চায়ের দোকানে বসে আলাপ করছেন দুই ভার্সিটি পড়ুয়া বন্ধু। আলাপের বিষয় হলো সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে কোথাও ঘুরতে যাওয়া। দুই বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পরীক্ষার পর ছুটিতে ভারত ঘুরে আসবেন। বেড়ানোর স্থান ঠিক হওয়ার পর আলোচনা শুরু হলো কোন কোন জায়গা ঘুরতে যাওয়া যায় তা নিয়ে। আনুমানিক কত খরচ হবে, আর কাদের এই ট্যুরে সাথে নেওয়া যায়, পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা ইত্যাদি নিয়ে তারা কথা বলতে থাকে। এক হাতে স্মার্টফোন এবং অন্য হাতে চায়ের কাপ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তারা নানা পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত।
দীর্ঘ সময় আলোচনা করার পর প্রত্যেকে নিজ নিজ বাসায় চলে গেলো। বাসায় পৌঁছে এক বন্ধু নিজের ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করে। স্ক্রল করতে করতেই তার চোখ একটি বিজ্ঞাপনে আটকে যায়। ভারতে অল্প খরচে কীভাবে ঘুরে আসা যায় তা নিয়ে একটি ট্রাভেল এজেন্সির বিজ্ঞাপন। বন্ধুটি ভাবতে থাকে, এটি কী কেবলই একটা কাকতালীয় ঘটনা?
আমরা নানা সময়ে বিভিন্ন অপরিচিত মানুষের সাথে পরিচিত হই। এভাবে আমরা বাস্তব জগতে বন্ধু বানাই। কখনো কী আপনার সাথে এমনটা হয়েছে যে, সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর ঐ দিনই আপনার ফেসবুকের “পিপল ইউ মে নো” অপশনে তার একাউন্ট সবার আগে চলে এসেছে? হয়ে থাকলে এটি কী একটি চিন্তা করার মতো বিষয় নয়?
ক্লাসের একটি লেকচার কোনোভাবেই মাথায় ঢুকছে না। বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে জানতে পারলেন যে তাদেরও একই অবস্থা। এখন তাহলে ইউটিউবের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু ইউটিউবে ঢুকেই আপনি একটি আজব বিষয় আবিষ্কার করলেন। যে টপিকের ভিডিও আপনি সার্চ করতেন, তা আগে থেকেই আপনার হোমপেজে উঠে বসে আছে। এর ব্যাখা কী হতে পারে?
এসব ঘটনা বা এর সমতুল্য কোনো ঘটনা আপনার সাথে ঘটে থাকলে অবাক হবেন না। কারণ এটি নিয়ে অনেকেই প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটে অভিযোগ করছে।
তাহলে এসব কাকতালীয় ঘটনাগুলোর পেছনে মূল কারণ কী? সহজভাবে বলতে গেলে দুই শব্দেই এর ব্যাখা হয়ে যায়। আর তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কেবল প্রযুক্তিই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা ক্ষেত্রেও এর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এখন প্রায় সকল আধুনিক যন্ত্রে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী স্মার্টফোন ও কম্পিউটারও এর ব্যতিক্রম নয়।
বড় বড় সকল কোম্পানির এখন অন্যতম চালিকা শক্তি হলো মেশিন লার্নিং। নিত্য নতুন যত অ্যাপ্লিকেশন ও গ্রাহক সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে আছে, তারা সকলে এই প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহকের ইচ্ছা, চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে অনেক বিস্তারিতভাবে জানা যায়। এসব তথ্যের উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
মেশিন লার্নিং আসার আগে গ্রাহকের চাহিদা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য থাকতো সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই প্রযুক্তি রাতারাতি উন্নত হওয়ার পর মানুষের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করার নানা উপায় বের হয়ে এসেছে। এদের মধ্যে কিছু পদ্ধতি একজন মানুষের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে সক্ষম। তা সত্ত্বেও নানা প্রতিষ্ঠান এগুলোর প্রয়োগে পিছপা হয়নি।
আমাদের প্রত্যেকের হাতে হাতে এখন রয়েছে স্মার্টফোন। এই বস্তুটি ছাড়া আমাদের এক মুহূর্তও চলা সম্ভব না। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে অঙ্গঅঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে এটি। এই ফোনে ব্যবহার করা যায় লক্ষ লক্ষ অ্যাপ্লিকেশন। গ্রাহককে সুবিধা প্রদান করার জন্য চলে এসেছে নানা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) সুবিধা। এদের মধ্যে অ্যাপলের সিরি ও গুগল হোমের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে মাইক্রোসফটের করটানা ও অ্যামাজনের অ্যালেক্সা। গ্রাহকের ভয়েস কমান্ড থেকে এরা নানা রকম কাজ সম্পাদন করতে পারে। এদের ‘ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট’ নামেও অভিহিত করা হয়।
