আমরা যা কিছু করি, প্রতিনিয়ত যা কিছু ভাবি, সবই নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের মাধ্যমে। কিন্তু এটা ঠিক কীভাবে কাজ করে তা আজও অনেক বড় এক রহস্যই থেকে গেছে। আর আমরা যতই এই রহস্যের গভীরে যাই আর নতুন কিছু আবিষ্কার করি, ঠিক ততই চমকাই।
– নিল ডিগ্রেস টাইসন
প্রতিটি মুহূর্তে জটিল কত রহস্যের সমাধান করে চলেছি আমরা এই মস্তিষ্ক ব্যবহার করে। মস্তিষ্ক ব্যবহার করেই তৈরি হয়েছে বিস্ময়কর সব আবিষ্কার আর দৈনন্দিন জীবনের কত সূত্র। কিন্তু আজও আমাদের কাছে এই মস্তিষ্ক নিজেই যেন এক রহস্য। এই মস্তিষ্ককেই ব্যবহার করে এর কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে জানা এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগেও অনেকটাই দুষ্কর।
কিন্তু তারপরেও রহস্যপিপাসু বিজ্ঞানীগণ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেননি। মস্তিষ্কের রহস্যভেদ করতে বের করেছেন অনেক পদ্ধতি আর প্রযুক্তি। আর এর থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান তৈরি করছে ভবিষ্যতের উন্নত এক পৃথিবীর সম্ভাবনা যেখানে মাইন্ড রিডিংয়ের মতো কাল্পনিক প্রযুক্তিও বাস্তবয়ন সম্ভব। মস্তিষ্কের অজানা সব রোগ নিরাময়ও হয়ে উঠছে সহজতর। কিন্তু মোটা-শক্ত একটি খুলির নিচে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য প্রোটেক্টিভ টিস্যুর স্তর আর ৮০ বিলিয়ন নিউরনের এই মস্তিষ্কের রহস্য কীভাবে সমাধান করা হয়? শুধু তা-ই নয়, জীবন্ত একজন মানুষকে কোনো কষ্ট না দিয়ে কীভাবেই বা চালানো হয় গবেষণা?
আজকের লেখায় থাকছে এমনই তিন প্রযুক্তির কথা, যা মানব মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচনে যুগের পর যুগ ভূমিকা রেখে চলেছে। কীভাবে মস্তিষ্ক কাজ করে, কোনো উদ্দীপনায় কোন অংশ সাড়া দেয়, কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় এসবই খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীগণ। প্রতিটি প্রযুক্তিরই আছে কিছু বিশেষ সুবিধা, আবার আছে কিছু সীমাবদ্ধতাও, আবার প্রত্যেকটির কাজও আলাদা।
এবার তবে জেনে নেয়া যাক সেই জাদুর কাঠিগুলোর কথা।
ইইজি (EEG)
পূর্ণরূপ করলে দাঁড়ায় ইলেক্ট্রো-এনসেফ্যালো-গ্রাফি (electroencephalography)। এটি আসলে একটি বৈদ্যুতিক-শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করা হয়। নাম শুনে বেশ বিদঘুটে মনে হলেও কাজের ধরণ কিন্তু বেশ সাধারণ। কিন্তু তা জানার আগে মস্তিষ্কের নিউরনের দিকে একটু নজর দেয়া যাক।
মানব মস্তিষ্কের প্রায় ৮০ বিলিয়ন নিউরনের প্রতিটিতে আছে প্রায় ১০ হাজার সিন্যাপটিক যোগাযোগ। তারা প্রতিনিয়ত আমাদের যাবতীয় কাজের জন্য একটি আরেকটির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে প্রতি সেকেন্ডে। আর এই যোগাযোগের কাজটি হয়ে থাকে ইলেকট্রন আদান প্রদানের মাধ্যমে। এটি আমাদের অনেকেরই জানা।
এই নিউরনগুলো বৈদ্যুতিক আধানযুক্ত। যোগাযোগের সময় ইলেকট্রন বিনিময়ের কারণে আধানগুলো একধরনের তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এই তরঙ্গ তৈরির প্রক্রিয়ার নাম ভলিউম কন্ডাকশন। আর এই তরঙ্গকে কাজে লাগিয়েই ইইজি করা হয়।
এবারে পুরোটা পরিষ্কার করা যাক। যার উপর পরীক্ষাটি চালানো হবে তার মাথায় পরানো হয় একটি ক্যাপ যাতে থাকে অনেকগুলো ছোট ছোট ইলেক্ট্রোড এবং তরল ইলেক্ট্রোলাইট জেল। ইলেক্ট্রোড হলো ছোট ধাতব দন্ড যেগুলো অধাতব পদার্থ থেকে ধাতব পদার্থে বৈদ্যুতিক যোগাযোগে সাহায্য করে। যখন মস্তিষ্কে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তখন মাথায় বসানো এই ইলেক্ট্রোডগুলোতে বিভব পার্থক্য সৃষ্টি হয়, যা মাপতে থাকে এর সাথে যুক্ত কম্পিউটার। এভাবে প্রাপ্ত তথ্যগুলো সংরক্ষণ করে ইইজি করা হয়।
কিন্তু এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এটা করে কী কী করা সম্ভব?
