
যারা গাড়ি চালান বা নিয়মিত গাড়িতে চড়েন, ‘স্পেয়ার পার্টস’ কথাটি তাদের খুবই পরিচিত। এই স্পেয়ার পার্ট (Spare Part) আসলে কী জিনিস? যখন যানবাহনের কোনো অংশবিশেষ বিকল হয়ে যায়, বা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে, তখন মজুদ থাকা সেই একই অংশবিশেষের বদলাই হলো স্পেয়ার পার্ট।
রসদ যোগান আর সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার একটা বড় অংশই হলো স্পেয়ার পার্ট জোগাড়। কখনও কখনও কিছু কোম্পানিতে কেবল সাপ্লাই চেইন না, বরং আলাদাভাবে স্পেয়ার পার্ট ব্যবস্থাপনা সিস্টেমও থাকে- এতটাই গুরুত্ব এর!

গাড়ির এমন কিছু পার্ট রয়েছে যেগুলো অনেকদিন স্থায়ী থাকবার গ্যারান্টি দেওয়া হয়, বিকল হবার সম্ভাবনাও কম- কিন্তু যদি কখনও হয়েই যায় বিকল, তাহলে পুরো যান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই বিকল হয়ে পড়ে থাকবে, কারণ সেই পার্টের বদলা আসতে বহুদিন লেগে যায়। এ ধরনের স্পেয়ার পার্টগুলোকে বলে ক্যাপিটাল স্পেয়ার।
স্পেয়ার পার্ট হতে পারে দুই রকমের। এক ধরনের হলো যেগুলো মেরামত করে ফেলা যায়, এগুলোকে বলা হয় রিপেয়ারেবল (Repairable), আর আরেক ধরন হলো, যেগুলো মেরামত করা যায় না, সেগুলোকে বলা হয় কনজিউমেবল (Consumable)।
ধরুন আপনার গাড়ির যে পার্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আপনি ভাবছেন যে সেটি হয়তো মেরামত করা যাবে। কিন্তু মেরামত করতে গিয়ে আপনি আবিষ্কার করলেন, মেরামতের খরচ এতই বেশি আসছে যে, এর চেয়ে রিপ্লেস করার জন্য যে খরচ যাবে তা সামান্যই বেশি, বরং নতুন পার্ট পাচ্ছেন সেখানে। সেক্ষেত্রে আপনি কী করবেন? অবশ্যই স্পেয়ার পার্ট এর অর্ডার দিয়ে দেবেন, যেন তা দিয়ে বিকল অংশ রিপ্লেস করে ফেলা যায়। এটাই মূলত স্পেয়ার পার্টস কিনবার মূল কারণ। ভাঙা কাঁচ যেমন মেরামত করলেও ফাটল রয়েই যায়- তাতে মেরামতের খরচও যায়, কিন্তু এর চেয়ে কিছু বেশি দাম দিয়ে নতুন কাঁচ কিনে ফেললেই সমাধান হয়ে যায়; স্পেয়ার পার্টসের ব্যাপারটাও তেমনই, মেরামত করা পার্টসের বদলে নতুন পার্ট পেয়ে যাওয়া।

রিপেয়ারেবল পার্টগুলো সাধারণত খুব সহজেই খুলে ফেলা যায়, এরপর মেরামত করে আবার জায়গামতো বসানো যায়। অন্যদিকে, যেহেতু কনজিউমেবল পার্ট মেরামত করা যায় না, তাই সেগুলো নষ্ট হলে একেবারে বাতিলের খাতাতেই নাম লেখাতে হয়, এরপর নতুন পার্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তবে এ পার্টগুলো অর্ডার দেওয়ার সময় পাইকারিতে অর্ডার দেওয়াই ভালো, কারণ, সেগুলোর দাম সাধারণত কম আর বেশি পরিমাণে আনা যায়, যা ব্যবসায় লাভের মুখ দেখায়।

