সাইবর্গ, মানব শরীর আর প্রযুক্তির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী কিংবা মুভির বদৌলতে সাইবর্গ সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। সাইবর্গ পুলিশ ওরফে রোবোকপ কিংবা টার্মিনেটর সিনেমার সাইবর্গ, এদের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানি না বর্তমান প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার ফলে সাইবর্গরা আর শুধু বইয়ের পাতা কিংবা মুভিতে নয়, তারা পা রেখেছে বাস্তবেও। আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে এমন কয়েকজন বিশ্বখ্যাত সাইবর্গের সাথে, যাদের বিচরণ বইয়ের পাতা বা সিনেমার কল্পরাজ্যে নয়, বরং আমাদের এই বাস্তব পৃথিবীতে।
ম্যানফ্রেড ক্লাইনেস এবং নাথান ক্লেইন ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম ‘সাইবর্গ’ টার্মটি উদ্ভাবন করেন। সাইবর্গ হলো প্রাকৃতিক মানব দেহ ও যন্ত্রের সমন্বয়। আরো সহজভাবে বলতে গেলে, সিনেমার চরিত্রগুলোর আশ্রয় নিতে হবে। সেই রোবোকপকে মনে আছে? এলেক্স মার্ফি নামের একজন পুলিশ অফিসার, যাকে কিনা একটি বড় দুর্ঘটনার পর বাঁচিয়ে রাখতে শরীরে অনেকগুলো কৃত্রিম যন্ত্রাংশ লাগানো হয়। ফলে মানুষ আর রোবটের সমন্বয়ে তিনি হয়ে উঠেন স্বাভাবিকের চেয়ে অত্যন্ত উন্নত একজন মানুষ, সাইবর্গ। অর্থাৎ সাইবর্গ হলো এমন ধরনের মানুষ, যাদের শরীরের কোনো একটি অঙ্গ যন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে! ফলে তারা হয়ে উঠেছেন স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আরো উন্নত।
আসুন তাহলে এবার বাস্তব জগতের সাইবর্গদের সম্পর্কে জানা যাক।
১. নিল হার্বিসন
বাস্তব জগতের সাইবর্গদের সম্পর্কে বলতে গেলে সবার প্রথমে যার নাম আসে তিনি নিল হার্বিসন। মাথায় বড়সড় একটা পিঁপড়ার শুঁড়ের মতো এন্টেনা লাগানো হার্বিসনকে দেখলে আপনার মনে হতে পারে তিনি কোনো সাই-ফাই মুভি থেকে উঠে আসা এক চরিত্র। কিন্তু উনি আসলে পেশায় একজন শিল্পী। জন্ম থেকেই অ্যাক্রোম্যাটোপসিয়া নামক এক বর্ণান্ধতা নিয়ে জন্মানো নিল হার্বিসন সাদা আর কালো ছাড়া আর কোনো রংই দেখতে পেতেন না। তার কাছে গোটা পৃথিবীটাই ছিল সাদা-কালো। কিন্তু তার জীবন বদলে দেয় জটিল একটি অপারেশন।
অপারেশনের মাধ্যমে তিনি তার মাথায় স্থাপন করেন একটি এন্টেনা যা আসলে একটি ‘আইবর্গ’ বা বিশেষ ইলেকট্রিক চোখ। এই আইবর্গের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন রং দেখতে পান শব্দের আকারে। সাদা-কালো জগতের একজন মানুষ থেকে পরিণত হন এমন একজন মানুষে, যিনি কিনা এমন অসাধারণভাবে রংগুলো দেখতে পান, যা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে! তিনি বলে দিতে পারেন কোন শব্দের রং কী। হ্যাঁ,অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি।