সহজ ভাষায়, ইইজি থেকে আমরা জানতে পারি কোনো কাজের প্রতি আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে সাড়া দিচ্ছে আর কখন সাড়া দিচ্ছে। নিউরনের দ্বারা সৃষ্ট তরঙ্গগুলো একেক ধরনের প্যাটার্ন তৈরি করে আর বিজ্ঞানীগণ সেসব প্যাটার্ন নিয়ে গবেষণা করেন। এছাড়াও কিছু শেখার সময় বা মনোযোগ দিয়ে কাজ করার সময় মস্তিষ্কের কোন অংশ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে সেটিও জানা সম্ভব হয়। বর্তমানে গবেষণায়, মৃগীরোগীর মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ, ঘুমের রোগসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির জয়জয়কার।
ইইজি অনেক দ্রুততর, সাশ্রয়ী এবং নন-ইনভেসিভ অর্থাৎ সুরক্ষিত, কারণ এতে কোনো আঘাত বা কাটাকাটি করা হয় না। সবথেকে মজার ব্যাপার হলো, এই প্রযুক্তি কিন্তু প্রায় ১০০ বছরের পুরনো। ১৯২৪ সালে হান্স বার্জার সর্বপ্রথম মানব মস্তিষ্কের ইইজি করেন।
পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে জটিল অসংখ্য ওয়েভ প্যাটার্ন। ইইজি সেসব প্যাটার্নের খোঁজ দেয় কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো প্যাটার্ন মস্তিষ্কের ঠিক কোন জায়গা থেকে তৈরি হচ্ছে তা নিখুঁতভাবে জানাতে পারে না। আর এর সমাধান যে প্রযুক্তি দেয় তা হলো এফএমআরআই।
এফএমআরআই (fMRI)
মস্তিষ্ক গবেষণাকে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে এফএমআরআই বা ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (functional magnetic resonance imaging)। এমআরআই প্রযুক্তির কথা আমরা অনেকেই জানি, যেখানে চৌম্বকক্ষেত্র আর বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে পুরো শরীরের বিস্তারিত একটা ছবি পাওয়া যায়। এফএমআরআই পদ্ধতিতেও ঠিক একই প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হয় কিন্তু পুরো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ছবি নেয়ার পরিবর্তে শুধুমাত্র মস্তিষ্কের অক্সিজেন আর রক্ত সঞ্চালনের উপর লক্ষ্য রাখা হয়।
এখন মনে প্রশ্ন জাগে, এই কাজ কেন করা হয়? উত্তর হলো, আমরা যখন কোনো চিন্তা করি বা বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো কাজ করি তখন মস্তিষ্কের যে সকল অঞ্চল এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকে, সেসব অঞ্চলে অনেক বেশি পরিমাণ অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। আর তাই অধিক দ্রুত পরিমাণে রক্ত সঞ্চালন ঘটে সেসব অঞ্চলে। আর এই রক্ত সঞ্চালনের তারতম্য থেকে খুব সহজেই বোঝা যায় মস্তিষ্কের ঠিক কোন অংশটি ঐ কাজে সাড়া দিচ্ছে।
এমআরআই এর শুরুটা হয় বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ আইজাক রাবির হাত ধরে। পরমাণুর ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ধর্ম আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৪ সালে তাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেয়া হয়। এর প্রায় অর্ধশতাব্দী পর নব্বইয়ের দশকে নিউ জার্সির বেল ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় সেইজি ওগাওয়া লক্ষ্য করেন, কম অক্সিজেন যুক্ত রক্তের হিমোগ্লোবিন চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা যেভাবে প্রভাবিত হয় বেশি অক্সিজেন যুক্ত হিমোগ্লোবিন তার থেকে অন্যভাবে প্রভাবিত হয়। আর এই ধর্মকে কাজে লাগিয়েই তৈরি করা হয় এফএমআরআই। তবে এরও আগে ত্রিশের দশকে লিনাস পলিং নামের এক রসায়নবিদ এই ধর্ম আবিষ্কার করেন বলে শোনা যায়।
তবে ইইজি যেমন কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যেই যেকোনো পরিবর্তন জানাতে পারে, সে তুলনায় এফএমআরআই প্রায় হাজার গুণ ধীরগতির। কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ বা ব্যবহারিক কাজের সময় এফএমআরআই করা হলে তা মস্তিষ্কের কোন অঞ্চলকে উদ্দীপিত করছে তা জানা যায়। এই প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা কারো মুখের ছবি চেনা থেকে শুরু করে আমাদের অনুভূতিতেও কোন অঞ্চল জড়িত তা নিয়েও করা যায় বিস্তর গবেষণা। আর কোনো অঞ্চলের পরিবর্তনে কয়েক মিলিমিটার পর্যন্ত নিখুঁত ফলাফল দিতে সক্ষম এই প্রযুক্তি।
