Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইয়াহুর পতন: সেরার মুকুট হারিয়ে যাওয়ার গল্প

ইন্টারনেটের দুনিয়ায় বর্তমানে ১৪০টিরও বেশি সার্চ ইঞ্জিন রয়েছে । কিন্তু সেসব ব্যবহার করা তো দূরের কথা, আমরা ক’টারই বা নাম জানি? সার্চ ইঞ্জিন বলতে বেশিরভাগ মানুষ গুগলকেই চিনে থাকে, তবে ইন্টারনেটের সাথে যাদের পুরনো যোগসূত্র রয়েছে এবং দীর্ঘসময় ধরে সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে আসছেন, তারা গুগলের পাশাপাশি ইয়াহুকে রাখতে চাইবেন। কেননা এই সার্চ ইঞ্জিনটিই একসময় নেটের দুনিয়ায় রাজত্ব করেছে।

২০০৫ সালে ইয়াহু ছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইটগুলোর মাঝে অন্যতম। আজকে যেমন আমরা গুগলের মেইল বা জিমেইল ব্যবহার করছি, সেসময় প্রায় অধিকাংশ মানুষই ইয়াহু মেইল ব্যবহার করতো। ২০১১ সালে ক’দিনের জন্য শীর্ষস্থানও দখল করে ইয়াহু মেইল। কিন্তু ধীরে ধীরে গুগল যেন ইয়াহুর থেকে সবই ছিনিয়ে নিতে লাগল। অবশেষে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে মার্কিন টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি ভেরাইজনের কাছে ৪.৪৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে মূল ব্যবসা বিক্রির সম্মতি প্রকাশ করে ইয়াহু। এই চুক্তিকে ফোর্বসের লেখক ব্রায়ান সলোমন প্রযুক্তি দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখজনক চুক্তি  হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

ইয়াহুর পতনের সাক্ষী হয়তো আমরা সবাই, কিন্তু এর গৌরবের দিনগুলো সম্পর্কে কমই জানি। চলুন জানা যাক সেই গল্প।

শুরুর ইতিহাস

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ডেভিড ফিলো এবং জেরি ইয়াং এর হাত ধরে ১৯৯৪ সালে ইয়াহু তার যাত্রা শুরু করে। তবে শুরুতে কিন্তু নাম ইয়াহু ছিল না। ডেভিড এবং জেরি তাদের ওয়েবসাইটের নাম দিয়েছিলেন “David and Jerrys guide to the World Wide Web। ‘৯৪ সালেরই মার্চ মাসে ওয়েবসাইটটির নাম পরিবর্তন করে ‘ইয়াহু’ রাখা হয়। সেসময় পুরো ইন্টারনেট জগত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল। তাই ওয়েবসাইটটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিলো টেলিফোন ডিরেক্টরির মতো ওয়েবসাইটের একটি ডিরেক্টরি তৈরি করা। সেসময় দুই সদ্য গ্রাজুয়েটের এই ওয়েবসাইট ছিল প্রযুক্তিজগতের বৃহৎ প্রচেষ্টাগুলোর মাঝে অন্যতম।

ফিলো এবং ইয়াং; Image source: Eric Sander

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের পরিচিতি সেভাবে না থাকা সত্ত্বেও নব্বই-এর দশকে ইয়াহু দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯৬ সালে ইয়াহুর যখন প্রথম পাবলিক অফারিং হয় তখন এর মূল্য ছিলো প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় থাকলে যে সফল হওয়া সম্ভব ইয়াহু তার চরম একটি উদাহরণ। পরবর্তী দু’বছরে কোম্পানিটির স্টক মূল্য প্রায় ৬০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৮ সালের মাঝেই ইয়াহুতে যুক্ত হয় ইমেইল, শপিং, গেমস, ট্রাভেলিং, ম্যাপস, ওয়েদার, অনলাইন ম্যাগাজিনসহ নানা সেবা।

ইয়াহুর শেয়ার বাড়তে বাড়তে সেই সালে মোট মূল্য গিয়ে দাঁড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলারে। ঝড়ের গতিতে যাত্রা শুরু করেছিল ইয়াহু। সার্চ ইঞ্জিন এবং ফ্রি ইমেইল সেবা প্রদানের মধ্য দিয়ে শীঘ্রই প্রযুক্তিবাজারের শীর্ষস্থানীয় তালিকায় নাম লিখিয়ে নেয় কোম্পানিটি। তবে তখনও গুগল তার যাত্রা শুরু করেনি, কালো ছায়ার দিন যে সামনেই তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

