বয়স তখন সবে ৩০ ছুঁয়েছে। এই বয়সে লোকে ভালো একটা চাকরিতে থিতু হতে চায়, সম্পর্কের জটিলতাগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চায়, জীবনটাকে আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে পরবর্তী দিনগুলোর জন্য পায়ের নিচে ভিত্তি ও মাথার ওপর ছাদ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। অথচ জেফ বেজোস কিনা ওয়াল স্ট্রিট ফার্মের চাকরিতে ইস্তফা দিলেন। এত ভালো বেতনের চাকরিটা ছেড়ে বই বিক্রি করার আশায় পাড়ি জমালেন সিয়াটলে।
ওয়াশিংটন স্টেট থেকে ১৯৯৫ সালে অনলাইন বুকশপ হিসেবে Cadabra, Inc. যাত্রা শুরু করল। কয়েক মাস পর অবশ্য জেফ নামটা পাল্টে ফেলেন। সেই থেকে বিশ্ববাসীর কাছে Amazon, Inc. নামেই কোম্পানিটি পরিচিত হয়। দীর্ঘ ২৭ বছরের পথচলায় সেই অনলাইন বুকশপ আজ বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের একটি। রিটেইল ও লজিস্টিকসের দুনিয়ায় ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের এক মহাদানবের নাম অ্যামাজন। পৃথিবী জুড়ে কোম্পানিটির অধীনে কর্মরত আছে ১.৩ মিলিয়ন দক্ষ কর্মী।
২০২০ সালে সারা বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ এর আক্রমণে অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত, অ্যামাজন তখন দেখেছে নিজেদের ইতিহাসের সফলতম একটি বছর। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই চার মাসে অ্যামাজনের নেট সেলস ছিল ১২৫.৬ বিলিয়ন ডলার যা কিনা ২০১৯ এর একই সময়সীমার তুলনায় ৪৪% বেশি। একই সাথে এ সংখ্যাটি ওয়াল স্ট্রিট অ্যানালাইসিসে অ্যামাজনের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রাকে ১১৯.৭ বিলিয়ন ডলারে ছাড়িয়ে গেছে। এমন একটি সাফল্যমণ্ডিত প্রতিবেদনের সাথেই এলো একটি আকস্মিক ঘোষণা। দীর্ঘ ২৭ বছর কোম্পানিটি পরিচালনার পর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে সরে দাঁড়াচ্ছেন জেফ বেজোস।
শীঘ্রই স্থলাভিষিক্ত হিসেবে তার পদটি গ্রহণ করবেন অ্যান্ডি জেসি। ১৯৯৭ সাল থেকে অ্যামাজনের সাথে জেসি কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি Amazon Web Services (AWS) এর সিইও হিসেবে নিযুক্ত আছেন। অর্থনৈতিক সব তথ্য অনুযায়ী, এই ক্লাউড বিজনেসই অ্যামাজনের সবচেয়ে লাভজনক খাত।
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ২৫শে মার্চ ২০২১ এ জেফ বেজোসের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৮১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি সবসময়ই দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। ২৭ বছর আগে ওয়াল স্ট্রিটের সেই চাকরি ছেড়ে বুকশপ খোলার ব্যাপারটাকে জেফ ‘ব্যক্তিগত আক্ষেপ কমানোর চেষ্টা’ হিসেবেই আখ্যায়িত করেন। কারণ ৩০ বছর বয়সী সেই জেফ ঠিক বুঝতে পেরেছিল, সামনের দিনগুলোতে ইন্টারনেটই হতে চলেছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তাই, সময়মতো ইন্টারনেটে নিজের ব্যবসা তৈরি করে নিতে অত ভালো চাকরি ছেড়ে দেয়ার ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেননি তিনি। তাহলে অ্যামাজনের এই অভাবনীয় সাফল্যের পর সিইও পদ ছেড়ে এক্সিকিউটিভ চেয়ার পদ গ্রহণ করার পেছনে রহস্য কী? সাফল্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে গেছেন জেফ বেজোস? নাকি কাঁধ থেকে বর্তমান দায়িত্বভার কমিয়ে তৈরি হচ্ছেন নতুন এক লড়াইয়ের জন্য? সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পদত্যাগের কারণ হিসেবে বেজোস বলেন,
