বর্তমানে প্রায় ৪ বিলিয়ন ওয়াইফাই যুক্ত ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহৃত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। স্মার্টফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশন, খেলনা, ড্রোন সব কিছুতেই ব্যবহৃত হচ্ছে ওয়াইফাই প্রযুক্তি। ওয়াইফাই প্রযুক্তি সর্বপ্রথম উদ্ভাবিত হয় সেই ১৯৯৭ সালে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে উন্নতি হয়েছে প্রযুক্তির এ শাখারও। সেই উন্নয়নের ধারায় ২০১৯ সালে আসছে নতুন প্রযুক্তির ও দ্রুতগতির পরবর্তী প্রজন্মের ওয়াইফাই, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘Wi-Fi 6‘।
গতির সাথে সাথে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারবে নতুন এই ওয়াইফাই প্রযুক্তি। শুধু এটিই নয়, এখন থেকে সবধরনের ওয়াইফাই প্রযুক্তিকেই নির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা হবে। পূর্বের ওয়াইফাই ভার্সন স্ট্যান্ডার্ডগুলো ছিল খুবই বিভ্রান্তিকর। তিন-চার অক্ষরের নাম্বার দেখে অনেকেই বুঝতেন না কোনটি আগের আর কোনটি পরের প্রযুক্তি। তাই বর্তমানে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। যেমন, পুরনো ‘802.11ac’ ওয়াইফাই ভার্সনকে পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয়েছে ‘Wi-Fi 5’ হিসেবে। আগামী বছর থেকেই আপনি বিভিন্ন ওয়াইফাই যুক্ত ডিভাইসে নিচের ভার্সনগুলো দেখতে পাবেন। সেক্ষেত্রে-
- ২০০৯ সালে বের হওয়া 802.11n ওয়াইফাই প্রযুক্তির নাম হবে WiFi 4
- ২০১৪ সালে বের হওয়া 802.11ac ওয়াইফাই প্রযুক্তির নাম হবে WiFi 5
- এবং ২০১৯ সালে বের হওয়া 802.11ax ওয়াইফাই প্রযুক্তির নামকরণ করা হবে WiFi 6
ওয়াইফাই সংস্থার ঘোষণানুসারে, হার্ডওয়্যারের পাশাপাশি বিভিন্ন সফটওয়্যারেও এখন ওয়াইফাইকে এ ধরনের নাম্বার হিসেবে দেখতে পাওয়া যাবে। এতে খুব সহজেই একজন কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন ব্যবহারকারী বুঝতে পারবেন কোন ওয়াইফাই নেটওয়ার্কটি নতুন ও দ্রুতগতির। নতুন এই প্রযুক্তিগুলোর পাশাপাশি পুরনো প্রযুক্তিগুলোর নামও পরিবর্তন করা হয়েছে। যদিও এই পুরনো প্রযুক্তিগুলো উন্নত দেশগুলোতে বর্তমানে খুব একটা ব্যবহৃত হয় না। পুরনো প্রযুক্তির নামকরণ করা হয়েছে এভাবে-
- WiFi 1 হিসেবে ১৯৯৯ সালে বের হওয়া 802.11b প্রযুক্তি
- WiFi 2 হিসেবে ১৯৯৯ সালে বের হওয়া 802.11a প্রযুক্তি
- WiFi 3 হিসেবে ২০০৩ সালে বের হওয়া 802.11g প্রযুক্তি
খুব শীঘ্রই আমরা আমাদের স্মার্টফোন, ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটারে এই ওয়াইফাই নাম্বারগুলো দেখতে পাবো।
এখন চলুন জেনে নেয়া যাক ২০১৯ সালের আসন্ন WiFi 6 প্রযুক্তিতে কী কী সুবিধা পাওয়া যাবে।
দ্রুতগতি
