Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস: মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে কম্পিউটার

স্টিফেন হকিং; নামটি শুনলেই সৃষ্টিতত্ত্ব, কৃষ্ণগহ্বর, কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ ও বহির্বিশ্বের প্রাণ সংক্রান্ত ক্ষেত্রগুলোতে চোখে পড়ার মতো সমৃদ্ধির চিত্র ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে এমন একজন মানুষের চেহারা, যিনি মোটর নিউরন ব্যাধিতে শারীরিক বোধ হারিয়ে জীবনের তিন-চতুর্থাংশ সময় হুইলচেয়ারে কাটিয়েছেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হারিয়েছেন বাকশক্তি; তারপরেও পুরোপুরি কার্যক্ষম মস্তিষ্ককে আমৃত্যু বিজ্ঞানচর্চায় কাজে লাগিয়ে গিয়েছেন। লিখে গিয়েছেন ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইম’, ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ সহ একাধিক অসামান্য গ্রন্থ।

স্টিফেন হকিং; Image Courtesy: KARWAI TANG/GETTY IMAGES

পুরোপুরি শারীরিক বোধ ও বাকশক্তিহীন এই তাত্ত্বিক পদার্থবিদ বই লেখা, ভাষণ দেওয়া এবং পুরো পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের কাজটি করতেন হুইলচেয়ারের সাথে সংযুক্ত কম্পিউটারের মাধ্যমে। ১৯৮৫ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারানোর পর ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক কোম্পানি ‘স্পিচ প্লাস’-এর ‘ইকুয়ালাইজার’ নামক একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে তিনি সাধারণ লেখালেখি ও যোগাযোগের কাজটি করতেন। প্রোগ্রামটি রিমোটের মতো ছোট কন্ট্রোলারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শব্দ বাছাই করে হ্যান্ড ক্লিকারের সাহায্যে কম্পিউটারকে নির্দেশ করে হুইল চেয়ার নাড়ানো ও লেখালেখির সুবিধা দিয়েছিল।

ওয়ার্ড প্লাসের ইকুয়ালাইজার অ্যাপ্লিকেশন ইন্সটল করা কম্পিউটারভিত্তিক হুইলচেয়ারে স্টিফেন হকিং; Image Source: ALAMY

কিন্তু ধীরে ধীরে অসুস্থতা বৃদ্ধির কারণে পুরো শরীর বোধহীন হয়ে যায়। সে সময়ই, ১৯৯৩ সালের দিকে ইন্টেল স্টিফেন হকিংয়ের জন্য নতুন একটি সিস্টেম ডিজাইন করে, যেটি লেখালেখি সহ টেক্সট-টু-স্পিচ জেনারেটিং ফিচারের মাধ্যমে কথা বলা, লেকচার দেওয়ার কাজটিও করতে সক্ষম ছিল।

সিস্টেমটি চশমার সাথে সংযুক্ত ইনফ্রারেড সুইচের মাধ্যমে সামনে থাকা কম্পিউটার স্ক্রিনে নির্দিষ্ট বর্ণের কলামে প্রয়োজনীয় শব্দটি খুঁজে বের করে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। পুরো কাজটি সম্পাদনের জন্য স্টিফেন হকিংকে গালের মাংসপেশি সামান্য নাড়াতে হতো। এই পদ্ধতিতে মাঝে মাঝে একটি শব্দ খুঁজে বের করার জন্য মিনিটখানেক বেশি সময়ও লেগে যেত।

যদিও পরবর্তীতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও ডিপ লার্নিং প্রযুক্তি তার বই, পূর্ববর্তী লেকচার এবং নিয়মিত ব্যবহার করা শব্দ, বাক্য বিশ্লেষণ করে এক বা একাধিক শব্দ ইনপুট দিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূর্ণ বাক্য তৈরির সুযোগ করে দেয়। কিন্তু ভাবুন একবার, শারীরিক অক্ষমতা বাধা না হয়ে দাঁড়ালে বা মনের ভাব প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত কম্পিউটার আরো উন্নত হলে, স্থান ও কাল সংক্রান্ত বিজ্ঞানের এই বিশাল অঙ্গনে তার অবদানের পরিমাণ কেমন হতো? কেমন হতো, যদি তিনি এমন একটি কম্পিউটার সিস্টেমের সাহায্য পেতেন, যেটি মস্তিষ্কের সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে? মনে মনে যা নির্দেশ করছে, মস্তিষ্ক যে বাক্যগুলো সাজাচ্ছে, তা-ই কম্পিউটারের সাহায্যে প্রকাশ পাচ্ছে?