“অ্যামাজনের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও হওয়া সহজ নয়। আর এত বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করাটা আরও কঠিন। এক্সিকিউটিভ চেয়ার হিসেবে আমি সবসময়ই অ্যামাজনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে অংশ নেবো। এখন ‘ব্লু অরিজিন’ (অ্যারোস্পেস কোম্পানি), ‘ডে ওয়ান ফান্ড’, ‘বেজোস আর্থ ফান্ড’, ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ ও অন্যান্য স্বপ্নগুলোতে মনোযোগী হতে চাই আমি। তাই বলে ভাববেন না যে অবসর নিচ্ছি। বরং সবটুকু সময় ও শ্রম দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষাতেই রয়েছি আমি।”
ইন্টারনেট সেবা
২০২০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪.৯৫ বিলিয়ন। অর্থাৎ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ শতাংশ মানুষ এখন ইন্টারনেট সেবার আওতাধীন রয়েছে।
শুধুমাত্র ২০২০ সালেই এ পরিবারে যুক্ত হয়েছে ৩১৯ মিলিয়ন নতুন সদস্য যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার সমান। ফলশ্রুতিতে এ বছর মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুব সহজেই ৫ বিলিয়ন স্পর্শ করবে। নিঃসন্দেহে এটি মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম একটি মাইলফলক। কিন্তু, সাফল্য সবসময়ই আমাদের জন্য সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত করে। আর তাই বাকি ২.৮ বিলিয়ন মানুষকে ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আধুনিক জীবনধারায় মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়েছে ইন্টারনেট। আর কাগজ কলমের হিসেব বলছে, ২০৩৩ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষই ইন্টারনেট সেবার আওতাধীন হবে। যার অর্থ বিশ্বের প্রতিটি কোনায় পৌঁছে যাবে ইন্টারনেট। দুর্গম এলাকা কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়াই মুশকিল, সেই এলাকাগুলোর মানুষজনের জন্যও নিশ্চিত করতে হবে ইন্টারনেট সেবা।
সেই লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই নানা রকম প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের নামীদামী টেক-জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এসব উদ্যোগকে মানবসেবার অংশ ভেবে ভুল করবেন না। পৃথিবীতে যত বেশি মানুষ ইন্টারনেট সেবা নিতে আগ্রহী হবে সিলিকন ভ্যালি হবে তত বেশি লাভবান। আর সে কারণেই দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থানরত মানুষগুলোকেও চলমান দশকের মধ্যে এই সেবায় অন্তর্ভুক্ত করতে তারা বদ্ধ পরিকর।
গুগল লুন ও টারা
সর্বপ্রথম এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল টেক-জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান গুগল। ‘প্রজেক্ট লুন’ নামের এই প্রকল্পের মূলনীতি ছিল বড় বড় গ্যাস বেলুনের সাহায্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়াইফাই হটস্পট সেবা নিশ্চিত করা।
কিন্তু এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এত বেশি ঝামেলায় পড়তে হবে তা হয়তো প্রতিষ্ঠানটি কল্পনাও করেনি। ২০১৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে শ্রীলংকায় তেমনই একটি বেলুন ওড়ানোর কিছুদিনের মধ্যেই সেটি চা বাগানে ক্র্যাশ ল্যান্ড করে। একের পর সমস্যার মুখে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে গুগল আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পের সমাপ্তি ঘোষণা করে। কেনিয়ায় চলমান প্রকল্পটির সব কার্যক্রম মার্চ মাসের মধ্যে গুটিয়ে আনা হবে।
প্রজেক্ট লুনের ব্যর্থতাতেই গল্পের শেষ হয়নি। বরং নতুন উদ্যমে ‘প্রজেক্ট টারা’ নামের এক নতুন প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছে গুগল। মাটি থেকে ১২.৪ মাইল উপরে ভাসমান একটি টারা ইউনিট থেকে কোনো তারের সাহায্য ছাড়াই নিচের দিকে ইন্টারনেট সিগনাল প্রেরণ করা হবে। প্রাথমিকভাবে উচ্চ গতিসম্পন্ন এ ব্যান্ডউইথের মাত্রা সেকেন্ডে প্রায় ২০ গিগাবিট হবে বলেই আশা করছেন প্রকল্পটির কর্মকর্তারা। তাদের মতে, একটি টারা ইউনিটে যুক্ত থেকে একইসাথে কয়েক হাজার মানুষ হাই ডেফিনেশনে ইউটিউব ভিডিও দেখতে পারবে।
