মোটরসাইকেলের ইতিহাস নিয়ে আলোচনার সূচনাপর্বে কথা হচ্ছিল যাতায়াত ব্যবস্থায় মানুষের পরম নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠা মোটরসাইকেলের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে। একদম সূচনালগ্ন থেকে শুরু করেছিলাম আমরা। জেনেছিলাম প্রথম বাষ্পচালিত বাইসাইকেলের কথা। এরপর একে একে তিন চাকার মোটো-সাইকেল, গোতলিব ডেইমলারের রিটওয়্যাগন এবং বাণিজ্যিকভাবে মোটরসাইকেল নির্মাণের সূচনা সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে। থেমেছিলাম হার্লি-ডেভিডসন মোটর কোম্পানিতে এসে। এখন আবার ইঞ্জিন স্টার্ট করব আমরা, তবে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে।
মোটরসাইকেল রেসিংয়ের সূচনা
হার্লি-ডেভিডসন মোটর কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করেছিল ১৯০৩ সালে। কিন্তু তার বছর দুই আগেই, ১৯০১ সালে ইংলিশ বাইসাইকেল প্রস্তুতকারক রয়্যাল এনফিল্ড অভিষেক ঘটায় তাদের প্রথম মোটরসাইকেলের। সামনের চাকায় চালিত বাইক ছিল সেটি। আর সামনের দিকে উঁচু হয়ে থাকা ২৩৯ সিসি ইঞ্জিনটির সাথে একটি বেল্টও সংযুক্ত ছিল। ওই একই বছর যুক্তরাষ্ট্রে ইন্ডিয়ান মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি নকশা তৈরি করে প্রথম ডায়মন্ড ফ্রেমের মোটরসাইকেলের। সেটির নাম রাখা হয় ইন্ডিয়ান সিঙ্গেল। প্রথম বছরে ৫০০টি ইন্ডিয়ান সিঙ্গেল বাজারে এসেছিল। আর ১৯১৩ সাল নাগাদ বছরে ২০,০০০টি করে বাইক তৈরি করতে থাকে তারা।
কয়েক বছরের মধ্যে বাজারে যখন রয়্যাল এনফিল্ড, ইন্ডিয়ান সিঙ্গেল আর হার্লি-ডেভিডসনের মোটরসাইকেলের জোর প্রতিযোগিতা শুরু হলো, ঠিক সেই সময়টাতেই শুরু হলো সংগঠিত মোটরসাইকেল রেসিংয়ের। রেসারদের চাহিদা মেটাতে মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারীরাও আরও শক্তিশালী ইঞ্জিন ও সুবিধাজনক নকশার মোটরসাইকেল নির্মাণ করতে শুরু করল। অর্থাৎ বিষয়টা অনেকটা এমন যে, মোটরসাইকেল রেসিং-ই মোটরসাইকেলের ক্রমোন্নতিকে ত্বরান্বিত করে যাচ্ছিল। তাই আজকের সকল বাইকারদের কাছ থেকে ধন্যবাদ প্রাপ্য সেই রেসারদের, কারণ তাদের অনুপস্থিতিতে মোটরসাইকেলের উন্নয়নের চাকা কিন্তু অনেকটাই স্থবির হয়ে যেত।
বিশ্বযুদ্ধে মোটরসাইকেলের ভূমিকা
প্রাচীনকালে ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধের ময়দানে হাজির হতো সৈন্যরা। কালের বিবর্তনে ঘোড়ার প্রয়োজনীয়তা বা কার্যকারিতা ফুরিয়ে যায়, তার জায়গায় আরও অনেক আধুনিক প্রযুক্তির মতো হাজির হয় মোটরসাইকেলও। যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যরা সবসময় মোটরসাইকেলে চেপে উপস্থিত হতো না বটে, তারপরও দুটি বিশ্বযুদ্ধেই অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিল মোটরসাইকেল। এর প্রধান কারণ, মোটরসাইকেলের দ্রুতগতি ও ছোট আকার, যে কারণে শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে খুব সহজেই গোপন তথ্য বা বার্তা নিয়ে এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে যাওয়া যেত। যুদ্ধক্ষেত্রে জ্যামিং কিংবা খারাপ আবহাওয়ার জন্য রেডিও সিগনাল যখন দুর্বল হয়ে যেত, তখনও যোগাযোগের সেরা মাধ্যমে পরিণত হতো মোটরসাইকেল।
হার্লি-ডেভিডসন কোম্পানি তো তাদের কারখানার ৫০%-ই ব্যয় করতে শুরু করেছিল যুদ্ধের জন্য উপযোগী মোটরসাইকেল নির্মাণে। আর কেবল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্যই ট্রায়াম্ফ মোটরসাইকেলস তাদের নব্যনির্মিত টাইপ এইচ বাইকের ৩০,০০০ ইউনিট দান করেছিল মিত্রশক্তিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি দুই পক্ষই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল নতুন নতুন মডেলের মোটরসাইকেল ব্যবহার করে নিজেদেরকে এগিয়ে রাখতে। যুদ্ধের প্রাক্কালে শুধু ইংল্যান্ডেই ৩০টি আলাদা মডেলের মোটরসাইকেল ছিল। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক দশকেরও বেশি সময় আগেই, ১৯২৮ সালে আমেরিকান ব্র্যান্ড ইন্ডিয়ান মোটরসাইকেলস ও হার্লি-ডেভিডসনকে পেছনে ফেলে বিশ্বের এক নম্বর মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছিল জার্মান মোটরসাইকেল কোম্পানি ডিকেডব্লিউ।
বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপে ভিন্ন চিত্র
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মোটরসাইকেলের বিবর্তন আমেরিকা ও ইউরোপে একদমই বিপরীতভাবে ঘটতে থাকে।
যুদ্ধের পর আমেরিকার ওয়ার ভেটেরান বা যুদ্ধে অংশ নেওয়া সৈন্যরা যখন দেশে ফিরে আসেন, যুদ্ধে মোটরসাইকেল ব্যবহারকে তারা গৌরবমণ্ডিত স্মৃতি বলে মনে করতে শুরু করেন। এজন্য তাদের কাছে আকারে বড়সড়, দ্রুতগতির মোটরসাইকেল অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের দেখাদেখি তরুণ প্রজন্মের কাছেও এধরনের মোটরসাইকেল সেসময়কার ট্রেন্ডে পরিণত হয়।
মানুষের চাহিদা অনুযায়ী আমেরিকান মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও এধরনের মোটরসাইকেল নির্মাণে বেশি মনোযোগী হয়। এ সময় আমেরিকায় ওয়ার ভেটেরানদের উদ্যোগে অসংখ্য মোটরসাইকেল ক্লাবও গড়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালে মার্লন ব্র্যান্ডোর ‘দ্য ওয়াইল্ড ওয়ান’ ছবিতে এসব মোটরসাইকেল ক্লাব দেখানো হলে, এদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে থাকে। সব মিলিয়ে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আমেরিকায় মোটরসাইকেল যতটা না কাজের জিনিস ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল গৌরব ও আভিজাত্যের প্রতীক।
এদিকে ইউরোপীয়রা বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মোটরসাইকেল ব্যবহারে বাস্তব প্রয়োজনীয়তাকে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে। তাদের কাছে মোটরসাইকেলের গতি বা নকশার চেয়ে কার্যকারিতা ও সহজে পরিবহন সম্ভব কিনা, এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পেতে থাকে। মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও তাই চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে কীভাবে একে আরো বেশি কার্যকর ও সুবিধাজনক করে তোলা যায় সেটি নিয়ে। আর এভাবেই ইতালি ও যুক্তরাজ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মোপেড। বলে রাখা ভালো, মোপেড হলো আকারে ছোট একধরনের মোটরসাইকেল, যাতে বাইসাইকেলের মতো প্যাডেল থাকে।
জাপানের আধিপত্য
মোটরসাইকেলের ইতিহাসের শুরুতে রাজত্ব ছিল কেবল আমেরিকান ও ইউরোপীয়দের। সে তুলনায় এশীয়রা অনেকটা পিছিয়েই ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সে ব্যবধান ক্রমশ কমতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজিত পক্ষ হওয়া সত্ত্বেও, মোটরসাইকেল প্রস্তুতে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে যায় এশিয়ার উদিত সূর্যের দেশ জাপান। আর যে ব্যক্তির বদৌলতে তা সম্ভব হয়, তিনি হলেন সইচিরো হোন্ডা।
তাকেও ফুজিসাওয়াকে সাথে নিয়ে ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে হোন্ডার হাত ধরে পথচলা শুরু হয় একটি মোটরসাইকেল ও অটোমোবাইল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের। নিজের নামে সেই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ তিনি করেন ‘হোন্ডা’। মাত্র এক যুগের কিছু সময় পরই, ১৯৫৯ সালে হোন্ডা পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে। সেই থেকে বিগত ৬০ বছরে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে এটি। এছাড়াও ২০০১ সাল থেকে জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম অটোমোবাইল প্রস্তুতকারক, এবং ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম অটোমোবাইল প্রস্তুতকারকও হোন্ডাই। সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় মোটরসাইকেলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘হোন্ডা সুপার কাব’, যেটি ৬ কোটিরও বেশি ইউনিট বিক্রি হয়েছে এখন পর্যন্ত।
