Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হুলো বেড়াল, ঈগল আর লড়াকু বাজপাখি: তিন মার্কিন যোদ্ধা

সোভিয়েত বা রুশেরা ভালো যুদ্ধাস্ত্র বানায়, এ কথা সবাই জানে। তা বলে ইউরোপীয়দেরকে কিন্তু পিছিয়ে রাখা চলে না। আবার চীনও এ বিষয়ে অনভিজ্ঞ নয়। তবে সামরিক বিচারে গত সাত দশক ধরে বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতার নাম বললে একটি দেশের কথাই আসে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিপুল পুঁজি, শক্তিশালী গবেষণাখাত, সরকারি সহায়তা, উচ্চমানের প্রশিক্ষণ আর বিশ্বময় যুদ্ধে মোড়লগিরির বদৌলতে মার্কিনরা বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। জলে, স্থলে বা ব্যোমপথে মার্কিন সমরযন্ত্রের মুখোমুখি হওয়ার দুঃসাহস তাই খুব কম দেশই দেখিয়েছে। এ আধিপত্যের পেছনে মার্কিন যন্ত্রকৌশল, বিশেষ করে বিমানশিল্প যে বিশেষ অবদান রেখেছে, তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। উপসাগরীয় যুদ্ধেই যেমন হাজার হাজার ট্যাংক-সাঁজোয়া যান সম্বলিত ইরাকি বাহিনীকে স্রেফ দুরমুশ করে দেওয়া হয়েছিল দুর্ধর্ষ সব বোমারু আর জঙ্গী বিমানের সাহায্যে। 

আজকের আলাপ মার্কিনদের তিন বিশ্বস্ত যোদ্ধা- হুলো বেড়াল, ঈগল আর লড়াকু বাজপাখিকে নিয়ে। নাম শুনে বিভ্রান্ত হবেন না, এই যোদ্ধারা কেউ রক্ত-মাংসের নয়। পোশাকি বিচারে এদের নাম এফ-১৪, এফ-১৫ আর এফ-১৬।

গ্রুমান এফ-১৪ টমক্যাট

সত্তরের দশকে মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য বানানো হয় গ্রুমান এফ-১৪ টমক্যাট। মূল উদ্দেশ্য ছিল অন্য যুদ্ধবিমান বা ক্রুজ মিসাইল থেকে মার্কিন রণতরীগুলোকে নিরাপত্তা প্রদান। পাশাপাশি ইন্টারসেপ্টার হিসেবে আর আকাশযুদ্ধে এফ-১৪ তার দক্ষতা প্রমাণ করেছে। 

এফ-১৪ টমক্যাট; Image Source: nationalinterest.org

এফ-১৪ ৬২ ফুট লম্বা, দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট, ভ্যারিয়েবল সুইপ্ট উইং যুদ্ধবিমান। ‘ভ্যারিয়েবল সুইপ্ট উইং’-এর অর্থ হচ্ছে, বিমানটি এর ডানা দুটো ছড়িয়ে বা গুটিয়ে নিয়ে উড়তে পারে। উচ্চতাভেদে এ পরিবর্তন গতিবেগ আর জ্বালানির পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি সুবিধা দেয়। দুজন পাইলট বিমানটি চালান। এর শক্তিশালী রাডার ২৪টি পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করতে সক্ষম। বিমানটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ম্যাক ২.৩ আর সামরিক পাল্লা প্রায় ৯৩০ কিলোমিটার। বিমানবাহী রণতরী থেকে এটি ওঠা-নামায় পারদর্শী। মার্কিন টিন সিরিজের প্রথম নিদর্শন এফ-১৪। ২০ এমএম কামান সমৃদ্ধ এফ-১৪ আকাশযুদ্ধে ফিনিক্স, সাইডউইন্ডার আর স্প্যারোর মতো শক্তিশালী মিসাইল আর গতিবেগের বদৌলতে সাফল্য দেখিয়েছে। তবে টিন সিরিজের পরবর্তী বিমান এফ-১৫ এর অধিকতর সাফল্যের কারণে এফ-১৪ অনেকক্ষেত্রেই স্রেফ ইন্টারসেপ্টার এবং এসকোর্ট বিমান হিসেবে অভিযান চালিয়েছে।

আমেরিকার হয়ে উপসাগরীয় যুদ্ধসহ ইরাক, লিবিয়া আর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে এফ-১৪। তবে এই হুলো বেড়ালের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেবা পেয়েছে ইরান। রেজা শাহর আমলে বেশ কিছু এফ-১৪ ইরানে রপ্তানি করা হয়েছিল। পরে ইরানের ইসলামী সরকার ক্ষমতায় এসে ইরাকের বিরুদ্ধে এফ-১৪ আকাশে নামায়। অন্তত দেড়শো ইরাকি হেলিকপ্টার, মিগ আর মিরেজ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করবার বিপরীতে ইরানিরা সর্বোচ্চ পনেরোটি এফ-১৪ হারিয়েছিল। যদিও মার্কিন সাহায্যের অভাবে অনেক এফ-১৪কেই ইরানিরা অন্যান্য প্রযুক্তি দিয়ে সাজিয়েছে।

