Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভিডিও গেম কি সহিংস আচরণের জন্যে দায়ী?

গত বছরে আমেরিকার টেক্সাস ও ওহায়ো রাজ্যে গোলাগুলির ঘটনার পরপরই ভিডিও গেমের বিরুদ্ধে আলোচনা বেশ সরব হয়ে উঠেছিল। এর কারণ, টেক্সাসের সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিটি তার ‘ম্যানিফেস্টো’তে কল অব ডিউটি গেমের নাম উল্লেখ করেছিল। কল অব ডিউটি একটি তুমুল জনপ্রিয় গেম, যেখানে কাল্পনিক ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন যুদ্ধে সৈনিকের ভূমিকায় খেলা যায়। এই ঘটনার পরে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার একটি প্রেস কনফারেন্সে ভিডিও গেমকে এ ধরনের সহিংসতার উৎস হিসেবে দাবি করেছিলেন।

আমাদের সমাজে সহিংসতাকে আকর্ষণীয় করে তোলার সংস্কৃতিটি বন্ধ করতে হবে। এর মধ্যে প্রচলিত ভয়ানক ও জঘন্য ভিডিও গেমগুলো অন্তর্ভুক্ত। কমবয়সীদের জন্যে এরকম একটি সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হওয়া এখন খুব সহজ হয়ে উঠেছে।

ট্রাম্পের এই বিবৃতি ভিডিও গেমের ব্যাপারে অনেক আইনপ্রণেতার মনোভাবকে সমর্থন করে। বড় মিডিয়াগুলোও ট্রাম্পের এই মতামতকে গ্রহণ করেছিল। যেমন: ইএসপিএন তখন একটি ইস্পোর্টস টুর্নামেন্টের সম্প্রচার শুরু করতে সময়ক্ষেপণ করেছিল। ওয়ালমার্ট তাদের স্টোরগুলোতে সাময়িকভাবে সকল ভিডিও গেম অপসারণ করেছিল। এই সিদ্ধান্তটি বিতর্কিত, কারণ সেই স্টোরগুলোতে তখনো বন্দুক বিক্রি করা হচ্ছিল এবং তা বন্ধ হয়নি।

অনেক গবেষক ভিডিও গেমকে এভাবে স্বতন্ত্রভাবে সহিংসতার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করাকে আসল কারণগুলো এড়িয়ে যাওয়ার একটি উপায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মতে, সাধারণ নাগরিকের বন্দুক কেনা ও তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে একটি শক্তিশালী আইন তৈরি করা উচিত। বন্দুক সংক্রান্ত সহিংস ঘটনাগুলোর প্রায় সবরকম আলোচনায় ভিডিও গেমের প্রসঙ্গ নিয়ে আসা হচ্ছে, যেখানে মূল আলোচনা হওয়া উচিত বন্দুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে। এখান থেকে সহজেই আঁচ করা যায়, আইন প্রণেতারা বন্দুক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কতটা অনিচ্ছুক। তাই রাজনৈতিক বক্তব্যগুলোতে বারবার শুধু ভিডিও গেমের দিকেই আঙুল তাক করা হচ্ছে।

বন্দুক সহিংসতার বিরুদ্ধে র‍্যালি; Image Source: Alex Wong

তবে ভিডিও গেমের এই প্রসঙ্গটি একেবারে নতুন নয়। বরং, একটি বড় সময় ধরে সহিংসতার পেছনে গেমকে দোষারোপ করতে গিয়ে তা রাজনৈতিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রথমবার তা দেখা গিয়েছিল ১৯৭০ সালে। তবে একটি দল দাবি করছে, হিংস্র আচরণের পেছনে ভিডিও গেমের যতটুকু প্রভাব থাকতে পারে, এটিকে তার চেয়েও অনেক বেশি দোষারোপ করা হচ্ছে। এই দলে শুধুমাত্র গেমপ্রিয় মানুষরাই রয়েছে ভাবলে ভুল হবে, এখানে গবেষক থেকে শুরু করে এমনকি বন্দুকজনিত সহিংসতা থেকে বেঁচে ফেরা মানুষও রয়েছেন। এমনই একজন হচ্ছেন ডেভিড হগ, যিনি ২০১৮ সালে ফ্লোরিডায় একটি গোলাগুলির ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরার পর থেকে বন্দুক নিয়ন্ত্রক অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করছেন। টুইটারে তিনি সরাসরিই লিখেছেন,

