Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যাশমুক্ত অর্থনীতি: অর্থব্যবস্থায় চীনের নয়াদিগন্তের সূচনা

বেইজিংয়ের রাস্তায় একটি প্ল্যাকার্ড দেখা যাচ্ছে, তাতে লেখা, “উইচ্যাটের মাধ্যমে ভিক্ষা দিন!” পাশে করুণ মুখে বসে আছে এক ভিক্ষুক, একটি স্মার্ট ফোন হাতে! বছর কয়েক আগে মুদি দোকানগুলো থেকে হ্যান্ডবিল বিলি করা হতো, “মূল্য পরিশোধ করুন আপনার স্মার্টফোন ব্যবহার করে” ইত্যাদি লেখা ছেপে।

চীনের নিয়মিত দৃশ্য এসব। প্রাচ্যের সিলিকন ভ্যালি হিসেবে খ্যাত শেনজেন শহরটি হয়তো কাগুজে অর্থকে মান্ধাতার আমলের কাতারে ফেলে দিয়েছে। হংকংয়ের নিকটতম প্রতিবেশী হলেও সেখানকার অধিবাসীদের থেকে বিস্তর ফারাক এরা তৈরি করেছে জীবনযাত্রার মাত্র একটি দিক আমূল বদলে দিয়ে। সেখানকার মানুষেরা এখন দৈনন্দিন কাজে একেবারেই নগদ অর্থ ব্যবহার করছে না। কিছু হয়তো সঙ্গে করে রাখছে গুরুতর কোনো সংকটের কথা চিন্তা করে, তবু সেগুলো পকেটে পড়ে থাকছে মাসের পর মাস।অর্থাৎ, যে ক্যাশলেস অর্থব্যাবস্থাকে আমরা ভবিষ্যতের অর্থব্যবস্থা হিসেবে ভেবেছিলাম, চীনে তা এখন বর্তমান।

বেইজিংয়ের রাস্তার এই ভিক্ষুক পথচারীদের নিকট ভিক্ষার বাটির বদলে বাড়িয়ে দেন তার স্মার্টফোন, কিউ আর স্ক্যান করলেই মোবাইল ওয়ালেটে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা হয়ে যায় © The Wall Street Journal

ক্যাশের সাথে সাথে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে ক্রেডিট কার্ডভিত্তিক লেনদেনও। স্মার্টফোনের যে বিপ্লব গত দশকে হয়ে গিয়েছে, কেবল তারই সুবিধা ভোগ করছে চীন। ‘সুবিধা ভোগ করছে’ কথাটি বলা বোধ হয় ঠিক হলো না, স্মার্ট ফোনের এই বিপ্লবে চীনের অবদান কিছু কম নয়।

শুধুমাত্র মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তারা তাদের যাবতীয় অর্থনৈতিক লেনদেন করছে। এজন্য হাজার হাজার অ্যাপ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ছে না তাদের, মাত্র দুটি মেগা অ্যাপ তাদের দৈনন্দিন সকল চাহিদা পূরণ করছে। যেখানে চীন ফেসবুকের মেসেঞ্জারকে রেখেছে কড়া নজরে, হোয়াটস অ্যাপকে নিষিদ্ধ করেছে গত বছর, দক্ষিণ কোরীয় ‘লাইন’ অ্যাপকে নিষিদ্ধ করেছিল ২০০৯ সালে; সেই চীন সরকারই কিনা দুটি চীনা অ্যাপের উপর ভরসা রাখছে তাদের নয়া এই অর্থনীতি নির্মাণে! তাই টেনেসন্টের ‘উইচ্যাট’ এবং অালিবাবার ‘আলিপে’ হয়ে উঠেছে চীনের মানুষের ইলেক্ট্রনিক ওয়ালেট।

ব্যক্তিগত কাজে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার দিন দিন কমিয়ে আনছে চীন © The Wall Street Journal