দশ বছর ধরে হার্বিসন মাথার উপর এই এন্টেনা নিয়ে দিব্যি আরামে বেঁচে আছেন। তিনি মনে করেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে ডিঙিয়ে যাওয়া প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব। তিনি বিশ্বাস করেন, অদূর ভবিষ্যতে সব মানুষের মাথার পিছনেই একটি তৃতীয় চোখ থাকবে, যার মাধ্যমে পেছনের সব জিনিসের উপর নজর রাখা যাবে। তিনি এ ব্যাপারে এতটাই আশাবাদী যে, যারা সাইবর্গ হতে চান তাদেরকে সাহায্যের জন্য ২০১০ সালে ‘সাইবর্গ ফাউন্ডেশন’ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি মানব শরীরে বিভিন্ন সাহায্যকারী যন্ত্র প্রতিস্থাপন করার কাজ করে থাকে।
২. কেভিন ওয়ারউইক
‘ক্যাপ্টেন সাইবর্গ’ নামে পরিচিত কেভিন ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটি অফ রিডিংয়ের একজন প্রফেসর। বিশ্বের ‘সবচেয়ে সম্পূর্ণ সাইবর্গ’ হওয়ার প্রচেষ্টায় যিনি নিজেই হয়েছেন নিজের পরীক্ষাগারের গিনিপিগ।
১৯৯৮ সাল থেকে তিনি নিজের শরীরে বিভিন্ন মাইক্রোচিপ ইমপ্লান্ট করে পরীক্ষা চালিয়েছেন। তিনি তার বাহুতে লাগিয়েছেন এমন এক মাইক্রোচিপ যার সাহায্যে তিনি ঘরের লাইট, ফ্যান, টিভি সহ নানা রকম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কেভিনই সর্বপ্রথম মানব যিনি নিজ দেহে প্রতিস্থাপিত মাইক্রোচিপের সাহায্যে তার নিজের শরীরকে যুক্ত করতে পারেন ইন্টারনেটের সাথে!
৩. জেসি সুলিভান
ইলেক্ট্রিক্যাল লাইন্সম্যান হিসেবে কর্মরত জেসি সুলিভান ২০০১ সালের মে মাসে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হন। এই দুর্ঘটনায় তিনি তার দুটি হাতই হারান। ডাক্তাররা যখন তাকে প্রচলিত রাবারের হাত লাগানোর পরামর্শ দেন ঠিক তখনই শিকাগোর পুনর্বাসন কেন্দ্র তাকে বায়োনিক বা রোবোটিক হাত লাগানোর প্রস্তাব দেয়। সানন্দে রাজি হয়ে যান সুলিভান। এরপর থেকে পাল্টে যায় তার জীবনের গল্প। তিনি হয়ে উঠেন বিশ্বের প্রথম বায়োনিক হাতযুক্ত সাইবর্গ।
সুলিভানের এই বায়োনিক হাত দুটি তার শরীরের নার্ভাস সিস্টেমের সাথে যুক্ত। ফলে তিনি স্বাভাবিক হাতের মতোই রোবোটিক হাত দুটিকে মস্তিষ্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, তার এই কৃত্রিম হাতের সাহায্যে তিনি কোনো জিনিসের তাপমাত্রা এবং কোনো জিনিস মুঠো করে ধরলে কত জোরে চাপ দিয়ে ধরছেন সেটাও বুঝতে পারেন।
৪. ক্লডিয়া মিশেল
বিশ্বের প্রথম মহিলা সাইবর্গ হলেন ক্লডিয়া মিশেল। প্রায় চার বছর ধরে মেরিন কর্পে কর্মরত মিশেল একদিন এক মোটরবাইক দুর্ঘটনায় একটি হাত হারিয়ে ফেলেন। এরপর জেসি সুলিভানের মতো তার শরীরেও স্থাপন করা হয় একটি বায়োনিক হাত যা তার শরীরের নার্ভাস সিস্টেমের সাথে যুক্ত। এই বায়োনিক হাতের সাহায্যে মিশেল এখন প্রায় সব ধরনের স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন ।
তিনিই ইতিহাসের প্রথম মহিলা যিনি তার বায়োনিক হাতের সাহায্যে রান্নাবান্না, কাপড় ভাঁজ করা কিংবা পানির বালতি বহন করা সহ প্রায় সকল গৃহস্থালির কাজ করতে পারেন। তিনি তার হাতটিকে এতটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন যে এই হাতটির সাহায্যে স্বাভাবিক মানুষের মত কলা ছিলে খেতে পারেন তিনি।
৫. জেরি জালাভা
