নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম
বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম?
যোগাযোগ মাধ্যমের অভাবে আপনজনের কাছে মনের খবর পাঠাতে পারছেন না গায়িকা। তবে একটি বিষয় জানা থাকলে হয়তো এ দুঃখ করতে হতো না তার। পিয়ন কিংবা টেলিগ্রাফের মতো আরো একজন বার্তা বাহক আছেন, যাদের দেখা পাওয়া অতোটা কঠিন নয়। তারা হলেন আমাদের অতিপরিচিত কবুতর বা পায়রা পাখি। কিছুটা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কবুতররাও সুদক্ষ ডাকপিয়ন হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য এটি নতুন কোনো খবর নয়। আরো হাজার বছর আগ থেকেই কবুতররা নিষ্ঠার সাথে বার্তা-বাহক হিসেবে কাজ করে আসছে।
বিশেষ করে যুদ্ধক্ষেত্রে পায়রাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জুলিয়াস সিজার, চেঙ্গিস খান থেকে শুরু করে ওয়াটারলুর যুদ্ধে ডিউক অব ওয়েলিংটনও নির্ভর করেছেন পায়রা-বাহিত যোগাযোগের ওপর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীও পায়রা ব্যবহার করেছে। তাদের ‘চের আমি’ নামের পায়রাটি বীরত্বের জন্যে ফ্রান্সের ‘ক্রিক্স ডি গেরে’ পদকও লাভ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ পায়রা-বাহিনী। যাদের মধ্যে ৩২টি লাভ করেছিল ডিকিনস মেডেল।
১৯৭০ এর দশকে এসে কবুতররা আর স্রেফ বার্তা-বাহক হয়ে থাকেনি। আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র হাত ধরে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতে শুরু করে তারা। সিআইএ-র গবেষকরা এ সময় খুবই হালকা ও ছোট একটি ক্যামেরা উদ্ভাবন করেন। যাকে কবুতরের বুকের সাথে লাগিয়ে দেওয়া যেত। একটি মোটরের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ছবি তুলতে পারতো ক্যামেরাটি। পায়রা যেহেতু ভূমি থেকে খুব বেশি উঁচু দিয়ে ওড়ে না, তাই বিমান বা স্যাটেলাইটের চেয়ে অনেক ভালো ছবি তুলতে পারতো তারা। তবে সিআইএ-র এই প্রকল্প কতটা সফল হয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি, কারণ সেসব নথিপত্র এখনো গোপনই আছে।
পায়রাদের দিয়ে ছবি তোলানোর এ আইডিয়াটি সিআইএ অবশ্য অন্য একজনের কাছ থেকে ধার করেছে। জুলিয়াস নিউব্রোনার নামের একজন জার্মান ঔষধ বিক্রেতা প্রথম ‘পায়রা-ক্যামেরা’ উদ্ভাবন করেন, এবং কবুতরদের দিয়ে ছবি তোলা শুরু করেন। বিশ শতকের শুরুর দিকে উদ্ভাবন করা তার ক্যামেরাটিকে স্ট্র্যাপের সাহায্যে আঁটকে দেওয়া যেত পায়রার শরীরে। এরপর টাইমারের সাহায্যে কিছুক্ষণ পরপর ছবি তুলতো সেটি। প্রুশিয়ান সেনাবাহিনী নিউব্রোনারের ক্যামেরাটিকে সামরিক খাতে ব্যবহারের চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু কবুতরের ওড়ার প্যাটার্ন ও কোন ছবি তোলা হবে তা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায়, আর এগোয়নি তারা।