আমরা জানি, ভিডিও গেমগুলোকে দোষ দেওয়া যায় না।

এর আগে যতবারই এই প্রসঙ্গে কথা উঠেছে, কখনোই নির্দিষ্ট কোনোদিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়নি। কারণ, কোনো গবেষণাই এখন পর্যন্ত দাবি করতে পারেনি যে, ভিডিও গেমের সাথে সত্যিকারের সহিংসতার যোগাযোগ রয়েছে।

২০১৫ সালের আগের অনেকগুলো মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণাতে বেশ শক্তিশালীভাবেই দাবি করা হয়েছিল যে, ভিডিও গেম স্বাভাবিক আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার সামর্থ্য রাখে। এই গবেষণাগুলোর বেশিরভাগই অবশ্য তুলনামূলক নতুন গবেষণা দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। উদাহরণ দেওয়া যাক। নিকি ফিলিপস নামের একজন অপরাধবিজ্ঞানী পপুলার মিডিয়ায় দেখানো সহিংসতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, বেশিরভাগ অপরাধবিজ্ঞানীই বিনোদন মাধ্যমের সাথে অপরাধের যোগাযোগের আলোচনাটি প্রত্যাখ্যান করেন। তারা বরং সামাজিকভাবে কারো আচরণে সহিংসতা কীভাবে তৈরি হতে পারে সে ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।

১৯৭৬ সালে ‘ডেথ রেইস’ নামের একটি গেম মুক্তি পাওয়ার পরে, প্রথমবারের মতো ভিডিও গেমের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ এসেছিল। এই গেমে পালিয়ে যেতে থাকা পথচারীকে গাড়িচাপা দিতে পারলে রিওয়ার্ড দেওয়া হতো এবং পথচারীর তীব্র চিৎকার শোনা যেত। এরকম গেমপ্লের ফলে তখনই এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এমনকি সিক্সটি মিনিটস টিভি শোয়ের একটি অংশে এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঐসময়ে অন্য আরো কিছু গেম মুক্তি পেয়েছিল, যেগুলো যুদ্ধকালীন সহিংসতাকে কেন্দ্র করে তাদের গেমপ্লে সাজিয়েছিল। সেগুলো কোনো ধরনের আলোচনা তৈরি করেনি।

‘ডেথ রেইস’ গেম: Image Source: CNBC

২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘মোর‍্যাল কমব্যাট: হোয়াই দ্যা ওয়ার অন ভায়োলেন্ট ভিডিও গেমস ইজ রং’ বইয়ে মনোবিজ্ঞানী প্যাট্রিক মার্কি ব্যাখ্যা করেন, যারা ভিডিও গেমের সহিংসতা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন তারা এর আগে আর্কেড গেমের দিকেও আঙ্গুল তাক করেছিল যার কারণ গেমগুলো ছিল না। সেগুলো কিশোরদের আড্ডা দেওয়ার একটি জায়গা হয়ে উঠার অভিযোগ ছিল মূল কারণ। অনেকে স্কুলে না গিয়ে, বাবা-মার টাকা চুরি করে এসব আর্কেডে গেম খেলতে যেত।

Arcades were being shut down across the nation by activist parents intent on protecting their children from the dangerous influences lurking within these neon-drenched dungeons.

বিখ্যাত মর্টাল কমব্যাট ফ্র্যাঞ্চাইজি আসার পরে আর্কেডের প্রতি প্রাপ্তবয়স্কদের যে ভয় ছিল, তা এই গেমের গেমপ্লের দিকে নজর ঘুরালো। তার কারণ এই গেমের ‘ফ্যাটালিটি’ ফিচার। এই ফিচার অনুসরণ করে প্লেয়ার নিজের বিজয় বিভিন্নভাবে উদযাপন করতে পারে। তাকে অপনেন্টের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে ফেলার কিংবা স্পাইনাল কর্ড ভেঙে ফেলার অপশন দেওয়া হয়।