নতুন বাইক কিনে খুব ফূর্তিতেই চালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন ফিনিস প্রোগ্রামার জেরি জালাভা। কিন্তু বিধি বাম! বাইক কেনার এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি এক দুর্ঘটনার শিকার হন। দুর্ঘটনার পর পরই লাইটার বের করে সিগারেট ধরাতে গিয়ে তিনি দেখেন দুর্ঘটনায় উড়ে গেছে তার মধ্যমা আঙ্গুলের অর্ধেক। তারপর আর কী! তিনিও নাম লেখান সাইবর্গদের লিস্টে। তবে একটু ভিন্নভাবে। একজন সাইবর্গ হতে হলে যে আপনাকে রোবোটিক্স এক্সপার্ট হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন জেরি জালাভা।
দুর্ঘটনায় আঙ্গুল হারানোর পর তিনি নিজেই তার হাতে কৃত্রিম আঙ্গুল লাগিয়ে নেন। আর সেই আঙ্গুলের মধ্যে তিনি স্থাপন করেন একটি ২ গিগাবাইট ইউএসবি ড্রাইভ। ভাবতে পারেন? আপনি যে পেনড্রাইভ আপনার পকেটে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ান, জালাভার একটি আঙ্গুলই সেই পেনড্রাইভ হিসাবে কাজ করে! যদিও এই ইউএসবি ড্রাইভের সাথে তার নিজের মস্তিস্কের কোনো সংযোগ নেই। ভবিষ্যতে তার এই আঙ্গুলকে আরও উন্নত করার ইচ্ছা আছে জালাভার।
৬. স্টেলিওস আর্কাডিও
সবশেষে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে পাগলাটে এক সাইবর্গের সাথে। স্টেলিওস আর্কাডিও বা স্টেলার্ক নামেই যিনি বেশি পরিচিত। পেশায় তিনি একজন পারফর্মেন্স আর্টিস্ট, যিনি কিনা নিজের বাহুতে লাগিয়েছেন তৃতীয় একটি কান। হ্যাঁ, বিষয়টি খুব উদ্ভট মনে হলেও সত্য। ১৯৯৬ সালে তিনি এই কান লাগানোর পরিকল্পনা করলেও শেষমেশ ২০০৭ সালে একটি অপারেশনের মাধ্যমে তিনি তার চামড়ার নিচে একটি কৃত্রিম কান স্থাপন করতে সক্ষম হন। এই কানটির মধ্যে পরবর্তীতে শিরা-উপশিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের বিস্তারের মাধ্যেমে এটি হয়ে উঠে তার শরীরের একটি অংশ।
স্টেলার্কের পরিকল্পনা ছিল কানটির মধ্যে ছোট্ট একটি মাইক্রোফোন বসানোর, যেটি ওয়াইফাই হটস্পটের মাধ্যমে যুক্ত হবে ইন্টারনেটের সাথে আর চালু থাকবে ২৪ ঘন্টা। এই কানের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কেউ তাকে ২৪ ঘন্টা শুনতে পারবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। স্টেলার্ক বলেন, “এই কানটি আমার জন্য নয়। শোনার জন্য আমার আগে থেকেই দুটি কান রয়েছে। এই তৃতীয় কানটি হলো একটি রিমোট লিসেনিং ডিভাইস। যেটি দিয়ে বিভিন্ন জায়গার মানুষ আমাকে শুনতে পাবে।” স্টেলার্ক মনে করেন শরীর আর যন্ত্রের সমন্বয়ের যে ভীতি আমাদের মধ্যে রয়েছে তা মন থেকে দূর করা উচিত। কারণ, টেকনোলজি আমাদের শরীরেরই একটা অংশ।
এগিয়ে যাচ্ছে দিন, এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রযুক্তি। আগে কোনো মানুষ কোনো দুর্ঘটনায় শরীরের কোনো অংশ হারালে হয়ে পড়তো পঙ্গু, সমাজের চোখে হয়ে উঠতো বোঝার মতো। কিন্তু প্রযুক্তির এই অগ্রগতির ফলে আজ মানুষ তার বাধাগুলো উতরে যাচ্ছে, দূর করছে তার পঙ্গুত্ব। উপরের মানুষগুলোই হচ্ছে তার প্রমাণ। কিন্তু শরীরের সাথে যন্ত্রের যোগের ফলে মানুষ যাতে পুরোপুরি যান্ত্রিক না হয়ে যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নাহলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী কিংবা মুভির মতো বাস্তবেও শুরু হতে পারে সাইবর্গ ও মানুষের যুদ্ধ, হতে পারে সাইবর্গ বিল্পব!