প্রশ্ন হচ্ছে পায়রা কীভাবে বুঝতে পারে যে, তাকে কোন পথে যেতে হবে? কীভাবে তার ওড়ার পথকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? পায়রাকে যে অনেক দূরে নিয়ে ছেড়ে দিলেও তারা ঠিকমতো ঘরে ফিরতে পারে, তা সেই প্রাচীন কালে মিশর ও মেসোপটেমিয়ার পর্যবেক্ষকরাই লক্ষ্য করেন। কিন্তু কীভাবে তারা এ কাজটি করে তা খুব সম্প্রতি বুঝতে শুরু করেছেন বিজ্ঞানীরা। একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে- প্রকৃতিগতভাবে তাদের ম্যাগনেটো-রিসেপশনের ক্ষমতা আছে। অর্থাৎ তারা পৃথিবীর চুম্বক-ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করে কোনো অবস্থানকে চিহ্নিত করতে পারে এবং নির্ধারণ করতে পারে নিজেদের গতিপথ।
১৯৬৮ সালে, উলফগ্যাং উইলস্কো (Wolfgang Wiltschko) নামের একজন জার্মান প্রাণিবিজ্ঞানী ইউরোপিয়ান রবিন পাখির একটি আচরণ লক্ষ্য করেন। তিনি দেখেন বন্দী পাখিগুলো খাঁচার এক কোনে একটি নির্দিষ্ট দিকে মুখ করে অবস্থান করে। এরপর খাঁচায় বিভিন্ন দিক থেকে চুম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করে তিনি দেখেন সে অনুসারে তারা নিজেদের অবস্থানও পরিবর্তন করে। অর্থাৎ স্পষ্টতই চুম্বকত্বের সাথে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের একটি সম্পর্ক পাওয়া যায়।
তবে পায়রার পথ চেনার কৌশল বুঝতে এ ধরণের পর্যবেক্ষণ চালানোটা কিছুটা কঠিন কাজ। কারণ এ পর্যবেক্ষণ চালাতে হবে তাদের খোলা আকাশে ছেড়ে দিয়ে। এক্ষেত্রে গবেষণাগারের বাইরে চুম্বকক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করাটা বেশ কঠিন কাজ। তাছাড়া এটাও বোঝা দুষ্কর যে, আসলেই তারা কী চুম্বকক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে নাকি অন্য কোনো কিছুতে প্রভাবিত হচ্ছে। যেমন পায়রারা হয়তো চুম্বকক্ষেত্র নয় বরং সূর্যের অবস্থানের মাধ্যমে নিজেদের দিক ঠিক করছে।
১৯৭০ সালে চার্লস ওয়ালকট ও পি গ্রিন নামের দুজন গবেষক এ সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে একটি পরীক্ষণ ডিজাইন করেন। তারা গোটা পঞ্চাশেক পায়রাকে বাড়ি ফেরার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তিনটি ভিন্ন অবস্থান থেকে ছেড়ে, পূর্বদিকে পায়রাদের ওড়ান তারা। রৌদ্রজ্জ্বল ও মেঘলা, দু’ধরনের আবহাওয়াতেই তারা প্রশিক্ষণ দেন পায়রাগুলোকে। যখন পায়রারা সবরকম পরিস্থিতিতে বাড়ি ফিরতে শিখে গেল, গবেষকরা তখন প্রত্যেকটি পায়রার মাথায় একটি আকর্ষণীয় টুপি পরিয়ে দিলেন। সেই টুপির সাথে একটি ব্যাটারি চালিত কয়েল সেঁটে দেওয়া হলো। আরেকটি কয়েলকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো পায়রার গলায়। এ কয়েলগুলোর সাহায্যে পায়রার চারপাশের চুম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তন করা যেত।
এরপর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রৌদ্রজ্জ্বল দিনে চুম্বকের প্রভাব তেমন একটা পড়ে না পায়রার মাঝে। কিন্তু মেঘলা দিনে তারা চুম্বক ক্ষেত্র অনুসরণ করে হয় বাড়ি ফেরে অথবা চুম্বক ক্ষেত্রের দিক পরিবর্তন করে দিলে উড়ে যায় বাড়ি থেকে দূরে। এ পরীক্ষণ থেকে তারা সিদ্ধান্তে আসেন যে, পায়রারা সাধারণত সূর্যের অবস্থানকে অনুসরণ করে বাড়ী ফেরে, কিন্তু মেঘলা দিনে পৃথিবীর চুম্বকত্বই তাদের ভরসা।