প্রকল্পটি বর্তমানে কেনিয়াতে পরীক্ষাধীন রয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে নিঃসন্দেহে গুগলকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে। কিন্তু প্রক্রিয়াগত বাধা ছাড়াও তাদের কপালে চিন্তার ভাজ মোটা করতে এ খেলায় যুক্ত হয়েছে এক নতুন প্রতিযোগী।
ইন্টারনেট স্পেস রেস
২.৮ বিলিয়ন মানুষের এই বিশাল বাজার হাত করে পরবর্তী কয়েক দশক সাফল্যের শীর্ষে অবস্থান করার লক্ষ্যে শুরু হয়েছে এক নতুন প্রতিযোগিতা। যার নাম ইন্টারনেট স্পেস রেস।
এখন অবধি স্যাটেলাইট ভিত্তিক ব্রডব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিধি তুলনামূলকভাবে বেশ ছোট। ২০১৮ সালে এই ইন্ডাস্ট্রির রেভিনিউ ছিল মাত্র ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে, আসন্ন বছরগুলোতে নানা ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২৪ সালে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াবে ২২ বিলিয়নে। সেই সাথে ২০২৯ সালের মধ্যে ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারিত হয়েছে।
ভাসমান স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার চেষ্টা নতুন নয়। ৯০র দশকে বেশ কিছু কোম্পানি এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু, পরীক্ষামূলকভাবে এসব ব্যয়বহুল প্রকল্প চালাতে গেলেও অনেক বেশি অর্থনৈতিক সহায়তার প্রয়োজন। তাই, একের পর এক ব্যর্থতায় অধিকাংশ কোম্পানিই দেউলিয়া হয়ে পড়ে। বিনিয়োগকারীরাও তখন এসব উদ্যোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
এখনকার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। অনিন্দ্য উৎকর্ষে প্রযুক্তির আকার কমেছে, বেড়েছে শক্তিমত্তা। সেই সাথে বেড়েছে রকেট-লঞ্চিং কোম্পানির সংখ্যা। ইলন মাস্কের ‘স্পেসএক্স’ কিংবা জেফ বেজোসের ‘ব্লু অরিজিন’ এর মতো কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণে স্যাটেলাইটের নির্মাণ ব্যয় ও প্রক্রিয়া দুটোই অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে।
স্পেসএক্স স্টারলিংক
ধরে নিচ্ছি, ইলন মাস্কের সম্পর্কে আপনার নূন্যতম ধারণা আছে। টেসলা নামটার সাথেও আপনি পরিচিত। প্রযুক্তি দুনিয়ার সেই খ্যাপাটে লোকটা এবার ইন্টারনেট স্পেস রেসে টেক্কা দিতে তার আরেক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘স্পেসএক্স’ সূচনা করেছে ‘স্টারলিংক’ নামের একটি প্রকল্প।
উচ্চ গতি সম্পন্ন স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ২০১৯ সালের মে মাসে স্পেসএক্সের নিজস্ব ‘ফ্যালকন ৯ রকেট’র সাহায্যে স্টারলিংক স্যাটেলাইটের প্রথম ব্যাচ উৎক্ষেপণ করা হয়। বর্তমানে পৃথিবীকে ৩৪০ মাইল উচ্চতায় প্রদক্ষিণ করছে ১২ হাজারেরও বেশি স্টারলিংক স্যাটেলাইট। একেকটি স্যাটেলাইটের আকার অনেকটা মিনি রেফ্রিজারেটরের মতো। ২০২৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সক্রিয় স্টারলিংক স্যাটেলাইটের সংখ্যাকে ৪২ হাজারে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করছে স্পেসএক্স।
২০২০ সালের অক্টোবরে প্রিঅর্ডারের ঘোষণা দেয় স্টারলিংক কর্তৃপক্ষ। অবিশ্বাস্যভাবে মাত্র চার মাসের মধ্যেই ১০ হাজারেরও বেশি গ্রাহক পেয়ে গেছে তারা। এই সেবা নিতে গ্রাহকের প্রয়োজন হবে ৪৯৯ ডলারের একটি স্টারলিংক কিট ও ওয়াইফাই রাউটার। এছাড়াও প্রতিমাসে সাবস্ক্রিপশন ফি হিসেবে গুনতে হবে ৯৯ ডলার।