ইইজি আর এফএমআরআই এর যৌথ ব্যবহার তাই খুলে দিয়েছে গবেষণা ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনার দ্বার। কখন এবং কোথায় এই দুইয়ের উত্তরই পাওয়া যাবে এর মাধ্যমে। ধারণ করা হচ্ছে, এই দুই প্রযুক্তির সমন্বয়ে আগামী কয়েক দশকের মাঝেই আসছে মাইন্ড রিডিং প্রযুক্তি।
পিইটি (PET)
তৃতীয় এই প্রযুক্তিটি আরো বেশি নিখুঁত। পিইটি বা পজিট্রন ইমিশন টমোগ্রাফি (positron emission tomography), যা মূলত কাজ করে রাসায়নিক বিষয়গুলো দেখার জন্য। তবে এই প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা হয় মৌলের তেজস্ক্রিয়তা ধর্ম। ভয় পাবার কিছু নেই, কারণ ইইজি এবং এফএমআরআই এর মতোই পিইটি-ও নিরাপদ।
মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ বা টিস্যুগুলো কীভাবে কাজ করে এবং মস্তিষ্কে কী ধরনের রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ চলছে তা জানতে নির্ভর করতে হয় এই প্রযুক্তির ওপর। শুধু তা-ই নয়, পিইটির মাধ্যমে পুরো মস্তিষ্কের একটি ত্রিমাত্রিক ছবি পাওয়া যায় যাতে বিভিন্ন অংশ আলাদাভাবে বিশ্লেষণ এবং গবেষণার কাজে আসে।
শরীরে একধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইনজেকশনের মাধ্যমে পুশ করে দেয়া হয় ভেইনের মাধ্যমে। এরপর অপেক্ষা করা হয় রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছানোর। এই তেজস্ক্রিয় পদার্থকে বলা হয় ট্রেসার (Tracer)। অতি স্বল্পমাত্রায় এই ট্রেসার প্রয়োগ করা হয়, তাই ক্ষতি হবার কোনো সম্ভাবনাও থাকে না। এরপর বিজ্ঞানীগণ মস্তিষ্কে ট্রেসারের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন এবং বিভিন্ন অংশের তথ্য সংগ্রহ চালিয়ে যান এর থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় রশ্মির সাহায্যে।
পিইটির সাহায্যে মস্তিষ্কের ভেতরের অঙ্গগুলোর রাসায়নিক ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই এর উপর ঔষধের প্রভাব সম্পর্কে জানা সম্ভব। এমনকি আলঝেইমার্সের মতো মানসিক রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা হয় পিইটি স্ক্যান। কিন্তু এর বড় অসুবিধা হলো এর থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে সময় লাগে কয়েক মিনিট, যেখানে এর তুলনায় ইইজি এবং এফএমআরআই বেশ চটপটে।
যুগ যুগ ধরে এই প্রযুক্তিগুলো আমাদের রহস্য অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানীদের মনের সব অজানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছে। প্রতিনিয়ত আবিষ্কার হচ্ছে নতুন নতুন চমকপ্রদ তথ্য। কিন্তু এখনও রয়ে গেছে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা।
বিজ্ঞানীগণ যদি কয়েকজন মানুষের ওপর একটি গবেষণা চালান যেখানে তাদের কিছু জিনিস দেখিয়ে তা মনে রাখতে বলা হয় এবং এমআরআই করার সময় সেগুলো মনে করতে বলা হয় তবে মস্তিষ্কের কোন অংশগুলো উদ্দীপিত হচ্ছে, অন্যান্য অংশের সাথে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে এবং স্মৃতিশক্তির সাথে কোন অংশ তা বোঝা যায়।
কিন্তু এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। আগামী কয়েক যুগের মধ্যেই আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসতে পারে এমন ডিভাইস যা দিয়ে মনের কথা পড়ে ফেলা সম্ভব মুহূর্তেই। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের প্রয়োজন হবে মস্তিষ্ককে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার এবং এর সম্পূর্ণ রহস্য উদঘাটন করার।
এজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদদের অক্লান্ত শ্রম। আগামীর ভবিষ্যত আমাদের জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে তাই এখন দেখার বিষয়। আপনি কতটুকু জানেন মস্তিষ্কের রহস্য নিয়ে?
তথ্যসূত্র: TED Ed.