ঢাকা থেকে বান্দরবনের উদ্দেশ্যে যখন বাস ছাড়ল, ঘড়িতে তখন রাত ৯.৩০টা বাজে। আমরা কয়েকজন সহ বাস ভর্তি সবাই ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। পূজার ছুটি পেয়ে ঢাকার কোলাহল ছাড়িয়ে কোনো এক নয়নাভিরাম পরিবেশে সময় কাটানোর ইচ্ছা এখানকার সবার। হয়তো গন্তব্য আলাদা, তবে অভিপ্রায় সবারই এক। বাসে হালকা গল্প, আড্ডা আর জমিয়ে ঘুম শেষে সবাই যখন নড়েচড়ে বসলো, বাস তখন ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে বান্দরবন শহরের পথে। আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা আর মেঘের ফাঁকে সূর্যের আগমনী বার্তা দেখি। যতবারই আসি ততবারই মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকি আসমান জমিনের এই বিচিত্র ক্যানভাসের দিকে। তাই ভোরে যখন বাস থেকে নেমে আসার সময় হলো, মন যে আরেকটু দীর্ঘ পথের জন্যে আকুলি বিকুলি করেনি তা নয়।
যা-ই হোক, নাস্তার পর আরেকটু অপেক্ষা করতে হলো। তারপর আমাদের পরবর্তী বাস ছাড়বে রুমা উপজেলার উদ্দেশ্যে। অন্যবারের মতো এবারেও যাত্রা করছি প্রিয় ভ্রমণপিপাসুদের একটি দলের সাথে। এই চেনা বন্ধু, সহযাত্রীদের সাথে অপেক্ষার প্রহরও ক্ষুদ্র মনে হয়। বহু জল্পনা-কল্পনা শেষে এবার আমাদের দলের নির্ধারিত গন্তব্য তিনাপ সাইতার। সাধারণত রোয়াংছড়ি দিয়ে রনিন পাড়া হয়ে তিনাপ সাইতার গেলেও অনুমতির জটিলতায় এবার রুমা দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
রোমাঞ্চের শুরু সেখান থেকেই। বলা বাহুল্য, রুমাগামি মিনি বাস দৃশ্যপটে আসতেই আমাদের রোমাঞ্চেরও শুরু হয়ে গেল। রেইন কভারে মোড়া বস্তাগুলো বাসের ভিতরে ফেলে প্রায় সবাই উঠে এলাম বাসের ছাদে। একজন তো সামনে শুয়েই পড়লেন। পাহাড়ী উঁচুনিচু রাস্তায় বাসের ছাদে গাদাগাদি বসে গলা ছেড়ে গান গাওয়া, মাথায় সূর্যের প্রখর আশীর্বাদ- যেন সূর্যদেব ঠিক মাথার উপরেই হাত বাড়িয়ে রেখেছেন। আর একটু পরপরই আম গাছের ডাল, কাঁটা, মোটা, চিকন বিভিন্ন ধরণের ডালপালার হুঁশিয়ারির সঙ্গে সঙ্গে ছাদের সকলে হুমড়ি খেয়ে নিচু হয়ে যাওয়া। সেই সাথে পাতার আঘাত পেয়েছি বিনামূল্যে। সত্যিকার অর্থেই জীবনের অভিনব প্রাপ্তিগুলো পেতে একটু ঝুঁকি না নিলেই নয়। আঁচড় দুয়েকটা লাগবে, কিন্তু ভালো লাগা চিরকাল থাকবে।
মূল রুমা উপজেলায় ঢোকার আগেই লিডার ঘাড় ধরে ছাদ থেকে নামিয়ে বাসের ভিতর ঢোকালেন। তখনই অনুভব হলো, বাকি পথের সৌন্দর্য থেকে ভীষণ রকম বঞ্চিত হলাম। এবার সারবদ্ধভাবে আর্মি ক্যাম্প থেকে অনুমতি নেয়ার পালা। সে যেন অপেক্ষার এক বিশাল যুদ্ধ। রুমা ঘাট থেকে নাতিদীর্ঘ দূরে ঋজুক ঝর্ণা ঘুরে আসার ইচ্ছা থাকলেও তক্ষুণি অনুমতির আশায় আশায় অবশেষে যখন আমাদের পরবর্তী যাত্রা শুরু হলো তখন বেলা পড়ে এসেছে, ঘন্টা খানেকের মাঝেই সূর্য্যি মামা ছুটি নিবেন। এবার গন্তব্য আত্তাহ পাড়া। চান্দের গাড়িতে কিছুটা হতাশ মনে যখন রুমা বাজার পার হয়ে রাস্তাটা পাহাড়ি খাড়াই চড়তে শুরু করলো, বুঝলাম আজকের দিনের রোমাঞ্চের কোটা এখনও বাকি আছে!
