।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে একে সৌভাগ্যই বলা চলে। নচেৎ, হয়তো সেই প্রকট লিঙ্গবৈষম্যের সময়ে এ কাজটি করার সুযোগই পেতেন না তারা। পারতেন না কম্পিউটারের ইতিহাসের এই মাইলফলকে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার নজির স্থাপন করতে। যদিও তাদের কাজের জন্যে তারা সেসময় যথাযোগ্য স্বীকৃতি পাননি, তবে বর্তমানে প্রযুক্তিজগতের অনেক নারীর জন্যেই অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসেবে কাজ করে তাদের সেই গল্প।