মর্টাল কমব্যাটের ‘ফ্যাটালিটি’ ফিচার; Image Source: Midway Games

১৯৯২ সালে প্রথমবারের মতো যখন আর্কেডে গেমটি এলো, তা অভিভাবকদের এমনই হিস্টেরিয়াতে আক্রান্ত করেছিল যে ব্যাপারটি ১৯৯৩ সালের একটি কংগ্রেসের শুনানিতে পর্যন্ত গেল। এরপরে ‘এন্টারটেইনমেন্ট সফটওয়্যার রেটিং বোর্ড’ (ESRB) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেটি সিনেমার মতো ভিডিও গেমকেও রেটিং দেওয়া শুরু করলো। তবে এখনো, ফাইটিং গেম ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর প্রতিটি নতুন রিলিজ এই বিতর্ককে প্ররোচিত করে।

ভিডিও গেমের একজন সমালোচক ১৯৯৯ সালে কলম্বাইন হাই স্কুলে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের পরে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য উল্লেখ করে বলেছেন, ভিডিও গেমকে দোষারোপ করা তাদের নিজেদের দোষ ধামাচাপা দেওয়ার একটি প্রয়াস। রাজনীতিবিদরা অবশ্য খুব সহজেই বিভিন্ন ব্যাপারে বিনোদন মাধ্যমের উপরে দোষ চাপিয়ে দেন। যেমন: ২০০৭ সালে সিনেটর মিট রোমনি একাধারে সংগীত, সিনেমা, টিভি শো এবং ভিডিও গেমের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি ও সহিংসতার অভিযোগ এনেছিলেন। এই মাধ্যমগুলো কলম্বাইন ও ভার্জিনিয়া টেকের বন্দুকধারীদের উপরে প্রভাব ফেলেছে বলে তিনি দাবি করেন।

একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, আমেরিকান কিশোর বয়সীদের ৯০ শতাংশ ভিডিও গেম খেলে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে তা ৬৫ শতাংশ, যেখানে ৭৭ শতাংশ অভিভাবক বিশ্বাস করে, ভিডিও গেমের সাথে সহিংসতার যোগাযোগ রয়েছে। এরকমই একজন হচ্ছেন টিম উইন্টার। তিনি ‘প্যারেন্টস টেলিভিশন কাউন্সিল’ নামের একটি সংস্থার প্রেসিডেন্ট। সংস্থাটির কাজ হচ্ছে, বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি যেন বাচ্চাদের সামনে হিংস্র কোনো কনটেন্ট উপস্থাপন না করতে পারে সে ব্যাপারে নিরীক্ষা করা।

তার মতে, সহিংস কন্টেন্টের সাথে অপরাধী তৈরির সম্পর্ক হচ্ছে, সিগারেটের সাথে ফুসফুস ক্যান্সারের সম্পর্কের মতো। পরিমিত পরিমাণ ধূমপান করলে বেশিরভাগ মানুষেরই তেমন ক্ষতি হয় না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার নেতিবাচক প্রভাব বাড়তে থাকে। তার যুক্তিটি অবশ্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট বলে, অনিয়মিত ধূমপায়ীদের ঝুঁকি নিয়মিত ধূমপায়ীদের তুলনায় কোনো অংশে কম না।

যেটা আমি সত্য বলে মনে করি তা হলো, আমাদের বিশ্বাস কাঠামো, বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন, মূল্যবোধ ও মতামতের উপরে বিনোদন মাধ্যমের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে।

আমেরিকার বিনোদন মাধ্যমগুলোতে সহিংসতাকে অনেকভাবে মহিমান্বিত করা হয়, এই ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না। টিভি, সিনেমা, গেম, বই থেকে শুরু করে সবধরনের মাধ্যমে এটার মাত্রা এতো বেশি যে তাদের ‘বন্দুক সংস্কৃতি’ পরিবর্তন করার কোনোরকম আগ্রহ দেখাই যায় না। ‘বন্দুক সংস্কৃতি’ বলতে, বন্দুক কেনা এবং দেশজুড়ে তার বিশাল সরবরাহকে বুঝায়। তার পাশাপাশি, সবকিছুর সমাধান হিসেবে বন্দুক ব্যবহার করাও এই সংস্কৃতির একটি অংশ। যেমন: ব্যক্তিগত সহিংসতা থেকে শুরু করে পুলিশ ও বিভিন্ন ব্যাপারে রাষ্ট্রও বন্দুকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করে।