আমাদের দেশের পাহাড়ি জনপদ কতটা দূর্গম এলাকায় বসবাস করে তা বুঝতে হলে একবার হলেও সশরীরে এসব অঞ্চল ঘুরে আসতে হবে। বুনো, জংলি গাছে ঘেরা, চড়াই-উতরাই ভরা রাস্তা, কোথাও ভালো কোথাওবা বিপজ্জনকভাবে ভাঙা কিংবা ভয়ঙ্কর কোনো বাঁকের পাশ দিয়ে সাঁই করে পার হয়ে যাওয়া- সে যেন এক ঘণ্টা খানেক দীর্ঘ রোলার কোস্টার। মাঝে মাঝে একপাশে খাড়া ঢাল নেমে গেছে অজানায়। মুক্ত আকাশে মেঘের ঘন ঘন রূপবদল, দূরে কত শত নাম না জানা পাহাড়। মুহূর্তের জন্যে হলেও কল্পনার জগতে হারিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। কেন যেন শখ জাগে মেঘগুলোকে ছুঁয়ে দেখার।
না, আমরা এখনও পাড়ায় আসিনি। নিচে জুম চাষিদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে দূরে যখন টেবিল পাহাড়ের প্রায় সমতল চূড়া চোখে পড়ল, ততক্ষণে ঘন কালো মেঘের দল আমাদের তাড়া করে ধরেই ফেলেছে প্রায়। বৃষ্টি নেমে আসতে না আসতেই হঠাৎ করে পাহাড়ের বুক ফুড়ে ঘরবাড়ি জেগে উঠে জানান দিল লোকালয়ে পৌঁছে গেছি। গাড়ি থামতেই দৌড়ে চায়ের দোকানের ঝাঁপিতে মাথা গুঁজে সবাই যখন নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত, আমরা কজন মন জুড়িয়ে নিলাম পাহাড়ি বৃষ্টিতে। ভিজতে ভিজতে একটু এগোতেই বুঝলাম- চলে এসেছি আত্তাহ পাড়া।
রাতটা চায়ের দোকানে আড্ডা, খেলা আর তারা গুনে শেষ হল। সাথে ছিল বিশেষ আমেজ হিসেবে তক্ষকের ডাক। পাহাড়ি রাত বলতে যা বোঝায়, সোলারের আলো আর অল্প একটু পানির ব্যবস্থা থাকায় হয়তো পুরোপুরি মনের আশ মেটে না। কিন্তু আমরা শহুরে প্রকৃতিপ্রেমীরা এতটুকু সুযোগ সুবিধা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথেই গ্রহণ করেছি। মোটামুটি ভালো একটা ঘুমের শেষে বেশ ফুরফুরে ভাবেই শুরু হল নতুন দিনের যাত্রা। লক্ষ্য বহুদিনের আরাধ্য তিনাপ সাইতার। ঝর্ণা প্রেমীদের কাছে সুপরিচিত একটি নাম। পাড়া পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই সামনের পথ দু’ভাগ হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। বামের রাস্তা দিয়ে কিছু দূর নামতেই হাতের বাঁয়ে টেবিল পাহাড়ের সম্পূর্ণ রেঞ্জ চোখে পড়ে। নিচে তাকালে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে দুধসাদা মেঘের পরত। এরকম মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতে শুরু হয়ে গেল মাটির ঢালু রাস্তা। এবার পথচলা তেমন সহজ নয়। তবুও উত্তেজনায় সবারই বেশ চটপট পা চলছে। অনেকটা সময় এভাবে সোজা নিচের দিকে হেঁটে আর মাঝে ছোট-খাটো কিছু ছড়া আর ঝিরি পেরিয়ে অবশেষে যখন পাহাড় থেকে নেমে দেখলাম বেশ বড়সড় পাইন্দু খাল সামনে অপেক্ষা করে আছে। সবাই যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পানির স্রোতে গা এলিয়ে সব ক্লান্তি ভাসিয়ে দিলাম। কিন্তু এখন বিশ্রামের সময় কই? আবারও সদলবলে হাঁটা শুরু, তবে এবার পাহাড় নয়, ঝিরি পথে।
