টুম্ব রেইডার বলতেই কল্পনায় চলে আসে অ্যাঞ্জেলিনা জোলির অবয়ব, আসাটাই স্বাভাবিক। এক সময় টুম্ব রেইডারখ্যাত লারা ক্রফটের ভূমিকায় তো তিনিই ছিলেন। কিন্তু এতগুলো বছর বাদে এখন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি না থাকলেও এতটুকু অমলিন হয়নি টুম্ব রেইডার। এখনও দুর্গম সব জায়গায় নিষিদ্ধের আকর্ষণে হরেক রকমের অস্ত্র হাতে ছুটে চলেছে আবেদনময়ী লারা। যুগের পর যুগ গেমারদের আনন্দ দিয়ে যাওয়া গেম সিরিজটির রয়েছে তিনটি সিনেমাও। টুম্ব রেইডারের ২২ বছরের ইতিহাস শোনাতেই এ পোস্ট। আজ তবে লারা ক্রফটেরই গল্প হোক।
১৯৯৬ সালের ২৫ অক্টোবর প্রথম টুম্ব রেইডার গেমটি বাজারে আসে। আর সর্বশেষ গেমটি মুক্তি পায় ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। মাঝের ২২টি বছরে অন্তত দশটি মূলধারার গেম জয় করে দেয় গেমারদের মন। এর মধ্যে প্রথম ছয়টি গেম ছিল কোর ডিজাইন (Core Design) থেকে, আর পরের চারটি বের হয় ক্রিস্টাল ডাইনামিক্সের (Crystal Dynamics) নির্মাণে, প্রকাশক স্কোয়ার এনিক্স (Square Enix)। লারা ক্রফটের বিবর্তনে তার কাহিনী পরিবর্তন হয়েছে বেশ কয়েকবারই। বাস্তবের চরিত্র না হয়েও ছয়টি গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড লারার ঝুলিতে! এর মাঝে আছে- ভিডিও গেমের ইতিহাসে সবচেয়ে পরিচিত নারীমুখ, মুভিতে সবচেয়ে সফল রূপায়ণ ইত্যাদি।
বাদামী চোখের সুন্দরী লারা ক্রফট সুঠামদেহী, আর হালকা লালচে-বাদামি চুলের অধিকারিণী। কখনও সে চুল থাকে খোলা, কখনও বেণী বা পনিটেইল করা- বিশেষ করে প্রথমদিকের গেমগুলোতে তেমনটাই থাকত। প্রথম যখন লারা ক্রফটের গেম বাজারে আসে তখন তার পরনে থাকতো ট্যাংক টপ, উরু পর্যন্ত বুট জুতো আর সাদা মোজা। দু’হাতে দুটি পিস্তল আর নানা রকমের উপকরণ নিয়ে নানা অভিযানে বেরিয়ে পড়তো লারা ক্রফট। আর একেকটি অভিযান মানেই হলো একেকটি দুর্দান্ত রহস্যের সমাধান। লারার অসাধারণ ইতিহাস জ্ঞানের পাশাপাশি আরেকটি গুণ হলো তার ভাষাজ্ঞান- অনেকগুলো ভাষাতেই লারা ক্রফট যে অনর্গল কথা বলতে পারতো!