এবার আসা যাক এই স্পেয়ার পার্টসের খোঁজ কোথায় পাওয়া যায় সে কথায়, উদাহরণ হিসেবে টয়োটার নামই টানা যাক, যেহেতু এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রাস্তায় চলা সবচেয়ে বেশি গাড়ি টয়োটা ব্র্যান্ডেরই। টয়োটা গাড়ির জন্য আপনার স্পেয়ার পার্টসের প্রয়োজন হলে সোজা চলে যেতে পারেন টয়োটা সার্ভিস সেন্টারে, যেখানে আপনার গাড়ির সার্ভিসিং করা যাবে একেবারে জাপানিজ স্টান্ডার্ডে! আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, তাদের শতভাগ আসল স্পেয়ার পার্ট।
কিন্তু শতভাগ আসল স্পেয়ার পার্ট কেনা কি জরুরি? মানে, টয়োটার নিজস্ব সার্ভিস সেন্টার ছাড়া বাজারে অন্যান্য যেসব স্পেয়ার পার্ট পাওয়া যায়, সেগুলো লাগালে কি কোনো অসুবিধা আছে? সবসময় যে টয়োটা গাড়ির জন্য টয়োটা ব্র্যান্ডের পার্টস আনতে হবে, এটাই বা কতটা দরকারি?

এর উত্তরে বলতে হয়, টয়োটা গাড়ির প্রতিটি পার্ট এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যেন তা স্বাভাবিক অবস্থায় গাড়ির আয়ুর পুরোটা জুড়েই টিকে থাকে। গাড়ির নির্মাণে যে প্রকৌশলীরা নিয়োজিত থাকেন, তারাই স্পেয়ার পার্টগুলোর গুণগত মান নিজেরা পরীক্ষা করে দেখেন। কিন্তু একটি গাড়ি ব্যবহারের সাথে সাথে এর পার্টগুলোও পুরনো হতে থাকে, কখনও না কখনও তো দরকার হয় সেগুলো রিপ্লেস করার। বাজারে দেখতে প্রায় একই রকম অন্য ব্র্যান্ডের স্পেয়ার পার্টস খুঁজে পাওয়া যায়, যেগুলো আসল নয়, এদেরকে বলা হয় ‘আফটারমার্কেট’ বা ‘গ্রে মার্কেট’ ইত্যাদি। অনভিজ্ঞ চোখে আসল পার্টের সাথে হয়তো কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাওয়া যাবে না এগুলোর। তবে টয়োটার ইঞ্জিনিয়ারগণ কখনই পরামর্শ দেবেন না যে আপনি এগুলো ব্যবহার করেন আপনার টয়োটা গাড়ির জন্য। কারণ, সেগুলো আদৌ দীর্ঘ সময়ের জন্য আপনার গাড়ির জন্য ভালো হবে কিনা, সেটা তো টয়োটা আর অফিশিয়ালভাবে পরীক্ষা করে দেখেনি।