চীনে সাধারণ ক্যাফে বা মুদিখানায় ক্যাশ বা ক্রেডিট কার্ডে বিল পরিশোধ করার উপায়টিই থাকছে না এখন। বিল যতই নগণ্য হোক বা বিশাল, আপনাকে অ্যাপ দুটির মাধ্যমে ‘কিউ আর কোড’ স্ক্যান করে তবে বিল পরিশোধ করতে হবে। ফলত দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ২০১৬ সালে মোবাইলের মাধ্যমে সমগ্র চীনে লেনদেন হয়েছে নয় ট্রিলিয়ন ডলার! যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোবাইল পেমেন্টের পরিমাণ মাত্র ১১২ বিলিয়ন ডলার।

দৈনন্দিন এমন কোনো কাজ নেই যেখানে মানুষ মোবাইল পেমেন্ট ব্যবহার করছে না। রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার আগেই অর্ডার করে ফেলছে মোবাইলে, সাথে সাথে বিলও পরিশোধ করছে। আর তাতে করে মিলছে ছাড়ও!

দৈনন্দিন এমন কোনো কাজ নেই যেখানে মানুষ মোবাইল পেমেন্ট ব্যবহার করছে না; Source: CNBC.com

সেই রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে কারো যানবাহনের দরকার পড়লে, সে কাজও করা যাবে অ্যাপ দুটি ব্যবহার করে। নগরীর ব্যস্ততম জায়গাগুলোতে মোড়ে মোড়ে সাজিয়ে রাখা বাইসাইকেলগুলোতে যে কেউ মোবাইল পেমেন্টের মাধ্যমে চড়ে বসতে পারবেন। এজন্য বাইসাইকেলের পেছনের কিউআর কোডটি স্ক্যান করে অ্যাপের মাধ্যমে পেমেন্ট করলে একটি কোড আসবে মোবাইলে। সাইকেলের পেছনে থাকা নম্বরপ্যাডে সেই কোড প্রেস করলেই খুলে যাবে সাইকেলের লক! ট্যাক্সিক্যাবের ক্ষেত্রেও ভাড়া চুকানোর একমাত্র উপায় উইচ্যাট বা আলিপে।

চীনের এই মোবাইলে পেমেন্টের সংস্কৃতি বৃহৎ পরিসরে চালু করে আলিবাবার হুমা সুপার মার্কেট। সেখানকার প্রতিটি পণ্যের সাথেই দেওয়া থাকে কিউআর কোড, যাকে স্ক্যান করে পণ্য সম্পর্কে জানা যাবে সকল তথ্য। আর পেমেন্ট করতে সেখানে ব্যবহার করতে হবে আলিপে।

ফাস্ট ফুড কেনাবেচায় চীনাদের লেনদেনের গ্রাফ তাদের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থারই চিত্র ফুটিয়ে তোলে © The Wall Street Journal

ক্রেতা যখনই কিছু স্ক্যান করছেন, তা সরাসরি চলে যাচ্ছে আলিপের ডাটাবেজে। সেখানে তারা বিশ্লেষণ করছে, ক্রেতা হিসেবে কে কেমন। কে কোন ধরনের পণ্য কিনছেন, কোথা থেকে কিনছেন, কত খরচ করছেন ইত্যাদি বিচার করে অ্যাপ নতুন নতুন পণ্য ক্রেতাকে প্রদর্শন করছে। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার খুব একটা বালাই নেই এখানে, এটাই প্রধান নেতিবাচক দিক বলা যায় এই অ্যাপভিত্তিক লেনদেনের। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের তুলনায় চীনের মানুষ তাদের ‘ডেটা প্রাইভেসি’ নিয়ে অতটা চিন্তিত নন।

কাঁকড়ার কিউআর কোড স্ক্যান করে এক ক্রেতা স্মার্টফোনে পেয়ে যাচ্ছেন সেসম্পর্কিত সকল তথ্য © The Wall Street Journal

