মহাকাশ এখন স্রেফ কৌতূহলের জায়গা নয়, সময়ের চাহিদায় মহাকাশে অভিযান চালানো, স্যাটেলাইট পাঠানো এখন প্রয়োজনে রূপ নিয়েছে। এ কারণেই অঢেল অর্থ-কড়ি খরচ করে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্যাটেলাইট পাঠায় মহাকাশে। কিন্তু এসব স্যাটেলাইট পাঠানোর জন্যে যে ব্যবস্থা দরকার তা সকল দেশের নেই। নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়ে সবাই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে। ফলে বিকশিত হতে শুরু করেছে মহাকাশ-বাণিজ্যের ক্ষেত্র।
এ খাতে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবার আগে নজরকাড়ে ‘স্পেসএক্স’ ও ‘ব্লু অরিজিন’। উচ্চাভিলাষী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দিক থেকে তাদের কাছাকাছি আর কেউ নেই। দুটি কোম্পানির কর্ণধারই ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসা থেকে বিলিয়নিয়ার হয়ে উঠেছেন। ব্লু অরিজিনের জেফ বেজোস তার বিশাল সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন ‘অ্যামাজন ডট কম’ থেকে। স্পেসএক্সের কর্ণধার ইলন মাস্কও পেপ্যালের মতো ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দিয়েই শুরু করেছিলেন।
এ দুটি কোম্পানি বর্তমানে বিশালাকার সব পুনঃব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরি করছে, যেগুলো স্যাটেলাইট ও মানুষ নিয়ে যাবে মহাকাশে। ভবিষ্যতে পৃথিবীর বাহিরে মানুষের আবাসস্থল তৈরির স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। আগামী বছরগুলোতে যে তারা একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে মহাকাশ বাণিজ্যের দখল নিতে চাইবে সেটা অনুমান করাই যায়।
স্পেসএক্স কী করছে?
মহাকাশ জয়ের দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে আছে স্পেসএক্স। শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই তারা ২১টি উৎক্ষেপণ করেছে, যা এ বছরে মোট উৎক্ষেপণের প্রায় ২০ শতাংশ। আরো একদিক থেকে কোম্পানিটি সবচেয়ে সফল। একমাত্র তারাই কোনো উৎক্ষেপণের পর তাদের রকেট পুনরায় সংগ্রহ করতে পেরেছে, যেটি মহাকাশে উড়ে গিয়েছে আরো কয়েকবার।
কয়েক বছর আগেও কোনো রকেট মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়ে পুনরায় ফিরে আসবে, এমন চিন্তাও হাস্যকর মনে হতো। কিন্তু স্পেসএক্স তা বাস্তবে করে দেখিয়েছে। এ চেষ্টায় কয়েকবার চরম ব্যর্থও হয়েছে তারা। সময়ের সাথে সাথে তারা সব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তারা প্রথমবারে মতো সফল হয়। তাদের ‘ফ্যালকন-নাইন’ রকেটটির প্রথম স্টেজ ঠিকঠাকভাবে ফেরত আসে পৃথিবীতে। এরপর এখনতো এটি রুটিনমাফিক দৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
কয়েক মাস আগে স্পেসএক্স ফ্যালকন-নাইনের সর্বশেষ সংস্করণ ‘ব্লক-ফাইভ’ সামনে এনেছে। এর প্রথম স্টেজটি দশবারেরও বেশি মহাকাশে পাড়ি জমাতে পারবে। আগামী কয়েক বছর ফ্যালকন-নাইনই হবে স্পেসএক্সের বাজির ঘোড়া। তবে ইতোমধ্যেই তারা ‘ফ্যালকন হেভি’ নামের একটি নতুন রকেট যোগ করেছে আস্তাবলে। তিনটি ফ্যালকন-নাইনের প্রথম স্টেজ সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে ফ্যালকন হেভির প্রথম স্টেজ। এটি পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ৬০ মেট্রিক টনেরও বেশি লোড নিয়ে যেতে সক্ষম, বর্তমানের যেকোনো রকেটের তুলনায় যা অনেক বেশি।
তবে বর্তমানে স্পেসএক্স যা তৈরি করছে, তার তুলনায় ফ্যালকন হেভিকেও নিতান্ত সাধারণ বলে মনে হয়। এটিকে ‘বিগ ফ্যালকন রকেট’ (BFR) নামে ডাকা হতো। কিছুদিন আগে নাম পরিবর্তন করে এর প্রথম স্টেজটিকে ‘সুপার হেভি’ ও দ্বিতীয় স্টেজটিকে ‘স্টারশিপ’ নাম দেওয়া হয়। অন্য যেকোনো রকেটের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী এ রকেটটির দুটি স্টেজই পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব হবে। কয়েক ডজন মানুষকে পৃথিবীর কক্ষপথ পেরিয়ে বহুদূরে নিয়ে যেতে পারবে স্টারশিপ।
২০১৬ সালে এর কাজ শুরু করার পর থেকে এতে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে, এটি মঙ্গলের ভূমিতে ১০০ মেট্রিক টন ওজনের বস্তু নিয়ে যেতে পারবে। মঙ্গলে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে পৃথিবীর কক্ষপথে এর দ্বিতীয় স্টেজে পুনরায় জ্বালানি সরবরাহ করা হবে। স্পেসএক্স সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের শেষ দিকে স্টারশিপের বিভিন্ন অংশের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো শুরু করবে তারা।
কী করছে ব্লু অরিজিন?
জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন অনেকটাই পিছিয়ে আছে স্পেসএক্স এর তুলনায়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কক্ষপথে কিছুই উৎক্ষেপণ করেনি তারা। তবে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার দিক থেকে খুব একটা পিছিয়ে রাখা যাবে না তাদের। তারা এখনো তৈরি করার প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। রকেট তৈরির জন্যে কেনেডি স্পেস সেন্টারের কাছেই সত্তর হাজার বর্গ-কিলোমিটারের একটি কারখানা প্রস্তুত করা হয়েছে। কাছাকাছিই তৈরি হচ্ছে পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা। ২০১৯ সালের প্রথমদিকে এটিও সম্পন্ন হয়ে যাবে। কেপ ক্যানাভেরালে একটি লঞ্চপ্যাডকেও তারা প্রস্তুত করে নিয়েছে প্রয়োজন মতো।
ব্লু অরিজিন বর্তমানে ‘নিউ গ্লেন’ নামের একটি রকেট নিয়ে কাজ করছে। এর নাম রাখা হয়েছে পৃথিবীর কক্ষপথে যাওয়া প্রথম আমেরিকান জন গ্লেনের নামে। দুই স্টেজের এ রকেটটি প্রথমবার উড়বে ২০২১ সালের দিকে। পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ৪৫ মেট্রিক টন অজনের লোড নিয়ে যেতে পারবে এটি। এর প্রথম স্টেজটি উড়তে পারবে ২৫ বারেরও বেশি। এরই মধ্যে নিউ গ্লেনের জন্যে বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সাথে চুক্তিও হয়ে গেছে।
নিউ গ্লেনে ব্যবহারের জন্যে বিই-ফোর নামের ইঞ্জিন তৈরি করছে ব্লু অরিজিন। এ ইঞ্জিন তারা বিক্রি করছে ‘ইউ.এল.এ’ (ইউনাইটেড লঞ্চ এলায়েন্স) এর কাছেও। এ সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে মহাকাশযান সরবরাহ করে। এদিকে গত অক্টোবরে ব্লু অরিজিনের চুক্তি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর সাথে। বিমান বাহিনীর কাজে তাদের রকেট ব্যবহারের জন্যে প্রায় পাঁচশ মিলিয়ন ডলারে এ চুক্তি হয়।
ব্লু অরিজিনের আরেকটি রকেট হচ্ছে নিউ শেফার্ড। এটি কোনো স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে না বরং মহাকাশে নিয়ে যাবে পর্যটকদের। এটি সাব-অরবিটাল ভ্রমণ করবে, অর্থাৎ এটি মহাকাশে যাবে কিন্তু পৃথিবীর কক্ষপথে পূর্ণ আবর্তন না করেই ফিরে আসবে। নিউ শেফার্ড এখনো পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্ব পার করছে। গত বছরেই এর যাত্রী নিয়ে মহাকাশে ওড়ার কথা ছিল। কিন্তু একে সম্পূর্ণ নিরাপদ করে তুলতে আরো সময় নিয়েছেন তারা। আশা করা যাচ্ছে, ২০১৯ সালের মধ্যেই এটি প্রথমবারের মতো মহাকাশ ভ্রমণে যেতে পারবে। একসাথে ছয়জন যাত্রী ভ্রমণ করতে পারবেন মহাকাশযানটিতে।
