Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যালান ট্যুরিংয়ের ‘ভুল’ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভুল ধারণা

আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এ.আই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমানে একইসাথে ভীষণ আকর্ষণীয় ও উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে নিত্য-নতুন সব অর্জনের খবর আসছে, তুমুল বুদ্ধিমান কোনো মেশিনের কথা কল্পনা করে কেউ বা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছেন, কেউ আবার ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছেন মানবজাতির ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করে। কিন্তু একটু ভালোভাবে দেখলে দেখা যায়, আমাদের তৈরি করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনো আমাদের মতোই সাধারণ। আর শোরগোল তোলা অনেক প্রযুক্তি আসলে বুদ্ধিমত্তার নামে চাতুরী বৈ ভিন্ন কিছু নয়। এসব বিষয় নিয়েই এখানের আলোচনার উদ্দেশ্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের একজন- অ্যালান ট্যুরিংয়ের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক।

ট্যুরিং প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘মেশিন কি চিন্তা করতে পারে?’ Image Source: twitter.com/mldcmu

১৯৫০ সালের কথা, ডিজিটাল যুগ সবে বিকশিত হতে শুরু করছে। এ সময় অ্যালান ট্যুরিং ‘কম্পিউটিং মেশিনারি এন্ড ইন্টিলিজেন্স’ শিরোনামে তার বিখ্যাত নিবন্ধটি প্রকাশ করেন। ট্যুরিং প্রশ্ন তোলেন, মেশিন কি চিন্তা করতে পারে? প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে গিয়ে, চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধিমত্তা বলতে আমরা কী বুঝি ইত্যাদি সংজ্ঞায়ন ও বিশ্লেষণের পথ মাড়াননি তিনি। ‘দ্য ইমিটেশন গেইম’ নামের ভিক্টোরিয়ান যুগের একটি বিনোদনমূলক খেলার সাথে তুলনা টেনে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেন তিনি।

এ খেলার নিয়ম অনুযায়ী, এতে তিনজন ব্যক্তি অংশগ্রহণ করতো। একজন নারী, একজন পুরুষ ও অন্য একজন বিচারক, সে নারী-পুরুষ যে কেউই হতে পারে। বিচারক অন্য দুজনকে দেখতে পেতেন না। তাদের সাথে হাতে লেখা চিরকুটের মাধ্যমে যোগাযোগ হতো তার। দুজনকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বিচারককে সিদ্ধান্ত নিতে হতো যে, কে নারী কে পুরুষ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল, এর মধ্যে একজন অন্য একজনকে অনুকরণ করে বিচারককে বোকা বানানোর চেষ্টা করতো। আর অন্যজন চেষ্টা করতো বিচারককে সহযোগিতা করতে। হয়তো পুরুষ খেলোয়াড়টি একজন নারীর মতো করে বিচারকের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলো যাতে বিচারক ভুল করে তাকে নারী ভাবে। অন্যদিকে নারী খেলোয়াড় বিচারককে বোঝাতে চেষ্টা করলো যে, সে-ই আসলে নারী।

ভিক্টোরিয়ান ইমিটেশন গেইম; Image Source: bbc.com

এখান থেকে ট্যুরিং প্রশ্ন করেন, ‘কম্পিউটার কি ইমিটেশন গেমে ভালো করতে পারবে?’ তিনি একটি ‘থট এক্সপেরিমেন্ট’ দাঁড় করান- ইমিটেশন গেমে একজন মানুষের বিপরীতে কম্পিউটারকে বসিয়ে কল্পনা করেন তিনি। ট্যুরিং বলেন, একটি কম্পিউটারকে যদি এমনভাবে প্রোগ্রাম করা সম্ভব হয় যে, তার সাথে প্রশ্নোত্তর চালিয়ে গেলে বিচারক বুঝতে পারবে না, তিনি মানুষ নাকি মেশিনের সাথে কথা বলছেন, তবে সে কম্পিউটারকে বুদ্ধিমান বলা চলে। এ থট এক্সপেরিমেন্টটিই বর্তমানে ‘ট্যুরিং টেস্ট’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে সবচেয়ে বিখ্যাত ও সমৃদ্ধ ধারণার মধ্যে একটি।