স্পেয়ার পার্টস বা মার্কিন উপদেষ্টা ছাড়াই এসব অর্জন প্রমাণ করে সমরযন্ত্র হিসেবে বিমানটি দারুণ সফল। ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র এফ-১৪ কে অবসর দিলেও ইরানিরা এখনো বেশ কিছু হুলো বেড়াল ব্যবহার করছে। মার্কিন নৌবাহিনীতে এফ-১৪ এর স্থান দখল করেছে এফ-১৮ হরনেট। ‘টপ গান’সহ নানা সিনেমা আর কার্টুনে এফ-১৪ কে দেখা যায়।  

রণতরীতে এফ-১৪; Image Source: https: www.defense.gov

ম্যাকডনেল ডগলাস এফ-১৫ ঈগল

ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনদের প্রধানতম সমস্যাগুলোর একটি ছিল ছোট আর দ্রুতগামী মিগ-১৯ এবং মিগ-২১ এর বিরুদ্ধে নিজেদের ভারি বোমারুগুলোর নিরাপত্তা প্রদান। এফ-৪ ফ্যান্টম উৎকৃষ্ট যুদ্ধবিমান হলেও মিগের তুলনায় ধীরগতির ছিল। এছাড়া, ষাটের দশকে সোভিয়েতরা মিগ-২৫ ফক্সব্যাট নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গোয়েন্দাদের কল্যাণে ফক্সব্যাটের ছবি দেখে তো মার্কিন কর্তাদের চক্ষু চড়কগাছ! বিরাট আকার আর শক্তিশালী ইঞ্জিনের মিগ-২৫ ছিল মূলত ইন্টারসেপ্টার, কিন্তু মার্কিনরা ভাবল, এ বুঝি কোনো ভয়ানক ফাইটার বিমান। কাজেই সোভিয়েতদেরকে টেক্কা দিয়ে আকাশে পূর্ণ আধিপত্য বিস্তারের খায়েশ থেকে জন্ম নেয় এফ-১৫ ঈগল।

এফ-১৫ ঈগল; Image Source: airspacemag.com/ Neil Bates

৬৩ ফুট লম্বা, দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট, একক পাইলট চালিত এফ-১৫ ঈগল মার্কিন বিমানশিল্পের শ্রেষ্ঠতম নমুনাগুলোর একটি। এর ডেল্টা ডানা, বাবল ক্যানোপিযুক্ত ককপিট, লুক ডাউন/শ্যুট ডাউন রাডার, ফ্লাই বাই ওয়্যার কন্ট্রোল, শক্তিশালী ইঞ্জিন, শত্রু/মিত্র বিমান চিহ্নিত করবার প্রযুক্তি, হেডস আপ ডিসপ্লে আর আধুনিক কম্পিউটার এফ-১৫ কে দারুণ এক যুদ্ধবিমানে পরিণত করেছে। চটপটে এই বিমান ডাম্ব আর স্মার্ট বোমা, ২০ এমএম কামান আর নানাবিধ মিসাইল বহনে সক্ষম। সর্বোচ্চ গতিবেগ ম্যাক ২.৫, পাল্লা দিতে পারে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার অবধি। এফ-১৫ই স্ট্রাইক ঈগল নামের একটি ভার্সন আছে, যা মূলত ভূমিতে হামলা চালানোয় ব্যবহৃত হয়। এফ-১৫ যেকোনো আবহাওয়ার জন্য উপযোগী বিমান। মার্কিনরা এই বিমান থেকে স্যাটেলাইট বিধ্বংসী মিসাইল পর্যন্ত সফলভাবে উৎক্ষেপণ করেছে। 

চার দশকের বেশি সময় ধরে আকাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই মার্কিন ঈগল। লেবাননে আশির দশকে আকাশযুদ্ধে ৮০টির বেশি সিরীয় মিরেজ আর মিগ ভূপাতিত করেছিল ইজরায়েল, এর অর্ধেকই এফ-১৫ এর শিকার। সৌদিরা এ বিমান ব্যবহার করেছে ইয়েমেনের হুতিদের বিরুদ্ধে। জাপানি বিমানবাহিনীতে এফ-১৫ এর লাইসেন্স নির্মিত নিজস্ব ভার্সন- মিৎসুবিশি এফ-১৫জে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুগোস্লাভ আর উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকি বিমান ও স্থলবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য আছে বিমানটির। আকাশে এফ-১৫ যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তা একটি উপাত্ত থেকেই পরিষ্কার- এ পর্যন্ত কোনো বিমানবাহিনী একটিও এফ-১৫ ভূপতিত করতে পারেনি। এর বিপরীতে ঈগলের নখরে বিধ্বস্ত হয়েছে একশোর বেশি শত্রুবিমান। 

