ভ্রমণ সর্বদাই আনন্দদায়ক। ভ্রমণ শুধু আনন্দই দেয় না, বরং এর মাধ্যমে চারপাশের জগৎ সম্পর্কে নানা তথ্যও জানা যায়। মানবমন একইসাথে আনন্দ ও জ্ঞানপিপাসু। ভ্রমণ মানুষের মনকে আনন্দিত করে। পাশাপাশি জ্ঞানের পরিধিও বৃদ্ধি করে। জ্ঞানার্জন শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ রাখা উচিৎ নয়। তাই শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝেই দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা দর্শনীয় স্থান, ঐতিহাসিক স্থান, সবুজ বনানী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি ভ্রমণ করতে যাওয়া উচিৎ।
ভ্রমণ কি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই জরুরি? শরীর ও মনকে প্রফুল্ল করতে, কর্মময় জীবনে একঘেয়েমী কাটাতে প্রতিটি ব্যক্তিরই মাঝে মাঝেই ভ্রমণে বের হওয়া উচিত। বাস্তব কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর যিনি ভ্রমণে যেতে পছন্দ করেন না। যা-ই হোক, আজকে এমন এক দর্শনীয় স্থানের কথা বলবো, যেখানে ভ্রমণপিয়াসী মন খুঁজে পাবে আনন্দ আর ইতিহাসপ্রেমীরা পেয়ে যাবে নানা ইতিহাস-ঐতিহ্যের খোঁজ। কথা না বাড়িয়ে চলুন জানা যাক সেই দর্শনীয় স্থানটির কথা। স্থানটি হচ্ছে টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলায় অবস্থিত ‘ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি’।
ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর অমর কৃর্তি। এই নামটির সাথে আমাদের সকলেরই পরিচয় কম-বেশি থাকার কথা। কারণ এই ব্যক্তি ছিলেন নাথান কমিটির একজন সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রস্তাবক এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী। ভারতীয় উপমহাদেশে নওয়াব আলী নানাবিধ অবদান রেখে গেছেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছে তিনি খান বাহাদুর, নওয়াব, সি.আই.ই এবং নওয়াব বাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ লর্ড রোনাল্ডসকে আমন্ত্রণ করার জন্য জমিদার বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। ব্রিটিশ লর্ড সে সময় স্টিমার দিয়ে বৈরান নদীর কয়ড়া ঘাটে আসেন। জানা যায়, সে সময় ব্রিটিশ লর্ডকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ৩০টি হাতির বহর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এদেশের পরিবেশ-প্রকৃতিতে এককালে যে প্রচুর সংখ্যক বন্যপ্রাণী ছিল এই ঘটনা সেই স্বাক্ষ্যও দিচ্ছে।
ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি কে নবাব প্যালেস বলা হয়। মূলত এর নাম নবাব বাড়ি বা নবাব প্যালেসই ছিল। কিন্তু বাড়িটি জমিদারের হওয়ায় স্থানীয়রা একে ‘জমিদার বাড়ি’ বলেই ডাকতেন। অতঃপর তা স্থানীয়দের কাছে জমিদার বাড়ি বলেই অধিকতর পরিচিতি লাভ করে। তাই ধনবাড়ীর যে কাউকে জমিদার বাড়ি বললেই দেখিয়ে দিবে বাড়িটিতে যাওয়ার পথ। কিন্তু ধনবাড়ী জমিদার বাড়িতে ঘুরতে গেলে অনেকেই নাম নিয়ে দ্বিধায় ভুগতে পারেন। কারণ বাড়িটির কোথাও ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি কথাটি লেখা দেখা যায় না। তার পরিবর্তে প্রবেশ পথেই দেখা মিলবে ‘নওয়াব আলী হাসান আলী রয়েল রিসোর্ট’। টিকেটের উপরও লেখা দেখবেন ‘রয়েল রিসোর্ট’।
