দুর্গ নাম শুনলেই এক ধরনের রহস্যময় আর গা ছমছমে অনুভূতি আমাদের সবার মধ্যেই হয়। মানুষের হাতে তৈরি এসব দুর্গ কোন রূপকথা বা কল্পনার বিষয়বস্তু নয়। জাঁকজমকপূর্ণ সৌন্দর্যের নিদর্শন ও ঐতিহ্য বহন করে দুর্গগুলো। সাধারণত, এসব দুর্গ হয় শহর থেকে অনেক দূরে। নজরকাড়া সবুজের সমারোহ দুর্গগুলোকে মানুষের কাছে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়! সৌন্দর্যের অপর পিঠে থাকে রহস্যময়তা। এই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কত শত দুর্গ। তাদের ঘিরে কত কল্প-কাহিনী, কত ইতিহাস আর কত রহস্যময়তা!
ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসটি পড়েননি এমন ব্যক্তি বোধহয় খুব কমই আছে। যারা পড়েননি তাদের জন্য গল্পটির সার সংক্ষেপ এরকম: মৃত কাউন্ট ড্রাকুলা দিনের আলোতে কফিনের ভেতর নিথর হয়ে থাকতেন। সূর্য ডোবার সাথে সাথে জেগে উঠতেন তিনি। তারপর বের হতেন শিকারের খোঁজে। অবশেষে শিকার করা মানুষের গলায় তীক্ষ্ণ দুটি দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে খেতেন। এই হল গল্পটির সারকথা। এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে রোমানিয়ার ট্রান্সসিলভানিয়ার ব্রান দুর্গ এমনই এক দুর্গ যার সাথে জড়িয়ে আছে ড্রাকুলার গল্প।
ব্রান হচ্ছে ব্রাসভের একটা উপশহরের মত ছোট্ট জনপদ, যেখানে প্রবেশের পরপরই পাহাড় চূড়োয় সবুজ বন ঘেরা লাল ছাদের প্রায় ৬০০ বছরের প্রাচীন মধ্যযুগীয় সুদৃশ্য দুর্গটি চোখে পড়ে।
লোকে বলে, রোমানিয়ার কার্পাতিয়ান পর্বতমালার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিসের যেন মন খারাপ করা হু হু বাতাস বয়ে যায় মেঘ করে এলেই। সন্ধ্যে নামার সময় কার যেন চাপা, অস্পষ্ট কান্না ভেসে বেড়ায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। কেউ শোনেনি, আবার শুনেছে সবাই। কেননা ট্রানসিলভানিয়া এবং ওয়ালাশিয়ার সীমানায় এক পাহাড়ের চূড়ায় পরিত্যক্ত ব্রান প্রাসাদটিকে ঘিরে ঘুরপাক খায় নানা গল্প, উপকথা, স্থানীয় বিশ্বাস। এমন দুর্গ মধ্য ইউরোপে বিরল কিছু নয়, কিন্তু সেই যে পরিবেশের প্রভাব, একে তো দুর্গম ট্রানসিলভানিয়া তার উপর আবার খোদ ড্রাকুলার আস্তানা বলে কথা, দেখামাত্রই মনে হল জানালা দিয়ে কেউ উড়ে বের হল কিনা ডানা ঝাপটে! বেশ লম্বা লাইন সেই সাত সকালেই দুর্গের সামনে।
এর দুর্গটি ড্রাকুলার দুর্গ হয়ে উঠার পিছনে রয়েছে এক ইতিহাস। ১৪৪৮ সালে ওয়ালিসিয়ার যুবরাজ হিসেবে জন্ম নেন তৃতীয় ভ্লাদ টেপাস। কথিত আছে, তিনি এক অত্যাচারী শাসক ছিলেন। তবে রোমানিয়া বা পূর্ব-ইউরোপের চেয়ে বরং পাশ্চাত্যই ভ্লাদকে এক অতিমাত্রায় নিষ্ঠুর, রক্তপিপাসু শাসক হিসেবে চেনে। বলা হয়ে থাকে অটোম্যান সম্রাট দ্বিতীয় মেহমুদ ভ্লাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় ভ্লাদের রাজধানীর কাছে এক অঞ্চলে শূলে চরানো ২০,০০০ মৃতদেহ দেখেন, আর এই নিষ্ঠুরতা চাক্ষুষ করেই তিনি অসুস্থ বোধ করেছিলেন।
কিন্তু রোমানিয়ায় ভ্লাদ টেপাসকে একজন দেশপ্রেমী রাজা হিসেবেই দেখা হয়। তুর্কি হানাদার এবং অন্যদের থেকে মাতৃভূমি রক্ষা করতেই যে সারা জীবন যুদ্ধ করে গেছে। তবে তার মৃত্যুর কারণ এখনও রহস্যে ঘেরা। তার কবরটি যেখানে পাওয়া যায় সেখানে কোন মৃতদেহ ছিল না। হয়ত সে থেকেই অমর ভ্লাদের গল্প ডানা মেলা শুরু করে।
কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নেই যে এখানে ড্রাকুলাদের আবাস ছিল। আর ড্রাকুলার খ্যাতিমান স্রষ্ট্রা ব্রাম স্টোকার কিন্তু জানতেনও না সেখানের পাহাড়ে ড্রাকুলারা কোনদিন থেকেছে কিনা। তবে কীভাবে যেন জনশ্রুতি রটে গেছে। সেই বিশ্বাসের জন্যই লোকে দূরদূরান্ত থেকে ঘুরতে যায় সেখানে। তাদের নাকি একটা হাড় হিম করা অনুভূতিও হয়। হয়তো এর পিছনে এই গুজবও দায়ী।
