HTC, গত দশকের শুরুর দিকে স্মার্টফোন জগত দাপিয়ে বেড়ানো এক কোম্পানির নাম। সবার প্রথমে অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন মার্কেটে লঞ্চ করার পাশাপাশি HTC ছিল একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন নির্মাতা কোম্পানি। শুরু থেকেই HTC ফোনের হার্ডওয়্যার ও ফিচারের সাথে ডিজাইনকেও বেশ গুরুত্ব দিত। ফলশ্রুতিতে, ভোক্তাদের কাছে এই ফোনের গ্রহণযোগ্যতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। Arnnet এর এক রিপোর্ট অনুসারে, ২০১১ সালের শেষদিকে, HTC তৎকালীন স্মার্টফোনের সবচেয়ে বড় মার্কেট, যুক্তরাষ্ট্রের স্মার্টফোন বাজারে ৫.৭ মিলিয়ন স্মার্টফোন ছাড়ে। এক ধাক্কায় তারা অ্যাপল ও স্যামসাংকে পেছনে ফেলে মার্কেটের ২০ শতাংশ শেয়ার নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসার মাধ্যমে শীর্ষস্থান দখল করতে সক্ষম হয়। অথচ বর্তমানে মার্কেট শেয়ারে HTC ধুঁকে ধুঁকে চলছে। একসময় বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে রাখা কোম্পানিটি বর্তমানে এমন দুর্দশার সম্মুখীন হলো ঠিক কী কারণে?
HTC-র প্রতিষ্ঠা তাইওয়ানের উদ্যোক্তা শের ওয়াং-এর হাত ধরে। ১৯৮১ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অর্থনীতিতে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ১৯৮২ সালে তাইওয়ানিস্ট ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটারে যোগদান করেন। সেখান থেকে তিনি ব্যবসা সম্পর্কিত খুঁটিনাটি জ্ঞান আহরণ করতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে তিনি বেশ কয়েকজন পার্টনার নিয়ে ‘High Tech Computer Corporation’ প্রতিষ্ঠা করেন। সংক্ষেপে আজকে যাকে আমরা ‘HTC’ নামে চিনি। নোটবুক কম্পিউটার উৎপাদনের মাধ্যমে HTC নিজেদের যাত্রা শুরু করলেও বছরখানেক পরেই কোম্পানিটি ‘টাচ অ্যান্ড ওয়্যারলেস হ্যান্ড হেল্ড ডিভাইস’ নির্মাণে মনোনিবেশ করে। বিশ্ববাসী প্রথম ‘টাচ অ্যান্ড ওয়্যারলেস হ্যান্ড হেল্ড ডিভাইস’ এর দেখা পায় HTC-র বদৌলতে। এর পরের কয়েকবছর কোম্পানিটি এ ধরনের ডিভাইস তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন পেটেন্ট ফাইলিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের ব্যবসার পরিধি ক্রমশ বাড়িয়ে নিচ্ছিল। ২০০৪ সালে শের ওয়াং কোম্পানির সিইও পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তখন HTC-র সিইও পদে আসীন হন কোম্পানির তৎকালীন কো-ফাউন্ডার পিটার চাও।
পিটার চাও তখন নিজের খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য বেশ পরিচিত ছিলেন। তিনি নির্ভুল কাজকে বরাবরই প্রাধান্য দিতেন। ফলে, HTC স্মার্টফোনগুলোর হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং ইউজার এক্সপেরিয়েন্সে ব্যবহারকারীরা অ্যাপল প্রোডাক্টের সমপর্যায়ের গুণাগুণসম্পন্ন ডিভাইস পাচ্ছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই HTC হ্যান্ড হেল্ড ডিভাইসগুলোতে মাইক্রোসফটের সফটওয়্যার ব্যবহার করে আসছিল। HTC তাদের ব্যবহারকারীদের মাঝে মাইক্রোসফটের ‘উইন্ডোজ মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম’ জনপ্রিয় করে তুলতে ইতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। যদিও HTC এর মূল কাজ ছিল তখন অন্যান্য ম্যানুফ্যাকচারারদের জন্য ডিভাইস ম্যানুফ্যাকচার করে দেওয়া। ২০০৪ সালে থেকে HTC Qtek ব্র্যান্ডের অধীনে উইন্ডোজ মোবাইল PDA বা ‘Personal Device Assistant’-কে বিশ্ববাসীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে HTC Qtek রেঞ্জটিকে HTC-র অফিসিয়াল ব্র্যান্ডিংয়ের আওতায় রি-ব্র্যান্ডিং করে এবং বাজারে নিয়ে আসে HTC TyTN।
২০০৭ সালে অ্যাপল বাজারে আইফোন ছাড়ার পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বিপ্লবের সেই ঘূর্ণিতে পরিবর্তন আসে HTC-র ভবিষ্যতেও। ২০০৮ সালে গুগল অপারেটিং সিস্টেম ‘অ্যান্ড্রয়েড’ উন্মুক্ত করলে কোম্পানিটি প্রথম অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন HTC Dream বাজারে উন্মুক্ত করে, যা ‘T Mobile G1’ নামেও পরিচিত ছিল। সে বছরই তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রথম ফোর-জি স্মার্টফোন ‘HTC Max 4G’ রিলিজ করে।
পরের বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালে তারা বিশ্ববাসীকে চমক দেয় প্রথম ক্যাপাসিটিভ টাচস্ক্রিন উইন্ডোজ স্মার্টফোন ‘HTC HD 2’ রিলিজের মাধ্যমে। এই ফোনটি বাজারে আসার আগপর্যন্ত সব উইন্ডোজ স্মার্টফোনেই ছিল রেজিস্টিভ টাচস্ক্রিন, যার ফলে ফোনগুলো হয়ে উঠত অপেক্ষাকৃত মোটা এবং ভারী। HTC সেই চিরাচরিত ধারার অবয়ব পাল্টে দিল। হার্ডওয়্যার মার্কেটে HTC-র এমন অভূতপূর্ব সাফল্যে গুগল HTC-র সাথে একত্রে গুগলের প্রথম হার্ডওয়্যার ‘Nexus One’ স্মার্টফোন বাজারে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে গুগলের এই Nexus সিরিজের লাইনআপ পরিবর্তিত হয় Pixel লাইনআপ বদলের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে HTC মোট ১১.৭ মিলিয়ন হ্যান্ডসেট শিপিংয়ের সাথে জড়িত ছিল।
২০১০ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে পৌঁছে ২৪.৬ মিলিয়ন ইউনিটে। শতকরার হিসেবে যা ১১১ শতাংশেরও অধিক। যার ফলে কোম্পানিটির রাজস্ব আগের বছরের তুলনায় ৯৩ শতাংশ বেড়ে একলাফে ৭ বিলিয়ন ডলারের ঘরে গিয়ে ঠেকে। মাল্টি ডিভাইস পলিসি অনুসরণ করে এগোতে থাকা HTC ২০১১ সালে ৪৫ মিলিয়নের বেশি ফোন আনে মার্কেটে। দুর্নিবার সফলতাকে পুঁজি করে কোম্পানির রাজস্ব গিয়ে পৌঁছায় ১৫.৫১ বিলিয়ন ডলারে। HTC-র ফোনগুলোর এমন গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার পেছনে ইতিবাচক প্রভাবক হিসেবে যে নিয়ামকটি কাজ করেছে তা হলো, মার্কেটের সর্বাধুনিক হার্ডওয়্যার ব্যবহারের পাশাপাশি ফোনগুলোকে চমকপ্রদ ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলার ক্ষেত্রেও কোম্পানিটি বেশ সচেষ্ট ও সতর্ক ছিল। স্মার্টফোনের উত্থানকালে সকল কোম্পানি যেখানে অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলোর বডিতে প্লাস্টিক ব্যবহার করে আসছিল, সেখানে HTC সর্বপ্রথম স্মার্টফোন জগতে সবাইকে মেটাল ইউনিবডি ডিজাইনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। অন্যান্য ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি ফোনের অডিও ফিচারকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও, শুরু থেকেই HTC তাদের ফোনগুলোতে স্টেরিও সাউন্ড সিস্টেম এডপ্ট করে নিয়েছিল। আবার ফোনের সফটওয়্যার বা ইউজার এক্সপেরিয়েন্সের দিকেও HTC সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখত। ২০০৯ সালে যখন কোম্পানিটি উইন্ডোজ ফোন বাজারজাত করত, তখন তারা উইন্ডোজের স্প্রেডশিটের মতো ইউজার ইন্টারফেসকে আধুনিক গ্রাফিক্যাল লুক দিতে নতুন সফটওয়্যার ‘TouchFLO 3D’ নিয়ে এসেছিল।
এরপর HTC নিজেদের দৃষ্টি উইন্ডোজ ছেড়ে অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মে সরিয়ে নিয়ে আসলে, TouchFLO 3D-কে অপটিমাইজ করে অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মের জন্য HTC Sense বানানো হয়। অপার সম্ভাবনার একটি সিস্টেম হলেও বিভিন্ন কারণে এটি সময়ের চেয়ে খানিকটা পিছিয়ে ছিল। এই সফটওয়্যারের ফিচারে অনেক ঘাটতির পাশাপাশি ছিল অপটিমাইজেশনেরও অভাব। ফলে এটি ব্যবহারকারীদের মুখে তেমন একটা হাসি ফোটাতে পারেনি। ২০১২ সালে HTC-র গ্লোবাল মার্কেট শেয়ার ৫ শতাংশেরও নিচে নেমে গেলে HTC মার্কেট শেয়ারে প্রথম ধাক্কাটা খায়। অথচ ২০১১ সালেও কোম্পানিটির গ্লোবাল মার্কেট শেয়ার ছিল ৯.১ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০০৯ সালে মার্কেট শেয়ারের দিক থেকে HTC থেকে পিছিয়ে থাকা Samsung ২০১৩ সালে ২৪.৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে স্মার্টফোন বাজারের শীর্ষস্থান দখল করে।
স্মার্টফোনের বিক্রি কমে আসতে থাকায় নিম্নমুখী হতে থাকে HTC’র রাজস্ব গ্রাফ। ২০১২ সালে কোম্পানির রাজস্ব ৩৭.৯১ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৯.৬৩ বিলিয়ন ডলারে। এভাবে ধীরে ধীরে প্রতি বছরই কোম্পানিটি ক্রমশ লোকসানের দিকে এগোতে থাকে। HTC অল্প সময়ে স্মার্টফোন মার্কেটে জনপ্রিয়তাকে করায়ত্ত করতে পারলেও, তাদের সেই জনপ্রিয়তা তলিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দুর্বল পজিশনিং এবং ব্র্যান্ডিং। HTC তাদের প্রোডাক্টগুলো কাস্টমারদের কাছে সঠিকভাবে পজিশনিং করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর পাশাপাশি বিজ্ঞাপন খাত ও মার্কেটিংয়ে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ায় সঠিকভাবে ব্র্যান্ডিংও করতে পারেনি কোম্পানিটি।
HTC ব্র্যান্ড ঠিক কী রিপ্রেজেন্ট করে, সেই সম্পর্কে ক্রেতাদের কোনো পরিষ্কার ধারণাও দিতে পারেনি কোম্পানিটি। এর পেছনে দায়ী ছিল মূলত তৎকালীন সিইও পিটার চাও-এর পারফেকশনিস্ট মনোভাব। তার ধারণা ছিল, HTC-র উন্নতমানের হার্ডওয়্যার, স্মুথ ইউজার ইন্টারফেস এক্সপেরিয়েন্স, আর প্রিমিয়াম ডিজাইনই ব্যবহারকারীদের HTC-র ডিভাইসের প্রতি আকৃষ্ট করতে যথেষ্ট। তাই HTC-র ব্র্যান্ড ট্যাগলাইনও নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘Quietly Brilliant’। কিন্তু এখানেই মূলত ভুল করে বসেন চাও। HTC যেখানে মার্কেটে প্রিমিয়াম কোয়ালিটি দিয়ে অ্যাপলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছিল, স্যামসাং তখন মার্কেটে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত ও শক্তিশালী করতে দুর্দান্ত সব অ্যাড ক্যাম্পেইন লঞ্চ করছিল।
