
১
চাকার আবিষ্কার মানব সভ্যতার জন্য নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক। মানবসভ্যতার গতিপ্রকৃতিতে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিলো ‘চাকা’ নামের এই অসাধারণ বস্তুটি। একটা সময় মানুষের যাতায়াতের প্রধান উপায় ছিলো, পায়ে হেঁটে পথ চলা কিংবা পশুর পিঠে ভ্রমণ করা। আর ভারী কোনো কিছু বহন করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এক্ষেত্রে ভারী বস্তুটিকে হয় টেনে নিতে হতো, নয়তো পশুর পিঠে চড়ানো হতো। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এই সমস্যার সমাধানের ধারণা অবশ্য সমাধান পাওয়া গেলো বেশ অদ্ভুতভাবেই। আজ থেকে প্রায় ১৫,০০০ বছর পূর্বে Palaeolithic যুগে মানুষ প্রথমবারের মতো খেয়াল করলো অনিয়মিত আকারের কোনো বস্তুর চেয়ে গোলাকার কোনো বস্তু, যেমন গাছের ভারী গুঁড়িকে টেনে নেওয়া বেশ সহজসাধ্য ব্যাপার। এমনকি সেটা অনিয়মিত আকারের কোনো বস্তু থেকে ভারী হলেও।

তবে এই ধারণা থেকেই যে মানুষ চাকা আবিষ্কার করেছিলো, ঠিক তা নয়। ব্যবহারযোগ্য চাকা আবিষ্কার করতে আরো বেশ কয়েক হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো মানুষকে। আজ থেকে প্রায় ৭,০০০ বছর আগে সর্বপ্রথম মেসোপটেমিয়াতে ব্যবহারযোগ্য চাকা আবিষ্কার করা হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। তবে শুরুর দিকে শুধুমাত্র কুমোরের মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজে এই ধরনের চাকা ব্যবহার করতো বলে জানা যায়।

চাকাকে গাড়ির সাথে জুড়ে দিয়ে যোগাযোগ কিংবা মালামাল পরিবহণের ধারণা আসে আরো প্রায় ১৫০০-২০০০ বছর পরে। আজ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে পুরোনো কাঠের চাকা পাওয়া গেছে স্লোভেনিয়ায়, ৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। প্রায় সমসাময়িক সময়ে চাকা ইউরোপ আর এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যেতে শুরু করে।

২
প্রথম দিককার চাকাগুলো গাছের ভারী গুঁড়ি কেটে তৈরি করা হতো। আর এধরনের কাঠের চাকার চারপাশে লোহার বেষ্টনী দিলে যে তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরো বেশী সুবিধাজনক হয়, এই ধারণা আসতে অবশ্য আরো বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়। সর্বপ্রথম কেল্টরা খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালে এই ধারণা থেকে নতুন একধরনের চাকা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। এই ধরনের চাকা কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে গরুর গাড়িগুলোতে ব্যবহৃত হতো।

এরপর পরবর্তী প্রায় ২৮০০ বছর চাকার তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন আর হয়নি! ১৮০৮ সালে উড়োজাহাজ আবিষ্কারের অন্তরালের অন্যতম নায়ক জর্জ ক্যালি (১৭৭৩-১৮৫৭) চাকার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করে ফেললেন। তিনি চাকার রিম আর চাকার অক্ষকে শক্ত তারের (স্পোক) মাধ্যমে জুড়ে দিলেন, যার ফলে ব্যবহারের ক্ষেত্রে চাকা আরো বেশি উপযোগী হয়ে উঠলো।

এই ধরনের চাকা শুরুর দিকে শুধুমাত্র বাইসাইকেলে ব্যবহার করা হতো। আর এখন তো মোটর সাইকেল থেকে শুরু করে অনেক গাড়িতেও এই ধরনের চাকা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

এরপর অবশ্য খুব দ্রুতই চাকার উন্নতি হতে লাগলো। আর এখন বিভিন্ন গাড়িসহ অন্যান্য যানবাহনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে বাতাসভর্তি চাকা। যার রিমকে (মূল চাকার বাইরের প্রান্ত) সুরক্ষা দিতে রিমের উপরে থাকে সিনথেটিক রাবার, প্রাকৃতিক রাবার, বিভিন্ন ধরনের ফেব্রিক্স আর অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরি টায়ার। এ ধরনের চাকায় রিম আর টায়ারের মাঝে বায়ুভর্তি রাবারের টিউব ব্যবহার করা হয়, যার ফলে ব্যবহারের ক্ষেত্রে চাকাটি আরো বেশি কার্যকরী হয়ে উঠে।

সাধারণত ভূ-পৃষ্ঠে চলাচলকারী যানবাহনগুলো যেমন বাস, ট্রাক বা গাড়ি ইত্যাদির চাকাগুলো এই ধরনের হয়। কিন্তু মজার ব্যপার হচ্ছে, বিমান মূলত আকাশযান হলেও ট্যাক্সিং এর জন্য চাকার প্রয়োজন হয়। ট্যাক্সিং হচ্ছে বিমান আকাশে ওড়ার পূর্বে এবং ল্যান্ডিং এরপর মাটিতে চলার ঘটনা।