বরাবরের মতো এবারও নতুন ওয়াইফাই ভার্সনটিতে থাকছে পূর্বের তুলনায় দ্রুত ডাটা ট্রান্সফার স্পিড। এক্ষেত্রে পূর্বের ওয়াইফাই ৫ এর তুলনায় নতুন ওয়াইফাই ৬ এর গতি হবে ৪০ শতাংশ বেশি। পূর্বের তুলনায় আরো কার্যকর ডাটা এনকোডিং টেকনোলজির ফলেই ওয়াইফাই ৬ এই উচ্চগতি দিতে সক্ষম হবে।
নতুন এই ওয়াইফাই ৬ প্রযুক্তির ফলে পুরনো ২.৪ গিগাহার্টজ নেটওয়ার্কেও বেশি গতি পাওয়া যাবে। বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে নতুন ৫ গিগাহার্টজের ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বহু দেশের বেশিরভাগ ইলেকট্রিক ডিভাইস এখনো পুরানো ২.৪ গিগাহার্টজ ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। এছাড়া ২.৪ গিগাহার্টজের নেটওয়ার্ক কভারেজ ৫ গিগাহার্টজ থেকে বেশি। ফলে নতুন ওয়াইফাই ৬ প্রযুক্তি পুরনো ২.৪ গিগাহার্টজ নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে হবে আশীর্বাদস্বরূপ।
আরো বেশি ব্যাটারি ব্যাকআপ
নতুন এই ওয়াইফাই ৬ প্রযুক্তিতে থাকছে ‘Target Wake Time’ (TWT) নামে নতুন একটি ফিচার। আর এর ফলে আপনার স্মার্টফোন, ল্যাপটপ সহ বিভিন্ন ওয়াইফাই যুক্ত ডিভাইসগুলোতে পাওয়া যাবে পূর্বের তুলনায় বেশি ব্যাটারি ব্যাকআপ।
নতুন এই প্রযুক্তিতে যখন কোনো ডিভাইস কোনো ওয়াইফাই নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে, তখন ডিভাইসটিতে কখন ডাটা আদান-প্রদান হবে আর কখন হবে না, সেটির তথ্য নেটওয়ার্ক ডিভাইসটিকে দেবে। ফলে ডিভাইসটি বুঝতে পারবে, কখন তাকে ডাটা নিতে হবে আর কখন তাকে ডাটা নেয়া বন্ধ করতে হবে। এর ফলে মোট ব্যাটারি খরচ কমে আসবে। ফলে ডিভাইসে চার্জ থাকবে বেশি।
জনাকীর্ণ স্থানে আরো ভালো কার্যক্ষমতা
সাধারণত স্টেডিয়াম, এয়ারপোর্ট, হোটেল, শপিং মল, আপনার অফিস কিংবা ভার্সিটির মতো বিভিন্ন জনাকীর্ণ স্থান, যেখানে বহু মানুষ ওয়াইফাই ব্যবহার করছে এমন স্থানে ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়। ফলে গতিও তুলনামূলকভাবে কমে আসে। কিন্তু এই সমস্যা আর থাকছে না। 802.11ax বা ওয়াইফাই ৬ নেটওয়ার্কে এমন কিছু নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া যাবে উপরের এই সমস্যার হাত থেকে।
শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইন্টেল জানিয়েছে, নতুন এই ওয়াইফাই প্রযুক্তির মাধ্যমে জনাকীর্ণ এলাকায় প্রত্যেক ব্যবহারকারী আগের তুলনায় ৪ গুন বেশি গতি পাবেন। আর এটি কিন্তু শুধু বিভিন্ন জনাকীর্ণ এলাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বর্তমানে প্রত্যেক বাসা কিংবা ফ্ল্যাটেই বহু ব্যবহারকারী ওয়াইফাই ব্যবহার করে থাকেন। সেক্ষেত্রে প্রচুর ডিভাইস একটি ওয়াইফাই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকে। নতুন এই প্রযুক্তির ফলে এমন জনাকীর্ণ পরিস্থিতিতেও আপনি পাবেন দ্রুতগতি।