সত্যিকার অর্থে পাহাড়ি রাস্তা, বিশেষ করে ঝিরি পথের সৌন্দর্য শব্দের দ্যোতনায় ধরা সম্ভব নয়। ঝিরির পানিতে রোদের ঝিকিমিকি খেলা, চোখের সামনে ঠায় দাঁড়ানো বুনো পাহাড়, যেন দৃষ্টিসীমা আড়াল করতে চাইছে। চোখ ধাঁধানো সবুজে কখনো বা মুখ তুলে চেয়ে থাকতে মন চাইবে। তবু একটু অসাবধান হলেই ঘটবে দুর্ঘটনা। পানির নিচে ডুবে থাকা পাথরে ব্যথা পাওয়া ট্র্যাকারদের জন্য নতুন কিছু নয়। ঝিরি পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পথের দূরত্ব খুব দ্রুত কমে আসছে। হঠাৎ মোড় ঘুরতে দেখি দু’পাশে দুই পাহাড়ের মাঝে বিস্তৃত পাথুরে স্ল্যাব। একপাশ দিয়ে খালের পানি সাদা ফেনা হয়ে তীব্র স্রোতে বয়ে চলেছে। পায়ের নিচের ঝিরিটা স্ল্যাবের অন্যপাশে খরস্রোতা রূপ নিয়েছে। মনে তখন একটাই প্রশ্ন, তিনাপ আর কতদূর?
গাইড জানালো পিচ্ছিল এই পাথুরে ঢাল পেরিয়ে ডানে খাড়া পাহাড়েই আমাদের পথ। মাঝে রয়েছে গভীর খাদ, লাফিয়ে পেরোলেই তবে ওপারে যাওয়া সম্ভব। অতঃপর সব বাধা অতিক্রম করে একে একে সবাই পাহাড়ে উঠে গেলাম। কিছুদূর যেতেই দেখা গেল নামার পথ এতটাই খাড়া আর পিচ্ছিল যে আমাদের দলনেতা সবার সুবিধার জন্যে দড়ি বেঁধে দিয়েছেন। দড়ি বেয়ে নেমে কিছুদূর ঢাল পেরোনোর আগেই একি শুনি! নীরবতা খান খান করা পানির তীব্র গর্জন। একটু আগেও বুঝিনি ঝর্ণার এত কাছে বসে আছি, পাহাড়ের দেয়াল তাকে সুচতুরভাবে আড়াল রেখেছে। প্রবল শক্তি নিয়ে পাথরের বুকে আছড়ে পড়া এই সুউচ্চ জলরাশির নাম তিনাপ সাইতার।
তিনাপ সাইতারের দুধসাদা ফেনিল পানি প্রকৃতির অমোঘ শক্তির প্রকাশ হয়ে সজোরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নিচে বিশাল পাথরের স্তুপে। এই বিশালতার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা দেখি আর ভাবি সৃষ্টিকর্তার কী অপার মহিমা! তিনাপের আশেপাশের গঠন সত্যিই রুক্ষ ও আদিম। কবে, কীভাবে এখানে ঝর্ণার সৃষ্টি হয়েছে কেউ জানে না। কিন্তু তিনাপের ঠিক নিচে এবং পুরো এলাকা জুড়ে বিরাট বিরাট পাথর খণ্ড দেখে মনে হয় কোনো এককালে এগুলো পাহাড়েরই অংশ ছিল। জাগতিক চাহিদায় ইচ্ছে মতন ছবি তোলার পাট চুকিয়ে এবার চোখে দেখে মন ভরানোর পালা। যত দেখি ততই মুগ্ধ হতে হয়। সংজ্ঞায়িত নিয়মে তিনাপ একটি ক্যাসকেড। ধাপে ধাপে পড়তে থাকা উঁচু জলধারা বা বড়সড় ক্যাসকেডগুলোকে আদিবাসীরা সাধারণত সাইতার বলে। সাইতার, ক্যাসকেড, জলপ্রপাত যা-ই হোক না কেন, আমরা এসব কিছুকেই ঝর্ণা বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি।