‘আলিপে’র শুরুটা হয়েছিলো ২০০৪ সালে, টাওবাও নামের আলিবাবারই এক অনলাইন মার্কেটে মোবাইল পেমেন্ট করার জন্য। ২০০৯ সাল নাগাদ তারা চালু করে মোবাইল ওয়ালেট সেবা, যাতে করে গ্রাহকেরা নিজেদের মাঝেও অর্থের লেনদেন করতে পারতেন। উদ্যোক্তাদের জন্য যে বিষয়টি অনেকের সাদা চোখে এড়িয়ে যায়, সময়; সেটারই সর্বোচ্চ ব্যবহারের উপায় নিয়ে কাজ করলেন আলিবাবার বাজার গবেষকরা। এবং তারা সেটার অসাধারণ সুফলও পেয়েছেন।

২০০৯ সালে চীনে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিলেন মাত্র ২২০ মিলিয়ন, আট বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে প্রায় তিনগুণ বেড়ে যার পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ছয়শ’ মিলিয়নে!

সাইকেলের পেছনে থাকা নম্বরপ্যাডে সেই কোড প্রেস করলেই খুলে যাবে সাইকেলের লক! Source: TechNode

মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে মোবাইলে পেমেন্টের হার। যার ফলে মোবাইলে পেমেন্ট করেন এমন গ্রাহক ২০১৬ সালে দাঁড়ায় সাড়ে চারশো মিলিয়নেরও বেশি, ২০১২ সালেই যা ছিল মাত্র পঞ্চাশ মিলিয়ন।

চীনের জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে রাতারাতি পরিবর্তন, তার ভবিষ্যত আঁচ করতে পেরে আলিবাবার সেসময়কার উদ্যোগগুলোই বাতলে দিয়েছিলো বর্তমান চীনের অর্থব্যবস্থার গতিপথ।

২০১৩ সালে চীনের বিখ্যাত উইচ্যাট অ্যাপলিকেশনটিতে চালু করা হয় মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেম। এবং সেটি রাতারাতি বদলে দিতে থাকে দৈনন্দিন জীবনের লেনদেনের ক্ষেত্রগুলোকে। তিন বছর বাদেই তাই চীনের মোবাইল পেমেন্ট ট্রানজেকশনের ৪০ শতাংশ দখল করে নেয় উইচ্যাট।

মোবাইল পেমেন্ট মার্কেটের ৪০ শতাংশ দখল উইচ্যাট-এর, ৫৬ শতাংশ আলিপে এবং ৪ শতাংশ অন্যান্য; © The Wall Street Journal

এত অল্প সময়ে উইচ্যাটের এত বেশি জনপ্রিয়তার মূল কারণ, একের ভেতর অনেক কিছু। অর্থাৎ, একটি মাত্র অ্যাপ ব্যবহার করে দৈনন্দিন এমন কোনো কাজ নেই যা করা যায় না। আর এই ছোট ছোট অ্যাপগুলো একেকটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরি, যাতে করে বাস্তব জগৎটি মোবাইলের স্ক্রিনে যেন ভেসে উঠছে। মোবাইল পেমেন্ট থেকে শুরু করে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, থানায় জিডি করা, যানবাহন ভাড়া করা, ভিডিও কনফারেন্স, ইমার্জেন্সি ফোর্স যেমন ফায়ার সার্ভিস, পুলিশকে খবর দেওয়া, এমনকি বন্ধু বা পরিবারের সাথে আড্ডাবাজি- সবই হচ্ছে কেবল একটিমাত্র অ্যাপের মাধ্যমেই।

একটি মাত্র অ্যাপ ব্যবহার করে দৈনন্দিন এমন কোনো কাজ নেই, যা করা যায় না; Source: Enterprise Innovation

প্রযুক্তির বদৌলতে হয়তো সম্পূর্ণভাবেই নগদ ক্যাশবিহীন অর্থব্যবস্থা গড়ে উঠবে বিশ্বব্যাপী এবং তা আগামী দশকেই। বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ব্লকচেইনের মতো সুরক্ষাদাতা প্রযুক্তি একে নিয়ে যাবে নতুন মাত্রায়। আমাদের বাংলাদেশ কি প্রস্তুত সে সময়ের মুখোমুখি হতে?

ফিচার ইমেজ: thebeijinger.com

Related Articles