মস্তিষ্ক দ্বারা অন-স্ক্রিন কার্সর নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে; GIF Source: techcrunch.com

এক্স-ম্যান, ট্রান্সসেন্সডেন্স, টোটাল রিকল, আপগ্রেড, কিংবা দ্য ম্যাট্রিক্সের মতো সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলোতে মস্তিষ্ক থেকে সরাসরি কম্পিউটার বা কম্পিউটার থেকে সরাসরি মস্তিষ্কে তথ্য, নির্দেশ প্রেরণের এই প্রচলিত ধারণাটি দেখা যায়। এর বাস্তব প্রয়োগ অসম্ভব মনে হলেও বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি মানুষের মস্তিষ্কের ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে এমন একটি কম্পিউটার সিস্টেমের ধারণাই বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে। ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) নামে পরিচিত সায়েন্স ফিকশনে বহুল ব্যবহৃত কম্পিউটার সিস্টেমটি নিয়েই আজকের আয়োজন।

ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস

কম্পিউটার বা কম্পিউটারভিত্তিক ডিভাইসগুলোর সাথে মানুষের যোগাযোগ হয় মাউস, কি-বোর্ড, টাচ-স্ক্রিন, মনিটর, স্পিকারসহ ইনপুট-আউটপুট সংক্রান্ত কাজে সাহায্য করে এমন অসংখ্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে। ইনপুট ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে ব্যবহারকারী কম্পিউটারকে নানা নির্দেশ দিয়ে থাকে এবং সেই নির্দেশের উপর ভিত্তি করেই কম্পিউটারের প্রসেসিং ইউনিট বা CPU কাজটি সম্পাদন করে আউটপুট ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে তা ব্যবহারকারীকে দেখার সুযোগ দেয়। 

ইনফ্রারেড সুইচ, মোশন সেন্সর, স্পিচ জেনারেটেড কমান্ড, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি সহ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সভিত্তিক স্মার্ট অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগের এই ব্যবস্থাকে আরো সহজ করে দিয়েছে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা থেকে শুরু করে সুস্থ, অসুস্থ- অনেক মানুষই উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নিজের অসম্পূর্ণতা, অক্ষমতাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাথে সাথে সীমিত পর্যায়ের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে নিচ্ছে। হাত-পা নাড়াতে পারছে না এমন যে কেউ হুইল চেয়ার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। দৃষ্টিশক্তি নেই এমন যে কেউ চাইলেই ভয়েস নিয়ন্ত্রিত সফটওয়্যারের সাহায্যে কম্পিউটারকে নির্দেশনা দিতে পারছে, ফলাফল পাচ্ছে স্পিকারের মাধ্যমে।

মোশন সেন্সর নিয়ন্ত্রিত ইনপুট ডিভাইস; Image Courtesy: Sarah Tew/CNET

অর্থাৎ, কম্পিউটারের সাথে ইন্টার‍্যাকশনের জন্য মানুষকে কোনো না কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্য নিতে হয়, সামান্য হলেও পেশি শক্তির ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু যাদের দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও বাকশক্তি নেই, স্টিফেন হকিংয়ের মতো পুরোপুরি বোধশক্তিহীন, তারা কিন্তু চাইলেই কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে না। অর্থাৎ, প্রযুক্তির এত সুবিধা থাকতেও সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ তাদের নেই। থাকলেও তা সীমিত পর্যায়ে। আর এই জায়গাটিতেই ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের আগমন।