মোটরসাইকেলের রাজত্বে হোন্ডা একাই জাপানের প্রতিনিধিত্ব করছে না। ১৯৬০ এর দশকেই আবির্ভাব ঘটে আরও বেশ কিছু বিশ্বমাতানো জাপানী মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারকের। সেগুলোর নাম আপনারা সকলেই জানেন- সুজুকি, কাওয়াসাকি এবং ইয়ামাহা। শীর্ষস্থানে তো হোন্ডা ছিলই, পাশাপাশি এই তিনটি প্রতিষ্ঠান যোগ হওয়ায় মোটরসাইকেল নির্মাণে বাকি গোটা বিশ্বের থেকে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে যায় জাপান। ফলে অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, ইউরোপে একসময় সম্ভাবনা জাগিয়েছিল এমন বেশ কিছু কোম্পানিও তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
৬০ এর দশকে মোটরসাইকেলের সোনালী সময়
একটা সময় পর্যন্ত বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের মনেই মোটরসাইকেল ও এর আরোহীদের সম্পর্কে ভুল ধারণা ছিল। অনেকে তো এমনও মনে করত, সভ্য সমাজের ভদ্রলোকেরা কখনো মোটরসাইকেলে চড়ে না। এর ফলে এত এত সুবিধা সত্ত্বেও, সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারছিল না মোটরসাইকেল। এই অবস্থার পরিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে হোন্ডা। তারা শুরু করে “You Meet the Nicest People on a Honda” শীর্ষক উদ্ভাবনী এক ক্যাম্পেইন। ফলে ধীরে ধীরে মোটরসাইকেলের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা জাগতে থাকে সর্বসাধারণের মনে।
১৯৬৫ সাল নাগাদ মোটরসাইকেলের দুনিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলে বিভিন্ন কাস্টম মোটরসাইকেল। নতুন নতুন স্টাইল ও কাস্টম পেইন্টের সমন্বয়ে নির্মিত মোটরসাইকেলগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে সে সময়টাতে। বেশ কয়েকবছর এ জনপ্রিয়তা টিকে ছিল। তবে সেক্ষেত্রে আবারো পরিবর্তন নিয়ে আসে হোন্ডা। ১৯৬৯ সালে তারা বাজারে আনে চার সিলিন্ডার বিশিষ্ট মোটরসাইকেল, যেটি কিনা ইতিহাসের প্রথম ‘সুপার বাইক’। মোটরসাইকেলের এ জয়যাত্রা অব্যহত থাকে, এবং ১৯৭০ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই তৎকালীন রেকর্ড ৫০ লক্ষ মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়।
৭০ এর দশকের হোঁচট
সব ভালো সময়েরই শেষ আছে। ব্যতিক্রম নয় মোটরসাইকেলের দুর্দান্ত জনপ্রিয়তারও। একসময় যে জনপ্রিয়তাকে মনে হচ্ছিল কখনো কমার নয়, সেটিই কিনা ৭০ এর দশকের শেষ নাগাদ তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
১৯৬২ সালে মূলত ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি ছিল, এবং তারা সুলভমূল্যের ৫০-৪৫০ সিসি মোটরসাইকেল নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু ৭০ এর দশক যখন শেষের দিকে, ১৯৬২ সালের সেই তরুণ ও যুবকেরাই হয় শুরু করতে যাচ্ছিল তাদের নিজেদের পরিবার, জীবনে আনতে চাইছিল স্থিতাবস্থা, কিংবা প্রতিপালন করতে শুরু করেছিল তাদের নিজেদের সন্তান। রোমাঞ্চের প্রতি তাদের একসময়কার মোহ তখন কেটে যেতে শুরু করে, আর এর ফলে ১৯৭৮ সাল থেকে বিক্রি কমতে শুরু করে মোটরসাইকেলের।
মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারীরা তখন বুঝে উঠতে পারছিল না, নতুন প্রজন্ম কেন মোটরসাইকেলের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে না। তাই তারা ক্রুজার, ট্যুরার কিংবা স্পোর্ট বাইকের মতো নতুন নতুন ডিজাইনের মোটরসাইকেল বাজারে আনতে শুরু করেছিল। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হচ্ছিল না। বাজারে যত নতুন নতুন মোটরসাইকেলই আসুক না কেন, সেগুলো জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছিল। এ কারণেই ১৯৮০-১৯৮৮ পর্যন্ত খুব জনপ্রিয় কোনো মোটরসাইকেল মডেলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