২০১১ সালে স্যামসাং তাদের Galaxy SII ফোনটি বাজারে ছেড়ে বেশ সাড়া ফেলে দেয়, যা স্যামসাংয়ের ক্ষেত্রে আশীর্বাদ হয়ে আসে। এ ধরনের বিজ্ঞাপনের কারণে ভোক্তাদের মধ্যে ‘IOS বনাম Android’ নামক এক নীরব স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তখন অ্যান্ড্রয়েড বলতে সাধারণ স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা স্যামসাংকেই ধরে নিত। যার বিপরীত জবাব হিসেবে HTC সেভাবে প্রচারণা চালায়নি, এবং আগে থেকেই কোম্পানির ব্র্যান্ডিংও ছিল বেশ দুর্বল। আবার HTC চাইলেও নিজেদের মার্কেটিং এক্সপেরিয়েন্স বাড়াতে পারছিল না। কারণ, ‘ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করতে মার্কেটিং এবং অ্যাডভার্টাইজিং সমান তালে গুরুত্বপূর্ণ’, এই কথা HTC যে সময়ে বুঝতে পেরেছিল, ততদিনে তাদের রাজস্ব অনেকটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
যদিও ২০১৩ সালে HTC আয়রন ম্যান অভিনেতা রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের সাথে ১২ মিলিয়ন ডলারের অ্যাডভার্টাইজিং কন্ট্রাক্ট সাইনের মাধ্যমে, ‘Here’s to change’ নামে একটি বিজ্ঞাপন লঞ্চ করে। কিন্তু বিজ্ঞাপনে কোম্পানিটি নিজেদের আসল প্রোডাক্ট স্মার্টফোনকে সঠিকভাবে উপস্থাপন, এবং তাদের কোম্পানিটি আসলে কী রিপ্রেজেন্ট করে তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়। সে বছর HTC বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ করে সর্বসাকুল্যে ১ বিলিয়ন ডলার, যা কোম্পানিটির তৎকালীন অবস্থার কথা চিন্তা করলে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিনিয়োগ বলা চলে। তবে, সে বছর স্যামসাংয়ের অ্যাডভার্টাইজিং বাজেট ছিল HTC-র দশগুণ, যা স্মার্টফোন ম্যানুফ্যাকচারারদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
HTC নিজেদের স্মার্টফোন বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে, ২০১১ সালে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে পিসি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি S3 Graphics-কে কিনে নেয়। কিন্তু কোম্পানিটি পরের কয়েক বছরেও HTC-র জন্য নতুন কোনো হার্ডওয়্যার তৈরি করতে পারেনি। ২০১১ সালে HTC আরও ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে Beats Audio-র ৫১% শেয়ার কিনে নেয়। যদিও তারা কোম্পানিতে তাদের শেয়ার ৩৫৬ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দিয়ে, ৫৬ মিলিয়ন ডলার লাভ করে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু ঠিক দুই বছর পর অ্যাপল ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে Beats Audio-কে অধিগ্রহণ করে নেয়। HTC শেয়ারগুলো বিক্রি না করে দিলে, কোম্পানিটির লাভের অংক থাকত বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০১১ সালে HTC লন্ডনের মোবাইলভিত্তিক মাল্টিমিডিয়া কোম্পানি Saffron Digital Ltd কে ৪৮.৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নিতে সক্ষম হয়। পরের বছর তারা আমেরিকান গেমস্ট্রিম কোম্পানি ‘On Live’-এ ৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকলেও, HTC এখানেও এই দুটি প্ল্যাটফর্মকে নিজেদের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। এছাড়াও ব্যবসায় বৈচিত্র্যময় ভাবধারা আনার লক্ষ্যে HTC আরও বেশ কয়েকটি ছোট-বড় সেগমেন্টে বিনিয়োগ করলেও কোনোটিই তাদের লাভের মুখ দেখাতে পারেনি। দুর্বল মার্কেটিং আর ত্রুটিপূর্ণ বিনিয়োগ ব্যবস্থার কারণে যেখানে কোম্পানিটির অবস্থা খারাপের দিকে ঝুঁকছিল, সেই অবস্থা আরও শোচনীয় পর্যায়ে নিয়ে যায় কোম্পানিটির স্মার্টফোন নামকরণ প্রক্রিয়া।
স্মার্টফোনের নামকরণের ক্ষেত্রে HTC বেশ অদ্ভুত অদ্ভুত সব নাম বাছাই করত। যেমন – ChaCha, Salsa, Desire, Sensation, Amaze, Incredible, Butterfly ইত্যাদি। আবার নামকরণে থাকত না কোনো ধারাবাহিকতাও।
২০১২ সালে কোম্পানিটি HTC One S, One V, One X নামে তিনটি প্রিমিয়াম স্মার্টফোন রিলিজ করে। পরের বছর তারা HTC One X এর সাফল্য-ধারা অনুযায়ী HTC One রিলিজ করে, যা আবার ব্যবহারকারীদের কাছে HTC One M7 হিসেবে অধিক পরিচিতি পায়। এর পরের বছর কোম্পানিটি One M8 নামে ফ্ল্যাগশিপ রিলিজ করে, অর্থাৎ প্রতিবছর শুধু ফ্ল্যাগশিপের নামেই পরিবর্তন আসছিল। অথচ স্যামসাং ফোনের নামকরণ প্রক্রিয়া শুরু থেকেই Galaxy S এর সাথে একটি সংখ্যা বাড়িয়ে করা হতো, যা ব্যবহারকারীদের পক্ষে মনে রাখা খুবই সহজ ছিল। এত কিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে কোম্পানিটির অভ্যন্তরীণ বেশ কিছু ইস্যুও HTC এর উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কোম্পানির সিইও কর্তৃক বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজারদের প্রতি সমালোচনা এবং বাহির থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তগুলো কোম্পানির কর্মকর্তাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছিল। সেই সাথে কোম্পানির দায়িত্ব নিয়েও চাকরিজীবীদের মাঝে সৃষ্টি হয় এক ঘোলাটে মনোভাব। ২০১৩ সালে কোম্পানিটির ‘গ্লোবাল কমিউনিকেশনস এর ভাইস প্রেসিডেন্ট, রিটেল মার্কেটিং ম্যানেজার, ডিজিটাল মার্কেটিং ডিরেক্টর আর প্রোডাক্ট স্ট্র্যাটেজি ম্যানেজার কোম্পানি ছেড়ে চলে যান। মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট শুরু থেকেই ছিল বেশ অগোছালো। ফলে ম্যানেজমেন্টের দিক থেকে কোম্পানিটি ধীরে ধীরে ভঙ্গুর অবস্থানে যাচ্ছিল, আর এসব বিষয় বুঝতে পেরে মাইক্রোসফট HTC অধিগ্রহণ করে নিতে চেয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে কোম্পানিটি নোকিয়া মোবাইল ডিভিশন অধিগ্রহণ করে নেয়। এসব ইস্যুর পাশাপাশি স্মার্টফোনের মার্কেট শেয়ারে ততদিনে স্যামসাংয়ের পাশাপাশি আরও অনেক নতুন নতুন ব্র্যান্ড প্রতিযোগী হিসেবে উঠে এসেছিল।