মানবদেহ এবং ইন্দ্রিয়গুলো যেহেতু পুরোপুরি মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু যদি কম্পিউটারগুলো ইনপুট-আউটপুটের জন্য পুরোপুরি মস্তিষ্ক নির্ভর হয়, তাহলেই উপরোক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যায়। অর্থাৎ, ভবিষ্যতের উন্নত ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের সাহায্যে দৃষ্টিশক্তি নেই এমন কাউকে ক্যামেরার সাহায্যে প্রাপ্ত দৃশ্যের বিস্তারিত তথ্য সরাসরি ব্রেইনে প্রবেশ করিয়ে দিলেই মানুষটি সাধারণ মানুষের মতো দেখতে পারবে। স্টিফেন হকিংয়ের মতো বোধশক্তিহীন, বাকশক্তিহীন মানুষগুলো শুধুমাত্র মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়েই কম্পিউটারের মাধ্যমে লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারবেন, কথা বলতে পারবেন অনবরত। এমনকি, যান্ত্রিক শরীরের সাহায্যেও সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডগুলো চালাতে পারবে।

মানব মস্তিষ্ক, নিউরন এবং কম্পিউটার

মানব মস্তিষ্ক প্রায় ১০০ বিলিয়ন ক্ষুদ্র নিউরন দ্বারা তৈরী। দেহের বিভিন্ন কাজের সমন্বয়কারী হিসেবে পরিচিত নিউরন বা স্নায়ুকোষগুলো একে অপরের সাথে ডেনড্রাইট এবং অ্যাক্সন নামক দুটো অংশ দিয়ে সংযুক্ত থাকে। ডেনড্রাইট মানব ইন্দ্রিয় ও নিউরন থেকে তথ্য গ্রহণ করে এবং অ্যাক্সন সেই তথ্যকে পরিবহন করতে সাহায্য করে। আমাদের কথা বলা, চলাফেরা, চিন্তা করা সহ প্রত্যেকটি কাজের সময় নিউরন কাজ করে। দেহের ইন্দ্রিয়গুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো নিউরনে সরবরাহ হয় এবং নিউরনের মাধ্যমেই আমরা আমাদের দেহের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কোনোকিছু করার নির্দেশ পৌঁছাই। কাজগুলো করার সময় এক নিউরন অপর নিউরনের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। আর বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, একটি নিউরন থেকে অপর একটি নিউরনে তথ্য আদান-প্রদানের কাজটি সম্পাদিত হয় ক্ষুদ্র ইলেকট্রিক সিগন্যালের মাধ্যমে।

শিল্পীর আঁকিবুঁকিতে নিউরন থেকে নিউরনে পরিবহন হওয়া ইলেকট্রিক সিগন্যাল; Image Courtesy: KTSIMAGE / ISTOCKPHOTO 

আমরা জানি, কম্পিউটারের মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোও ইলেকট্রিক সিগন্যালের উপর ভিত্তি করে কাজ করে। তাই বলা যায়, মস্তিষ্কের তথ্য আদান-প্রদান পদ্ধতির সাথে কম্পিউটারের তথ্য আদানপ্রদান পদ্ধতির সামঞ্জস্য আছে। মূলত এ কারণেই, রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরী মস্তিষ্কের সাথে আইসি, ট্রানজিস্টার, প্লাস্টিক এবং নানারকম ইলেকট্রনিক ডিভাইসের তৈরী কম্পিউটারের সংযোগ স্থাপন সম্ভব। আর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই বিজ্ঞানীরা দেহের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের সাথে মস্তিষ্কে নিউরন থেকে নিউরনে তথ্য প্রেরণের সময়ে তৈরী হওয়া সিগন্যাল ধরতে সক্ষম হয়েছেন। এর উপর ভিত্তি করেই মূলত ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের ধারণাটি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নিউরনের ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে প্রযুক্তিটি কাজ করে বিধায় মাঝে মাঝে একে ‘নিউরাল-কন্ট্রোল ইন্টারফেস’ বা এনসিই নামেও ডাকা হয়। 

