
বিশ্বায়নের এই যুগে বৈশ্বিক উষ্ণতা আসলেই এক উষ্ণতর আলোচনার বিষয়। যতই দিন যাচ্ছে, উষ্ণতার সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের উৎকন্ঠা। কীভাবে গ্রীন হাউস প্রক্রিয়াকে দমানো যায় এই নিয়ে বিজ্ঞানীদেরও চিন্তার শেষ নেই। অনেক পদার্থবিদ, রসায়নবিদ কিছুটা আশার আলোও দেখতে পেয়েছেন, তবে খুব কাছাকাছি যেতে পারছেন না, যদিও তাঁদের চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। চলুন জানা যাক, গ্রীন হাউস গ্যাস নিয়ে বিজ্ঞানীদের কাজের সাফল্য কতটুকু।

পৃথিবীর আদি পরিবেশে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড থেকে অক্সিজেন উৎপন্ন হয়েছিলো
অক্সিজেন আগে না কার্বন ডাইঅক্সাইড আগে?
পৃথিবীর শুরুতে এর বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ছিলো না কখনো। এর বায়ুমন্ডল ছিলো কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থের যৌগিক মিশ্রণ, অনেকটা এখনকার মঙ্গল গ্রহের পরিবেশের অনুরূপ। ধারণা করা হয় পৃথিবীতে উদ্ভিদের উদ্ভবই প্রাণীর জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন উৎপাদনের সূচনা করে। কারণ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং উপজাত হিসেবে অক্সিজেন ত্যাগ করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘গ্রেট অক্সিডেশন ইভেন্ট’ (Great Oxidation Event)।
পৃথিবীতে প্রাণিকূল প্রতি মুহূর্তে অক্সিজেন গ্রহণ করছে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করছে। আদি পৃথিবীতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর এই অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক ছিলো ভারসাম্যপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে যেমন বাড়ছে জনসংখ্যা, তেমনি কমে যাচ্ছে উদ্ভিদের সংখ্যা। ফলে বায়ুতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণও বাড়ছে দিন দিন, যা বৈশ্বিক উষ্ণতার সূত্রপাত করেছে।
কার্বন ডাইঅক্সাইড থেকে কার্বন ও অক্সিজেন
বছরের পর বছর, বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে চলেছেন কিভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2)-কে ভারসাম্যে আনা যায়। বিভিন্ন বিজ্ঞানী চেষ্টা করেছেন CO2-কে বিশ্লিষ্ট করে কার্বন ও অক্সিজেনে রূপান্তরিত করা যায় কিনা। যেহেতু কার্বনকে অক্সিজেনে দহনের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও শক্তি উৎপন্ন হয়, সেহেতু কার্বন ডাইঅক্সাইড ও শক্তিকে আবার সংযুক্ত করলে কার্বন ও অক্সিজেন পাওয়ার কথা। তাঁদের গবেষণার ফলে তারা CO2-কে তাপীয় বিযোজন দ্বারা ভাঙতে সক্ষম হন এবং এর ফলে কার্বন মনোঅক্সাইড (CO) ও অক্সিজেন অণু (O2) পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, কার্বন মনোক্সাইড, অক্সিজেন থেকে অধিক স্থিতিশীল দ্বিবন্ধন তৈরী করে।
এই বিভাজন বিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে বিজ্ঞানীরা ন্যূনতম শক্তিপথ (Minimum Energy Path – MEP) ধারণা ব্যবহার করেন। এই ধারণায় প্রত্যেকটি বিক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট নূন্যতম শক্তিপথ ব্যবহার করে বিক্রিয়া ঘটায়, অর্থাৎ সেই উৎপাদ (প্রোডাক্ট) উৎপন্ন করে যা সর্বনিম্ন পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন করা যেতে পারে। তবে কোনো কারণে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে বিক্রিয়ার এই পথ পরিবর্তন করে দেয়া যেতে পারে, আর ভিন্ন ভিন্ন প্রোডাক্ট বা উৎপাদ উৎপন্ন হতে পারে।

‘ন্যূনতম শক্তিপথ’ ধারণা অনুযায়ী কার্বন মনোক্সাইড অক্সিজেনের থেকে অধিক সুস্থিত বন্ধন গঠন করে
