প্রায় সময়ই একজন অসুস্থ ব্যক্তি কিংবা মাত্র অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠা একজন সুস্থ ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, “সুস্থতা যে সৃষ্টিকর্তার কত বড় উপহার তা আসলে বোঝা যায় কেবলমাত্র অসুস্থ হলেই।” এ কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেমন হতো যদি দেখতেন চলতে-ফিরতে আপনার শরীরে বিভিন্ন জায়গায় যখন সামান্য ঘষা লাগছে, তখনই সেখানে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে? যদি আপনার হাত কিংবা পায়ের আঙুলগুলো একে অপরের সাথে ধীরে ধীরে লেগে লেগে আসত এই ফোস্কার দরুন, তাহলে আপনি কী করতেন? বেশ ভয়াবহ এক পরিস্থিতির তৈরি হতো, তাই না? কিন্তু এমন ভয়াবহ এক রোগও আছে।
বিরল জীনগত এ রোগের নাম জাংশনাল এপিডার্মোলাইসিস বুলোসা (Junctional Epidermolysis Bullosa – JEB), যাতে রোগীর শরীরে সামান্য ঘষা লাগলেই উপরে বর্ণিত পরিস্থিতিগুলো তৈরি হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো প্রতিকার খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় নি। তবে সাম্প্রতিককালে একদল বিজ্ঞানী জেইবিতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত এক ছেলের দেহে সফলভাবে ত্বক প্রতিস্থাপনের অপারেশনে সক্ষম হয়েছেন, যা সামনের দিনগুলোর ব্যাপারে আশার আলো দেখাচ্ছে। এই অপারেশনের সময় ছেলেটির দেহের প্রায় ৮০ ভাগ এপিডার্মিস (ত্বকের বহির্ভাগ) জেনেটিক্যালি মডিফায়েড স্কিন সেল দিয়ে পুনর্গঠন করতে হয়েছে।
অপারেশনের জন্য স্কিন গ্রাফটগুলো ছেলেটির ডার্মিসে সংযুক্ত করতে হয়েছিল। বাচ্চা ছেলেটির দেহে চালানো এ অপারেশনকে অবশ্য জেইবির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চিকিৎসকদের প্রথম প্রচেষ্টা বলা যাবে না। কারণ এর আগেও অনুরুপ চিকিৎসা আরো দুজন রোগীর বেলায় দেয়া হয়েছিলো। তবে তাদের বেলায় সংযুক্ত কৃত্রিম ত্বকের পরিমাণ ছিল বেশ ছোট, যা এই ছেলেটির বেলায় প্রায় ৮০ ভাগ। এজন্যই মূলত বিশ্বজুড়ে তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে এক বিরাট আলোড়ন।
জাংশনাল এপিডার্মোলাইসিস বুলোসা হলো একধরনের জীনগত রোগ, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ার দশা হয় খুবই নাজুক, এমনকি খুব সহজেই তার শরীরে ফোস্কা পড়ে যায়। শরীরে সামান্য ঘষা লাগলেও ফোস্কা পড়া ও চামড়া উঠে যাওয়ার মতো দশা হয়। দৈনন্দিন জীবনে চলাফেরা সহ যাবতীয় কাজ করতে গিয়ে আমাদের শরীরে কতভাবে যে কতকিছুর ঘষা লাগে তা কখনো গুনে শেষ করা যাবে না। সেখানে জেইবিতে আক্রান্ত একজন ব্যক্তির অবস্থা কতটা খারাপ হতে পারে, তা তো রোগটির বর্ণনা শুনে সহজেই বোঝা যাচ্ছে।
গবেষকগণ জেইবিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করেছেন; হার্লিট্জ জেইবি (Herlitz JEB) এবং নন-হার্লিট্জ জেইবি (non-Herlitz JEB)। এ দু’শ্রেণীর মাত্রার তারতম্য থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই এদের উপসর্গ একইরকম এবং একই জীনের মিউটেশনের জন্যই এমনটা হয়ে থাকে।
দুই প্রকার জেইবির মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো হার্লিট্জ জেইবি। জন্মের পর থেকে কিংবা খুব শৈশব থেকেই আক্রান্ত শিশুর দেহে ফোস্কা দেখা দেয়। মিউকাস মেমব্রেনেও এটা হতে পারে। ফলে খাওয়া-দাওয়া ও হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দেয়। এতে করে শিশুটি অপুষ্টিতে ভোগে এবং তার দৈহিক বৃদ্ধির গতিও শ্লথ হয়ে যায়। ফোস্কার পরিমাণ বেশি হলে ক্ষত হয়ে গ্র্যানিউলেশন টিস্যু তৈরি করে। এই টিস্যুগুলো থেকে অল্পেই প্রচুর পরিমাণে রক্তপাত হতে থাকে। ফলস্বরুপ, আক্রান্ত শিশুটির দেহে আরো বড় ধরনের ক্ষত তৈরি হয়। সেই সাথে দেহ থেকে মিনারেল, প্রোটিন ও অন্যান্য দরকারি তরল বেরিয়ে যেতে থাকে। এছাড়াও আরো যেসব জটিলতা দেখা দেয় তাতে হার্লিট্জ জেইবিতে আক্রান্ত শিশুর আয়ুষ্কাল অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১ বছরও পেরোয় না।