সুসময়ের ফিরে আসা
১৯৮০’র দশকের একেবারে শেষভাগে এসে আবারো হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে থাকে মোটরসাইকেল। এর কারণ, ১৯৬২ সালের ‘বেবি বুমার’রা মধ্যবয়সে পৌঁছে মোটরসাইকেলের প্রতি নতুন করে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ওদিকে নতুন প্রজন্মও দেরিতে হলেও মোটরসাইকেলের মায়ায় আবদ্ধ হয়। তাই দীর্ঘদিন ধরে বাজার মাত করতে ব্যর্থ ক্রুজার ও স্পোর্টস বাইকই হঠাৎ করে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সীদের কাছে যেহেতু গতির চেয়ে আভিজাত্য ও বিলাসিতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাই তারা ক্রুজারকে বেছে নিতে থাকে। ওদিকে তরুণ প্রজন্মের রক্ত খানিকটা গরম থাকায়, তাদের চোখ পড়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন স্পোর্টস বাইকের দিকেই। তবে মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তার এই নবজন্মের সময়েও বাজারে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নতুন মডেল আসেনি।
জাপানের একচেটিয়াত্ব খর্ব
১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় তিন দশক যাবত মোটরসাইকেলের জগতে একতরফা প্রভাব বিদ্যমান ছিল জাপানের। কিন্তু এরপর আমেরিকান ও ইতালিয়ান মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারকরা বাজার সম্প্রসারণ করলে, জাপানের একচেটিয়াত্ব কিছুটা হলেও খর্ব হয়। ৮০’র দশকের শেষ দিকে নতুন করে মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায়, বাজারে প্রত্যাবর্তন ঘটে বিএমডব্লিউ, দুকাটি, আপ্রিলা ও ট্রায়াম্ফের মতো কোম্পানিগুলোর।
একুশ শতকের শুরুতে মোটরসাইকেল
গত শতকের শেষদিকে প্রতিযোগিতা বেড়ে যায় বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও মোটরসাইকেল বিশ্বকে শাসন করতে থাকে জাপানের হোন্ডা, কাওয়াসাকি, সুজুকি ও ইয়ামাহা- এই প্রতিষ্ঠানগুলোই। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এসময়েও নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখে হার্লি-ডেভিডসন। এর পেছনে আমেরিকানদের স্বদেশপ্রেম নিঃসন্দেহে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে।
এছাড়া নতুন শতাব্দীতে এসে বিএমডব্লিউ, ট্রায়াম্ফ ও দুকাটিও নির্দিষ্ট সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলতে শুরু করে। গত শতকের একদম শেষদিকে পথচলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ভিক্টোরি। তারাও দেড়যুগ ধরে বেশ ভালো সম্ভাবনা জাগিয়ে চলেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০১৭ সালে থেকে থেমে যায় তাদের যাত্রা।
মোটরসাইকেলে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া
এ কথা সত্য যে, সেই ১৯৮০’র দশকের গোড়ার দিকেই কাওয়াসাকি উদ্ভাবন করেছিল ফুয়েল ইনজেক্টেড মোটরসাইকেল। কিন্তু তখনো বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি এতটা উন্নতি করে উঠতে পারেনি যে হরহামেশাই ফুয়েল ইনজেক্টেড মোটরসাইকেলের দেখা পাওয়া যাবে। তবে চলতি শতকের শুরু থেকে এমন মোটরসাইকেলের বহুল প্রচলন শুরু হয়েছে। ২০০৬ সালের নভেম্বরে ডাচ মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক ইভিএ প্রোডাক্টস বিভি ঘোষণা দেয় ডিজেল পরিচালিত প্রথম বাণিজ্যিক মোটরসাইকেল ট্র্যাক টি ৮০০ সিডিআই আনার। এছাড়াও ২০০৯ সালে ইকো ভেহিকলের মাধ্যমে ভারতের বাজারে আসে ইতিহাসের প্রথম হাইব্রিড মোটরসাইকেল, ইটি-১২০। ২০১৮ সালে হার্লি-ডেভিডসন ঘোষণা দিয়েছে যে চলতি বছরে, অর্থাৎ ২০১৯ সালে তারা বাজারে আনবে নতুন ধরনের ইলেকট্রিক বাইক।
উন্নয়নশীল বিশ্বে মোটরসাইকেল
উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোও নিজেদের জনগণের উপযোগী, স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি সাশ্রয়ী মূল্যের কিন্তু টেকসই মোটরসাইকেল নির্মাণের চেষ্টা করে আসছে। এমন কিছু প্রতিষ্ঠান এখন বিশ্বের পরিণত বাজারেও প্রবেশের যোগ্যতাও অর্জন করেছে।
উন্নয়নশীল বিশ্বে মোটরসাইকেল ট্যাক্সি কিংবা বাইক রাইড শেয়ারিংও দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষত যেসব শহরে যানজট অত্যধিক বেশি, সেখানে যাতায়াতের জন্য চার চাকার গাড়ি কিংবা গণপরিবহনের চেয়ে মোটরসাইকেলই বেশি কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। কিন্তু সবার পক্ষে যেহেতু মোটরসাইকেল কেনা সম্ভব নয়, তাই তারা বিকল্প পন্থা হিসেবে বেছে নিচ্ছে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ভাড়া করা মোটরসাইকেল, যা তাদেরকে কম খরচে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছে। এবং এধরনের মোটরসাইকেল ট্যাক্সি বা রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে অনেক নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে; ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমছে, আবার অনেকে ফরমাল সেক্টরের বাইরে পার্ট-টাইম হিসেবে উপার্জনের রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে মোটরসাইকেল
আজকের বিশ্বে মোটরসাইকেলের সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্রটি হলো ভারত। ভারতে এই মুহূর্তে প্রতিদিন ৩.৭০ কোটি মোটরসাইকেল রাস্তায় নামে। ১৯৫৫ সালে যুক্তরাজ্য থেকে মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) আনা হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য রয়্যাল এনফিল্ড ইউকে কোম্পানির ৩৫০ সিসি বুলেট মোটরসাইকেল। সেটিই ছিল ভারতের প্রথম মোটরসাইকেল। কিন্তু তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের কাছে মোটরসাইকেলের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে হোন্ডা শব্দটি।
এই উপমহাদেশে মোটরসাইকেলের সমার্থক হিসেবে হোন্ডা শব্দটিকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে রয়েছে হিরো মোটোকর্পের অবদান। ভারতের হিরো সাইকেলস এবং জাপানের হোন্ডা কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে ১৯৮৪ সালে পথচলা শুরু হয়েছিল হিরো হোন্ডার। টু হুইলার (মোটরসাইকেল ও স্কুটার) নির্মাণ শুরু করেছিল তারা। ২০১০ সালে যৌথ উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে যায় হোন্ডা, আর হিরো গ্রুপ কিনে নেয় হোন্ডার শেয়ার। এতে করে হিরো গ্রুপের লাভই হয়েছে। যৌথ উদ্যোগ থাকাকালীন নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা বাদে অন্য কোনো দেশে মোটরসাইকেল রপ্তানি করতে পারত না তারা। কিন্তু হোন্ডার সাথে বিচ্ছেদের পর তারা বিশ্বের যেকোনো দেশে রপ্তানি করতে পারছে। আর এর মাধ্যমে তারা পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টু হুইলার প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে। এছাড়া ভারতের বাজারের ৪৬% দখল রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশেও এখন তুমুল জনপ্রিয় হিরো মোটরসাইকেল।
শেষ কথা
যাতায়াত ব্যবস্থায় এই মুহূর্তে গাড়ির পরেই মোটরসাইকেলের অবস্থান। প্রতিদিন ৫৯ কোটি গাড়ির পাশাপাশি রাস্তায় নামে ২০ কোটি মোটরসাইকেলও। এ থেকে খুব সহজেই বোঝা যায়, পৃথিবী নামক এই গ্রহে মোটরসাইকেলের কী আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা! এ জনপ্রিয়তা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে শত বছরের ইতিহাসও। এবং এ কথাও নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দ্রুত গতিতে চলাচল আর আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে মানুষের যান্ত্রিক ডানার মতো অভাবনীয় কিছু আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত একবিন্দুও কমবে না মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তা।