দৃশ্যপট জাপান। ৯ম এবং ১০ম শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অজানা দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হলো। সাথে দেয়া হলো কিছু খাবার, পানি এবং অস্ত্র। তাদের গলায় বেঁধে দেয়া হলো একটি ব্যান্ড, কেউ যদি পালানোর চেষ্টা করে তাহলে সেই ব্যান্ড ফেটে সে মারা পড়বে। দ্বীপে থাকা সবাইকে হত্যা করে যে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে সে-ই শুধু ফিরতে পারবে দ্বীপ থেকে।
২০০০ সালে জাপানে মুক্তি পাওয়া ‘ব্যাটল রয়্যাল’ ছবির কাহিনী এটি। এই কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তৈরি হয়েছে হালের জনপ্রিয় ভিডিও গেম ‘প্লেয়ার আননোন ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ বা পাবজি। এই লেখায় পাবজির উত্থান, এর ব্যবসায়িক সাফল্য এবং সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্লেষণ থাকবে।
শুরুতেই পাবজির উত্থানের ব্যাপারে সংক্ষেপে জানা যাক। পাবজি নির্মাণের পেছনের মানুষ ব্রেন্ডন গ্রিন। গ্রিন তার ক্যারিয়ার শুরু করেন ডিজাইনার হিসেবে, ছিলেন ফটোগ্রাফারও। গেমিং নিয়ে তার কোনো প্রশিক্ষণ বা ডিগ্রি ছিল না, তবে ব্রাজিলে থাকাকালে প্রচুর মিলিটারি থিমভিত্তিক ভিডিও গেম খেলতেন। ভাবতেন, অনলাইনে যেসব অ্যাকশন জনরার গেম পাওয়া যায় সেগুলো ছোট্ট মানচিত্রের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ এবং সেসব গেমে কোনো বৈচিত্র্যও নেই। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন গেম তৈরি করবেন যেখানে বড় পরিসরে বহু সংখ্যক মানুষ খেলতে পারবে। ২০১০ সালের শুরুর দিকে গ্রিন ‘আরমা টু মোড ডেজেড: ব্যাটেল রয়্যাল’ নামে একটি গেমের ডিজাইন করেন।
ব্যাটেল রয়্যাল জনরার মতো গেমস বেঁচে থাকা, স্ক্যাভেঞ্জিং এবং অ্যাকশনের জন্য দ্রুততম সময়ে গেমিংয়ের অন্যতম জনপ্রিয় ধারায় পরিণত হয়। কিন্তু সব গেমেই কিছু একটা ব্যাপারের অভাব ছিল যার জন্য গেমগুলো ঠিক পূর্ণতা পায়নি বা ব্যবসা টিকিয়ে রাখায় হিমশিম খেয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয় গেমগুলোর। সীমাবদ্ধ মানচিত্রের গন্ডি ছাড়িয়ে ওপেন ওয়ার্ল্ড ম্যাপ এবং র্যান্ডমাইজেশনে বৈচিত্র্য আনাটা হয়ে পড়ে সময়ের দাবি।
সে সময় সনি অনলাইন এন্টারটেইনমেন্ট ব্রেন্ডন গ্রিনের কাজগুলোয় নজর রাখছিল। তাদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ‘এইচ ওয়ান জেড ওয়ান’ নামে একটি নতুন ব্যাটল রয়্যাল থিমের গেম তৈরির প্রজেক্টে কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ দেন গ্রিন। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভিডিও গেম ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ডে ব্রেক। ব্রেকের ব্যানারেই পরের বছর বাজারে আসে ‘এইচ ওয়ান জেড ওয়ান’ এর দুটি আলাদা সংস্করণ- কিং অফ দ্য হিল এবং জাস্ট সার্ভাইভ। প্রজেক্টটি শেষ হওয়ায় গ্রিনেরও চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে আসে।
সে সময় দক্ষিণ কোরিয়ার গেমিং কোম্পানি ‘ব্লু হোল’ চাচ্ছিল তাদের গেমগুলো আরও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে পৌঁছাতে। গ্রিনের ডেজেড গেমটি খেলে গেমটির ডেভেলপার অর্থাৎ গ্রিনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন ব্লু হোলের ডিরেক্টর চাং হান কিম। তার দেয়া প্রস্তাবের পর গ্রিন ব্লু হোলে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন, শুরু করেন নতুন ব্যাটেল রয়্যাল কনসেপ্টের কাজ। ২০১৬ সালের বাকি সময়টা নতুন গেমের পেছনেই ব্যয় করে গ্রিন ও ব্লু হোল টিম।