ইয়াহুর সময়গুলো ছিলো তরঙ্গের মতো- কখনো উপরে তো কখনো নিচে। ২০০০ সালে ইয়াহুর মোট মূল্যমান দাঁড়ায় ১২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা কোম্পানিটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর পরপরই ডট কম সাইটগুলো হুট করেই অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে এবং মূল্যও অত্যধিক বেড়ে যায়। একে ডট কম ক্রাশ বা Dot com bubble বলা হয়। এসব সাইটের উচ্চমূল্যের কারণে ইয়াহুর মূল্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে। মাত্র ২ বছরেই ১২৫ বিলিয়ন থেকে ২০০২-এ গিয়ে নেমে যায় ১০ বিলিয়নে, যা অতীত গৌরবের ছায়ামাত্র।

ইতিহাসে ইয়াহুর মার্কেট শেয়ার; Image Source: Business Insider

আজকে আমরা যে সেবাগুলোকে প্রাপ্তি হিসেবে গ্রহণ করি, যেমন- ইউটিউব, ফেসবুক এগুলোর ধারণাও জন্মেছিল ইয়াহু থেকেই। ইউটিউবের মতো একটি প্লাটফর্ম ছিলো Broadcast.com, যা পরবর্তীতে Yahoo TV হিসেবে চালানো হয়। এছাড়া ছিলো ইন্সটাগ্রামের মতো Flickr, Evernote এর মতো Yahoo Notebook এবং Yahoo Music ছিল সেসময়ের Spotify। তবে কোথায় হারিয়ে গেল সেসব?

ভুল সিদ্ধান্তের পাহাড়

ইয়াহুর পতনের পেছনে হয়তো নানা তত্ত্বই দাঁড় করানো যাবে, কিন্তু ইয়াহুর নেয়া সিদ্ধান্তগুলোতে যে ব্যাপক ভুল ছিল এই কথায় সবাই সম্মতি জানাবে। গুগলের আজকের অবস্থানে আসার পেছনেও ইয়াহুর ভুলই দায়ী।

১৯৯৮ সালে স্ট্যানফোর্ডেরই দুজন পিএইচডি শিক্ষার্থী ইয়াহুর কাছে তাদের অ্যালগরিদম বিক্রির জন্য গিয়েছিল। ১ মিলিয়ন ডলারে ঐ অ্যালগরিদম কেনা তখন ইয়াহুর যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। কারা ছিলেন ঐ দুই তরুণ? গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ এবং সের্গেই ব্রিন। তাদের তৈরি পেজর‍্যাঙ্ক অ্যালগরিদমের কারণেই আজ আমরা গুগলে একটি শব্দ লিখলেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেয়ে যাচ্ছি।

গুগল ভালোভাবে প্রতিষ্ঠালাভের পরেও ল্যারি এবং সের্গেই গুগলকে ইয়াহুর কাছে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে ইয়াহুর তৎকালীন সিইও টেরি সেমেল তা গায়েই লাগাননি। যখন তার সম্মতি প্রদানের ইচ্ছে হলো তখন গুগলের দাম বেড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে গিয়েছে!

ওই সময়ের আশেপাশেই এক ২২ বছর বয়সী যুবক ইয়াহুর প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সে ছিল মার্ক জাকারবার্গ। ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ফেসবুককে কিনতে চেয়েছিল ইয়াহু, কিন্তু জাকারবার্গ রাজি হননি।

শুধু কেনার ক্ষেত্রেই নয়, বিক্রির ক্ষেত্রেও ইয়াহু নিয়েছিল ভুল সিদ্ধান্ত। ২০০৮ সালে মাইক্রোসফট ৪৪.৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ইয়াহুকে কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে, যা ইয়াহুর বর্তমান মূল্যের চেয়ে ঢের বেশি। কিন্তু তখন সেটিও প্রত্যাখ্যান করা হয়।

ভুল বিনিয়োগ

১৯৯৯ সালে ইয়াহু দুটি বিখ্যাত অধিগ্রহণ চুক্তি করে, যা প্রযুক্তির ইতিহাসে অন্যতম দুই বাজে চুক্তি হিসেবে বিবেচিত। এর মাঝে একটি Geocities, এবং আরেকটি Broadcast.com। 