স্টারলিংকের পক্ষ থেকে গত অক্টোবরে প্রাথমিকভাবে গ্রাহকদেরকে ৫০ থেকে ১৫০ এমবিপিএস স্পিড আশা করতে বলা হলেও, এখন পর্যন্ত ধারণকৃত সর্বোচ্চ স্টারলিংক স্পিড ছিল ২১৫ এমবিপিএস। এমনকি ঝড়ো হাওয়া, তুষারপাত কিংবা প্রচণ্ড শীতেও স্টারলিংক দিয়েছে ১৭৫ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট সেবা।
এ ব্যাপারে এক টুইট বার্তায় মাস্ক জানান,
“বছরের শেষ দিকে স্টারলিংক ইন্টারনেটের গতি দ্বিগুণ হয়ে ৩০০ এমবিপিএস হবে। সেই সাথে ল্যাটেন্সিও ২০এমএস-এ নেমে আসবে।”
এখন পর্যন্ত ছয়টি দেশে প্রিঅর্ডার চলছে। তবে ২০২১ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মেক্সিকোসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা চলে আসবে স্টারলিংক সেবার আওতায়। একই সাথে স্পেন, ইতালি, ভারত, জাপান ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেও এ সেবার পরিধি বিস্তৃত করতে স্পেসএক্সের অধীনে ১০ হাজারেরও বেশি কর্মী নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে।
অ্যামাজন কাইপার
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে আবারও জেফ বেজোসকে হটিয়ে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন ইলন মাস্ক। বিশ্বখ্যাত দুই প্রতিষ্ঠান টেসলা ও স্পেসএক্স এর সাফল্যই তাকে আজকের এ অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। ওদিকে শীর্ষস্থান হারিয়ে থেমে নেই জেফ বেজোস। বরং ইন্টারনেট স্পেস রেসে মনোনিবেশ করার মধ্য দিয়ে তিনি এ প্রতিযোগিতাকে দিয়েছেন এক নতুন মাত্রা। মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের এ লড়াই যেন বিশ্বের শীর্ষ দুই ধনীর ব্যক্তিগত লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা দিতে অ্যামাজন নিয়ে এসেছে ‘প্রজেক্ট কাইপার’ নামের একটি প্রকল্প। ইতিমধ্যেই ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন (এফসিসি) এর কাছ থেকে ৩,২৩৬টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের অনুমোদন পেয়েছে অ্যামাজন। যার প্রত্যেকটি নির্মাণে খরচ হবে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই লক্ষ্যে পুরোপুরিভাবে কাজ করে চলেছে অ্যামাজন ও জেফ বেজোসের অত্যাধুনিক মহাকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ব্লু অরিজিন।
সামনের দশকে প্রজেক্ট কাইপারের মাধ্যমে বিশ্বকে আরও সংকুচিত করে তুলবে অ্যামাজন। ২০২৬ সালের মধ্যে এফসিসি অনুমোদিত ৩,২৩৬টি স্যাটেলাইটের অন্তত অর্ধেক সংখ্যককে সক্রিয়ভাবে উৎক্ষেপণ করতে হবে। পরবর্তীতে ২০২৯ এর মধ্যে বাকি স্যাটেলাইটগুলো উৎক্ষেপণের সময়সীমাও বেঁধে দেয়া হয়েছে।
এখন পর্যন্ত কাইপার-এর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো অপেক্ষাকৃত ছোট সিগনাল রিসিভিং ডিভাইস। আকৃতির দিক থেকে একটি কাইপার স্যাটেলাইট ডিশ অ্যান্টেনার আকার হবে স্টারলিংক কিটের ১/৩ ভাগ। গত ডিসেম্বরে অ্যামাজন এই বিশেষ ডিভাইসের প্রোটোটাইপ ডিজাইন প্রকাশ করে। তাতে দেখানো হয়েছে, গোলাকার এই অ্যান্টেনার ব্যাস হবে মাত্র ১২ ইঞ্চি।
“সাধারণ সার্কিট বোর্ড প্রস্ততকারক কোম্পানিগুলোর তৈরি করতে পারবে এমন একটি সহজে নির্মাণযোগ্য অ্যান্টেনা চেয়েছিলাম আমরা। এতে তারা যেমন উপকৃত হবে, তেমনি আমরাও কম খরচে ম্যাস প্রোডাকশন করাতে পারব। আর সেই লক্ষ্যে আমরা যতটা সম্ভব সহজ ডিজাইন করার চেষ্টাই করেছি।” -নিমা মাহানফার, কাইপার
এছাড়াও কাইপারের রয়েছে আরও একটি বাড়তি সুবিধা। কোনোভাবে একবার এই কাইপার সিস্টেম দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারলেই অ্যামাজন খুব সহজে এই সেবায় যুক্ত করবে অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস (এডব্লিউএস)।