এসব ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টগুলোকে নিজেদের কাজে ব্যবহার করার সময় নির্দিষ্ট কিছু শব্দ বা ভয়েস কমান্ড দিয়ে ট্রিগার করতে হয়। অ্যাপলের সিরির ক্ষেত্রে যা হলো ‘হেই সিরি’ এবং গুগল হোমের ক্ষেত্রে ‘ওকে গুগল’। এই কি-ওয়ার্ডগুলো শোনার পর এরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যবহারকারীর নির্দেশনা নেওয়া শুরু করে।
এখন এআই এর কাজ কী কেবল কথা শোনা ও আদেশ পালন করার মাঝেই সীমাবদ্ধ? না। এই প্রযুক্তি যে কতটা উন্নত তা আমাদের কল্পনার বাইরে। ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছাড়াও আরো অনেক এআই সিস্টেম রয়েছে যা নিয়মিত আমাদের কথা শুনছে। স্মার্টফোনে ব্যবহারের জন্য রয়েছে লক্ষ লক্ষ অ্যাপস। এগুলোর অনেকেই বিনা অনুমতিতে ব্যাকগ্রাউন্ডে থেকে আমাদের কথা শুনে যাচ্ছে। আবার আমরা নিজেরাও নানা দিক উপেক্ষা করে এসব অ্যাপগুলোকে আমাদের কথা শোনার অনুমতি দিয়ে দিচ্ছি। যেকোনো অ্যাপ্লিকেশন ফোনে ইনস্টল করার পর দেখবেন এটি আপনার ফোনের গ্যালারি, মাইক্রোফোন ইত্যাদিতে অনুপ্রবেশের অনুমতি চায়। আর আমরা ঝোঁকের বশে সব ‘ওকে’ করেও দেই। কখনো কী ভেবেছেন, একটা ই-কমার্স ওয়েবসাইটের অ্যাপ আপনার মাইক্রোফোনে অনুপ্রবেশের অনুমতি পেলে কী করবে?
মানুষের গলার আওয়াজ বিশ্লেষণের জন্য ইতোমধ্যে নানা গবেষক কাজ করে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন মেশিন লার্নিং পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এগুলো দিয়ে একজন বক্তার শুধু কথা থেকেই নানান তথ্য বের করে আনা সম্ভব। যেমন ব্যক্তির পরিচয়, তার বাসা কোথায়, তার বয়স, সে কোন ভাষায় কথা বলে ইত্যাদি।
এগুলো যদি নিতান্ত স্বাভাবিক মনে হয়, তবে কিছু উন্নত অডিও অ্যানালাইসিস অ্যালগরিদম সম্পর্কে বলা যাক। এসব অ্যালগরিদম মানুষের কথা থেকে তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে। সে বিষণ্ণতায় ভুগছে কিনা, মাদকাসক্ত কিনা, দাম্পত্য কলহে জর্জরিত কিনা ইত্যাদি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বের করে আনতে পারে এসব আধুনিক এআই সিস্টেম। এছাড়া কেবল মানুষের মুখের আওয়াজ ছাড়াও তার পারিপার্শ্বিকের নানা শব্দ থেকে তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
এই যে এত সূক্ষ্মভাবে শব্দ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যায়, এর জন্য পুরো কৃতিত্ব দিতে হবে মেশিন লার্নিংকে। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই একটি শাখা। এই মেশিন লার্নিং আসলে যা করে, তা হলো এর একটি নির্দিষ্ট অ্যালগরিদম থাকে। এই অ্যালগরিদম কোটি কোটি তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে। এসব তথ্যের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় তারা নানা মিল বা প্যাটার্ন খুঁজে পায়। এই মিল অনুযায়ী অ্যালগরিদমগুলো নিজেরাই নিজেকে হালনাগাদ করে। এভাবে তাদের সংগৃহীত ফলাফল হয় নির্ভুল ও নিখুঁত। আর যেহেতু যন্ত্র নিজেই নিজের প্রোগ্রামে পরিবর্তন আনতে পারে। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে মেশিন লার্নিং।
এখন কথা হলো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের এত ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে আসলে করবেটা কী? এর সহজ উত্তর হলো মানুষ সম্পর্কে জানা। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদা সম্পর্কে জানা। প্রত্যেক বড় বড় ইন্টারনেট সুবিধাযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থা কাজ করে। এরা যেমন অর্থ দিয়ে অন্যান্য কোম্পানির ওয়েবসাইটে নিজেদের পণ্য প্রচার করে থাকে, তেমনি বিনিময়ে এরা ঐ কোম্পানির গ্রাহকদের তথ্য চায়।