জিওসিটিস এর ওয়েবসাইট; Image source: Fastcompany.net

সেসময়ে Geocities ইন্টারনেট বিশ্বে তৃতীয় সর্বাধিক ব্রাউজ করা সাইট ছিল। ১৯৯৯ সালে ইয়াহু ৩.৭ বিলিয়ন ডলারে জিওসিটিসকে কিনে নেয়। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ইন্টারনেটে তাদের নিজেদের হোমপেজ তৈরি করতো। সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং নতুনত্ব না থাকায় ধীরে ধীরে এটিও তার ব্যবহারকারী হারাতে থাকে এবং ২০০৯ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়।

Broadcast.com এর ইন্টারফেস; Image Source: Business Insider 

একই বছরে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস ব্রডকাস্টকে ৫.৭ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় ইয়াহু। পরবর্তীতে ইয়াহু ব্রডকাস্ট থেকে পৃথকভাবে মিউজিক এবং ভিডিও সার্ভিস চালু করে। ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের জন্য সেসময়ের ইন্টারনেট অনেক ধীরগতির ছিল। বলা যায়, ব্রডকাস্ট ছিল সময়ের চেয়ে অগ্রসর। ইয়াহু ঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করতে পারলেও ব্রডকাস্টের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক কিউবান নাম কামিয়ে নিয়েছিলেন।

২০০৫ সালে ইয়াহু ফটো শেয়ারিং সাইট Flickr-কে ৩০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়। তারা একে সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে রুপান্তর করতে চাইলেও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে সেখানেও ব্যর্থ হয়। নতুনত্ব না এনে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সেটিই ছিলো মূল চিন্তা। একই বছরে ইয়াহু আলিবাবার ৪০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। পরবর্তীতে এর কারণেই ইয়াহু দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা পায় এবং এই শতাংশের বর্তমান মূল্য প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার।

কিন্তু কেন এত ব্যর্থতা ঘিরে ধরেছিল ইয়াহুকে? কারণ ইয়াহুর কোনো সিইও-ই আদর্শ ছিলেন না। শুরু থেকেই কোম্পানিকে কীভাবে চালানো হবে এ নিয়ে কারোরই স্পষ্ট কোনো দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। তারা না ছিল কোনো সার্চ কোম্পানি, না কোনো টেক কোম্পানি। ইয়াহু ছিল একটি মিডিয়া কোম্পানি যাদের কাছে প্রযুক্তি ছিল লাভ তৈরির একটি ক্ষেত্র। ব্যর্থতার পেছনে সিইও ছাড়াও দায়ী কর্মীরা। অদক্ষ কর্মীতে ভরপুর ছিল ইয়াহু। ফলে কোনো খাতেই নতুনত্ব আনতে তারা সক্ষম হয়নি। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইয়াহু ১১৪টি কোম্পানি অধিগ্রহণ করেছিল, যার একটিও তাদের গৌরব ফিরিয়ে দিতে পারেনি।

মেলিসা মেয়ার; Image Source: Forbes

২০১২ সালে ইয়াহুতে সিইও হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক গুগল কর্মী মেলিসা মেয়ার। ইয়াহুর ইতিহাসে এই একজনই পারতেন কোম্পানিকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু মেলিসার আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। সর্বস্ব হারানো কোম্পানিকে মেলিসাও ঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হন এবং শেষপর্যন্ত ২০১৬ সালে ইয়াহুর ইন্টারনেট ব্যবসার ইতি ঘটে এবং কোম্পানির বাকি অংশগুলো নিয়ে Altaba.Inc গঠিত হয়।  

প্রযুক্তির স্রোতের সাথে তাল মিলাতে না পারলে বিলিয়ন ডলার কোম্পানিও যে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে ইয়াহু তার বাস্তব উদাহরণ। ফিলো এবং ইয়াং যা তৈরি করেছেন নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবিদার, কিন্তু তারা ইয়াহুকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেননি। ভুল সিদ্ধান্ত ও বাজে ব্যবস্থাপনাই ইয়াহুর অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছে। ইয়াহুর নেয়া ভুল পদক্ষেপগুলো যেকোনো প্রযুক্তি কোম্পানির জন্য শিক্ষণীয় হয়ে রইবে।

Related Articles