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গেম সেন্টার প্রোগ্রামের একজন অধ্যাপক বলেছেন, বড় সময়জুড়ে চলা আমেরিকার বন্দুক সংস্কৃতিই যুদ্ধভিত্তিক ভিডিও গেম নির্মাণ ও তা জনপ্রিয় করতে প্রভাবিত করেছে। কারণ, ভিডিও গেমের ইতিহাসের তুলনায় বন্দুকের সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্কই আমেরিকায় বেশি পুরনো। গোলাগুলির পরে ভিডিও গেম বিক্রি বন্ধ করলেও ওয়ালমার্টের স্টোরে বন্দুক বিক্রি অব্যাহত রাখার ঘটনা দেখে এই মন্তব্যটিকে যথার্থ মনে হতে পারে। 

বন্দুক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি নিয়ে আমেরিকায় যে সংবেদনশীলতা রয়েছে, তার কারণে আলোচনাটি ভিডিও গেমের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া রাজনীতিবিদদের জন্যে সহজ। কারণ, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললে রাজনীতিবিদদের ভোট হারানোর সম্ভাবনা থাকে। অপরদিকে, ভিডিও গেম ইন্ডাস্ট্রির পেছনে কোনো ক্ষমতাবান লবি নেই তাই তাদের জন্যে এটা একটা নিরাপদ টার্গেট হয়ে উঠেছে। জ্যাক গ্যারিস নামের একজন ভিডিও গেম ডিজাইনার বলেছেন,

The narrative that violence in video games contributes to the gun violence in America is, I think, a good example of a bad idea that seems right to people who don’t look too closely at the facts.

ভিডিও গেম একটি বৈশ্বিক ইন্ডাস্ট্রি। অন্যসব বিনোদন মাধ্যমকে আয়ের দিক থেকে এটা অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে গেম ইন্ডাস্ট্রির বার্ষিক উপার্জন ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে এসে তা ১৩৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো দেশগুলোতে ভিডিও গেম এখন প্রচুর জনপ্রিয়। কিন্তু বন্দুক সংক্রান্ত সহিংসতার তীব্রতা যুক্তরাষ্ট্রেই তুলনামূলক অনেক বেশি দেখা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইউরোপের দেশগুলোতে ভিডিও গেমের রেটিং সিস্টেম আমেরিকার তুলনায় অনেক বেশি উদার। ভিডিও গেমের সাথে সহিংসতার সম্পর্ক নিয়ে যে দাবি করা হয় তার বিপরীতে অনেকে এটাকে প্রমাণ হিসেবে দেখান। কিন্তু অপরাধের সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি আচরণিক আগ্রাসনের পরিমাণও বাড়তে পারে। আগ্রাসন যে সহিংসই হতে হবে তা নয় এবং তার সাথে অপরাধের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। 

জ্যাক গ্যারিস উল্লেখ করেন, এই বিতর্কটি ভিডিও গেমের গুরুত্ব নিয়ে যে আলোচনাটি হওয়া প্রয়োজন সেটাকে দূরে সরিয়ে ফেলে। স্টারডিউ ভ্যালি, মাইনক্র্যাফট, জার্নির মতো গেমগুলো মানুষের মনকে হালকা করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, পেপারস, প্লিজ, দ্যাট ড্র্যাগন ক্যান্সার কিংবা লাইফ ইজ স্ট্রেঞ্জ গেমগুলো মানুষের জীবনের ভালোবাসা, শোক, একাকীত্ব ও মৃত্যুর মতো ভারি ঘটনাগুলোর ব্যাপারে অনুসন্ধান করে।

‘জার্নি’ গেম; Image Source: Pinterest

যদিও সহিংস নয় এরকম অনেক গেম রয়েছে, তবুও কল অব ডিউটি, কাউন্টার স্ট্রাইক, ফোর্টনাইটের মতো গেমগুলো বেশি জনপ্রিয় এবং সফল। ফোর্টনাইটের পাবলিশার এপিক গেমস শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই তিন বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছিল। এ ধরনের গেমগুলো সাধারণত বড় কোম্পানিই মুক্তি দিয়ে থাকে। গেম নির্মাণ জটিল এবং কঠিন একটি প্রক্রিয়া যার বাজেট কয়েকশ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। আবার কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডার থাকে, তাই তাদেরকে জবাবদিহি করতে হয়।