চিন্তা-ভাবনা বা বুদ্ধিমত্তার সত্যিকারের স্বরূপ কী? কম্পিউটার কি আসলেই চিন্তা করতে পারবে? এসব প্রশ্ন নিয়ে তো অনন্তকাল বিতর্ক করা যেতে পারে। তাতে দার্শনিক তত্ত্বের খাতাই ভরবে কেবল, প্রযুক্তির কাজ এগোবে না। তাই এ বিতর্কে যতি টানার জন্যে অনেকে ট্যুরিং টেস্টকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যাচাইয়ের কষ্টিপাথর হিসেবে মেনে নিয়েছে। তারা একমত হয়েছেন যে, কোনো মেশিন যদি এ পরীক্ষায় উৎরে যায়, তবে সেটিকে বুদ্ধিমান বলা চলে। কিন্তু ট্যুরিংয়ের প্রবন্ধে একটি ছোট বিষয় সন্দেহ জাগায় যে, তিনি একে আদৌ কোনো ব্যবহারিক পরীক্ষণ হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন কি না!

ট্যুরিং টেস্ট; Image Source: bbc.com

তার প্রবন্ধের এক অংশে তিনি একটি বুদ্ধিমান কম্পিউটারের সাথে বিচারকের কথোপকথন কেমন হতে পারে, তা অনুমান করেছিলেন। প্রশ্নকর্তা (বিচারক) কিন্তু জানেন না, তিনি কম্পিউটার নাকি মানুষের সাথে কথা বলছেন। ট্যুরিং এর কল্পনায় কথোপকথনটি অনেকটা এরকম ছিল-

প্রশ্ন- ফোর্থ ব্রিজ বিষয়ে আমাকে একটি সনেট লিখে দাও।

উত্তর- এটা পারবো না আমি, কবিতা হয় না আমার দ্বারা।

প্রশ্ন- ৩৪৯৫৭ ও ৭০৭৬৪ যোগ করলে কত হয়?

উত্তর- (তিরিশ সেকেন্ড পর) ১০৫৬২১

প্রশ্ন- তুমি কি দাবা খেলতে পার?

উত্তর- হ্যাঁ

এরপর আরো কিছু প্রশ্নোত্তর ছিল। কিন্তু আমরা যেটিকে খুঁজছি তা চলে এসেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নোত্তরটি লক্ষ্য করুন। কম্পিউটার কিন্তু যোগে একটি ভুল করে বসে আছে। সঠিক উত্তরটি হবে ১০৫৭২১। ট্যুরিংয়ের মতো একজন গণিতবিদ অবহেলাবশত এ ভুলটিকে এড়িয়ে গেছেন, তা অসম্ভব বলেই মনে হয়। বরং এ ইচ্ছাকৃত ভুলের মাধ্যমে তিনি সচেতন পাঠকদের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন ভাবাটাই যৌক্তিক। কারণ নিবন্ধের অন্য এক জায়গায় ইচ্ছাকৃত ভুল করে বিচারককে বোকা বানানোকে বুদ্ধিমান কম্পিউটারের একটি কৌশল হিসেবে তুলে ধরেছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই যে কেউ ভাববে, একটি মেশিন বুঝি গণিতে ভুল করবে? হয়তো আমরা মানুষের সাথেই কথা বলছি।

কম্পিউটারকে দিয়ে ভুল করাতে চেয়েছিলেন ট্যুরিং; Photo-illustration: IEEE Spectrum

