ভূ-গোলকে বাংলাদেশের প্রতিসম ভূখণ্ডটি চিলিতে অবস্থিত। ওদিকে ব্রাজিল ছাড়া দক্ষিণ আমেরিকার অন্য কোনো দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস নেই। এ দুই তথ্য থেকেই বোঝা যায় ভৌগোলিকভাবে ও মানসিকভাবে (ফুটবল ব্যতীত) দক্ষিণ আমেরিকা আমাদের কাছে কত অচেনা একটি গন্তব্য! এ কারণেই বিশ্বের অন্যান্য বিখ্যাত পর্যটনস্থলের কথা জানলেও দক্ষিণ আমেরিকা অনেকটাই ব্রাত্য আমাদের আগ্রহের তালিকায়! অথচ প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা এই মহাদেশেই সাজানো রয়ছে প্রকৃতির আশীর্বাদধন্য অপরূপ কিছু স্থান। সমুদ্র সৈকতগুলো বিবেচনার বাইরে রেখে সেইসব ১০টি জায়গা নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের এই লেখা। দেখে নিন জায়গাগুলো, যুক্ত করে নিন আপনার বাকেট লিস্টে।
১) পাতাগোনিয়া, চিলি
কেমন হয় যদি একইসাথে লাতিন আমেরিকার চোখ ধাঁধানো বন্যতার সাথে উত্তর ইউরোপের ‘ট্রেডমার্ক’ হিমবাহের সংমিশ্রণ পান? সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালার ৬,৫০০ ফুট তোরেস দেল পাইনে’র শ্বেত বরফাবৃত পর্বতের নিচে তুষারশোভিত চকচকে আসমানী হ্রদ হলে কেমন হয়? হ্রদের ধারের ফণীমোহন ঝোর্ডস সাপ, দুর্লভ গুয়ানাকো হরিণ আর হ্রদের নিচে চুণী-পান্নার আধার যদি হয়? এর সবই পাবেন লাতিন পাতাগোনিয়ার চিলি অংশে। ঐ অঞ্চলের মাগদালেনা দ্বীপে গেলে দেখা মিলবে মেরুর ‘কোট পরা ভদ্রলোক’ পেঙ্গুইনেরও! কায়াকে চড়ে বা ব্যাগপ্যাক কাঁধে হেঁটে এতসব বৈচিত্র্যকে আলাদা করে আবিষ্কার করাকে আপনার ‘ঝামেলা’ মনে হতেই পারে। সেক্ষেত্রেও আছে ‘শর্টকাট’। সরাসরি চলে আসুন ‘তোরেস দেল পাইন ন্যাশনাল পার্ক’ এ, পুরো চিলির এক-তৃতীয়াংশ যে পাতাগোনিয়া, ছোট কলেবরে তার প্রায় সকল বৈচিত্র্যেই ঠাসা এই ইকো পার্ক। প্রকৃতিপ্রেমীদের সাথে সামুদ্রিক খাবারপ্রেমীদের জন্য এ পার্ক যেন সাক্ষাৎ স্বর্গ!
