ইন্টারনেট থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমরা সিনেমা, বই, সফটওয়্যার কিংবা গানসহ নানা ধরনের উপকরণ ডাউনলোড করে থাকি। কিন্তু এসব ডাউনলোডের বেশিরভাগই অবৈধ। এগুলোকে বিনামূল্যে ব্যবহার করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়নি। বিভিন্ন কোম্পানী কিংবা ব্যক্তি এসব পণ্যের স্বত্বাধিকারী।
উন্নত দেশগুলোতে কপিরাইট আইন কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। বাংলাদেশ বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার সদস্যভুক্ত একটি দেশ। এ সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বার্ন কনভেনশন, ইউনেস্কো পরিচালিত ইউনিভার্সাল কপিরাইট কনভেনশন এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ার কারণে কপিরাইট সংক্রান্ত সকল শর্ত মেনে চলতে বাংলাদেশ বাধ্য। কিন্তু কপিরাইট আইন থাকলেও তার যথাযোগ্য প্রয়োগ নেই বাংলাদেশে।
তবে ইন্টারনেটে অনেক জায়গা আছে, যেখান সম্পূর্ণ বৈধভাবে কোনো খরচ ছাড়াই নির্দ্বিধায় ডাউনলোড করতে পারবেন প্রয়োজনীয় ফাইল। এর ফলে মানসিক অপরাধবোধ থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারবেন নিজেকে। বাংলাদেশে আইনের প্রয়োগ নেই ভলে এখোনো এ ব্যাপারটি নিয়ে তেমনভাবে চিন্তিত হওয়ার সময় আসেনি। কিন্তু আপনি যদি অন্য কোনো দেশে যান, সেখানকার আইনের প্রয়োগ বাংলাদেশের মতো না-ও হতে পারে। এছাড়া ডাউনলোডের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে সঠিক থাকতে চাইলে এ উপায়ের শরণাপন্ন হতে পারেন। কোনো জিনিসগুলো বিনামূল্যে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা বৈধ সেগুলো সম্পর্কে এখানে জেনে রাখা ভালো।
যে সকল সৃজনশীল উপকরণ কপিরাইট, ট্রেডমার্ক কিংবা পেটেন্ট আইন দ্বারা সুরক্ষিত নয়, তা পাবলিক ডোমেইনের অধীনে থাকে। এ উপকরণগুলোর স্বত্বাধিকারী সাধারণ জনগণ, কিংবা কোনো নির্দিষ্ট লেখক কিংবা কোনো শিল্পী নন। যে কেউ চাইলে পাবলিক ডোমেইনের সবকিছু ব্যবহার কিংবা বিতরণ করতে পারবে। তবে এগুলো পারলেও মালিকানা দাবি করতে পারবে না।
কোনো কিছু সাধারণত চারটি উপায়ে পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভু্ক্ত হতে পারে।
- কপিরাইটের সময়সীমা পার হয়ে গেলে।
- সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পর কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী যথাসময়ে কপিরাইট পুনঃনিবন্ধন করতে ব্যর্থ হলে।
- ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো স্বত্বাধিকারী পাবলিক ডোমেইনে তার কাজ উন্মুক্ত করে দিলে।
- কপিরাইট আইন সুরক্ষা দেয় না এরকম যেকোনো উপকরণ।
চারটি পয়েন্টের যেকোনো একটির কারণে কপিরাইট হারাতে পারে যে কেউ।
বাংলাদেশের বর্তমান কপিরাইট আইন অনুসারে, ফটোগ্রাফ বা ছবি ব্যতীত অন্যান্য কর্মের ক্ষেত্রে কপিরাইটের মেয়াদ, প্রণেতার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত বহাল থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুসারে এই মেয়াদ ৭০ বছর পর্যন্ত। দেশ ভেদে কপিরাইট আইন এবং সময়সীমায় পার্থক্য দেখা যায়। এ সময়সীমা পার হয়ে গেলে তা পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভু্ক্ত হয়ে যায়। যেমন ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া জর্জ রোমেরোর দ্য নাইট অব দ্য লিভিং ডেড সিনেমাটি কপিরাইট হারিয়ে এখন সবার কাছে ডাউনলোডের জন্য উন্মুক্ত।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কপিরাইট আইন বেশ জটিল। যেমন ধরা যাক একজন লেখকের সব বই পাবলিক ডোমেইনে থাকতে পারে। কিন্তু সেই বইগুলোর সুনির্দিষ্ট সংগ্রহ বা সমগ্র-এর কপিরাইট থাকতে পারে। কোনো একটি সিনেমার কপিরাইট না থাকলেও সে সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে এমন গানের কপিরাইট থাকতে পারে। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া রক, রক, রক! সিনেমার কপিরাইট না থাকলেও এর গানগুলোর কপিরাইট এখনো আছে।
পাবলিক ডোমেইন নিয়ে কাজ করে এমন কিছু ওয়েবসাইটের কথা না জানলেই নয়। এসব ওয়েবসাইটে পাবলিক ডোমেইনের আওতায় থাকা নানা রকম ডিজিটাল পণ্য এবং সেসব পণ্য সম্পর্কিত তথ্য থাকে। সময়ের সাথে সাথে পাবলিক ডোমেইনের পরিধি বাড়ছে এবং সেই সাথে বাড়ছে এরকম ওয়েবসাইটের সংখ্যাও।