মস্তিষ্কের সাথে কম্পিউটারের সিগন্যাল আদান-প্রদান প্রক্রিয়া

বর্তমানে, ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস অনেকটা অগ্রগামী হলেও কম্পিউটারের মাধ্যমে মস্তিষ্ক থেকে সিগন্যাল গ্রহণ এবং মস্তিষ্কে সিগন্যাল প্রেরণের প্রক্রিয়াটি বিজ্ঞানীদের বেশ ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। সাধারণত, মস্তিষ্কের বহিরাবরণ বা করোটিতে ‘ইলেক্ট্রোএনসেফ্যালোগ্রাফ’ নামক অনেকগুলো ইলেক্ট্রোড স্থাপন করার মাধ্যমে নিউরন থেকে সিগন্যাল রিড করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিউরন প্রত্যেক মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ সিগন্যাল তৈরি করে, যার অধিকাংশই মাথার শক্ত খুলির কারণে আটকে যায়; অর্থাৎ, ইলেক্ট্রোএনসেফ্যালোগ্রাফে অধিকাংশ সিগন্যালই পৌঁছতে পারে না। পৌঁছলেও, সিগন্যালগুলো অসম্পূর্ণ ও বেশ দুর্বল অবস্থায় থাকে।

মস্তিষ্ক থেকে ইলেক্ট্রোএনসেফ্যালোগ্রাফের মাধ্যমে সিগন্যাল রিড করে কম্পিউটারে প্রেরণ; Image Source:  Youtube/National Science Foundation

সরাসরি করোটির অভ্যন্তরীণ অংশে; অর্থাৎ, মস্তিষ্কের ঠিক উপরের অংশে ইলেক্ট্রোএনসেফ্যালোগ্রাফ স্থাপন করে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এতে করে মস্তিষ্কের যে জায়গাগুলো থেকে সিগন্যাল তৈরী হয়, সেসব জায়গা ও ইলেক্ট্রোড ডিভাইসগুলোর মাঝে আহামরি কোনো শক্ত বাধা না থাকায় ডিভাইসগুলোর জন্য সিগন্যাল রিড করা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি বেশ বিপজ্জনক। প্রথমত, এর জন্য বেশ বড় রকমের সার্জারির প্রয়োজন হয়, যা বেশ ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, সফলভাবে সার্জারি শেষ হলেও ধীরে ধীরে করোটির অভ্যন্তরীণ টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ইলেক্ট্রোড ডিভাইসগুলো যেখানেই স্থাপন করা হোক না কেন, মস্তিষ্কে কাজ চলার সময় তৈরী হওয়া সিগন্যালগুলো একই পদ্ধতিতে কম্পিউটারে ধরা পড়ে। প্রাথমিকভাবে, সিগন্যালগুলো বেশ দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে বিধায় সিগন্যালগুলোকে অ্যামপ্লিফাই ও ফিল্টার করে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামে রাখা হয়। প্রোগ্রামটি অনেকটা আদ্যিকালে ব্রেইন সিগন্যাল রেকর্ড করার কাজে ব্যবহৃত অ্যানসেফালোগ্রাফের ডিজিটাল সংস্করণ; রেডিও ওয়েভের মতো দেখতে সিগন্যালগুলো এখানে কাগজে ছাপার বদলে কম্পিউটারে জমা হয়। এরপর, কোন কাজের জন্য কী ধরনের সিগন্যাল তৈরী হচ্ছে, তা রিড করে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুসরণ করে সহজেই বিসিআই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেসব সিগন্যালকে রিভার্স করে আবার মস্তিষ্কের নিউরনে স্থাপন করা যায়।

মস্তিষ্ক থেকে কম্পিউটার ডিভাইস এবং কম্পিউটার ডিভাইস থেকে যেভাবে মস্তিষ্কে সিগন্যাল প্রেরণ করা হয়; Image Courtesy: ncbi.nlm.nih.gov 

ধরুন, আপনি কোনো একটি দৃশ্য দেখছেন। সাথে সাথেই নিউরন দৃশ্য দেখা সম্পর্কিত কাজটির জন্য পর্যাপ্ত সিগন্যাল তৈরি করে। সিগন্যালগুলোকে ইলেক্ট্রোডগুলো রিড করে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামে জমা করে রাখবে। এখন চাইলেই বিসিআই প্রোগ্রামটির মাধ্যমে রিড করা সিগন্যালগুলোর নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বুঝে ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে ধারণকৃত কোনো দৃশ্যকে রিভার্স সিগন্যালের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নিউরনে স্থাপন করা সম্ভব। এক্ষেত্রেও, নিউরন ভিডিও ক্যামেরায় ধারণকৃত দৃশ্যটি অবলোকন করতে পারবে।