অন্যদিকে টয়োটার আসল পার্টস কিনলে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারবেন যে এগুলো তাদের ফ্যাক্টরিতেই বানানো এবং আপনার গাড়ির আগের আসল পার্টের মতোই গুণসম্পন্ন। আসল পার্টস নিলে গুণে-মানে নির্ভরযোগ্যতা আর দীর্ঘ সময়ের জন্য নিশ্চিন্ত থাকা- দুটোই সম্ভব। আর তাছাড়া এতে করে গাড়ির ওয়ারেন্টি যেমন টিকে থাকে, তেমনই গাড়িতে অবস্থান করা যাত্রীদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়।
কিন্তু বাজারে পাওয়া নকল পার্টস তো দামে বেশ কম হয়। কীভাবে তারা দেখতে একই জিনিস কম দামে দিতে পারছে? এর উত্তর একটাই- উৎপাদনের কাঁচামালে ভিন্নতা।
যারা এই পার্টগুলো বানাচ্ছে, দেখতে তারা একই রাখছে বটে সেগুলোকে, কিন্তু ভেতরের উপাদান দিচ্ছে বদলে। উন্নত মানের উপাদানের বদলে দিচ্ছে অন্য উপাদান, যা দামে সস্তা আর পাইকারি উৎপাদনের জন্য লাভজনক। টয়োটা তাদের গবেষণার কাজে যে খরচটা করে, তা নিশ্চিত করে যে তাদের পার্টস টিকে যাবে, কিন্তু একই কথা নকলগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। পার্টসের পরিমাণ নয়, টয়োটা বরং জোর দেয় গুণের উপর- আর সেটাই আপনাকে রাখবে নিশ্চিন্ত।
আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, টয়োটার নাম দিয়েই তো ভাঁওতাবাজি করছে অনেকে, অন্য ব্র্যান্ড নয় বরং টয়োটার নাম দিয়েই নকল পার্টস বিক্রি করে চলেছে অনেকে। সেগুলোর মান বরং আরও খারাপ, যা বাড়িয়ে দিতে পারে আপনার গাড়ির দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। এর জন্য একমাত্র সমাধান হলো টয়োটার নিজস্ব সার্ভিস সেন্টার, যেখানে ভেজাল নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তার দরকার হবে না।
আপনি হয়তো একটি টয়োটা পার্ট কিনেই ফেলেছেন, কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না যে সেটি আসল নাকি নকল পার্ট। কী করবেন আপনি? ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতেই থাকবেন? এমন অবস্থায় আপনার উচিত টয়োটার সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে চেক করিয়ে আনা। তাই শুরুতেই যদি আসল পার্টস কিনে মেরামত করা হয় সেটাই ভালো। যদি টয়োটার নিজস্ব সেন্টার থেকে না কিনেন, তাহলে আপনি ধরে নিতেই পারেন যে, পার্টটি আসল নয়।

একারণে পরেরবার যখন আপনি আপনার গাড়ির স্পেয়ার পার্ট কেনার পরিকল্পনা করছেন, ভেবে দেখবেন যে আসল পার্ট কিনে নিশ্চিন্ত থাকা, নাকি নকল কিনে দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকা- কোনটা ভালো? টাকার চিন্তা না করে বরং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাই কিন্তু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত প্রত্যেক ব্র্যান্ডেরই নির্দিষ্ট কিছু কারণ থাকে আসল পার্ট কিনতে বলার। যেমন- টয়োটার ক্ষেত্রে কারণ মূলত তিনটি।
১) নিরাপত্তা: যেহেতু পার্টগুলো কেবল সেই মডেলের জন্যই নির্মিত, তাই আপনি নিরাপত্তার ব্যাপারে পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেন।
২) নির্ভরযোগ্যতা: অরিজিনাল পার্টস ব্যবহার করলে নিরাপত্তা তো আছেই, তার সাথে আছে দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্ভরযোগ্যতা।
৩) সহজতা: আপনাকে একদমই চিন্তা করতে হবে না, কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনব, কারণ টয়োটা আপনার গাড়ির একটা পার্টের জন্য একটা মডেলেরই স্পেয়ার বানিয়ে রেখেছে, আপনি কেবল গিয়ে কিনে ফেলবেন। এতই সহজ আপনার কাজ।

এই আসল পার্টগুলোকে বলা হয় OEM পার্ট, যার পূর্ণরূপ হলো Original Equipment Manufacturer; আর নকলগুলো যে আফটারমার্কেট নামে পরিচিত তা তো বলাই হয়েছে। এই তিনটি বিষয় যদি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে দায়সারাভাবে যেনতেন স্পেয়ার পার্টস না কিনে আসল পার্টস নিন টয়োটার সার্ভিস সেন্টার থেকে, অন্তত নিরাপদ ভ্রমণে নিশ্চয়তার জন্য এটুকু তো জরুরিই!