আপনি জানেন কি, অ্যাপল এখন পৃথিবীর ১ নম্বর ব্র্যান্ড? গুগলকে পেছনে ফেলে অ্যাপল পৃথিবীর এখন সবথেকে ‘মূল্যবান ব্র্যান্ড’, যার এই সময়ের অর্থমূল্যের পরিমাণ ঠিক ১৭০ বিলিয়ন ডলার!
প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড হিসেবে আজ অ্যাপলের পণ্য কিনতে অ্যাপল স্টোরের সামনে লম্বা লাইন পড়ে যায়। চড়া মূল্য সত্ত্বেও এই কোম্পানির পণ্য কিনতে লক্ষ লক্ষ অ্যাপল ভক্তের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। অ্যাপলের আজকের এই অবস্থান কিন্তু রাতারাতি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে হাজার হাজার মানুষের মেধা, মনন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম। ভোক্তাদের সর্বোচ্চ মানের পণ্য এবং সেবা দিতে অ্যাপল সবসময়ই সচেষ্ট। আসুন, জেনে নিই অ্যাপলের আজকের এই জনপ্রিয়তা এবং সফলতার কারণগুলো।
সহজ ব্যবহার
অ্যাপল পণ্যগুলোর দিকে খেয়াল করলে আপনি দেখবেন, এদের প্রায় প্রতিটি পণ্য ব্যবহার করা অত্যন্ত সহজ। ‘ইউজার ইন্টারফেস’ থেকে শুরু করে নকশা, নির্মাণশৈলী, ম্যাটেরিয়াল সবকিছুতেই অ্যাপল তার ব্যবহারকারীদের সুবিধার কথা সবসময়ই মাথায় রাখে। ব্যবহারবান্ধব হবার কারণে কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই খুব সহজে এই সব পণ্যের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। এমনকি যিনি কখনো কোনো অ্যাপল পণ্য ব্যবহার করেননি, তিনিও যদি হঠাৎ করে অ্যাপলের কোনো পণ্য ব্যবহার করা শুরু করেন, তাহলেও তিনি সহজেই এর ব্যবহার রপ্ত করতে পারবেন। ‘অ্যাপল ইকোসিস্টেমের’ প্রায় সব পণ্যের এই সহজ ব্যবহার প্রচণ্ডভাবে ভোক্তাদের আকৃষ্ট করে।
প্রিমিয়াম ব্রান্ডিং
অ্যাপল ইকোসিস্টেমের এমন কোনো পণ্য নেই, যার ব্র্যান্ডিং আপনাকে আকর্ষণ করবে না। প্রতিটি পণ্যের নকশা থেকে শুরু করে উৎপাদন, ফিনিশিং, প্যাকেজিং সবকিছুর মধ্যেই থাকে আভিজাত্যপূর্ণ নান্দনিকতার ছোঁয়া। এছাড়া প্রতিটি অ্যাপল পণ্য যেভাবে ভোক্তার সামনে উপস্থাপন করা হয়, তা আসলে বিস্ময়ের দাবি রাখে। অ্যাপল পণ্যের বিজ্ঞাপনও করা হয় নান্দনিকতার সাথে। অ্যাপলের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো তো নিত্যনতুন প্রযুক্তির এক স্বর্গক্ষেত্র। গোছানো, দেখতে সাদামাটা কিন্তু ‘সাম্প্রতিক প্রযুক্তির’ তৈরী এই বিক্রয়কেন্দ্রগুলো সবসময়ই ভোক্তাদের পদচারণায় থাকে মুখর।
নতুনত্ব
নতুন কোনো ফিচার আনতে অ্যাপল বরাবরই সবার থেকে এগিয়ে। হোক সেটা কোনো প্রযুক্তি কিংবা কোনো ফিচার অথবা নতুন ডিজাইনের নতুন কোনো পণ্য। আইফোনের অপারেটিং সিস্টেম (আইওএস) কিংবা ম্যাকবুকের ম্যাক ওএস’এর আপডেট মানেই নতুন কোনো ফিচার। নতুন আইওএস এলে অথবা নতুন কোনো আইফোনের বিক্রি শুরু হলে অ্যাপলের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ভোক্তারা। এছাড়া অ্যাপল তাদের প্রায় সব পণ্যের হার্ডওয়্যার নিজেদের তত্ত্বাবধানে নকশা এবং উৎপাদন করে বলে ঐসব ব্যবহারকৃত হার্ডওয়্যার তাদের নিজেদের ওএস’এর সর্বোচ্চ অপটিমাইজেশন করতে পারে। এইক্ষেত্রে অ্যাপল তার প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যানড্রয়েড কিংবা উইন্ডোজ পিসির থেকে এগিয়ে আছে। কেননা অ্যানড্রয়েড ফোন কিংবা উইন্ডোজ পিসির হার্ডওয়্যার এবং ওএস আসে ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানি থেকে। ফলে এখানে অপটিমাইজেশনের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় না।
ভোক্তা সেবা
অ্যাপল তার ভোক্তাদের গুণগত সেবা দিতে সবসময়ই বদ্ধপরিকর। এইজন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে এক ঝাঁক অ্যাপল কর্মী। অ্যাপলের ভোক্তা সেবা কেন্দ্রগুলোতে সবসময়ই আপনাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাবে কোনো না কোনো অ্যাপল কর্মী, তা আপনি যে সমস্যা নিয়েই যান না কেন! অত্যন্ত দক্ষ এসব কর্মী বিক্রয় পরবর্তী সেবা প্রদানের জন্য বদ্ধপরিকর। সমীক্ষায় দেখা যায়, অন্যান্য কোম্পানির বিক্রয় পরবর্তী ভোক্তা সেবার তুলনায় অ্যাপল বরাবরই এগিয়ে। প্রচণ্ড আন্তরিক অ্যাপল ভোক্তা সেবার প্রশংসা বরাবরই সব জায়গায়। এক্ষেত্রেও অ্যাপল তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলো থেকে একটু আলাদাই।
উদ্ভাবন
অ্যাপলের অতীত থেকে বর্তমান সবটা জুড়েই নিত্যনতুন উদ্ভাবনী শৈলীর জয়জয়কার। সেই স্টিভ জবসের সময় থেকেই চিন্তা, গবেষণা তথা উদ্ভাবনী শৈলীতে অ্যাপল তার স্বকীয়তা বজায় রেখে চলেছে। নতুনপ্রযুক্তি অথবা ফিচার যা-ই হোক না কেন, অ্যাপল বরাবরই অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। বলা হয়ে থাকে, অ্যাপল অন্যদের থেকে অন্তত দুই বছর এগিয়ে থাকে তাদের উদ্ভাবনী শৈলীতে। আজ আপনি হয়তো একটি নতুন ফিচারের কথা চিন্তা করছেন, কে জানে হয়তো অ্যাপল ল্যাবে এই প্রযুক্তি অথবা ফিচার অ্যাপল প্রকৌশলীরা হয়তো নিজেদের মধ্যেই ব্যবহার করছেন কিনা !