১. পাবলিক ডোমেইন শেরপা
ইন্টারনেটে অনেক আজগুবি কিংবা অসত্য তথ্যের দেখা পাওয়া যায়। তাই কেউ যদি কোনো সিনেমা বা বই কিংবা সৃজনশীল কাজকে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত বলে দাবী করে, তাহলে তা অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে যাচাই করে দেখা উচিত। এই ওয়েবসাইটে বৈধ উপায়ে বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে এরকম অনেক বই, সিনেমা, টেলিভিশন প্রোগ্রাম ইত্যাদির তালিকা দেয়া আছে। এছাড়া কোনটি পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভু্ক্ত তা-ও উল্লেখ করা আছে।
এড্রেস: publicdomainsherpa.com
২. অথোরামা
এ ওয়েবসাইটটিতে আছে পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভু্ক্ত বিভিন্ন বইয়ের সমাহার। এটি মূলত ব্রাউজার-নির্ভর, এখান থেকে কোনো বই ডাউনলোড করতে পারবেন না। তবে অনলাইনে পড়তে পারবেন। কিংবা পরবর্তীতে পড়ার জন্য অফলাইনে রেখে দিতে পারবেন।
এড্রেস: authorama.com
৩. গুটেনবার্গ প্রজেক্ট
অথোরামার মতো এ ওয়েবসাইটটিও ফ্রি বইয়ের জন্য বিখ্যাত। বিভিন্ন ফরম্যাটে ৫৬ হাজারেরও উপরে বই আছে এখানে। ডাউনলোড করে কিংবা অনলাইনে পড়া যাবে এগুলো। অনেক স্বেচ্ছাসেবকের নিরলস পরিশ্রমের ফসল এই সমৃদ্ধ সাইটটি। কপিরাইট নেই এমন সব বইগুলোকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এই প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়। এ প্রজেক্টের নাম প্রজেক্ট গুটেনবার্গ।
এড্রেস: gutenberg.org
৪. আর্কাইভ
সিনেমা, টেলিভিশন প্রোগ্রাম, গান থেকে শুরু করে নানা ধরনের বই কিংবা ওয়েবপেজের সুবিশাল সংগ্রহশালা হলো ‘আর্কাইভ ডট ওরজি’। প্রায় ৩১০ মিলিয়নের মতো বই, ১১ মিলিয়ন টেক্সট, ৪ মিলিয়ন অডিও, ৫ মিলিয়ন ভিডিও এবং এক লক্ষের মতো সফটওয়্যার রয়েছে এখানে। এছাড়া একটি একাউন্ট থাকলে আপনি যেকোনো কিছু আপলোডও করে রাখতে পারবেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে এখানের সবকিছুই পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত নয়।
এড্রেস: archive.org
৫. গুগল বুকস
গুগল বুকসকে বলা হয়ে থাকে ভবিষ্যতের সবেচেয়ে বড় জ্ঞানভাণ্ডার। এটি গুগলের এটি সেবা যেখানে আপনি বিভিন্ন বই কিংবা ম্যাগাজিন খুঁজে পাবেন। এখানে প্রথমে বইগুলোকে স্ক্যান করা হয়, তারপর অপটিক্যাল ক্যারেকটার রিকগনিশন কিংবা ওসিআর-এর সাহায্যে স্ক্যান করা বইগুলোকে ডিজিটাল বইয়ে রূপান্তর করা হয়। অনেক প্রশংসা পেলেও কপিরাইট সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সমালোচিতও হতে হয়েছে গুগল বুকসকে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডিজিটাল বই এর অধীনে আছে। ২০১০ সালে গুগলের হিসেব অনুসারে প্রায় ১৩০ মিলিয়ন বই ছিল পৃথিবীতে। উল্লেখ্য তারা সব বইকে গুগল বুকসের আওতায় আনার কথা বলেছিলো।
এড্রেস: books.google.com
৬. ওপেনফ্লিক্স
পাবলিক ডোমেইনে থাকা সিনেমাগুলো সম্পর্কে জানা যাবে এ ওয়েবসাইট থেকে। Genre অনুসারে আপনার পছন্দের সিনেমাগুলো খুঁজতে পারবেন এবং সেগুলো সংগ্রহ করতে পারবেন এখান থেকে।
এড্রেস: openflix.com
৭. লিব্রিভক্স
বর্তমানে অডিও বইয়ের অনেক জনপ্রিয়তা। এই ওয়েবসাইটটিতে পাবলিক ডোমেইনে থাকা অনেক বইয়ের অডিও খুঁজে পাবেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক স্বেচ্ছাসেবক এই বইগুলোকে অডিওতে রূপান্তরের কাজ করে চলেছেন।
এড্রেস: librivox.org
৮. পিক্সাবে
ব্যক্তিগত কিংবা ব্যবসায়িক কাজে বিভিন্ন সময়ে ছবির প্রয়োজন হয়। এই সাইটটিতে প্রায় ১.৩ মিলিয়ন ছবি এবং ভিডিও রয়েছে যেগুলো ফ্রি ডাউনলোড করা যাবে। এসব ছবি কিংবা ভিডিও আপনি যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবেন।
এড্রেস: pixabay.com
উল্লেখিত ওয়েবসাইটগুলো ছাড়াও আরো ওয়েবসাইট রয়েছে যার মাধ্যমে পাবলিক ডোমেইনের রাজ্যে ভ্রমণ করা যায়। প্রতি বছরই কপিরাইটের মেয়াদ হারিয়ে পাবলিক ডোমেইনের আওতায় চলে আসছে অনেক কিছু, আর সাথে সাথে বাড়ছে মুক্ত জ্ঞানচর্চা এবং বিনোদনের পরিসর।
ফিচার ইমেজ © স্কাইলাইট ডিজিটাল