তবে ভিডিও গেম যে পুরোপুরি নির্দোষ, এমন দাবির পক্ষেও বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। অনেক গেম সমালোচক ও নির্মাতা মনে করেন, সহিংস গেমগুলো মুক্তি দেওয়ার আগে তা একটি স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে নেওয়া দরকার। কারণ, একটি সহিংস মিডিয়া আগে থেকেই হিংস্র একটি সংস্কৃতিতে কোনোই প্রভাব ফেলবে না তা জোর দিয়ে বলা যায় না। যেমন: বর্ডারল্যান্ডস ও ডেস্টিনির মতো গেমগুলো বিক্রির প্রধান সেলিং পয়েন্টই হচ্ছে, গেমের মধ্যে ডেভেলপাররা কতগুলো বন্দুক যুক্ত করেছে। এ কারণে এ ধরনের কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের ভাষাও সেভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন, বর্ডারল্যান্ডসের বিজ্ঞাপনে ছিল এরকম:

Deliver devastating critical hits to enemies’ soft-and-sensitives, then joy-puke as your bullets ricochet towards other targets.

ব্র্যাড বুশম্যান আর ক্রিস্টোফার ফার্গুসন হচ্ছেন এ বিষয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত দুজন গবেষক। উভয়েই মনোবিজ্ঞানী এবং দীর্ঘ সময় ধরে ভিডিও গেম ও সহিংসতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। দুইজনে একইধরনের এক্সপেরিমেন্ট করলেও তারা সম্পূর্ণ বিপরীত দুইটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।

বর্ডারল্যান্ডস গেম; Image Source: USA Today

অনেক গবেষকের মতে, সহিংস গেমগুলোর একটি নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, তারা আচরণের দিক থেকে মানুষকে আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে। অনেকে আবার নিজ অথবা অন্য কারো মানসিক যন্ত্রণার প্রতি অনুভূতিহীন হয়ে ওঠে। বুশম্যানের সাম্প্রতিক একটি স্টাডি বলছে, যদি কোনো বাচ্চা সত্যিকারের বন্দুক পায় তাহলে সে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে ব্যাপারে ভিডিও গেম প্রভাব ফেলে। তার গবেষণায় দেখা গেছে, সহিংস গেম খেলা বাচ্চারা বন্দুক দেখলে তা স্পর্শ করা ও ট্রিগারে চাপ দেওয়ার ব্যাপারে তুলনামূলক বেশি আগ্রহী।

অন্য আরেকটি গবেষক দল অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ফলাফল দেখিয়েছেন। ২০১৫ সালে, আমেরিকান সাইকোলজিক্যল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) ১০ জন সদস্যের একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিল। টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে যাদেরকে নির্বাচন করা হয়েছিল, তারা সবাই বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাছাড়া, এর আগে ভিডিও গেম সংক্রান্ত কোনো গবেষণায় যুক্ত না থাকায় তাদের নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে, এরকমটি ভাবা হয়েছিল। ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মার্ক অ্যাপেলবাউম এই টাস্কফোর্সের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এর আগে এপিএর আরো কিছু টাস্ক ফোর্সের সাথে তিনি কাজ করেছিলেন। এই টাস্কফোর্সের রিপোর্টে এলো, সহিংস ভিডিও গেম মানুষের ব্যবহারের উপরে প্রভাব ফেলে, আচরণিক আগ্রাসন বৃদ্ধি করতে পারে। তবে তা শুধুমাত্রই আচরণিক, সত্যিকার সহিংসতা বা বন্দুক সহিংসতার সাথে এর সম্পর্ক নেই। ভিডিও গেমের সহিংসতা প্লেয়ারের চিন্তা, অনুভূতি ও অন্যের আচরণে প্রতিক্রিয়ার উপর প্রভাব রাখে। তবে তা সহিংস সিনেমা, টিভি শো এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও বলা যায়।

ক্রিস্টোফার ফার্গুসন এবং আরো অনেকে অবশ্য এপিএর এই রিপোর্টের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। টাস্কফোর্স অনেকজন গবেষকের রিপোর্ট জরিপ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফার্গুসনের মতে, তারা যে গবেষণা পদ্ধতিগুলো জরিপ করেছেন সেগুলো ভুলপথে চালিত। তাছাড়া এখানে প্রকাশনা সংক্রান্ত পক্ষপাতও রয়েছে। সায়েন্টিফিক জার্নালগুলো কোন গবেষণাগুলো প্রকাশ করবে সে ব্যাপারে অনেক পক্ষপাতী আচরণ করে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত অনেকগুলো গবেষণা পরবর্তীতে প্রতিলিপির যোগ্যতা হারায়। এই ব্যাপারটিকে ‘রেপ্লিকেশন ক্রাইসিস’ বলা হয়।