২) সালার দ্য ইয়ুয়ুনির লবণভূমি, বলিভিয়া
ডিজনির এ বছরের ব্লকবাস্টার ‘স্টার ওয়ার্স দ্য লাস্ট জেডাই’ সিনেমার একটি দৃশ্যের কথা মনে আছে? অ্যাকশন সেই দৃশ্যে কোনো সাদা-স্বচ্ছ বিস্তীর্ণ ভূমি দেখেছিলেন কি? হ্যাঁ, সেটিই ছিলো সালার দ্য ইয়ুয়ুনির বিখ্যাত লবণভূমি। বিশ্বের সব থেকে বড় এই লবণভূমি আয়তনে ১০,৫০০ বর্গ কিলোমিটার, উচ্চতায়ও তা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪,০০০ ফুট! বলিভিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের পতোসি প্রদেশের দানিয়েল কাম্পোস অঞ্চলে এটি অবস্থিত। যে ল্যাপটপ বা মোবাইলে এই আর্টিকেল পড়ছেন, তার ব্যাটারি যেই লিথিয়াম দিয়ে বানানো, বিশ্বে তার মোট মজুদের ৫০-৭০ ভাগ এই অঞ্চলেই! প্রাগৈতিহাসিক হ্রদসমূহের বিস্ময়কর বিবর্তনের ফল এই বিস্তীর্ণ লবণভূমি। মাথার ওপর পরিষ্কার আকাশ নিয়ে মাইলের পর মাইল জুড়ে আপনি যেন হাঁটবেন শুভ্র-স্বচ্ছ দর্পণের ওপর! ও হ্যাঁ, ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির সাথেও একদফা মোলাকাত হয়ে যাবে এই সফরে।
৩) তিতিকাকা হ্রদ, বলিভিয়া
দক্ষিণ আমেরিকার দীর্ঘতম এই হ্রদটি আপনাকে ভূমধ্যসাগরের কথা মনে করিয়ে দেবে। নৌকায় চড়ে যত মাঝহ্রদে এগোবেন গাঢ় নীলের স্বচ্ছতা হবে ততটাই দুর্দান্ত! মূল বন্দর পুনো থেকে ৪০ মিনিটের মতো গেলেই পেয়ে যাবেন ইউরোসদের। লাতিনের এই যাযাবর আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে এই হ্রদে ভাসমান ঘর বানিয়ে বাস করছে। অনন্য-সাধারণ ঘরগুলো বাঁশ ও ছনের তৈরি। সেই অসাধারণত্বের সম্পূর্ণ স্বাদ পেতে আপনাকে অমন কোনো বাড়িতে কোনো পরিবারের সাথে থাকতে হবে। তাদের ঘর, খাবার, জীবনাচরণ, আমোদের ধরনসহ সব কিছু কাছ থেকে দেখলেই না আসল রোমাঞ্চ!
৪) অ্যাঞ্জেল ফলস, ভেনেজুয়েলা
ভেনেজুয়েলার এই গৌরবের উচ্চতা প্রায় ৩,২০০ ফুট যা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উচ্চতার ১৯ গুণ, আইফেল টাওয়ারের ৩ গুণ! ১৯৩৩ সালে মার্কিন নাগরিক জেমস ক্রফোর্ড বিমানে চড়ে কাকতালীয়ভাবে এটি আবিষ্কার করেন। এর আগে ঐ অঞ্চল অধিগ্রহণকারী আদিবাসীরা পর্যন্ত জানতো না এর কথা! ১৯৬২ সালে একে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয় কানাইমা ন্যাশনাল পার্ক, ১৯৯৪-এ ইউনেস্কো যাকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ ঘোষণা দেয়। রাজধানী কারাকাস থেকে প্রায় ১,০০০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই পার্ক। চুরুন নদীতে নৌকা ভাসিয়ে, মশা নিরোধক ক্রিম লাগিয়ে জঙ্গলে হেঁটে কিংবা বিমানে চড়ে উপভোগ করতে পারেন বিশ্বের সর্বোচ্চ জলপ্রপাতের মনমাতানো সৌন্দর্য। মে থেকে নভেম্বর হচ্ছে জলপ্রপাত দেখবার সেরা সময়, কেননা তখন পানি বেশি থাকে। চোখধাঁধানো রংধনু তৈরিই কেবল নয়, ঐ অঞ্চলের গোটা মৌসুমী বর্ষা নিয়ন্ত্রণ করে এই জলপ্রপাতই।
৫) ইগুয়াজু জলপ্রপাত, আর্জেন্টিনা
নায়াগ্রাপ্রেমী যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি ইলেনা রুজভেল্ট প্রথম একে দেখে বলে উঠেছিলেন, “বেচারা, নায়াগ্রা!”