প্রথমদিকের গেমগুলোতে লারাকে দেখানো হয় লর্ড হেনশিংলি ক্রফটের (Lord Henshingly Croft) লন্ডনে জন্ম নেয়া মেয়ে হিসেবে, কিন্তু পরবর্তীতে ‘লেজেন্ড’ গেম থেকে সেই কাহিনী পরিবর্তন করে দেখানো হয়- তার বাবার নাম রিচার্ড ক্রফট। অভিজাতভাবেই তার বেড়ে ওঠা, তার বিয়ে ঠিক থাকে ফ্যারিংডনের আর্লের (Earl of Farringdon) সাথে। স্কটিশ আর সুইস স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে লারা।
যখন লারার বয়স কেবল ২১ বছর, তখন এক বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে সে, যদিও প্রাণে বেঁচে যায়। দুই সপ্তাহ তাকে টিকে থাকতে হয় হিমালয়ের কোলে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তার বিশ্বভ্রমণ আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা চেপে বসে। তার অভিযান নিয়ে বই লিখে অর্থকড়ি আসতে থাকে, পরবর্তীতে উড়নচণ্ডী জীবনের কারণে তার বাবা তাকে ত্যাজ্য করলেও তার অর্থসমাগমে কখনও তাই বাধা পড়েনি।
এ তো গেল প্রথমদিকের কাহিনী। টুম্ব রেইডার সিরিজ যখন দ্বিতীয় যুগে প্রবেশ করে তখন বদলে যায় কাহিনী। প্রত্নতত্ত্ববিদ অ্যাবিংডনের আর্ল লর্ড রিচার্ড ক্রফটের (Lord Richard Croft) মেয়ে লারা ক্রফট ছোট থেকেই ছিল তুখোড় মেধাবী, স্থানীয় স্কুলে পড়ার সময়ই সকলে সেটা বুঝে যায়। নয় বছরে লারা প্লেনক্র্যাশে পড়ে, এবার সাথে তার মা-ও ছিলেন। লারা ও তার মা এক প্রাচীন নেপালি মন্দিরে আশ্রয় নেয়, যেখানে লারার চোখের সামনে তার মা উধাও হয়ে যান একটি পুরনো তরবারি ধরবার সাথে সাথেই। স্ত্রীর খোঁজ করতে গিয়ে লারার বাবাও নিখোঁজ হয়ে যান। লারা হয়ে পড়ে একা, বাবা-মাকে খুঁজে বের করাই তার উদ্দেশ্য এখন।
টুম্ব রেইডারের তৃতীয় যুগে বদলে যায় কাহিনী আবারও। বাবা-মায়ের সাথে লারা ক্রফট বেড়ে উঠতে উঠতে ভ্রমণ করে অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গায়, যা তার শিশুমনে খুবই প্রভাব ফেলে। এরকমই এক অভিযানে তার মা হারিয়ে যান, আর পরবর্তীতে আত্মহত্যা করেন কয়েক বছর বাদে, অন্তত লারা তা-ই জানে। উত্তরাধিকারসূত্রে বিপুল সম্পত্তি হাতে পেয়ে ক্যামব্রিজে পড়ালেখা করার সুযোগ থাকলেও লারা পড়াশোনা করে লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে। সেখানেই তার বান্ধবী স্যামের সাথে পরিচয়। আর পথচলায় পরিচিত হয় জোনাহর সাথে। এ দুজনের সাথে তার সম্পর্ক ভালোই গড়াতে থাকে। কিন্তু জাপানি এক দূরদ্বীপে জাহাজ দুর্ঘটনায় আছড়ে পড়ার পর জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করে লারা। একদিকে অতিপ্রাকৃত সব শত্রু আর ঘটনা, অন্যদিকে সারা বিশ্বের ক্ষমতা দখলের নেশায় মত্ত ট্রিনিটিকে থামাবার দায়ভার তার ওপর। এভাবেই চলে যায় সিরিজের শেষ তিনটি গেম।
১৯৯৬ সালে যখন প্রথম টুম্ব রেইডার বের হলো, তখন তা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গেমের একটি আখ্যা পেয়ে বসে। ৭ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় গেমটির! পেরু, মিসর, আটলান্টিস- কী ছিল না এতে? তবে গেমের গ্রাফিক্স আজকের যুগের তুলনায় আসলে যাচ্ছেতাই। নিচে লারা ক্রফটের ছবিতেই দেখে নিন গ্রাফিক্সের উন্নতি ঠিক কতটা হয়েছে এ ২২ বছরে!
১৯৯৭ সালে এলো টুম্ব রেইডার টু। এক প্রাচীন চীনা সম্রাটের অতিপ্রাকৃত ছুরির সন্ধানেই গেমের কাহিনী গড়িয়ে যায়। ৮ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় গেমের!