হার্লিট্জের তুলনায় নন-হার্লিট্জ জেইবিতে আক্রান্ত শিশুর শারীরিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো থাকে। তার দেহের ফোস্কাগুলো সাধারণত হাত, পা, কনুই ও হাঁটুতেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং বাচ্চার বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর প্রকোপ কমতে থাকে। এছাড়া চুল পড়া, অবিকশিত হাত ও পায়ের নখ এবং অনিয়মিত দাঁতের এনামেলও দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্র্যানিউলেশন টিস্যু তৈরি হয় না। ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা সহ অন্যান্য জটিলতা কম দেখা দেয়।
আমাদের আজকের আলোচনায় যে ছেলেটির কথা বারবার বলা হচ্ছে, তার নাম হাসান, জন্ম সিরিয়ায়। জন্মের পর কয়েকদিন বয়স থেকেই তার জেইবিতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি বোঝা যায়। ২০১৫ সালে তাকে যখন জার্মানির রুহ্র (Ruhr) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো, তখন তাকে দেখে মাংসের পিন্ডের সাথে খুব একটা পার্থক্য করতে পারছিলেন না চিকিৎসকেরা, অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল। তারা বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেটির কী হয়েছে। কিন্তু জেইবির সামনে তারা ছিলেন একেবারেই অসহায়। কারণ এর কোনো প্রতিকার তাদের জানা ছিলো না। এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের মাঝে প্রতি ১০ জনের ৪ জন বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছানোর আগের মৃত্যুবরণ করে। ফলে ডাক্তাররাও হাসানকে নিয়ে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না।
শুরুতে তারা পরিকল্পনা করেছিলেন চিকিৎসা দিয়ে জেইবির প্রভাব যতটা সম্ভব প্রশমিত করে হাসানকে আরো কিছুদিন পৃথিবীর আলো-বাতাস গ্রহণের ব্যবস্থা করার কথা। হাসানের মা-বাবাও বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেটির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সম্পর্কে। তাই বুকে পাথর বেঁধে হলেও তারা সেই নির্মম সত্যকে মেনে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু এমন সময়ই সিনেমার কাহিনীর মতো দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে ইতালির ইউনিভার্সিটি অফ মডেনা এন্ড রেজ্জিও এমিলিয়া থেকে একদল জীববিজ্ঞানীর, যারা সবাই জীন থেরাপির বিশেষজ্ঞ। জার্মানির চিকিৎসকেরাই তাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। এরপর হাসানের বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে শুরু হয় শিশুটির উপর তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
ভেঙে যাওয়া একটি বাড়ি সংস্কার করতে গেলে যেভাবে একের পর এক ইট বসিয়ে বাড়িটিকে তার আগের রুপে ফেরাতে হয়, হাসানের দেহে হারানো এপিডার্মিস পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটা ছিল ঠিক তেমনই। প্রথমে তার শরীরের সুস্থ একটি অংশের ত্বকীয় কোষ সংগ্রহ করে সেগুলোর প্রোটিন কালচার করা হয়। LAMB3 নামক একটি জীন প্রকরণের মিউটেশন হাসানের এরুপ দুর্দশার জন্য দায়ী। সেই কালচারের মাঝে তাই জীনগত পরিবর্তন আনা হয়, যাতে করে তা LAMB3 এর প্রভাবমুক্ত হতে পারে। এখান থেকেই পরবর্তীতে গবেষকগণ তাদের কাজের জন্য দরকারি স্কিন গ্রাফট তৈরি করতে থাকেন। মোট তিনবার অপারেশনের মাধ্যমে হাসানের দেহের হারানো এপিডার্মিসের জায়গায় এই স্কিন গ্রাফটগুলো বসানো হয়েছে।
অপারেশন শেষ হবার পর হাসানকে নিয়মিতই চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়েছে। অবশেষে সর্বশেষ অপারেশনের ২১ মাস পর তাকে নিয়ে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। কারণ তার নতুন ত্বকে কোনো সমস্যা দেখা যাচ্ছে না, কোনো রকম ফোস্কারও অস্তিত্ব নেই সেখানে। এসব তার পুরোপুরি সেরে ওঠার ইঙ্গিতই দিচ্ছে। নতুন ত্বকটি আমাদের সাধারণ ত্বকের মতোই হয়ে উঠেছে। সেখানে কোনো রকম চুলকানি যেমন হয় না, তেমনই এখন আর তাতে কোনো ওষুধও দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
সামনের দিনগুলোতে হাসানকে নিয়ে নিয়মিতই কাজ করতে হবে গবেষকদের। কারণ এ চামড়া তার শরীরে এখনকার হিসেবে লাগানো হয়েছে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা পুরোপুরি ঠিক থাকে কিনা সেটাই এখন সবচেয়ে বড় বিষয়। তবে বিশ্বজুড়ে এপিডার্মোলাইসিস বুলোসায় আক্রান্ত প্রায় ৫,০০,০০০ রোগীর জন্য হাসানের ঘটনাটি যে এক নতুন আশার আলো বয়ে এনেছে, তা তো বলাই বাহুল্য।