১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের সময়ের এমআইটির একদল ছাত্র-ছাত্রী পুরো পৃথিবীর প্রযুক্তি জগতকেই চিরতরে পাল্টে দিয়েছিল। হ্যাকিং নিয়ে আজকের পৃথিবীতে যে উন্মাদনা, তার শুরুটা হয়েছিলো তাদের হাত ধরেই। নিছক বিনোদন কিংবা বিখ্যাত হওয়ার জন্য তারা যে কাজগুলো করেছিল তাই পরবর্তীতে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। তাদেরকে বলা হয় আধুনিক হ্যাকিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা, আধুনিক হ্যাকারদের পূর্বপুরুষ।
‘কম্পিউটারের বিবর্তন, হ্যাকারদের বিবর্তন‘ শিরোনামে এটি রোর বাংলায় দ্বিতীয় লেখা। প্রথম লেখাটিতে ১৮৭০ থেকে ১৯৬০ সালের আগের সময় পর্যন্ত কম্পিউটার এবং হ্যাকিংয়ে দুটোর ইতিহাসটুকু সমান্তরালে সংক্ষিপ্তভাবে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। পুরো ব্যাপারটি চট করে বুঝে ফেলা হয়তো খুব সহজ নয়। কারণ ওই সময়ের কম্পিউটার এবং হ্যাকিংয়ের ধারনা এখনকার মতো ছিলো না।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (Massachusetts Institute of Technology) বা সংক্ষেপে এমআইটি (MIT) বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। বলা যায় ১৯৬০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই সর্বপ্রথম হ্যাকার শব্দটির উৎপত্তি হয়। আর সেই সময়ের এমআইটির আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজন্স ল্যাবটি (MIT Artificial Intelligence Lab অথবা MIT AI Lab) ছিল এই সমস্ত ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু।
তখন এই ল্যাবে খুবই দক্ষ একদল প্রোগ্রামার ছিল। তারা FORTRAN প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে নানা রকম উচ্চমানের প্রোগ্রাম তৈরি করত। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি- FORTRAN হলো লো লেভেল থেকে হাই লেভেলের মাঝামাঝি একটি প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ যা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গণনাকার্যে ব্যবহৃত হতো। FORTRAN-কে আসলে হাই লেভেলের ল্যাংগুয়েজ হিসেবেই ধরা হয়। হাই লেভেলের ল্যাংগুয়েজগুলোর সাহায্যে খুব বড় একটি কাজ অনেক অল্প পরিশ্রমে করে ফেলা যায়। যেমন- Python, Visual Basic, Delphi, Perl, PHP, ECMAScript, Ruby, Lisp এগুলো হলো হাই লেভেল প্রোগ্রামিং ভাষা। আর লো লেভেল ল্যাংগুয়েজগুলোতে খুব অল্প কিছু কাজ করতে অনেক পরিশ্রমের দরকার হয়, অনেক বড় বড় সাইজের কোড লিখতে হয়। সেই সময়টাতে তারা আরও অনেকগুলো প্রোগ্রামিং ভাষাতে পারদর্শী ছিল, যেগুলো ছিল FORTRAN এর চেয়েও পুরোনো এবং আরও লো লেভেলের দিকের।
এতকিছু বলার কারণ হলো যাতে এমআইটির সেসব হ্যাকারদের প্রোগ্রামিং জ্ঞান নিয়ে কারও কোনো প্রকার সন্দেহ না থাকে। হ্যাকিংয়ের কথা আসলে সেখানে প্রোগ্রামিংও থাকবে। কারণ কোনো কিছু হ্যাক করতে গেলে সেখানে কোড তো লিখতেই হবে। কিন্তু এই ব্যাপারটা তখনকার সময়ে সত্যি ছিল না। তখনকার হ্যাকাররা সফটওয়্যারের চেয়ে হার্ডওয়্যার নিয়েই বেশী ব্যস্ত ছিল।