দ্বিধা দূর করার জন্য নওয়াবের বংশ পরম্পরাদের নিয়ে আমাদের একটু জানতে হবে। নওয়াব আলী চৌধুরীর স্ত্রী ছিল তিন জন। বগুড়ার মেয়ে আলতাফুননাহারকে প্রথম বিয়ে করেছিলেন। আলতাফুননাহার ছিলেন নবাব আবদুস সোবহানের মেয়ে। আবদুস সোবহান ছিলেন বগুড়ার জমিদার। জমিদার নওয়াব আলীর সাথে ঈশা খাঁর বংশেরও কিছু সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। তিনি ঈশা খাঁর শেষ বংশধর সাইয়েদা আখতার খাতুনকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। নওয়াব আলীর তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন সৈয়দা সাকিনা খাতুন চৌধুরানী। সাকিনা খাতুনের বংশপরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে ১৮৬৩ সালে জন্মগ্রহণকারী নওয়াব আলী ১৯২৯ সালে মৃত্যুবরণ করার সময় তৃতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত একমাত্র ছেলে সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী এবং মেয়ে উম্মে ফাতেমা হুমায়রা খাতুনের নাম ওয়াকফ নামায় লিখে যান। এই সৈয়দ হাসান আলীর নামেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নওয়াব আলী হাসান আলী রয়েল রিসোর্ট’। বর্তমানে রিসোর্টটির মালিকানা রয়েছে হাসান আলীর একমাত্র কন্যা সৈয়দা আশিকা আকবরের নামে। যে কারণে এই জমিদার বাড়ির স্মৃতিচিহ্নগুলো আজও টিকে আছে সুন্দরভাবে। আর রিসোর্টটি দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করছে লাইট হাউস নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
টিকেট কিনে প্রবেশপথ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করামাত্রই চোখে পড়বে নয়নাভিরাম সবুজে-শোভিত বাগান। এই বাগান পুরো জমিদার বাড়িতেই চোখে পড়বে। অতঃপর বরাবর উত্তরদিকে হাঁটতে থাকলে হাতের বাম দিকে দেখা মিলবে অফিস ভবন। এই ভবনের বারান্দা পর্যন্ত প্রবেশ করার অনুমতি আছে। সেখানে প্রবেশ করার পর জমিদারদের ব্যবহৃত কিছু চেয়ার ছুঁয়ে দেখা যায়, চেয়ারে বসে ছবিও তোলা যায়। দেয়ালে দেখা মিলবে নওয়াবের স্মৃতি ও ইতিহাস ধারণ করা বেশ কিছু পুরনো সাদা-কালো ছবির। বারান্দায় প্রবেশ করা গেলেও এই ভবনের কোনো কক্ষে প্রবেশ করার অনুমতি নেই। সবগুলো কক্ষই তালাবদ্ধ করে রাখা আছে। তাছাড়াও ছাদে ওঠার সিঁড়িটি তালাবদ্ধ থাকায় ছাদেও ওঠা যায় না।
অফিস ভবন থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে একটা প্রাচীর ঘেরা দেখা যাবে। প্রচীরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে দেখা মিলবে নবাব মঞ্জিল বা নবাব প্যালেসের। নবাব মঞ্জিলের প্রাসাদটি চার গম্বুজবিশিষ্ট ও দক্ষিণমুখী। দরজা ঠিক মাঝ বরাবর নয়। ভবনের কার্নিশে রয়েছে নানা ধরনের লতাপাতার নকশা। এই ভবনে রয়েছে চারটি বৃহৎ কক্ষ ও কিছু ক্ষুদ্রাকার কক্ষ। এসব কক্ষেও প্রবেশ করার অনুমতি নেই বললেই চলে। ভবনটি থেকে একেবারে পূর্বদিকে দেখা মিলবে শতাধিক বছরের পুরনো ৩০ বিঘা পরিমাণ বিশাল দিঘী। দিঘীর পাড়ে রয়েছে ছায়ায় ঘেরা গাছপালার সমারোহ। দিঘীতে শীতকালে নানা ধরনের পাখি আসে। ফলে শীতকালে ভ্রমণে বাড়তি কিছু আনন্দ যোগ হয়ে থাকে। তবে ময়লা-আবর্জনা ও কচুরিপানায় ভরপুর দিঘীটি ঐতিহ্য হারানোর পথে রয়েছে।