চীনা স্মার্টফোন ম্যানুফ্যাকচারার ‘Huawei’ ও ‘Xiaomi’ স্বল্প বাজেটের মধ্যে ভালো কোয়ালিটি ও পারফরম্যান্সের ফোন বাজারে আনতে থাকায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই স্মার্টফোন মার্কেটে বেশ ভালো অবস্থানে উঠে আসে। এছাড়াও তাদের বুদ্ধিদীপ্ত মার্কেটিং ক্যাম্পেইন ও অ্যাডভার্টাইজমেন্টের কারণে খুব সহজে ও দ্রুতই কাস্টমারদের আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। যদিও HTC এরপরেও বাজারে ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোন রিলিজ করছিল। ২০১৮ সালেই ‘HTC U12+’ রিলিজ করেছিল যা তেমন একটি সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ, ততদিনে ক্রেতারা HTC ফোনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে থাকে।
২০১৩ সালে HTC-র স্টক ছিল ২০১১ সালের স্টক ভ্যালুর ৯০ শতাংশ কম। ২০১৫ সালে কোম্পানিটির রাজস্ব আগের বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কমে গিয়ে ১৫৫ মিলিয়ন ডলার লোকসান হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে, ৬৬% মার্কেট শেয়ার পতনের পর তাইওয়ান স্টক এক্সচেঞ্জের ৫০টি বড় কোম্পানি থেকে HTC’র নাম বাদ পড়ে যায়। সে বছরই সিইও পিটার চাও পদত্যাগ করেন আর শের ওয়াং পুনরায় সিইও পদে ফেরত আসেন। কিন্তু ততদিনে HTC-র মার্কেট তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তাই, সে বছর HTC কোম্পানিটি বিশ্বব্যাপী ১৫% কর্মী ছাটাইয়ের ঘোষণা দেয়। পর পর বেশ কয়েকটি লোকসানের ধাক্কা খাওয়ার পর ২০১৭ সালে ১.১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে গুগল HTC’র হার্ডওয়্যার ব্যবসার বেশ বড় একটি অংশ কিনে নেয়। এই অধিগ্রহণের ফলে HTC-র দুই হাজারেরও বেশি ইঞ্জিনিয়ার গুগলে যোগ দেয়, যারা বর্তমানে গুগলের পিক্সেল ডিভিশনে কাজ করছে। এছাড়াও ২০১৮ সালে কোম্পানিটি এর ব্যয় কমানোর জন্য তাইওয়ানে আরও ১৫০০ কর্মী ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা বিশ্বব্যাপী HTC-র কর্মচারীর প্রায় ২২ শতাংশ। স্মার্টফোনের বদলে কোম্পানিটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, ও ব্লক চেইনের দিকে ফোকাস করছে। দায়িত্ব নেয়ার পর শের ওয়াং বুঝতে পেরেছিলেন, স্মার্টফোন মার্কেটে কোম্পানি যে ভরাডুবির সম্মুখীন হয়েছে তা থেকে বের হওয়া এককথায় অসম্ভব। যার ফলে তারা তাদের নজর সরিয়ে আনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির দিকে, এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে তারা বেশ সাফল্যের সাথে এগোচ্ছে।
মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মতো ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির দিকে ফোকাস ঘুরিয়ে নেয়ার অংশ হিসেবে ২০১৯ সালের শেষ দিকে ইভস মেইট্রিকে কোম্পানির সিইও হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। যদিও তিনি কিছুদিন পরেই নিজের পদ ছেড়ে দেন এবং শেষ খবর অনুযায়ী শের ওয়াং তৃতীয়বারের মতন সিইওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।