সাধারণত, ইলেক্ট্রোডগুলো মস্তিষ্কের কোনো কোনো জায়গায় স্থাপন করে নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরী সিগন্যাল রিড করা যাবে, সে ব্যাপারে ধারণা নিতে বিজ্ঞানীরা ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং বা এমআরআই স্ক্যানারের সাহায্য নেন। এমআরআইয়ে ব্যবহৃত প্রোগ্রাম বা অ্যালগরিদমটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গার কার্যকারিতা সম্পর্কে শক্তিশালী ধারণা দিতে পারে।

এমআরআই স্ক্যানার; Image Source: nhs.uk

ব্যাপারটি অনেকটা এরকম; ধরুন, একজন মানুষের মাথায় রোবোটিক হাত নিয়ন্ত্রণের জন্য ইলেক্ট্রোড স্থাপন করা হবে। তার জন্য, প্রথমে বিজ্ঞানীরা ঐ মানুষকে একটি এমআরআই মেশিনে প্রবেশ করিয়ে বলবেন চিন্তার মাধ্যমে হাত নাড়ানোর জন্য। এ সময়, এমআরআই দেখাবে মস্তিষ্কের ঠিক কোন জায়গাটি হাত নাড়ানোর সময় কাজ করেছে এবং এর উপর ভিত্তি করেই ইলেক্ট্রোড স্থাপন করা হবে।

যে অবস্থানে আছে বিসিআই প্রযুক্তি

কয়েক যুগ ধরেই ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ছোট-বড়, সরকারি-বেসরকারি নানা প্রযুক্তি কোম্পানি। সাধারণ ভোক্তাদের কাছে তেমনভাবে এই প্রযুক্তি না পৌঁছালেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে নির্দিষ্ট কিছু খাতে স্বল্প পরিমাণে বিসিআই পণ্য-সেবা দিচ্ছে। পারকিন্সন রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ডিপ ব্রেইন সিমুলেটর, কোয়াড্রিপ্লেজিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য রোবোটিক অঙ্গ স্থাপনসহ বেশ কয়েকটি খাতে কোম্পানিগুলো বেশ সফল।

https://assets.roar.media/assets/H84lGgMPKiNZl6Qq_1_NxMBJJNAJ4xQYfayd9hHDQ.png
কোয়াড্রিপ্লেজিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য রোবোটিক অঙ্গ; Image Courtesy: University of Pittsburgh Medical Center

এমনকি, মাত্র একশো ডলারেরও কম মূল্যে সাধারণ ভোক্তারা বিসিআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরী মাইন্ডফ্লেক্স গেম সেট কিনতে পারবে, যেখানে প্লেয়াররা চিন্তার মাধ্যমে একটি বলকে গেম সেটের গোলকধাঁধায় নিজের ইচ্ছেমতো স্থানান্তর করতে পারবে। অন্যদিকে গুগল গ্লাসে ব্যবহৃত মাইন্ডআরডিআর অ্যাপ্লিকেশনটি সরাসরি মস্তিষ্ক থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে গুগল গ্লাসের ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তুলে ফেসবুক ও টুইটারে শেয়ার করতে সক্ষম। মাইন্ডফ্লেক্স ও মাইন্ডআরডিআর, দুটো অ্যাপ্লিকেশনই সিলিকন ভ্যালির নিউরোস্কাই ইনকর্পোরেশন-এর ‘মাইন্ডওয়েভ’ নামের ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেসের উপর ভিত্তি করে তৈরী। মাইন্ডওয়েভ ব্যবহারকারীর তীব্র মনোযোগ ও রিলাক্সেশনকে ইনপুট হিসেবে নিয়ে কাজ করে।

মাইন্ডফ্লেক্স গেইম সেট; Image Source: Amazon

মস্তিষ্কের মেডিয়াল টেম্পোরাল লোবে অবস্থিত হিপোক্যাম্পাস মূলত আমাদের দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিগুলো লিখে রাখে। ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক কোম্পানি ‘কার্নেল কর্পোরেশন‘ তাদের তৈরী চিপের মাধ্যমে হিপোক্যাম্পাসের স্মৃতিগুলোর সাথে যোগাযোগ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন প্রোগ্রামের সাহায্যে সেখানে থাকা তথ্যগুলো রিড করতে সক্ষম। তাদের তৈরী এই বিসিআই প্রযুক্তি প্রায় ৮০ শতাংশ নির্ভুল। এছাড়াও, মাইন্ডমেজ, নিউরোস্পেস, রিদম, ব্রেইনকোসহ পৃথিবীব্যাপী অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য কোম্পানি রয়েছে, যারা নিয়মিত এ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