সুন্দরের সংজ্ঞা সবসময়ই আপেক্ষিক। তবে তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বের সবথেকে সুন্দর জলপ্রপাতটি সম্ভবত আর্জেন্টিনার ইগুয়াজু-ই! বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই জলপ্রপাতটি প্রায় ২৫০টি জলপ্রপাতের সঙ্গমস্থল, যার কাছে বৃহত্তম জলপ্রপাত নায়াগ্রাকে একটিমাত্র কল থেকে নির্গত পানির মতো মনে হয়। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা জুড়ে এর অবস্থান হলেও এটির সেরা দর্শন আর্জেন্টিনা অংশ থেকেই। রাজধানী বুয়েন্স এইরেস থেকে নব্বই মিনিটের ফ্লাইটে পুয়ের্তো ইগুয়াজুতে নেমেই যাওয়া যাবে ১৯৮৪-তে ইউনেস্কো স্বীকৃত এই ‘বিশ্ব ঐতিহ্যে’। অপূর্ব এই জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দ্বিগুণ করবার আয়োজন করতে সেখানে আপনার জন্য রয়েছে টাওকান, ম্যাকাও, জাগুয়ারের মতো সব লাতিন প্রাণীগৌরব। সেখানে কাছ থেকে রংধনুর রঙ আর স্বর্গীয় পানির ছোঁয়া পেতে নৌকাবিহারে বের হতে হবে আপনাকে।
৬) লেঙ্কোইস মারানহেনসেস, ব্রাজিল
জায়গাটির নাম বেশ শক্তপোক্ত হলেও এর দর্শনে মন আপনার মোমের মতো ঠিকই গলতে বাধ্য। মরুভূমির ভেতর নীল হ্রদওয়ালা মরুদ্যানের কথা আমরা রূপকথায় পড়েছি, তাই না? আরবের শেখরা তা বাস্তব করলেও সেটি তো কৃত্রিম। কিন্তু প্রাকৃতিক মরুদ্যান কোথায় পাবেন? ব্রাজিলের মারানহাও প্রদেশের উত্তর উপকূলের কাছেই পাবেন।
ঢেউখেলানো সাদা বালুর ফাঁকে ফাঁকে নীল পানি, যেন দুমড়ানো কাগজের খাঁজে খাঁজে ঢালা রঙ! মজার ব্যাপার, এটিকে আপনি মরুও বলতে পারবেন না, কেননা প্রতি মৌসুমী বর্ষায় এ অঞ্চলের বালি সিক্ত হয়ে মাটির নিচে অভেদ্য পাথুরে আস্তরণকে পরিশ্রুত করে। জায়গায় জায়গায় জমে থাকা পানি হয়ে যায় একেকটি হ্রদ, যাকে ‘লেগুন’ বলা হয়। টলটলে নীল, সংখ্যায় অগণিত এই লেগুনগুলো মাছেদের বিশাল অভয়ারণ্য। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝে গেলে সবচেয়ে সুন্দর অবস্থায় পাবেন লেঙ্কোইস মারানহেনসেসকে।
৭) অসাঙ্গাতে রংধনু পর্বত, পেরু
পেরুভিয়ান আন্দিজের অসাঙ্গাতে পর্বত পৃথিবীর এক অপার বিস্ময়! থরে বিথরে পর্বতের গায়ে যেন রঙ মাখিয়ে রেখেছেন স্বর্গের কোনো এক সুনিপুণ শিল্পী! ফিরোজা থেকে হালকা বেগুনী, কিংবা সোনালী থেকে উজ্জ্বল মেরুন, কী নেই এখানে! পেরুর কুসকো শহরের দক্ষিণে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথের অর্ধেকটা বাহনে, অর্ধেকটা হাইকিং করে তবেই দেখা মেলে এই রংধনু পর্বতের। এই পর্বতকে স্থানীয়রা কুসকোর দেবতা বলে মানে। মাটিস্থ আয়রন অক্সাইড, অক্সিডাইজড লিমোনাইট, আয়রন সালফাইট, ক্লোরাইটের জন্য পাললিক গাত্রে যথাক্রমে লাল, খয়েরি, হলুদ ও সবুজ রঙ দেখা যায়।