সেই সময়ে কিন্তু কম্পিউটারের অলিগলি সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল খুবই কম। এমনকি সেটা এমআইটির মতো বিখ্যাত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাকি সবাই যখন বিকালে মাঠে খেলাধুলা করতে ব্যস্ত ছিল, তখন এই সকল তরুণ-তরুণীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলোতে কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকতো। এই কারণে তাদেরকে Nerds অথবা Geeks বলে ঠাট্টা করতো সবাই। কিন্তু ল্যাবের ডিরেক্টর মারভিন মিনস্কি ঠিকই বুঝতে পারতেন তাদের প্রতিভা। তাই ল্যাবের সকল প্রকার যন্ত্রাংশ ব্যবহারে তাদের অনুমতি দেন তিনি। যদিও এদের মধ্যে অনেক হ্যাকারই আসলে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী, হ্যাকিংয়ে অনেক বেশী সময় দেওয়ার কারণে গতানুগতিক ধারার পড়াশুনা তাদের দিয়ে সম্ভব হতো না। এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোনোও তাদের দিয়ে সম্ভব হয়নি। এতক্ষণে হয়ত আমাদের এরকম ধারণা হয়েছে যে, আমাদের আজকের হ্যাকাররা খুবই ভদ্রগোছের, তারা শুধু প্রোগ্রামিং ছাড়া আর কিছু করতো না। আমাদের ধারণা যে কতটা ভুল সেটা আরেকটু পরেই বোঝা যাবে।
টেলিফোন তখন যোগাযোগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। আর টেলিফোন কোম্পানী ছিল তাদের অন্যতম টার্গেট। তারা অনেক সময় ব্যয় করে টেলিফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় কল করতে লাগল শুধুমাত্র কিছু প্যাটার্ন খুজে পাওয়ার জন্য যা দিয়ে বোঝা যায় কীভাবে টেলিফোন সিস্টেম কাজ করে। বিভিন্ন জায়গার কলের টোন প্যাটার্ন বিশ্লেষন করে তারা বুঝতে পারলো কীভাবে কলগুলো রাউটিং (route) করা হয়। টেলিফোন কোম্পানীগুলোর গোপন জার্নালগুলো থেকে তারা টেলিফোন অপারেটর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতো। তাদের ডাস্টবিন ঘেটে দেখতো কোনো ডকুমেন্ট পাওয়া যায় কিনা যা তাদের কাজে লাগতে পারে। তারপর রাতের বেলা গোপনে টেলিফোন কোম্পানীর বিল্ডিংয়ে ঢুকে তাদের টেলিফোন লাইনগুলো সেখানে লাগিয়ে দিয়ে আসতো।
তারা বেশকিছু ডিভাইস তৈরি করেছিল যেগুলোকে বলা হয় Blue boxes, Black boxes এবং Red boxes। এই ডিভাইসগুলো তাদের সৃষ্টিশীলতার অনন্য নিদর্শন। এগুলো ব্যবহার করে ফ্রি ফোন কল করা যেত। এছাড়া যেগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কল, সেগুলোকে থামিয়ে রাখা এবং একজনের কল অন্য একজনকে দিয়ে দেয়া এধরণের অনেক কাজ করা যেত ঐ ডিভাইসগুলো দিয়ে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ফোন ফ্রিকিং (Phone Phreaking)। পুরো ব্যপারটিই আসলে যথেষ্ট বে-আইনি, অনেকটা চুরি-চামারিও বলা যায়। অবশ্য হ্যাকিং তো চুরি-ডাকাতির মতো ব্যাপারই অনেকটা। বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষও এইসব হ্যাকারদের কর্মকান্ডকে কখনো সমর্থন করতো না। কিন্তু পুরো ব্যাপারটির সাথে একধরণের সৃষ্টিশীলতার ব্যাপার আছে। তাই তারা এগুলো থামানোর চেষ্টাও করে নি। এভাবেই এমআইটিতে গড়ে ওঠে একধরণের হ্যাকিং কালচার যা পরবর্তীতে স্ট্যানফোর্ড, ইয়েল, হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক প্রকার প্রতিযোগিতা লেগেই থাকতো। ঠিক এই কারণেই বার্ষিক হার্ভার্ড-ইয়েল ফুটবল খেলাতে হ্যাকাররা এসে হানা দিত। তারা হ্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে যেসব নৈপুণ্য প্রদর্শন করতো সেগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত হ্যাকিংয়ের ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম বলা যায়।