তবে সাব-অরবিটাল মহাকাশ ভ্রমণ বিষয়ে আগ্রহ নেই স্পেসএক্স এর। তারা শীঘ্রই কক্ষপথে মানুষ পাঠানোর কথা ভাবছে। নাসার সাথে তাদের এবং বোয়িং এর চুক্তি হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকে নভোচারীদের আনা নেওয়ার বিষয়ে। ‘ড্রাগন’ নামের তাদের মহাকাশযানটি বর্তমানে মহাকাশ স্টেশনে পণ্য আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। একে পরিবর্তন করে তৈরি করা হচ্ছে ‘ক্রু ড্রাগন’, যার কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। ব্লু অরিজিনও কোনো একদিন কক্ষপথে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা মাথায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে নাসার থেকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও পাচ্ছে তারা। তবে সে পর্যায়ে আসতে হয়তো পেরিয়ে যাবে আরো ৭-৮ বছর।
দুই বিলিয়নিয়ারের স্বপ্ন
বেজোস এবং মাস্ক দুজনই স্বপ্ন দেখেন তাদের কোম্পানি পৃথিবীর বাহিরে মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। তবে সে পথে যাওয়ার বিষয়ে দুজনের পরিকল্পনা কিছুটা ভিন্ন। মাস্ক আরো আগে থেকেই বলে এসেছেন, মানুষের শুধুমাত্র পৃথিবীকেন্দ্রিক না হয়ে, ‘মাল্টি-প্লানেটারি’ অর্থাৎ বিভিন্ন গ্রহে সভ্যতা গড়ে তোলা উচিত। যাতে মানবসভ্যতা বেঁচে থাকতে পারে বড়সড় প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের দ্বারা পৃথিবী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে।
এ যাত্রায় তাদের প্রথম লক্ষ্য মঙ্গল গ্রহ। এজন্যেই তাদের বিগ ফ্যালকন রকেটের কাজ চলছে যা মঙ্গলে পণ্য ও মানুষ নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তারা আশা করছেন, ২০২২ সালের দিকে এটি প্রথম পণ্য নিয়ে যাত্রা করবে এবং ২০২৪ সালের মধ্যেই এটি মানুষ বহণ করতে সক্ষম হবে। ব্লু অরিজিনের ভিশনও একই, তারা বিশ্বাস করে ভবিষ্যতে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের খাতিরে বসবাস করবে মহাকাশে। সে ভবিষ্যৎকে সম্ভব করতেই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে চায় তারা। তবে পৃথিবীর বাহিরে তাদের প্রথম লক্ষ্য মঙ্গল নয়, চাঁদ। ব্লু মুন নামের একটি লুনার ল্যান্ডার তৈরির পরিকল্পনা করেছে তারা, যা চাঁদে মানুষ ও পণ্য বহণ করে নিয়ে যাবে।
মাস্ক ও বেজোস দুজনের কাছেই তাদের এ মহাকাশ অভিযানের প্রচেষ্টা অত্যন্ত মূল্যবান। বেজোস বলেন, “আমার কাজের মধ্যে ব্লু অরিজিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি হয়তো এর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা সফল হওয়া পর্যন্ত দেখে যেতে পারবো না।” স্পেসএক্স নিয়ে মাস্কের ভাবনাও একই রকম, “আমি হয়তো স্পেসএক্সকে সম্পূর্ণ স্বনির্ভর হতে দেখা পর্যন্ত বেঁচে থাকবো না।”
বোঝাই যাচ্ছে, এ দুই মহারথী এখন পৃথিবী পেরিয়ে মহাকাশেও নিজেদের ছাপ রেখে যেতে চাইছেন । অন্যান্য সকল অর্জন ছাপিয়ে সেটিই তাদের কাছে গুরত্ব পাচ্ছে বেশি। তবে এ অর্জনগুলো স্রেফ তাদের বা কোম্পানিগুলোর নয়, এগুলো গোটা মানবসভ্যতারই অগ্রগতির নিদর্শন।