গ্রাহকদের তথ্য পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে তারা সেই গ্রাহক সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারে। একজন নির্দিষ্ট গ্রাহক কোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে নির্দিষ্ট কী কী পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখবে তা বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো এভাবে বের করে ফেলে। এই বিপণন নীতি এখন সকল প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স ওয়েবসাইট ব্যবহার করছে। গুগল অ্যাডস এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর জন্যই আপনি কোনো বিদেশী ওয়েবসাইটে দেশী পণ্যের বিজ্ঞাপণ দেখতে পান।
ডক্টর পিটার হ্যানে অস্ট্রেলিয়ার ইডিথ কোয়ান ইউনিভার্সিটির একজন প্রাক্তন লেকচারার ও গবেষক। বর্তমানে তিনি অ্যাস্টেরিস্ক নামের একটি সাইবার সিকিউরিটি ফার্মের সিনিয়র সিকিউরিটি কনসাল্ট্যান্ট পদে নিয়োজিত রয়েছেন। অডিও রেকর্ড থেকে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি নিয়ে তিনি দীর্ঘ মেয়াদী গবেষণা করেছেন। বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানির এভাবে তথ্য সংগ্রহ করা নিয়ে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন-
যেহেতু গুগল এই পদ্ধতিতে গ্রাহকদের তথ্য সংগ্রহ করা নিয়ে কোনো রাখঢাক করে না। তাই আমি ধরে নিতে পারি অন্যান্য কোম্পানিগুলোও এই কাজটি করছে। আর করবেই বা না কেন। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটি অনেক ফলপ্রসূ। আর তাদের নানা সেবার নিয়ম-নীতিতেও এ ব্যাপারটি উল্লেখ থাকে। তাই আমি ধরে নিতে পারি তারা এ কাজটি করছে। কিন্তু এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে না।
ফেসবুক বরাবরের মতোই রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করার অভিযোগ নাকচ করে আসছে। তবে ডক্টর পিটার হ্যানে একটি ব্যক্তিগত পরীক্ষার মাধ্যমে বড় বড় কোম্পানির এই বিপণন প্রথা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি টানা ৫ দিন ধরে দিনে দুইবার তার ইন্টারনেট সংযুক্ত ডিভাইসের সামনে কিছু নির্দিষ্ট বাক্য উচ্চারণ করে পরীক্ষা করতে থাকেন। এ বাক্যগুলোর মধ্যে ছিল, “আমাকে অফিসের জন্য কিছু সস্তা শার্ট কিনতে হবে”। আরেকটি হলো, “আমি পুনরায় ভার্সিটিতে যাওয়ার চিন্তা করছি”।
তিনি খুব দ্রুত তার এই পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে যান। কয়েকদিনের মাঝেই তিনি তার ফেসবুক নিউজফিডে কয়েকটা ব্রান্ডের দোকানের সস্তা শার্টের স্পনসরড পোস্ট দেখতে পান। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তথ্য সম্বলিত বিজ্ঞাপন দেখতে পান। এটি আসলেই একটি ভয়ংকর ব্যাপার। এভাবে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক সুবিধার্থে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে বিনিময় করছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী, প্রতি দশটি স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে কমপক্ষে সাতটি অ্যাপ্লিকেশন তৃতীয় কোনো পক্ষের সাথে গ্রাহক তথ্য বিনিময় করছে। অ্যাপগুলো ফোনে ইনস্টল করার পর আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে ঠিকই। তবে কিছু ক্ষেত্রে এগুলো একত্রিত হয়ে আপনার ব্যক্তিগত জীবনের পরিপূর্ণ চিত্র গঠন করতে পারবে। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো গুগল অ্যানালিটিকস।
আমাদের ফোন সবসময় আমাদের কাছে থাকে। যেখানেই যাই, পকেটে বা ব্যাগে করে আমরা এই যন্ত্রটা সাথে নিয়ে যাই। ব্যক্তিগত জীবনের যত আলাপ-আলোচনা, হাসি-কান্না সকল ঘটনার সময় এই স্মার্টফোনগুলো আমাদের কাছেই থাকে। দুশ্চিন্তার বিষয় হলো এত কিছু জানা সত্ত্বেও আমরা এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো না।
ইন্টারনেট এখন আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের অংশ। আর আমাদের গোপনীয়তা ইন্টারনেটের অংশ। আমাদের অনেক কাছের বন্ধুর থেকেও এই স্মার্টফোন আমাদের সম্পর্কে বেশি জেনে থাকতে পারে। তাই পরবর্তীতে কোনো অ্যাপ্লিকেশন বা গেইম ইনস্টল করার সময় তা আপনার মাইক্রোফোন ও গ্যালারিতে প্রবেশের অনুমতি চাইলে এই কথাগুলো মনে করতে পারেন।