তবে, বর্তমানে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি নির্মূলের জন্য বিসিআই প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে, স্ট্রোক, স্পাইনাল কর্ড আঘাত পাওয়া সহ নানা ধরনের রোগে বোধশক্তি, সংবেদনশীলতা, উপলব্ধি ক্ষমতা, স্মৃতি, বাকশক্তি হারানো মানুষগুলোর জন্যই মূলত এ প্রযুক্তি এগিয়ে আসছে।

ভবিষ্যতের ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস

“If the human brain was so simple that we could understand it, we would be so simple that we couldn’t.” – Emerson M. Pugh

বিজ্ঞানীদের কাছে মস্তিষ্ক সম্পর্কিত রহস্যগুলো যত বেশি উন্মোচিত হচ্ছে, বিসিআই প্রযুক্তি তত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিপাড়ায় চলছে এর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে হাজারো জল্পনা-কল্পনা। আশাবাদী প্রযুক্তিবিদ থেকে শুরু করে কল্পনাপ্রিয় মানুষগুলোর চিন্তায় প্রযুক্তিটি বেশ ভালোভাবেই স্থান করে নিয়েছে। আর নেবেই না বা কেন? এই প্রযুক্তির ক্ষমতা যে স্বয়ং সায়েন্স ফিকশনের অসম্ভব থেকে অসম্ভবতর ধারণাগুলোকেও হার মানায়। তো, কেমন হতে পারে ভবিষ্যতের ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস?

ভবিষ্যতে বিসিআই প্রযুক্তির সাহায্যে ব্যক্তি চাইলেই, তার আইডিয়াগুলো কম্পিউটার ভিজুয়াল গ্রাফিক্স বা ওয়ার্ড টেক্সটে রূপ দিতে পারবে। তার জন্য প্রয়োজন হবে না কোনো পেন টুল, মাউস কিংবা কি-বোর্ড। আঁকতে বা লিখতে অক্ষম যেকোনো মানুষ শুধুমাত্র তার চিন্তার মাধ্যমে কাজগুলো করতে পারবে।

ব্যক্তি চাইলেই ক্লাউড থেকে সরাসরি মস্তিষ্কে যেকোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। গুগলের সার্চ বারে টাইপ করে করে কোনো তথ্য খুঁজতে হবে না। অ্যালেক্সা, সিরি বা গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টকে নির্দেশ না করেও ব্যক্তি জেনে নিতে পারবে যেকোনো জিনিস সম্পর্কে। অর্থাৎ, দৃষ্টিশক্তি, বাকশক্তি, শ্রবণশক্তি, শারীরিক বোধশক্তিহীন মানুষগুলোও সার্চ ইঞ্জিন সুবিধা পাবে সহজে।

‘ট্রান্সসেনডেন্স’ ফ্লিমে জনি ডিপ তার স্মৃতিগুলোকে কম্পিউটারে স্টোর করে রাখছেন;  Image Courtesy:  Alcon Entertainment

পৃথিবীব্যাপী বিশাল সংখ্যক মানুষ অ্যালঝেইমার, ডিমেনশিয়া এবং পারকিন্সন সহ নানা ধরনের স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভুগছে। বিসিআই প্রযুক্তি এই স্মৃতি হারানো থেকেও মুক্তি দিতে সক্ষম। চাইলেই ব্যক্তি তার স্মৃতি কম্পিউটার মেমোরিতে জমা করে রেখে দিতে পারবে এবং হারানো স্মৃতিগুলোকে কম্পিউটারের সাহায্যে মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতে পারবে। এমনকি, অনেক গবেষকের ধারণা, নতুন দক্ষতা ও জ্ঞান সরাসরি মস্তিষ্কে ইনপুট করেও মানুষ যেকোনো কাজে দক্ষ হয়ে উঠতে পারবে। নেটফ্লিক্সের ‘আপগ্রেড’ সিনেমাটির গল্প এমন একটি ধারণার উপরই সাজানো হয়েছে।