তবে ব্রান প্রাসাদ তৈরির পিছনে এক ইতিহাস রয়েছে যা বেশ ঘটনাবহুল। ৫৭টি রুম এবং ১৬টি বেডরুম, সাথে ইউনিক এন্টিক ফার্নিচার দিয়ে সাজানো এই দুর্গ। ১২১২ সালে টিউটোনিক নাইটরা এটি তৈরি করেছিল। কিন্তু ১২৪৮ সালে মোঙ্গল দস্যুরা এটি প্রায় ধ্বংস করে দেয়। চতুর্দশ শতকে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের সময়ে এটি রোমানিয়ার মানুষদের কাছে নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। মাঝখানের সময়টাও অনেক হাতবদল হয়েছে এর মালিকানা।
তবে ১৯২০ সালে ট্রানসিলভানিয়া বৃহত্তর রোমানিয়ার অঙ্গ হয়ে যায়। সে সময় শহরের মেয়র প্রস্তাব করেন এটি রোমানিয়ার রাজপ্রাসাদ হওয়া উচিত। তখন রাণী মেরির নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশ জুড়ে। প্রথা মেনে এটি হস্তান্তর করা হয় রাজপরিবারের কাছে। আর তখন থেকে রাজপরিবারের সদস্যরা থাকতে শুরু করেন এখানে। রাণী মেরির খুব পছন্দের জায়গা ছিল এটি।
এরপর শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। রানী মেরির ছিল এক সুন্দর রূপবতী মেয়ে। নাম তার ইলিয়ানা। রাজকুমারী ইলিয়ানা তখন বড় হচ্ছেন। রাজকুমারী মানেই যে অহংকারী, তা কিন্তু সব সময় সঠিক নয়। এই রাজপ্রাসাদে তিনি আর্ত, অসুস্থ, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মানুষের সেবার জন্য হাসপাতাল খুলেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে রাজপরিবারকে সরিয়ে কমিউনিস্টরা প্রাসাদটি দখল করে নেয়।
বর্তমানে এই প্রাসাদকে ঘিরে একটি জাদুঘর আছে। এখানে শুধুমাত্র কুইন মেরির সংগ্রহ করা রাজকীয় আসবাবপত্র এবং রোমানীয় শিল্পকে তুলে ধরা হয়েছে। যে কেউ চাইলে সম্মানির বিনিময়ে তা দেখতে পারেন।
এখানেই শেষ নয়। রাণী মেরির মৃত্যুর পর শুরু হয় আরেক রহস্যময় কাহিনী। ব্রান প্রাসাদকে ঘিরে রোমাঞ্চ ছড়ানোর কারণও আছে। পাহাড়ের নীচে উপত্যকায় ছোট্ট একটি চ্যাপেল বা গ্রোটো রয়েছে। এখানে আছে ভারি অদ্ভুত এক জিনিস। রাণী মেরি মারা যাওয়ার সময় বলে যান, তার হৃদপিণ্ডটি যেন একটি সোনার কাসকেটে ভরে কৃষ্ণ সাগরের তীরে ব্যালচিক প্রাসাদের চ্যাপেলে রাখা হয়।
পরে ১৯৪০ সাল নাগাদ রাণীর প্রিয় ব্রান ক্যাসেলের এই গ্রোটোতে আনা হয় মেরির হৃদপিণ্ড। সেখানেই এই কাসকেটটি রোমানিয়ার জাতীয় পতাকায় মুড়ে একটি শ্বেতপাথরের সারকোফেগাসে রাখা আছে।
রোমাঞ্চকরই বটে, তাই না?
রোমানিয়ার সরকার বর্তমানে এই প্রাসাদটিকে জাদুঘর হিসেবে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যদি ড্রাকুলার সত্যিকারের কোন নিদর্শন দেখার জন্য যেতে ইচ্ছুক হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি হতাশ হতে পারেন। তবুও প্রতি বছর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ পর্যটক এই দুর্গের আধো অন্ধকার অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানোর গা শিউরে ওঠা অভিজ্ঞতা নিতে যান৷ দুর্গের উপর থেকে দেখবেন সেই উঠান, যেখানে নাকি ঘুরে বেড়াত কাউন্টের অনুগত নেকড়ের পাল৷ আর ব্রান ক্যাসেলের ব্যালকনি থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাবেন চারপাশের প্রকৃতি।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ট্রানসিলভানিয়ার অধিকাংশ হোটেলেই শুকনো রসুনের মালা রাখা হয়, বিশেষ করে ভিনদেশী শিশুদের জন্য, যাতে তারা রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারদের ভয় থেকে সামান্য হলেও মুক্ত থাকতে পারে। বলা হয়ে থাকে, রসুন, ক্রুশ এবং ধুনই পারে ঐ আঁধারের জীবদের দূরে রাখতে। ক্রুশ দেখেই উপরের জানালার দিকে তাকিয়ে আপনি পরখ করে নিতে পারেন কেউ আপনাকে অনুসরণ করছে কিনা। অজানা রোমাঞ্চকর মুহূর্তের আমেজ নিতে কে না চায় বলুন?