সহজ করে বলতে গেলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাসের মূল উৎস জীবাশ্ম জ্বালানি। কার্বন ঘটিত জৈব যৌগসমূহের দহনের ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়। সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, কার্বনকে পোড়ালে কার্বন ডাইঅক্সাইড পাওয়া যায়।
কিন্তু কার্বন ডাইঅক্সাইডকে আবার বিশ্লিষ্ট করলেই কার্বন ও অক্সিজেন পাওয়া যাবে না। কারণ আগেই বলা হয়েছে যে প্রত্যেকটি বিক্রিয়াই একটা নির্দিষ্ট শক্তিপথ অনুসরণ করে চলে। সুতরাং MEP ধারণানুযায়ী কার্বন ডাই অক্সাইড বিশ্লিষ্ট হয়ে কার্বন মনোক্সাইড ও অক্সিজেন উৎপাদন করে।
এক্ষেত্রে গবেষকেরা সৌরশক্তিকে ঘনীভূত করে প্রাপ্ত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও পানির বিক্রিয়া ঘটিয়ে কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন তৈরীর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
উল্লেখ্য যে বিক্রিয়াটি উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ বিক্রিয়ার সাথে প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ।
তাত্ত্বিক অঘটন
রসায়নের কিছু বিক্রিয়ার দ্বারা তাত্ত্বিকভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিশ্লেষণ সম্ভব হলেও বাস্তবে তা আসলেই অনেক কঠিন। যেমন- ম্যাগনেসিয়ামকে যদি কার্বন ডাই অক্সাইড সমৃদ্ধ পরিবেশে দহন করা হয়, তাহলে তিন ধাপে বিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে আলাদা করে কার্বন ও অক্সিজেন পাওয়া যায়।
সেমিকন্ডাক্টর-ক্যাটালিস্ট ডিভাইস
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও জৈব রসায়নের অধ্যাপক কুবিয়াক (Clifford Kubiak) এবং তার ছাত্র অ্যারন (Aaron Sathrum) একটি যন্ত্রের প্রোটোটাইপ উদ্ভাবন করেছেন যা সূর্যের আলো থেকে প্রাপ্ত সৌরশক্তিকে ধারণ করে সেটাকে তড়িৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে। এই তড়িৎশক্তি কাজে লাগিয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইডকে বিশ্লিষ্ট করে কার্বন মনোক্সাইড ও অক্সিজেন তৈরী করতে পারে। যেহেতু যন্ত্রটি এখনো সম্পূর্ণ নিঁখুত নয়, সেহেতু এতে অতিরিক্ত পরিমাণে বাহ্যিক শক্তি সরবরাহ করতে হয়।

কুবিয়াক ও অ্যারনের সেমিকন্ডাক্টর-ক্যাটালিস্ট ডিভাইস
কুবিয়াক এবং অ্যারনের তৈরী এই যন্ত্রটি একটি সেমিকন্ডাক্টর ও দুই স্তরে বিভক্ত ক্যাটালিস্ট নিয়ে গঠিত। যন্ত্রটি তিন ধাপে কার্বন ডাইঅক্সাইডকে ভেঙে কার্বন মনোক্সাইড ও অক্সিজেন তৈরী করে। প্রথম ধাপে সেমিকন্ডাক্টরটি সৌরশক্তিকে সংগ্রহ করে এবং দ্বিতীয় ধাপে সৌরশক্তিকে তড়িৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে। তৃতীয় ধাপে ক্যাটালিস্ট এই তড়িৎশক্তিকে বিস্তৃত করে এবং এই শক্তি কার্বন ডাইঅক্সাইডকে ভেঙ্গে একদিকে কার্বন মনোক্সাইড ও অন্যদিকে অক্সিজেন তৈরী করে।
এই বিক্রিয়ার জন্য বিশেষ ধরণের ক্যাটালিস্ট ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ যা তড়িৎশক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম। কুবিয়াক এই প্রণালীর জন্য তিনটি নিকেল পরমাণু সহযোগে একটি বৃহৎ অণু বিশিষ্ট ক্যাটালিস্ট ব্যবহার করেছেন।
কার্বন মনোক্সাইড একটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রাসায়নিক পদার্থ যা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে এই পদ্ধতিতে গ্রীন হাউস গ্যাসকে বিশ্লিষ্ট করে জ্বালানি তৈরীর মাধ্যমে গ্রীন হাউস গ্যাসের বৃদ্ধি কমানো সম্ভব। প্রতি বছর প্রায় মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড কার্বন মনোক্সাইড প্লাস্টিক ও ডিটারজেন্ট প্রস্তুত করতে ব্যবহার করা হয়। একে তরল জ্বালানিতেও রূপান্তরিত করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে কার্বন মনোক্সাইড বিষাক্ত গ্যাস যা বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। তাই বিজ্ঞানীরা কার্বন ডাই অক্সাইডকে কার্বন ও অক্সিজেনে বিভক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ভ্যাকুয়াম আল্ট্রাভায়োলেট