এটি শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের হার্ভার্ড-ইয়েল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ থেকেই। খেলা শুরুর আগের দিন রাতে বেশকিছু হ্যাকার হার্ভার্ড স্টেডিয়ামের মাঠের ভিতর ঢুকে প্রাইমার কর্ড (Primer cord) মাটির ভিতর পুঁতে রেখেছিল। তারা আসলে মাঠে “MIT” শব্দটি বড় করে লিখতে চেয়েছিল ওই কর্ডগুলো বিস্ফোরিত করে। যদিও তাদের এই পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। খেলা শুরুর দিন তারা খুব ভারী ব্যাটারী লাইনড পোশাক পরে মাঠে এসেছিল, যদিও ঐ দিনটি ছিল বেশ রৌদ্রজ্জ্বল। তারা তাদের সেই পোশাকের ভিতর অনেকগুলো ব্যাটারী এনেছিল ওই কর্ডগুলোকে বিস্ফোরিত করার জন্য। ব্যাপারটি বেশ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় মাঠের কর্মীরা তাদেরকে ধরে ফেলে। যদিও এমআইটির ডিন ঐসব হ্যাকারদের পক্ষ অবলম্বন করে বলেছিলেন যে, এমআইটির অনেকেই এধরনের যন্ত্রপাতি সাথে নিয়ে ঘোরাফেরা করে। এগুলো আসলে আমাদের মতো যারা প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, তাদের সব সময় কাজে লাগে। কিন্তু তার এই যুক্তি যে শেষপর্যন্ত খুব একটা কাজে আসেনি তা বোঝাই যায়।
এর অনেক পরে ১৯৮২ সালের হার্ভার্ড-ইয়েল ফুটবল খেলাতে এমআইটির হ্যাকাররা অবশ্য সফল হয়। খেলা শুরুর পর হঠাৎ দেখা গেল মাঠের ভিতর একটি বেলুন এবং সেটি ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। সেই বেলুনে বড় বড় করে লেখা ছিল “MIT”। একসময় বড় হতে হতে বিকট শব্দে বেলুনটা ফেটে গেল। আর গ্যালারী থেকে এমআইটির শিক্ষার্থীদের উল্লাস। গ্যালারীতে হার্ভাডের শিক্ষার্থীদের অংশে অবশ্য তখন পিনপতন নীরবতা, আয়োজকরাও হতভম্ব।
পরেরদিন Boston Herald পত্রিকা এরকম একটি শিরোনাম করে “MIT 1 — Harvard-Yale 0: Tech Pranksters Steal the Show”। এই পুরো ব্যাপারটির জন্য তারা একসপ্তাহ ধরে গোপনে মাঠে এসে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বসানোর কাজ করছিল। তারা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার মোটর এবং হাইড্রলিক প্রেসের মতো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিল।
এরপর ১৯৯০ সালেও এই একই চ্যাম্পিয়নশীপে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় একটি ফ্রি কিক নিতে যাবে এমন সময় এমআইটির হ্যাকাররা কীভাবে যেন “MIT” লেখাযুক্ত একটি ব্যানার মাঠে নিয়ে আসেন! ১৯৯৬ সালের খেলার হার্ভার্ডের স্কোরবোর্ড হ্যাক করা হয়। সেখানে লেখা ছিল VE-RI-TAS। এর পরিবর্তে লিখে দেওয়া হয় HU-GE-EGO মানে huge ego। অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাতে এভাবে বিঘ্ন ঘঠানোটা তাদের জন্য যে বেশ উপভোগ্য ছিল তা বোঝাই যাচ্ছে।
এমনও ঘটনা শোনা যায় যে একবার একদল শিক্ষার্থী পাখিদের খাবার হার্ভার্ডের মাঠে ছড়িয়ে রেখে যায়। হার্ভাডের ওই মাঠটাতে সেইদিন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা খেলা ছিল। কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে বেচারাদের খেলা পন্ড করে দেয়। ব্যাপারটা গুজবও হতে পারে অবশ্য। এমআইটির হ্যাকারদের নিয়ে এতই গুজব ছিল যে, কোনটা তারা করেছে আর কোনটা যে করেনি সেটা বোঝাটাই কষ্টকর হয়ে যেত। একবার তারা কোনো একটি বিখ্যাত পত্রিকার রিপোর্টারকে বলল যে, তারা একটি বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রুমের ভিতর কৃত্রিম তুষারপাত সৃষ্টি করেছে। বেচারা রিপোর্টার তাদেরকে বিশ্বাস করে পত্রিকায় খবর ছেপে দিল। পরে দেখা গেল পুরো ব্যাপারটিই আসলে নির্জলা মিথ্যা।
এমআইটির হ্যাকারদের পাগলামি এখানেই শেষ না। কিন্তু সবকিছু বলার মতো একটি লেখা যথেষ্ট নয়। পরের পর্বের জন্য পরের অংশটি রেখে দিলাম।