ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো (ISRO) সত্যিকার অর্থেই এক চমকের নাম। সমসাময়িক অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সাথে বাজেটের দিক দিয়ে ইসরোর আকাশ পাতাল তফাৎ। কিন্তু এত কম বাজেট স্বত্ত্বেও তাদের সাফল্য সবার জন্যেই ঈর্ষণীয়। এইতো কিছুদিন আগে একটি রকেট থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক স্যাটেলাইট পাঠিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ে ফেলেছে তারা। গত ২০১৭ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ইসরোর PSLV-C37 রকেটটি একবার উড্ডয়নে ১০৪টি স্যাটেলাইটকে পৌঁছে দিয়েছে মহাশূন্যে।
এরপর সাফল্যমণ্ডিত ২০১৮ সাল পেরিয়ে, এ বছর নতুন এক মিশনের সামনে দাঁড়িয়ে সংস্থাটি। আগামী জুলাইয়ে তাদের চন্দ্রাভিযানের দ্বিতীয় প্রকল্প চন্দ্রযান-২ পরিচালনার কথা আছে। এর আগে ২০০৮ সালে চন্দ্রযান-১ প্রকল্পের মাধ্যমে চাঁদে প্রথম ছাপ রেখেছিল ভারত। ইসরোর সে ঐতিহাসিক অভিযানটির বর্ণনা রইল এখানে।
প্রথমেই প্রশ্ন আসে, আবার চাঁদে কেন? যুক্তরাষ্ট্রের নভোচারীদের চন্দ্রজয় ছাড়াও, গত কয়েক দশকে সোভিয়েত, জাপান, চীন ও ইউরোপের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলোও আন-ম্যানড (মানুষ ছাড়া) অভিযান চালিয়েছে চাঁদে। তারপরেও কেন আবার চাঁদে অভিযান চালাতে গেল ভারত? এটি কি কেবলই নিজেদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা দেখানোর জন্যে? না, বিষয়টি পুরোপুরি তা নয়। চাঁদে অনেক অভিযান হলেও, চাঁদ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্যাদি এখনো জানতে পারেনি মানুষ। সেসব অনুসন্ধানের জন্যই চাঁদের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে নতুন করে। ভারত ছাড়াও জাপান, চীন, ইউরোপ চাঁদে নতুন করে মহাকাশযান পাঠানো শুরু করেছিল। ভারতের চন্দ্রযান-১ ছিল সেই প্রচেষ্টারই অংশ।
চন্দ্রযান-১ এর বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য ছিল চাঁদের রাসায়নিক, খনিজ ও ভূতত্ত্বিক মানচিত্র তৈরি করা। তাছাড়া এটি ছিল ডিপ স্পেসে অর্থাৎ পৃথিবী থেকে এতোটা দূরত্বে ইসরোর প্রথম অভিযান। তাই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয়টি তো ছিলই। সে লক্ষ্যেই ২০০৮ সালের ৮ই নভেম্বর পৃথিবী ছেড়ে যাত্রা শুরু করে চন্দ্রযান-১।
ভারতের শ্রী-হরিকোটায় অবস্থিত সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় মহাকাশযানটিকে। উৎক্ষেপণের জন্যে ব্যবহৃত হয় ইসরোর বিখ্যাত পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (পিএসএলভি)-এর কিছুটা পরিবর্তিত সংস্করণের একটি রকেট। নভেম্বরের আট তারিখে মহাকাশযানটি চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছায়। ১৪ই নভেম্বর চন্দ্রযান থেকে মুন ইমপ্যাক্ট প্রোব (এমআইপি) নামের অংশটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরিকল্পনামতো সেটি আছড়ে পড়ে চাঁদের বুকে।
এমআইপি নামের ৩৪ কেজি ভরের এ প্রযুক্তিটি চাঁদের ভূমিতে পৌঁছানো প্রথম ভারতীয় প্রযুক্তি। এর চারপাশে অঙ্কিত ভারতের পতাকা চাঁদে পৌঁছে দেয় তাদের দেশকেও। এর থেকে পাঠানো তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করাই ছিল একে চাঁদে ফেলার উদ্দেশ্য। এতে তিনটি প্রযুক্তি ছিল, ভিডিও ইমেজিং সিস্টেম, রাডার অ্যাল্টিমিটার ও মাস স্পেক্ট্রোমিটার। মাস স্পেকট্রোমিটারটি ব্যবহৃত হয়েছিল চাঁদের বায়ুমণ্ডল পর্যালোচনার জন্যে।
এমআইপি সহ সর্বমোট ১১টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি (পে-লোড) বহন করে নিয়ে গিয়েছিল চন্দ্রযান-১। এর মধ্যে পাঁচটি ছিল সম্পূর্ণ ভারতে তৈরি। তিনটি ছিল ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি থেকে নেওয়া, যার মধ্যে একটি ইসরোর সাথে যৌথভাবে তৈরি। আর বাকি তিনটি ছিল নাসার তৈরি ইন্সট্রুমেন্ট, এর মধ্যে একটি ছিল বিখ্যাত ‘মুন মিনারোলজি ম্যাপার’ (এম-থ্রি)। এ অভিযানের এ দিকটি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলার সম্মিলনের এক চমৎকার নিদর্শন প্রকাশ করে।
সব মিলিয়ে প্রায় ১৩৮০ কেজি ভরের এ মহাকাশযানটি দেখতে অনেকটা ঘনকাকৃতির ছিল। একপাশ দিয়ে বেরিয়ে ছিল এর সোলার প্যানেল। যেটি সৌরশক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতো যন্ত্রগুলোয়। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে চার্জ ধরে রাখার জন্য।