ঝর্ণার পানি প্রবল স্রোত নিয়ে সোজা সামনের দিকে ঝিরি হয়ে নেমে গেছে। দৃষ্টিনন্দন এই ঝিরির পানিতে নামা বেশ বিপজ্জনক, আগেও এখানে দূর্ঘটনা ঘটেছে। এমন ভরা বর্ষায় তাই শুধু চোখে দেখেই সাধ মিটালাম। কিন্তু তিনাপ দেখে তো আর সাধ মিটে না।তিনাপের ঠিক বরাবর সামনে অতিকায় এক পাথর, দানবীয় বললেও ভুল হবে না। সেখানে সবার একবার করে হলেও ওঠা চাই, যত পিচ্ছিলই হোক না কেন চোখের সামনে প্রমত্তার এমন রূপদর্শন কী করে হাতছাড়া করি! কিংবা তিনাপের ফেনিল জলধারার নিচে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকা, আত্মপরিশুদ্ধির সে এক মোক্ষম উপায়।
এবার ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। যে পথে আগমন সে পথেই পাড়ামুখো হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। মনের মাঝে তিনাপ জয় করার প্রশান্তি। সত্যি বলতে প্রকৃতিকে জয় করা বলে আসলে কিছুই নেই। প্রকৃতিই তার বিচিত্র রূপ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। আর আমাদের জয় করে নেয়। আমরাও অন্যরকম এক অনুভব নিয়ে বারবার ফিরে আসি, অর্জন করি জীবনে বেঁচে থাকার জন্য কিছু মুহূর্ত।
ফিরতি পথে এবার ফেলে যাওয়া পাইন্দু খালে বিশ্রামের পালা। পানি ছিটিয়ে, ছবি তুলে, শুয়ে-বসে বেশ সময় কাটছিল সবার। এমন সময় বোমা ফাটালেন দলনেতা, আজকের দিন তো এখনও শেষ হয়নি। পাড়া হয়ে অল্প কিছু দূরে দেখা মিলবে আরও এক ঝর্ণার। আমাদের আজকের দ্বিতীয় গন্তব্য। এই রুপসীর সন্ধান পাওয়া গেছে পাড়ার স্থানীয় গাইডের কাছে। তিনাপের মতো সেখানে এত লোকের যাতায়াত নেই, এখনও অন্তরালেই আছে বলা চলে। তাই পুরোপুরি রাস্তাও করা নেই। এলাকাবাসীর অনুমতিরও কিছু ব্যাপার ছিল, যার ব্যবস্থা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এ যে রীতিমত চাঞ্চল্যকর সংবাদ! এরপর আর বসে থেকে সময় নষ্ট করলাম না কেউই। পাহাড় বেয়ে পাড়ার পথ ধরলাম। মনের ভিতরে অন্য রকম জল্পনা কল্পনা। গাইডের ভাষ্যমতে পথ কিছুটা কঠিনই হবে। শহর ছেড়ে রোমাঞ্চের খোঁজে দুর্গমে ছুটে আসা আমরা কজন, আমাদের কানে এর চেয়ে মধুর শব্দ আর হয় না! নতুন কিছু পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে দ্বিগুন উদ্যমে ক্লান্ত-শ্রান্ত-ব্যাথাক্লিষ্ট শরীর নিয়ে সবাই পা বাড়ালাম পাড়ার উদ্দেশ্যে।
ফিচার ইমেজ: flickr.com
নতুন ঝর্ণার খোঁজে পরবর্তী রোমাঞ্চকর অভিযানের বিবরণ পড়ুন – আত্তাহপাই সাইতার: নতুন ঝর্ণায় অভিযাত্রীদল