পরের বছরই বের হয় টুম্ব রেইডার থ্রি। একই ধাঁচের গেম হওয়ায় একটু সমালোচিত হয় গেমটি, ছয় মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। এক প্রাচীন উল্কাপিণ্ডের অনুসন্ধান শেষে ভারতের মন্দির, এমনকি অ্যান্টার্কটিকা জুড়ে এবার ছুটে চলে লারা ক্রফট।
এ তিনটি গেম মূলত টুম্ব রেইডার সিরিজের ভিত্তিপ্রস্তর, এরপর একে একে বছর বছর বের হয় এ গেমগুলো-
১৯৯৯- টুম্ব রেইডার: দ্য লাস্ট রেভেলেশন
২০০০- টুম্ব রেইডার: ক্রনিকলস
২০০১- টুম্ব রেইডার: কার্স অফ দ্য সোর্ড
২০০২- টুম্ব রেইডার: দ্য প্রফেসি
২০০৩- টুম্ব রেইডার: দ্য অ্যাঞ্জেল অফ ডার্কনেস
২০০৬- টুম্ব রেইডার: লেজেন্ড
২০০৭- টুম্ব রেইডার: অ্যানিভার্সারি
২০০৮- টুম্ব রেইডার: আন্ডারওয়ার্ল্ড
২০১০- টুম্ব রেইডার অ্যান্ড দ্য গার্ডিয়ান অফ লাইট
এরপর টুম্ব রেইডার সিরিজকে আবার রিবুট করে আনা হয় ট্রিনিটির কাহিনী। একদমই অত্যাধুনিক গ্রাফিক্স আর দুর্দান্ত গেমপ্লে বদলে দেয় টুম্ব রেইডার খেলবার অভিজ্ঞতা। লারাকে ফুটিয়ে তোলা হয় আরও জীবন্তরূপে। এ ট্রিলজির গেমগুলো ছিল-
২০১৩- টুম্ব রেইডার
২০১৫- রাইজ অফ দ্য টুম্ব রেইডার
২০১৮- শ্যাডো অফ দ্য টুম্ব রেইডার
এ সিরিজে অবশ্য আগের টুম্ব রেইডারের শ্লেষ বা সারকাজমটুকু নেই, ঠিক যে কারণে একই ধারার প্লেস্টেশন গেম নাথান ড্রেকের আনচার্টেড জনপ্রিয় হয়। নতুন সিরিজের লারার হাস্যরসের অভাবটা বেশ চোখে পড়ে বটে।
এ সবগুলো গেম মিলিয়ে টুম্ব রেইডার সিরিজ কত কপি বিক্রি হয়েছে এ যাবত ভাবতে পারেন? ৬৭ মিলিয়ন!
লারাকে নিয়ে বেরিয়েছে তিনটি হলিউড মুভিও! ২০০১ সালে ‘লারা ক্রফট: টুম্ব রেইডার’, ২০০৩ সালে দ ক্র্যাডল অফ লাইফ আর সবশেষে ২০১৮ সালে বের হয় আবার রিবুট মুভি ‘টুম্ব রেইডার’। প্রথম দুটি ছবিতে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি অভিনয় করলেও শেষ ছবিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন অ্যালিসিয়া ভিকান্ডার।
ভিডিও গেমের ইতিহাসে শক্তিশালী নারী চরিত্র তুলে ধরার জন্য খুবই প্রশংসিত হয় টুম্ব রেইডার, কিন্তু একইসাথে তার সেক্স আপিলকে বাণিজ্যিকীকরণকে সমালোচকগণ ভালো চোখে দেখেননি। তবে যা-ই হোক, আনন্দময় আর দুর্দান্ত গেমপ্লের সাথে চমৎকার অভিযানমূলক কাহিনী উপহার দেয়ার বেলায় টুম্ব রেইডারের জুড়ি নেই, আর সেই সাথে লারা ক্রফটের আবেদনময় আন্দোলিত উপস্থিতি তো আছেই!