২০১৭ সালের মার্চে বাজারে আসে ‘প্লেয়ার আননোন ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ বা পাবজি-র বেটা ভার্সন। গ্রিন, তার সহকর্মী এবং সর্বোপরি ব্লু হোলের জন্য এটি ছিল প্যাশন প্রজেক্ট। এই গেমের পেছনে অতিরিক্ত সময় এবং শ্রম দিয়ে গেমটিকে আকর্ষণীয় করে তোলার সবরকম চেষ্টা করা হয়েছে৷ সেটির সফলতাও পেতে শুরু করে সংশ্লিষ্টরা। সাড়া পড়ে যায় গেমিং কমিউনিটিতে।
পাবজি গেমটি একসাথে ১০০ জন খেলতে পারে। প্লেন থেকে প্যারাসুট দিয়ে বিশালাকার মানচিত্রের যেকোনো স্থানে তারা ইচ্ছেমতো নামতে পারে। ১০০ জন একে অপরের সাথে লড়াই করে যে শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারে সে-ই হয় বিজয়ী। এটাই হলো পাবজির মূল নিয়ম। এই জনরার খেলা এটাই প্রথম হওয়ায় বিশ্বজুড়েই সাড়া ফেলে পাবজি। সাফল্যের পথ খুলে যাওয়ায় ব্লু হোল সমস্ত মনোযোগ পাবজিতেই কেন্দ্রীভূত করে। কোম্পানিটি নাম পাল্টে হয়ে যায় পাবজি করপোরেশন।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পিসির জন্য গেমটির ফুল ভার্সন রিলিজ হয়। পরের বছর অন্যান্য মাধ্যমের জন্যও পাবজি রিলিজ করা হয়। ২০১৭ সালের শুরুতে যখন বেটা ভার্সন বেরিয়েছিল তখন মাসখানেকের ব্যবধানে প্রায় মিলিয়ন সংখ্যক ডাউনলোড হয় গেমটি। তিন মাসের ব্যবধানে সেই সংখ্যা পৌঁছে যায় পাঁচ মিলিয়নে। ডিসেম্বরে ফুল ভার্সন বের হওয়ার পর ডাউনলোড সংখ্যা পৌঁছে যায় ৩০ মিলিয়নে। ২০২০ সালে এসে এই সংখ্যা ৭৩৪ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৪ শতাংশ ডাউনলোড হয়েছে ভারতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৮ সালে পাবজির মোট আয় প্রায় ৯২০ মিলিয়ন ডলার , এর মধ্যে তাদের মুনাফা প্রায় ৩১০ মিলিয়ন ডলার। কোম্পানির মোট আয়ের ৫৩ শতাংশই এসেছে এশিয়া থেকে। ২০২০ সালে এসে আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১.৩ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে গেল বছরের মার্চেই তাদের আয় ছিল ২৭০ মিলিয়ন ডলার। বাজারে আসার পর এখন পর্যন্ত তাদের মোট আয় তিন বিলিয়ন ডলার।
পাবজির এত আয়ের মূল উৎস গেমটির ইন-অ্যাপ পার্চেজ প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে একজন খেলোয়াড় অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে তার ক্যারেক্টারের জন্য নিত্যনতুন পোশাক ক্রয় করতে পারেন যা অন্যদের থেকে তাকে আলাদা রূপ প্রদান করে। শুধু পোশাকই নয়, এভাবে ক্রয় করা যায় স্কিন এবং ইমোটস।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাবজির ব্যবহারকারীর সংখ্যা যদি গড়ে প্রতিদিন পাঁচ কোটি হয়, এর মধ্যে অন্তত দেড় লাখ খেলোয়াড় ইন-অ্যাপ পার্চেজ সুবিধা গ্রহণ করেন। এতে প্রতিদিন একজন খেলোয়াড় পাঁচ ডলার করে ব্যয় করলে দেড় লক্ষ মানুষ থেকে পাবজির দৈনিক গড় আয় সাড়ে সাত লাখ ডলার। পাবজির আয়ের অন্য উৎসগুলোর মধ্যে স্পন্সরশিপ, তাদের আয়োজন করা টুর্নামেন্ট বা কনটেস্ট অন্যতম।
পাবজির আরেকটি আয়ের উৎস হচ্ছে ভয়েস ডাটা বিক্রি করা। পাবজি খেলার সময় খেলোয়াড়দের সিংহভাগই ভয়েস চ্যাট অপশনটি অন রাখেন, কথা বলেন একে অন্যের সাথে। অ্যাপটি অন্তরালে থেকে সেই চ্যাট অ্যানালাইসিস করে, জানার চেষ্টা করে আমাদের পছন্দ-অপছন্দ। তারপর সেগুলো মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয় অ্যাডভার্টাইজারদের কাছে।