এ তো জানা গেলো নতুন এই প্রযুক্তির সুবিধা। তবে এসব সুবিধা পেতে গেলে কী করতে হবে আপনাকে? হ্যাঁ, এসব সুবিধা পেতে হলে আপনার ডিভাইসটিকে নতুন এই ওয়াইফাই প্রযুক্তি সমর্থিত হতে হবে। আর সেজন্য এরপর থেকে নতুন কোনো ওয়াইফাই যুক্ত ডিভাইস কিনতে গেলে লক্ষ্য রাখবেন সেটি যেন ওয়াইফাই ৬ সমর্থিত হয়। সেক্ষেত্রে আপনাকে আর পুরনো 802.11ac কিংবা 802.11ax কোনটি ভালো বা কোনটি নতুন, এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়তে হবে না। আপনি শুধু খেয়াল রাখবেন ডিভাইসটিতে WiFi 6 কিংবা WiFi 5 লেখা রয়েছে কি না।
ভবিষ্যতের ডিভাইসগুলোতে থাকবে‘WiFi 6 Certified’ লোগো। ফলে খুব সহজেই বোঝা যাবে এটি নতুন প্রযুক্তি যুক্ত। পূর্বের ডিভাইসগুলোতে শুধু ‘WiFi Certified’ লোগো থাকতো, যা দেখে বোঝা যেত না যে এতে কোন ভার্সনের ওয়াইফাই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও নতুন ওয়াইফাই ৬ প্রযুক্তি যুক্ত রাউটারগুলোতে থাকবে নতুন প্রজন্মের WPA3 সিকিউরিটি, যা পূর্বের WPA2 থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।
কবে থেকে পাওয়া যাবে এই সুবিধা?
বর্তমানে বহু ওয়াইফাই রাউটার ইতিমধ্যে তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে 802.11ax প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেছে। তবে ওয়াইফাই ৬ হিসেবের এগুলোর বাজারজাত শুরু হয়নি এখনো। ওয়াইফাই ৬ সমর্থিত কোনো ডিভাইসও এখনো বাজারে আসেনি। তবে, ওয়াইফাই সংস্থার মতে, ২০১৯ সালের কোনো এক সময়েই পাওয়া যাবে এই ওয়াইফাই ৬ প্রযুক্তি যুক্ত পণ্যগুলো।
আর বরাবরের মতোই নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রেরক ও গ্রাহক দুটি ডিভাইসকেই হতে হবে ওয়াইফাই ৬ সমর্থিত। অর্থাৎ আপনি যদি আপনার রাউটার থেকে আপনার স্মার্টফোনে ওয়াইফাই ব্যবহার করে থাকেন, তবে নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হলে রাউটার এবং স্মার্টফোন দুটোই ওয়াইফাই ৬ সমর্থিত হতে হবে। আপনার রাউটারটি ওয়াইফাই ৬ সমর্থিত কিন্তু স্মার্টফোনটি ওয়াইফাই ৫ সমর্থিত, এমন হলে আপনি সেই স্মার্টফোনটি দিয়ে ওয়াইফাই ৫ প্রযুক্তির সুবিধা পাবেন, ওয়াইফাই ৬ নয়।
এছাড়া নতুন প্রযুক্তির ওয়াইফাই ৬ বাজারে আসলেও কোন কোন কোম্পানি তাদের আগামী ডিভাইসে সেটি ব্যবহার করবে আর কোন কোন কোম্পানি তা ব্যবহার করবে না, এটি একান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার। ওয়াইফাই সংস্থা সকল ডিভাইস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে নতুন এই নাম্বারিং সিস্টেম ব্যবহার করতে উৎসাহী করলেও এক্ষেত্রে জোর করার কোনো সুযোগ তাদের নেই। ফলে ভবিষ্যতে হয়তো অনেক ডিভাইস কোম্পানিই তাদের ডিভাইসগুলোতে পুরানো পদ্ধতিতে 802.11ax লিখে বাজারজাত করতে পারে। তবে আশা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে সকল ওয়াইফাই ভিত্তিক ডিভাইস কোম্পানি এই নাম্বার সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।