 At this point, you really can look at a number of other research groups and I’d say there’s maybe about, maybe ten to a dozen of these preregistered studies and almost, maybe, only one of them I can think of found evidence for any kind of, you know, effects, and that one was a correlational effect.

প্যাট্রিক মার্কির সাথে লেখা ‘মোর‍্যাল কমব্যাট’ বইয়ে ফার্গুসন বলেছেন,

ভিডিও গেম সংক্রান্ত গবেষণার দুনিয়ায় ডেভিড এবং গোলায়েথের একটি যুদ্ধ চলমান। এখানে গোলায়েথ হচ্ছে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত প্রবীণরা, যারা ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সত্যিকার পৃথিবীতে ঘটে চলা ভয়ানক সব নির্মম ঘটনার সাথে ভিডিও গেমের যোগসূত্র স্থাপন করে যাচ্ছেন। ভিডিও গেম বিরোধী এই ক্ষমতাবানরা অপেক্ষাকৃত কমবয়সী ও গবেষকদের দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে যারা আতারি, নিনটেন্ডো এবং প্লেস্টেশন সিস্টেমের সংস্পর্শে বড় হয়েছিল। এরকম ক্ষমতাবান ভিডিও গেম বিরোধী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামটি ভয়াবহ।

গবেষণার ক্ষেত্রে পক্ষপাতের অভিযোগটি সত্য এবং তা শুধু ভিডিও গেমের জন্যেই প্রযোজ্য নয়। আবার, এটাও সত্য যে, মনোবিজ্ঞানের গবেষণাতে রেপ্লিকেশন ক্রাইসিসের উপস্থিতি রয়েছে। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, তাদের কাছে যে গবেষণাগুলো পাঠানো হয়েছে সেগুলো আগ্রাসনের সাথে ভিডিও গেমের কোনো সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি। তাই, সহিংস ভিডিও গেম নিয়ে এতো আলোচনা, সমালোচনা সত্ত্বেও তা এই মাধ্যমটির উপরে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা অথবা নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। তবে তর্কের খাতিরে আচরণিক আগ্রাসনের সাথে ভিডিও গেমের সম্পর্ক যদি স্বীকার করাও হয়, তাতে আলাদা করে আতঙ্কিত হয়ে উঠার কোনো কারণ নেই। কারণ, সমাজের অনেক বিষয়ও মানুষের আচরণকে উগ্র করে তুলতে পারে। যেমন: প্রতিযোগিতামূলক খেলা, বিতর্ক, আর্থসামাজিক অবস্থান কিংবা অন্য কোনো বিনোদন মাধ্যম। 

এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণাই দাবি করতে পারেনি যে, ভিডিও গেম বাচ্চাদেরকে অপরাধী বা সহিংস হতে ভূমিকা পালন করে। তবুও বেশিরভাগ মানুষ ভিডিও গেমকে দোষারোপ করার সহজ পথটি বেছে নিয়েছেন। সত্যিকারের গবেষণা ও আলোচনা অনেক জটিল হয়ে উঠতে পারে। গঠনমূলক আলোচনার জন্যে অবশ্য পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যেমন: পাবজি অথবা কল অব ডিউটির মতো গেমগুলো মিলিটারিকে আকর্ষণীয় করে তুলছে কিনা এবং তা মানুষের চিন্তায় কীভাবে প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে, কয়েকটি গবেষণা গেম খেলার ইতিবাচক কিছু ফলাফল পেয়েছে যার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতিও রয়েছে। 

তবে, ভিডিও গেম ও সহিংসতা সংক্রান্ত বিতর্কটির সমাপ্তি খুব দ্রুত হচ্ছে না। নতুন কোনো হত্যাকাণ্ড ও বন্দুক সংক্রান্ত সহিংসতার পরপরই এই আলোচনাটি আবার নতুন করে শুরু হবে।

Related Articles