৮) গ্যালাপোগাস দ্বীপপুঞ্জ, ইকুয়েডর
ইকুয়েডরের উপকূল হতে ৫৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত এই বিখ্যাত দ্বীপপুঞ্জটির নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ তত্ত্বের ধারণাটি চার্লস ডারউইনের মাথায় গেঁথে দিয়েছিলো এই দ্বীপই। প্রাণীবৈচিত্র্যে এতটা সমৃদ্ধ কোনো দ্বীপ বিশ্বে আর দুটো আছে কিনা, এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। প্রকৃতিপ্রেমীদের এই স্বর্গে আপনি পাবেন শতবর্ষী কচ্ছপ, নীলপেয়ে বুবি পাখি, ‘সমুদ্রসিংহ’ সিল; সেই সাথে লাভা ভূমির ওপর সারি সারি নারিকেল গাছ তো আছেই! এটি বাকেট লিস্টে না রাখলে হয়তো পস্তাতেই হবে আপনাকে।
৯) কটোপ্যাক্সি আগ্নেয়গিরি, ইকুয়েডর
চিরবসন্তের শহর কিটো থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরেই এক আগ্নেয়গিরির তোরণ! তোরণে রয়েছে সাতটি গগনচুম্বী ১৭,০০০ ফুট উচ্চতার স্তম্ভ, অর্থাৎ গিরিশৃঙ্গ। এখানেই রয়েছে ৫,৯০০ মিটার উচ্চতার কটোপ্যাক্সি আগ্নেয়গিরি, যা বিশ্বের উচ্চতম ও দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ আগ্নেয়গিরি। বিগত ৭০ বছর ধরে সুপ্ত থাকলেও একসময়ের প্রতাপশালী কটোপ্যাক্সির জ্বালামুখ জ্বলে উঠতে পারে যেকোনো সময়। মজার ব্যাপার, জ্বালামুখের কাছে লাভাপৃষ্ঠটি আবার বরফে মোড়া থাকে বেশিরভাগ সময়। প্যান আমেরিকান হাইওয়েতে জিপে চড়ে বা গ্লাইডারে আকাশে উড়ে উপভোগ করতে পারেন আগুনে এই সৌন্দর্য!
১০) পান্তানাল বন, ব্রাজিল
ব্রাজিল বলতেই রিও ডি জেনিরোর সৈকতের সূর্যাস্ত, কিংবা আমাজনের কথা অনেকে বলে ওঠেন। সাধারণ পর্যটকদের কাছে ‘আন্ডাররেটেড’ এ জায়গাটি কিন্তু রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকদের কাছে অসম্ভব শিহরণ জাগানিয়া। বিশ্বের সর্ববৃহৎ নিরক্ষীয় আর্দ্র বনভূমি পান্তানাল আয়তনে ৭০,০০০ বর্গ কিলোমিটার, যা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যের দ্বিগুণ! এ বিশাল বনটিতে বাস করে জাগুয়ার, পিউমার সাথে জলের সব থেকে বড় শিকারী ‘অ্যালিগেটর’ কুমির। শুধু তা-ই নয়, গোটা দক্ষিণ আমেরিকার সব থেকে বড় বন্যপ্রাণীর সমাবেশ ঘটেছে এই পান্তানালের বনভূমিতেই! পিঁপড়াভূক দানবাকার এন্টিচার, আর্মাডিল্লোর সাথে রয়েছে ‘মানুষখেকো’ পিরানহা মাছ, আছে যমদূতের ‘সর্পকূলীয় প্রতিনিধি’ অ্যানাকোন্ডা। একবার ভাবুন তো, বনের নদী দিয়ে নৌকায় ভেসে চলেছেন আপনি, ওদিকে কাপুচিন বানর আর দুর্লভ লাখ টাকার হায়াসিন্থ ম্যাকাও পাখিরা অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আপনাকে! দারুণ হবে না?
ফিচার ইমেজ:nationalgeographic.com