৩
উড়োজাহাজের ট্যাক্সিং এর জন্য সবচেয়ে জরুরী যে অংশটি, তা হচ্ছে ল্যান্ডিং গিয়ার। আর ল্যান্ডিং হুইলের উপর ভর করেই উড়োজাহাজের ট্যাক্সিং সম্পন্ন হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেকোনো ধরনের বিমানের ক্ষেত্রেই চাকায় সাধারণ বাতাসের পরিবর্তে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এটা করা হয় মূলত নাইট্রোজেন গ্যাসের নিষ্ক্রিয় ধর্মের কারণে।

সাধারণত বড় বড় যাত্রীবাহী বিমানগুলো ৩০,০০০ ফুট থেকে ৬৫,০০০ ফুট উচ্চতায় চলাচল করে। আর এই উচ্চতায় বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে মাইনাস ৫৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণ বাতাসে সবসময়ই কিছু পরিমাণে জলীয় বাষ্প থাকবেই। যদি বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারের টায়ারে বাতাস ব্যবহার করা হয়, তাহলে এই নিম্ন তাপমাত্রায় বাতাসের সাথে থাকা জলীয় বাষ্প জমাট বেঁধে ছোট ছোট বরফের টুকরায় পরিণত হবে। এই অবস্থায় যখন বিমানটি মাটিতে অবতরণ করবে, তখন এর টায়ারের চাপ পরিবর্তিত হবে। যার ফলে বিমানটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় পতিত হতে পারে।
নাইট্রোজেন গ্যাসের মেল্টিং পয়েন্ট হচ্ছে মাইনাস ২১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কাজেই মাইনাস ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নাইট্রোজেন গ্যাস তরলে পরিণত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এর ফলে বিমানের চাকায় নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করা হলে এই সমস্যাটি আর হয় না। ফলে এয়ারক্রাফট অবতরণের সময় উদ্ভুত অনাকাঙ্ক্ষিত এই দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারে বাতাসের পরিবর্তে নাইট্রোজেন ব্যবহারের আরেকটি বড় সুবিধা আছে।
বাতাসের তুলনায় নাইট্রোজেন গ্যাসে জলীয় বাষ্প প্রায় থাকে না বললেই হয়। ফলে নাইট্রোজেন গ্যাস বাতাসের তুলনায় বেশি সময় ধরে টায়ারের চাপ ধরে রাখতে পারে। এর ফলে বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম হয়, আর বার বার টায়ারে গ্যাস ভরার ঝামেলা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।

৪
বিমানের চাকায় বাতাস ব্যবহার করলে আরেকটি সমস্যা তৈরি হতে পারে। যেহেতু বাতাসের প্রায় ২০ ভাগই হচ্ছে অক্সিজেন, আর সক্রিয়তার কারণে এই অক্সিজেন হুইলের টায়ারের সাথে রাসায়নিক ক্রিয়া করতে পারে। এতে টায়ারের রাবার অক্সিডাইজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর নন-অক্সিডাইজ রাবার অক্সিডাইজ রাবারের তুলনায় বেশি শক্তিশালী। বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারে বাতাসের পরিবর্তে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহারের আরেকটি বিরাট সুবিধা রয়েছে। বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ারে বাতাস ব্যবহারে আরেকটি বড় রকমের অসুবিধা হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলের বাতাসের প্রায় ২০ ভাগই থাকে অক্সিজেন। আর আমরা জানি অক্সিজেন দহনে সহায়ক একটি পদার্থ।
বিমান যখন রানওয়েতে অবতরণ করে তখন এর গতি প্রায় ২৫০ কিলোমিটারের কাছাকাছি থাকে। অবশ্য বিমানের আকারভেদে এই গতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আর গড়ে একেকটি সাধারণ টায়ার প্রায় ৩৮ টন ভার বহন করে। বিপুল পরিমাণ বোঝাসহ এই বিশাল গতিবেগ নিয়ে বিমানে যখন রানওয়ের মাটি স্পর্শ করে, তখন চাকার সাথে রানওয়ের প্রচণ্ড ঘর্ষণ তৈরি হয়। আর এই ঘর্ষণের ফলে তৈরি হয় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। আবার চাকার এই ঘর্ষণের ফলে তাপও উৎপন্ন হয়। চাকায় বাতাস ব্যবহার করলে, বাতাসের অক্সিজেন, ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন তাপ আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ থেকে খুব সহজেই আগুন ধরে যেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার সৃষ্টি করতে পারে।

এক্ষেত্রে চাকায় বাতাসের পরিবর্তে নাইট্রোজেন ব্যবহারের সুবিধা হলো, স্ফুলিঙ্গ থেকে কখনো আগুন যদি ধরেও যায় তাহলে নাইট্রোজেন তার নিষ্ক্রিয় ধর্মের কারণেই আগুন নিভিয়ে দিবে। বিমানের যাত্রীরাও নিরাপদে ভূমিতে অবতরণ করতে পারবে। তাই সব দিক দিয়ে বিবেচনা করে, বিমানের চাকায় সাধারণ বাতাস ব্যবহারের পরিবর্তে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহারই বেশি যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া বাতাসের পরিবর্তে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহারের এসকল সুবিধার কারণে আজকাল রেসিং কারের টায়ারেও নাইট্রোজেন ব্যবহার করা হচ্ছে!

ফিচার ইমেজ: wallpapers.place