এ তো গেল পাবজির নিজস্ব আয়ের কথা। পাবজিকে কেন্দ্র করেও ব্যবসার এক বিশাল সম্ভার গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী। পাবজিতে যে ইন-অ্যাপ পার্চেজ সিস্টেম আছে, সেটার জন্য দরকার হয় আননোন ক্যাশ বা ইউসি, আর সেটা কিনতে হয় অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু অনেকের কাছেই ক্রেডিট কার্ড নেই বা সে জানে না এগুলো কেনার প্রক্রিয়া। আর তাই অনেকে ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইট খুলে তাদের ইউসি প্রদান করে থাকেন অর্থের বিনিময়ে। এছাড়া অনেকেই পাবজির মডেলে কাপড় বানিয়ে, খেলনা অস্ত্র বানিয়ে ব্যবসা করছেন।
পাবজির এত বিপুল জনপ্রিয়তার পেছনের কারণ কী সেটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তাদের মতে, জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত গেমটির সামাজিকীকরণ প্রকৃতি। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন একটা গেম কীভাবে সামাজিকীকরণে ভূমিকা রাখে? পাবজি সেই প্রশ্ন উতরে গিয়েছে দারুণভাবে। পাবজিতে একসাথে অনেকে খেলেন, তারা নিজেদের সাথে কথা বলেন, চ্যাট করেন। শুধু যে তারা গেমিং সিচুয়েশন নিয়ে কথা বলেন তা কিন্তু নয়, তারা সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়েই কথা বলেন, শেয়ার করেন নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যাও। পাড়ার চায়ের আড্ডায় আমরা যেসব কথা বলি, সেটাই এখন ভার্চুয়ালি হচ্ছে গেমটিতে।
পাবজির জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ সম্ভবত এর বাস্তবসম্মত গেমপ্লে। এখানে আপনি বাস্তব পৃথিবীর মতো দৌড়াবেন, সাঁতরাবেন, জাম্প দেবেন, ড্রাইভ করবেন, ফায়ার করবেন, নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন এবং মারা যাবেন। এছাড়া গেমের পুরো ডিজাইন, যেমন- বাড়ি, আবহাওয়ার পরিবর্তন, গাছপালা, ব্রিজ সবকিছুতেই যেন মিশে আছে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি! গেমটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে এর এনগেজিং এলিমেন্ট, ডেভেলপিং ক্রিয়েটিভিটি, প্রতিনিয়ত আপডেটকরণ, সেন্ট্রালাইজড কন্ট্রোল, কিছু ফ্রি ইলেমেন্ট দিয়ে আসক্ত করে তোলা এবং সর্বোপরি এর রেভিনিউ মডেল। কমিউনিটি বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে গেমারদের কাছে এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হওয়ায় পাবজির জনপ্রিয়তা এখন আকাশচুম্বী।
সেই জনপ্রিয়তা কিংবা পাবজির আয়ের জায়গায় বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে ২০২০ সালে ভারত, চীনসহ ছয়টি দেশে পাবজির উপর নিষেধাজ্ঞা। দেশগুলো মূলত তিনটি কারণে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। প্রথমত, পাবজি শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষকে আসক্ত করে তুলছে, যার কারণে মানুষ সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছে এই গেমের পেছনে। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে গেমটি ভায়োলেন্স ছড়াচ্ছে। গেমে থাকা যুদ্ধের পরিবেশ প্রভাব ফেলছে মানুষের মনস্তত্বে। এতে মানুষের উগ্র হয়ে উঠার আশংকা জাগাচ্ছে। শেষ কারণটি হচ্ছে অ্যাপল, ফেসবুক যেমন ইউজারদের সবসময় স্ক্রিন টাইম সম্পর্কে সতর্ক করে, পাবজিতে সেই ব্যবস্থা নেই। পাবজিকে তাই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
সামনের দিনগুলোয় পাবজির জন্য অপেক্ষা করছে বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পাবজি টিম কী পদক্ষেপ নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।