সেই ১৯৫০ সালে কম্পিউটারকে দিয়ে ইচ্ছাকৃত ভুল করানোর এ প্রক্রিয়া বাস্তবে রূপায়ন করা হয়তো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে বর্তমান যুগে এসে এটি অনেক শাখার প্রকৌশলীদের জন্যেই স্বাভাবিক চর্চা হয়ে ওঠেছে। বিশেষত ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিংয়ের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ লক্ষ্যণীয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালে একটি খবর চাউর হয় যে, ইউজিন গোস্টম্যান (Eugene Goostman) নামের একটি চ্যাট-বট পৃথিবীর প্রথম প্রযুক্তি হিসেবে ট্যুরিং টেস্টে পাস করতে সক্ষম হয়েছে। এ প্রোগ্রামটি নিজেকে একজন ইউক্রেনিয়ান কিশোর হিসেবে তুলে ধরে, ইংরেজি যার দ্বিতীয় ভাষা। এক প্রতিযোগিতায় এটি ৩৩ শতাংশ মানুষকে বোকা বানাতে সক্ষম হয়। তারা এটিকে মানুষ বলে মনে করে।

কিন্তু ট্যুরিং টেস্ট উৎরাতে পেরেছে বলেই কি একে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ বলা যাবে? একদিক থেকে দেখলে এটিকে স্রেফ চতুর একটি কাজ বলেই মনে হয়। চ্যাটবটটি ব্যকরণে, বানানে ভুল করে। অনেক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান তার সীমিত। এসব বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবে মিলে যায় একটি কিশোর বালকের চরিত্রের সাথে, যার মাতৃভাষা ইংরেজি নয়। এছাড়া মাঝেমাঝে হুটহাট প্রসঙ্গও বদলে ফেলে। একে যুক্তিযুক্ত করার জন্যে আগেই বলে নেওয়া হয়েছে সে দীর্ঘক্ষণ মনযোগ ধরে রাখতে পারে না। সবমিলিয়ে প্রোগ্রামাররা মোটামুটি সন্তোষজনক চরিত্র বানিয়ে বেশ কয়েকজনকে বোকা বানাতে সক্ষম হয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা কাজে লাগিয়েছেন ট্যুরিংয়ের ইচ্ছাকৃত ভুল করার ধারণাটিকে। তারা প্রোগ্রামটিতে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু সীমাবদ্ধতা যোগ করেছেন, যাতে এটি তাদের বানানো পরিচয়ের সাথে খাপ খায়।

ট্যুরিং টেস্টে পাস করে গেছে ইউজিন গোস্টম্যান; Illustration: Getty Images

একইভাবে গুগলের ভয়েস অ্যাসিস্টেন্ট সিস্টেম ডুপ্লেক্সও গত বছরে মানুষের মতো দোনামনা করে বেশ বাহবা কুড়িয়েছিল। কিন্তু সে যে আসলেই চিন্তা করছিল, বিষয়টি তা নয়। প্রোগ্রামাররা ইচ্ছাকৃতভাবে তার মধ্যে মানুষের অনুকরণে দ্বিধার ভঙ্গি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এটিও ট্যুরিংয়ের ধারণা প্রয়োগ করে মানুষের মতো হয়ে উঠার চেষ্টা করেছিল। গুগলের কিংবা ইউজিনের প্রোগ্রামাররা বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষকে বোকা বানাতে মেশিনকে সত্যিকার অর্থে বুদ্ধিমান হতে হয় না, বরং উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ছোটখাটো কিছু কৌশলই যথেষ্ট।

উদাহরণগুলো থেকে আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, ট্যুরিং টেস্ট হয়তো কোনো একটি মেশিন সত্যিই বুদ্ধিমান কি না তা নির্ণয় করে না। এটি নির্ণয় করে যে, আমরা মানুষেরা এটিকে বুদ্ধিমান বলে স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত কিনা। ট্যুরিং নিজেই যেমনটা বলেছেন, “বুদ্ধিমত্তার ধারণাটি আসলে গাণিতিক নয় বরং মনস্তাত্ত্বিক। কোনো কিছু বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করছে কি না এটি নির্ণয় করতে, সেই বস্তুটির বৈশিষ্ট্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, ঠিক সমভাবে ভূমিকা রাখে আমাদের চিন্তাভাবনা ও প্রশিক্ষণও।” তাই বুদ্ধিমত্তা বলতে আমরা যা বুঝি তা কোনো মেশিনে আসলেই প্রোগ্রাম করে স্থাপন করে দেওয়া সম্ভব কী না সেই ‘দার্শনিক’ প্রশ্নটি আবার ফিরে আসে।

Related Articles