এই প্রযুক্তি আপনাকে টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা দেবে। অর্থাৎ, আপনি চাইলেই আপনার প্রিয়জনের সাথে সরাসরি কোনো ফোন, কম্পিউটার, ওয়্যারেবল গ্যাজেটের সাহায্যে ম্যাসেজিং অথবা কথা বলা ছাড়াও সরাসরি চিন্তার সাহায্যে যোগাযোগ করতে পারবেন।

প্রযুক্তিটি মূলত ব্রেইন-টু-ব্রেইন ইন্টারফেস (BBI) নামে পরিচিত। যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্রযুক্তিটি ট্রান্সক্রেনিয়াল ম্যাগনেটিক সিমুলেশন (TMS) নামের ডিভাইস ব্যবহার করে। ২০১৩ সালে, এনএফসি সেন্টার ফর সেন্সরিমোটর নিউরাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরিচালক ও ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের কম্পিউটার সায়েন্সের প্রফেসর রাজেশ রাও পরীক্ষামূলকভাবে ক্যাম্পাসের অন্যপাশে অবস্থানরত সহকর্মী অ্যান্ড্রিয়া স্টোকের সাথে ব্রেইন-টু-ব্রেইন ইন্টারফেসের সাহায্যে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০১৫ সালে বিজ্ঞানীরা বানর ও ইঁদুরের একের অধিক মস্তিষ্ক সংযুক্ত করতে সক্ষম হন।

নিকট ভবিষ্যতে বায়োনিক বডি পার্টসের সাথে বিসিআই প্রযুক্তির সংমিশ্রণে স্টিফেন হকিংয়ের মতো মানুষগুলোও খুব সহজে হাঁটাচলা, কথা বলা, লেখালেখির কাজটিও করতে পারবে। কৃত্রিম চোখের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পাবে চোখের আলো। শ্রবণশক্তিহীন মানুষেরা পাবে আরো উন্নত কোচলেয়ার ডিভাইসের ডিজিটাল সংস্করণ। এমনকি, ক্লাউডে ইনস্টল করা কোনো অপারেটিং সিস্টেমে থাকা অ্যাপগুলোও ব্যবহার করতে পারবে মস্তিষ্কের সাহায্যে।

 মস্তিষ্কের সাহায্যে ক্লাউডে থাকা অ্যাপ নিয়ন্ত্রণ; Image Source: cnet.com

বিসিআই প্রযুক্তির অগ্রগামিতা হয়তো এমন সব ডিভাইস আমাদের হাতে পৌঁছে দেবে, যেগুলো এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা শুধু কল্পনাই করতে পারি। আর এই প্রযুক্তি নিয়ে এত বেশি বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে যে, লিখে শেষ করা যাবে না। 

তবে, প্রযুক্তি যে শুধু সুবিধাই তৈরি করে তা নয়; বিস্তৃতি, বিবর্ধনের সাথে সাথে অসুবিধাও তৈরি করে, বাড়ায় নানা ঝুঁকি। ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস প্রযুক্তিও এর ব্যতিক্রম হবে না। আর যেহেতু মস্তিষ্কের মতো দেহের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান অঙ্গের সাথে প্রযুক্তিটি পুরোপুরি সম্পর্কযুক্ত, সেহেতু ঝুঁকির পরিমাণ এখানে আরো বেশি। খারাপ হাতে পড়লে হয়তো হিতে বিপরীত হবে।

আর্টিফিসিয়াল ইন্টেজিলেন্স, মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি এমনিতেই পৃথিবীতে মানুষদের মেশিনের আওতাধীন হওয়ার হুমকি দিচ্ছে, বিসিআই প্রযুক্তি এই হুমকি বাস্তবায়নে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই হয়তো, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষামূলক বড় রকমের সফল কাজ হলে, সাধারণের মাঝে পৌঁছতে শত বছরও লেগে যেতে পারে। তবে ভবিষ্যতের পৃথিবী যে বিসিআই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠবে, তার বলার অপেক্ষা রাখে না।

This article is in Bangla language. It's about brain-computer interface (BCI)  technology. Necessary references have been hyperlinked.

Featured Image: Jean-Pierre Clatot / AFP via Getty Images

 
 

Related Articles