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক দল গবেষক ‘ন্যূনতম শক্তিপথ’ ধারণা থেকে অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করে কার্বন ও অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব ও বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে Great Oxidation Event তত্ত্বের আবিষ্কার করেছেন যা বর্ণনা করে যে, উদ্ভিদ প্রকৃতি হতে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে, আর প্রাণী কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে ও অক্সিজেন গ্রহণ করে। গবেষকেরা উদ্ভিদের এই জৈব পদ্ধতিকে গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে ঘটানোর চেষ্টা করেছেন।

ভ্যাকুয়াম আল্ট্রাভায়োলেট ব্যবহার করে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিভাজন
এই পদ্ধতিকে বলা হয় আলোক বিভাজন (Photo dissociation), যেখানে স্বল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অতিবেগুনী রশ্মি ব্যবহার করা হয়, যা ভ্যাকুয়াম আল্ট্রাভায়োলেট (Vacuum Ultra Violet – VUV) উৎস থেকে পাওয়া যায়। এই ডিভাইসে দুইটি লেজার বিম ব্যবহার করা হয় যার একটি কার্বন ডাইঅক্সাইডের উপর আপতিত হয়ে একে বিভাজিত করে এবং অন্যটি এই বিভাজন পর্যবেক্ষণ করে উৎপাদ শনাক্ত করে। তবে এই ধরণের বিক্রিয়ায় অধিক শক্তির প্রয়োজন হয়। গবেষকদের মতে এই পদ্ধতি প্রায় ৫±২% কার্যকর এবং অধিক শক্তি প্রয়োগের ফলে এই হার বৃদ্ধি করা সম্ভব।
প্রথম দিকে এই ধরণের বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব হয়নি। কারণ VUV তৈরী করা কঠিন ছিলো। এটা তৈরীতে সিংক্রোট্রন (Synchrotron) নামক এক ধরণের পার্টিকেল এক্সেলেরেটর (Particle Accelerator) ব্যবহার করা হয়। তবে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক টিমের দাবী, তাঁদের উদ্ভাবিত লেজার এর থেকে ১০,০০০ গুণ বেশি উজ্জ্বল।
যদিও পদ্ধতিটি স্বল্প কার্যকর, তবুও এটি নির্দেশ করে যে কার্বন ডাইঅক্সাইড থেকে আণবিক অক্সিজেন ও কার্বন পাওয়া সম্ভব এবং বিজ্ঞানীরা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন কিভাবে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা যায়। এই গবেষণা আরো ব্যাখ্যা করে কিভাবে আদি পৃথিবীতে গাসীয় পরিবেশে অক্সিজেন উৎপন্ন হয়েছিলো। বিজ্ঞানীদের ধারণা পৃথিবীর আদি পরিবেশে এভাবেই অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড ভেঙে অক্সিজেন উৎপন্ন হয়েছিলো।
পৃথিবীর উন্নয়নের সাথে সাথে জনসংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, শিল্পোন্নয়ন ও নগরায়নের ফলে তেমনি গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ভিদ কার্বন ডাইঅক্সাইডের শোষণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করলেও অধিক জনসংখ্যার দরুন কার্বন ডাইঅক্সাইডের বৃদ্ধি এবং উদ্ভিদের সংখ্যা হ্রাসের ফলে এই প্রতিক্রিয়াও বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত। ফলে গবেষক মহল কৃত্রিমভাবে এই প্রতিক্রিয়ার সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং কিছুটা সফলও হয়েছেন। আশা করা যায় একদিন কার্বন ডাই অক্সাইডকেও সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।