চন্দ্রযান-১ এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল চাঁদে পানির (ওয়াটার আইস) অস্তিত্ব নির্ণয় করতে সাহায্য করা। চন্দ্রযানে করে পাঠানো নাসার এম-থ্রি এর পাঠানো তথ্য থেকে চাঁদের ভূমিতে হাইড্রোজেন-অক্সিজেন বন্ধনের প্রমাণ পাওয়া যায় (যা হাইড্রোক্সিল বা পানি নির্দেশ করে)। আরো দুটি অভিযান থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে মিলিয়ে নাসা সিদ্ধান্তে আসে যে, চাঁদে আসলেই জলজ বরফের অস্তিত্ব আছে।
যেহেতু এম-থ্রি ভূমির খুব বেশি গভীরে অনুসন্ধান চালাতে পারে না, তাই পানির অবস্থান চাঁদের পৃষ্ঠের কাছাকাছি বলেই ধরে নেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া মেরুর দিকে পানির ঘনত্ব বেশি বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পানির অবস্থান নির্ণয়ের এ তথ্য নাসা প্রকাশ করে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে। তাদের ঘোষণার পর ইসরো জানায় তাদের এমআইপি থেকে পাঠানো তথ্যেও চাঁদে পানির অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। এর আগ পর্যন্ত চাঁদে পানি থাকার বিষয়ে শক্ত কোনো প্রমাণ ছিল না।
প্রায় অর্ধশতক আগে অ্যাপোলোর নভোচারীরা ফিরে আসার সময় চাঁদ থেকে কিছু পাথর নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো বিশ্লেষণ করে খুবই স্বল্প পরিমাণ পানির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল। তখন মনে করা হয়েছিল, এগুলো চাঁদের পানি নয় বরং পৃথিবীতে আসার পর সংযোজিত হয়েছে। চাঁদ এবং পৃথিবীতে থাকা অক্সিজেনের আইসোটোপ একই হওয়ায়, চাঁদের পানি ও পৃথিবীর পানির মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন ছিল। অবশেষে ইসরোর চন্দ্রযান-১, নাসার ক্যাসিনি ও ডিপ ইমপ্যাক্ট প্রোব থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এবার শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে।
চন্দ্রগান-১ মহাকাশযানটি যখন উৎক্ষেপণ করা হয় তখন মনে করা হয়েছিল, এটি দুই বছর পর্যন্ত সচল থাকবে। কিন্তু ২০০৯ এর ২৯ই আগস্ট, মহাকাশযানটির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ইসরোর। এর আগ পর্যন্ত এটি নিয়মিত সঠিকভাবেই তথ্য পাঠিয়েছে চাঁদ থেকে। মূল্যবান সেসব তথ্যাদির কল্যাণে এ প্রকল্পের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পায়নি কেউ। সবচেয়ে অসাধারণ বিষয় ছিল এ মিশনে ভারতের ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩৮০ কোটি রুপী। যার মধ্যে ১০০ কোটি রুপী খরচ হয়েছে ইন্ডিয়ান ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক (আইএসডিএন) তৈরি করতে। এটি স্রেফ চন্দ্রযান-১ এর জন্যে নয়, কাজে আসবে ভবিষ্যতের অভিযানগুলোতেও।
মজার বিষয় হচ্ছে ২০০৯ সালে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরেও, চন্দ্রযান-১ এর গল্প যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ। ২০১৭ সালের মার্চে নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি (জেপিএল)-এর গবেষকদের রাডারে ধরা পড়ে এটি। বেচারা তখনো চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে চলছে আপন মনে। জেপিএল-এর বিজ্ঞানীরা একটি আন্তঃগ্রহ রাডার তৈরি করেছিলেন মহাশূন্যে বিকল হয়ে পড়া মহাকাশযান বা মহাকাশ বর্জ্য চিহ্নিত করতে। অপটিক্যাল টেলিস্কোপ দিয়ে এ কাজটি করা বেশ কঠিন। বিশেষত চাঁদের আশেপাশে তো আরো কঠিন, কারণ চাঁদ থেকে আসা উজ্জ্বল আলোর কারণে এই ছোটখাটো বস্তুগুলোকে চিহ্নিত করাই দুষ্কর।
সে প্রতিবন্ধকতা দূর করতেই রাডারটির উদ্ভাবন। এ রাডারটির ক্ষমতা দেখার জন্যেই চন্দ্রযান-১ কে চিহ্নিত করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। একবার কল্পনা করুন, আট বছর আগে হারিয়ে যাওয়া একটি বস্তুকে মহাকাশে খুঁজে বের করা কী দুষ্কর কাজ! তার উপর এটি ছিল বেশ ক্ষুদ্র একটি মহাকাশযান। তবে নাসার বিজ্ঞানীরা তা করতে সক্ষম হয়েছেন। পৃথিবী থেকে তিন লক্ষ আশি হাজার কিলোমিটার দূরে ঘুরতে থাকা চন্দ্রযান-এক কে খুঁজে বের করছেন তারা।
ভারতের চন্দ্র-অভিযানের সাফল্যের সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেই এ বছর তাদের নতুন প্রকল্প চন্দ্রযান-২। এ অভিযানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চাঁদে কোনো ক্ষতি এড়িয়ে মহাকাশযান ল্যান্ড করা ও চাঁদের মাটিতে একটি রোবোটিক রোভার পরিচালনা করা। আর গবেষণার দিক থেকে এর উদ্দেশ্য চাঁদের টপোগ্রাফি, খনিজ পদার্থ, বিভিন্ন পদার্থের প্রাচুর্যতা, বায়ুমণ্ডল এবং পানি ও হাইড্রক্সিলের নিদর্শন পর্যালোচনা করা। এক্ষেত্রে ইসরো কতোটা সফল হয় সেটাই এখন লক্ষণীয়।