জেনারেল ডায়নামিক্স এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন

এফ-১৪ বা এফ-১৫ যুদ্ধবিমান হিসেবে খুবই সফল হলেও বিমানগুলোর কিছু সমস্যা ছিল। এসব বিমান আকারে-ওজনে হতো বিরাট, আর বানাতে খরচ পড়ত প্রচুর। বিপুল সংখ্যক বিমান কিনতে গেলে মার্কিন বিমানবাহিনীর ভাঁড়ারে টান পড়বে, এ চিন্তা থেকেই অপেক্ষাকৃত সস্তা অথচ আধুনিক একটি যুদ্ধবিমানের দরকার পড়েছিল। তাছাড়া, ন্যাটো সদস্যরাও হালকা ও কার্যকরী একটি যুদ্ধবিমানের চাহিদা জানাতে থাকে। এসব প্রয়োজন থেকেই এফ-১৬ এর সৃষ্টি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি এটা আকাশে ওড়ে। সে থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে চার হাজারের বেশি এফ-১৬ নির্মিত হয়েছে।  

এফ-১৬; Image Source: nationalinterest.org

এফ-১৬ একক ইঞ্জিন, একক পাইলট, ডেল্টা ডানা বিশিষ্ট সুপারসনিক যুদ্ধবিমান। দিনে-রাতে যেকোনো আবহাওয়ায় উড়তে পারে। আকাশযুদ্ধ বা ভূমিতে হামলা থেকে শুরু করে গোয়েন্দাগিরি; সবেতেই পারদর্শী। দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট, গতিবেগ প্রায় ম্যাখ ২। এর ককপিটের ডিজাইন কিছুটা ভিন্ন। বিমান চালাবার স্টিক বসানো হয়েছে পাইলটের ডানপাশে (অন্যান্য বিমানে এই স্টিক বা হ্যান্ডেল থাকে পাইলটের সামনে)। ক্যানোপির পুরোটাই কাঁচের ফ্রেম হওয়ায় অন্যান্য বিমানের তুলনায় এফ-১৬ এর পাইলটের দৃষ্টিসীমাও বেশি সুবিধাজনক। ফ্লাই বাই ওয়্যারের সাথে রিল্যাক্সড স্ট্যাটিক স্ট্যাবিলিটি প্রযুক্তি যোগ করা প্রথম যুদ্ধবিমান হচ্ছে এফ-১৬।

এতে বিমানের নিয়ন্ত্রণে পাইলট বাড়তি সুবিধা পায়। এছাড়া লুক ডাউন বা শ্যুট ডাউন রাডার, হ্যান্ডস অন থ্রটল অ্যান্ড স্টিক প্রযুক্তি, হেডস আপসহ কয়েকরকম ডিসপ্লে, অত্যাধুনিক কম্পিউটারসহ নানা ইলেকট্রনিক জ্যামিং প্রযুক্তির ফলে এফ-১৬ এর পাইলট যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে থাকে। বিমানটি ছোট হওয়ায় পাল্লা অপেক্ষাকৃত কম; সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার। তবে ২০ এমএম কামান, ছয়খানা মিসাইল আর নিউক্লিয়ার বোমাসহ নানাবিধ বোমা ও রকেট বহনের ক্ষমতা এফ-১৬কে এক ভয়ানক মারণাস্ত্রে পরিণত করেছে। 

আকাশে যুদ্ধাস্ত্র; Image Source: sputniknews.com

বিশ্বের ২৫টির বেশি দেশের বিমানবাহিনীতে এফ-১৬ কর্মরত। যুগোস্লাভিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়াসহ সমস্ত ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত সব অভিযানেই এফ-১৬ অংশ নিয়েছে। বস্তুত ইসরায়েল, মিশর, সৌদি আরব আর তুর্কি বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত হওয়ার কল্যাণে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে এফ-১৬ পরিচিত মুখ। তুর্কি এফ-১৬ রুশ, সিরীয় আর গ্রিক বিমানের বিরুদ্ধে সাফল্য পেয়েছে। কুর্দিদের বিরুদ্ধে হামলাতেও তুর্কি এফ-১৬ কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তানের হয়ে এ বিমান আফগান, সোভিয়েত আর ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।

এফ-১৬ ব্যবহার করেই ইসরায়েল ইরাকের ওসিরাক পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছিল। সিরিয়া, লেবানন আর প্যালেস্টাইনের সংঘাতে এফ-১৬ বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে লেবানন যুদ্ধে ৪০টির বেশি সিরীয় যুদ্ধবিমান ভূপতিত করা নিঃসন্দেহে সাফল্যের প্রমাণ। তুরস্ক, মিশর, ইসরায়েলসহ কয়েকটি দেশ নিজেদের দেশেই এফ-১৬ এর নিজস্ব সংস্করণ বানিয়ে থাকে। মার্কিন বিমানবাহিনী ২০২৫ সাল পর্যন্ত এফ-১৬ ব্যবহার করবে। 

Related Articles