পাখিদের ম্যাগনেটো-রিসেপশন নিয়েও আরো গবেষণা হয়েছে কিন্তু শরীরের ঠিক কোন অঙ্গে তাদের ম্যাগনেটোরিসেপটর অবস্থান করে, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। ২০০২ সালে এক দল গবেষক বলেছিলেন, ডান চোখের মাধ্যমে তারা এ কাজটি করে। কিন্তু তার নয় বছর পর আরেকদল গবেষক জানিয়েছেন, একই পরীক্ষা চালালেও আগেরবারের সাথে তাদের ফলাফল মেলেনি। ফলে এ ডান চোখকে এ কৃতিত্ব দেওয়া চলে না। এরপর এরকম আরো কয়েকটি অঙ্গের নাম উঠে এসেছিল এবং যথারীতি খারিজও হয়ে গেছে। এর সন্ধ্যানে গবেষণা চলছে এখনো।
অন্যান্য গবেষকরা চুম্বকত্বের বাইরেও আরো অনেক ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন পাখিদের পথ-চেনার বিষয়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে পায়রা দিয়ে যোগাযোগ করতে গেলে এত সব জানার দরকার পড়বে না আপনার। সহজেই পায়রাকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন আপনি। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো তাদের এক জায়গায় থাকতে দেওয়া এবং অন্য জায়গায় খেতে দেওয়া; এতে করে তারা সেই পথের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে। এছাড়া অপরিচিত জায়গা থেকে বাড়ি ফিরতে শেখানোও সম্ভব তাদের।
এক একটি পায়রা প্রায় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারে। প্রতিযোগিতা করে কখনো এর চেয়েও বেশি পেরিয়ে যায় তারা। তবে একটি পায়রা একসাথে খুব বেশি তথ্য বয়ে নিয়ে যেতে পারে না। মাইক্রোফিল্ম উদ্ভাবনের পর তাদের এ ক্ষমতা কিছুটা বাড়ে। মাইক্রোফিল্মে ছবিকে অনেক সংকোচিত করে রাখা যেত, ফলে পায়রারাও আগের থেকে বেশি ছবি বয়ে নিয়ে যেতে পারতো। মাইক্রোফিল্ম উদ্ভাবন করেছিলেন ফরাসি ফটোগ্রাফার রেনে ডাগ্রন (René Dagron) ১৮৫০ সালে।
এর এক দশক পরে ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে যখন প্যারিস অবরুদ্ধ হলো, ডাগ্রন তখন যোগাযোগের জন্য পায়রা ব্যবহার করার প্রস্তাব দেন। মাইক্রোফিল্মে করে প্যারিস থেকে দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান করতে থাকে পায়রার দল। সে সময় ডাগ্রনের সেই পায়রা ডাকঘরের মাধ্যমে প্রায় দেড় লক্ষ মাইক্রোফিল্ম শিট পরিবহণ করা হয়েছিল, যাতে ছিল মিলিয়নেরও বেশি বার্তা। প্রুশিয়ানরা যে বুঝতে পারেনি তেমনটা নয়। তারাও আবার চিল ও বাজপাখি লাগিয়ে দিয়েছিল, প্যারিসের এসব ডাকপিয়নদের ধরার জন্যে।
বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে যখন ডাকঘর, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন আরো নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠতে থাকে তখন হারিয়ে যেতে থাকে যোগাযোগখাতে পায়রাদের ব্যবহারের ঐতিহ্য। তবে শখের বশে এখনো অনেকে পায়রা-ডাকপিয়নদের ব্যবহার করেন। যেমন রকি মাউন্টেন এডভেঞ্চার নামের একটি রাফটিং কোম্পানি ১৯৯৪ সাল থেকে করে আসছিল। তারা নদীতে রাফটিং করার সময় পর্যটকদের ছবি তুলে ফিল্মগুলো পায়রার মাধ্যমে পাঠিয়ে দিত স্টুডিওতে। রাফটিং শেষে এসে পর্যটকরা দেখতেন তাদের ছবি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। পায়রার মাধ্যমে পাঠানো বলে এই ছবিগুলোর কদরও কিছুটা বেড়ে যেত পর্যটকদের কাছে। এভাবে পৃথিবীর অনেক জায়গায় এখনো হয়তো অনেকের খেয়ালবশে বার্তা বহণ করে চলছে পায়রার ঝাঁক, যা তারা করে আসছিল হাজার বছর আগ থেকে।