স্যামসাং, ইএ স্পোর্টস, লায়ন্সগেট, কেলগ’স, নিনটেনডো, নোকিয়া, অটোডেস্ক, কমক্যাস্ট, ফিলিপস, ইউবিসফট, ইউনিলিভার, ফাইজার, অ্যাডোবি, ন্যাসড্যাক, নেটফ্লিক্সসহ বিশ্বের নামিদামি সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই এডব্লিউএস ব্যবহার করছে। তাই, মাঠপর্যায়ের গ্রাহক ছাড়া এন্টারপ্রাইজ লেভেলেও বাড়তি আয়ের সুযোগ থাকছে অ্যামাজনের সামনে।
সম্ভাবনা ও অন্ধকার
ইতিমধ্যেই স্মার্টফোন হাতে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। সেই জীবনধারায় নতুন মাত্রা দিবে এই স্যাটেলাইট ভিত্তিক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। শীঘ্রই পৃথিবীর আকাশে ভিড় জমাবে ইন্টারনেট সেবা দানকারী এসব মিনি স্যাটেলাইট। তৈরি করবে নতুন এক চাদর। উন্মোচিত হবে সম্ভাবনার অসংখ্য নতুন দুয়ার।
“মহাকাশে আমরা এখনো অদৃশ্য। বহুদূরের কোনো গ্রহ থেকে এলিয়েন সভ্যতার কেউ টেলিস্কোপ দিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকলে, জানতেও পারবে না যে এখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন আছে। বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ানো কৃত্রিম সিএফসি গ্যাস ছাড়া আমরা তো এ গ্রহে নিজেদের অস্তিত্বের তেমন কোনো দৃশ্যমান নিশানাই তৈরি করতে পারিনি। টেলিস্কোপের সাহায্যে দূর থেকে চোখে পড়ার মতো তেমন নেটওয়ার্ক তৈরি করতেও স্টারলিংকের প্রায় ৮০০ বছর লেগে যাবে।” -জেমি কার্টার, ফোর্বস
স্পেসএক্স, অ্যামাজনের মতো ইন্টারনেট স্পেস রেসের আরেক ঘোড়ার নাম ওয়ানওয়েব। কয়েক বছরের মধ্যেই পৃথিবীর আকাশে নতুন করে ঠাঁই পাবে অন্তত কয়েক হাজার স্যাটেলাইট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন অফ কনসার্নড সাইন্টিস্টস প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীর আকাশে সক্রিয় স্যাটেলাইটের সংখ্যা ২,২০০টি। এ দশকে সংখ্যাটি ৪৫,০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এসব প্রযুক্তির সংস্পর্শে আধুনিক জীবনধারা আরও সহজ ও গতিশীল হয়ে উঠলেও স্যাটেলাইট ভিত্তিক নতুন এই ইন্টারনেট সেবার প্রতি জ্যোতির্বিদ্যার সাথে যুক্ত থাকা ব্যক্তিবর্গ তীব্রভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
“হাই অলটিটিউড ট্রান্সমিশন থেকে রক্ষা করা যায় না বলে, এসব প্রযুক্তির প্রাচুর্যে রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি ফ্যাসিলিটিগুলো বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” -লিজ ভ্যান যি, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সাইন্স
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান তারা।
“বিশাল এই স্যাটেলাইট বহর প্রতি মুহূর্তে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকবে যার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকায়, আমাদের গবেষণা করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।” -হার্ভি লিশট, ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরি
এছাড়া, বিভিন্ন কোম্পানির অসংখ্য স্যাটেলাইটের এই কার্যক্রমে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ কিংবা প্রক্রিয়াগত জটিলতা এড়াতে প্রয়োজন হবে স্পেস ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট। কারণ ঘণ্টা প্রতি প্রায় ৩০,০০০ কিলোমিটার বেগে ঘুরতে থাকা এই স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হলে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এসব সিস্টেমকে অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পরিবেশগত দিকগুলোও খতিয়ে দেখার দাবি তুলেছে।
সব মিলে ভালোই যাচ্ছে তাদের প্রযুক্তির লড়াই। এ লড়াই নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও এখান থেকে অনেক ভালো কিছু বেরিয়ে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।