নেতৃত্ব
অ্যাপলের আজকের সাফল্যের পেছনে সবসময়ই যোগ্য নেতৃত্ব বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে প্রাক্তন সিইও (CEO) স্টিভ জবসের ভুমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাপলের আজকের যে আকাশচুম্বী সাফল্য, তার পেছনে তার নামটি আজীবন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। ১৯৯৭ কালে অ্যাপলের ক্রান্তিকালে স্টিভ জবসই তাঁর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মাইক্রোসফটের বিল গেটসকে রাজি করান অ্যাপলে ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার জন্য। দুই কোম্পানির আদর্শগত বিরোধের মধ্যে কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। এভাবেই নানাক্ষেত্রে স্টিভ জবস অ্যাপলের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে দেখিয়েছেন তার বিচক্ষণতা। পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যুর পরে অ্যাপলের হাল ধরেন টিম কুক। অসাধারণ বিচক্ষণ এই ব্যক্তিও অ্যাপলে তার অবদান রেখে চলেছেন। এভাবেই যোগ্য নেতৃত্ব কখনোই অ্যাপলকে সাফল্যের পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেয়নি।
সুবিশাল পণ্য সামগ্রী
আপনি আইফোন ব্যবহার করছেন? কিংবা একটি ম্যাকবুক? এটিকেই অ্যাপলের একমাত্র পণ্য হিসেবে ভেবে থাকলে ভুল করবেন। অ্যাপলের আছে সুবিশাল প্রোডাক্ট লাইনআপ। আইপড থেকে শুরু করে আইফোন, ম্যাকবুক, ম্যাক পিসি, আইপ্যাড, অ্যাপল ওয়াচসহ আরও নানা পণ্য রয়েছে এই লাইন আপে। এছাড়া আইটিউন, আইপে এবং সফটওয়্যার থেকে অ্যাপল বছরে কোটি কোটি ডলার আয় করে থাকে। অ্যাপল এখন মূলত একটি ‘লাইফস্টাইল গ্যাজেট ইকোসিস্টেম’ হিসেবে কাজ করে, যার রয়েছে সাড়া পৃথিবীব্যাপী কোটি কোটি ভোক্তা। এই অ্যাপল ইকোসিস্টেম আজকের তাদের এই সাফল্য এবং জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
গতিশীল ব্যবসা পরিকল্পনা
ব্যবসা পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অ্যাপল বরাবরই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। প্রোডাক্ট লাইনআপ থেকে শুরু করে ভোক্তার আগ্রহ, বাজার সবকিছু নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অ্যাপল। এছাড়া বর্তমান প্রযুক্তির সাথে সাথে কীভাবে ভবিষ্যতের জন্য নতুন কিছু তৈরি করা যায়- তা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলে অ্যাপল ল্যাবে। পরিকল্পনার ব্যাপারে প্রচণ্ড রক্ষণশীল অ্যাপল সম্পর্কে তাই ভোক্তা থেকে শুরু করে সবারই কম বেশি আগ্রহ থাকে, এমনকি প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোরও। অ্যাপলের কোন পণ্য উদ্ভোধন অনুষ্ঠান বরাবরই থাকে প্রযুক্তিপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।
অংশিদারিত্ব
অ্যাপল সবসময়ই যেকোনো পণ্য বা সেবা প্রদান করে ভোক্তাদের কথা বিবেচনা করে। কাজেই একজন ভোক্তার যেসব সেবার দরকার হতে পারে, তা প্রদান করার জন্য অ্যাপলের ‘অংশিদারিত্বমূলক চুক্তি’ আছে অন্ততপক্ষে কয়েকশ প্রতিষ্ঠানের সাথে। এভাবেই অ্যাপল সবসময়ই তার ভোক্তাদের সবধরনের প্রয়োজন পূরণে বদ্ধপরিকর। তাইতো কোটি কোটি মানুষের ভালবাসায় সিক্ত অ্যাপল আজ এতটা জনপ্রিয় এবং ব্যবসাসফল।
ফিচার ইমেজ- leoprinting.co.uk