পুকুরে যাওয়ার আগে ভবনটির পূর্বদিকে লাগানো তোরণ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে দেখা মিলবে দুটি আবাসিক ভবন, ফুলের বাগান, চিড়িয়াখানা, বৈঠকখানা, গোমস্তা, নায়েব, পাইকপেয়াদার বসতি ঘর, কাচারিঘর এবং দাস-দাসীদের চত্বর। চিড়িয়াখানা থাকলেও সেখানে কয়েকটি পাখি ছাড়া কিছুই দেখা মেলে না। তোরণটি ব্রিটিশ লর্ডদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
পুরো জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখার পর, বের হয়ে আসলে সামনেই দেখা মিলবে নওয়াব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘ধনবাড়ী নওয়াব ইনস্টিটিউশন’। শিক্ষা বিস্তারে অসামান্য অবদানের সাক্ষী হিসেবে আজও সুনামের সাথে চলছে ইনস্টিটিউশনটি। এটি দেখার পর একটু সামনে অগ্রসর হলেই দেখা মিলবে ধনবাড়ী নওয়াব শাহী জামে মসজিদ। একে নবাব বাড়ি মসজিদও বলা হয়।
ধনবাড়ী শাহী মসজিদটি ৭০০ বছরের পুরনো। মসজিদটি মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি করা ছিল। তবে একাধিকবার সংস্কার করে মসজিদটির বর্তমান অবয়ব নিয়ে আসা হয়েছে। সংস্কার করার ফলে এর প্রাচীনত্ব অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে পূর্বের চেয়ে অনেক মনোরম হয়েছে। শুরুতে মসজিদটি আয়তাকার থাকলেও বর্তমানে এটি বর্গাকার হয়েছে। পূর্বে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ছিল ১৫ ফুট। এই মসজিদের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। তার মৃত্যুর পর থেকে অর্থাৎ ৮৯ বছর ধরে এক মিনিটের জন্যও কোরআন তেলাওয়াত বন্ধ হয়নি সেখানে। মসজিদ পরিচালনাকারীদের নিয়োজিত ক্বারীরা পর্যাক্রমে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। মসজিদটির পশ্চিম পাশে ঘেরা রয়েছে নবাবদের পারিবারিক কবরস্থান। আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে আফতাবুন্নেছা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা।
ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি বা রিসোর্ট ও নওয়াব শাহী জামে মসজিদ দেখার জন্য প্রতি বছর অসংখ্য দর্শনার্থীর সমাগম হয়। এছাড়াও জমিদার বাড়িতে মাঝে মাঝে নাটক, সিনেমা, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানেরও শুটিং হয়ে থাকে। গারো নৃত্য, লাঠি খেলা ইত্যাদির আয়োজন করা হয় সেখানে। জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ৫০ টাকা। এই ৫০ টাকায় রিসোর্টের ভিতর মাত্র দু’ঘন্টা ঘোরার সুযোগ মিলবে। সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে।
ধনবাড়ী জমিদার বাড়িটি ঢাকা-জামালপুর মহাসড়কের ধনবাড়ী বাসস্যান্ডের কাছেই অবস্থিত। ধনবাড়ী বাসস্যান্ড থেকে হেঁটে যেতে মাত্র ৩-৪ মিনিট সময় লাগবে। ঢাকা থেকে মাত্র ১২০-১৫০ টাকা ভাড়ায় বাসযোগে আসা যাবে ধনবাড়ী বাসস্যান্ডে। ধনবাড়ী জমিদার বাড়িটি বর্তমানে নওয়াব আলী হাসান আলী রয়েল রিসোর্ট হিসেবেও বহুল পরিচিত হচ্ছে। রিসোর্টের ভিতর বর্তমানে দর্শনার্থীদের রাত্রি যাপনেরও সুযোগ রয়েছে। সুতরাং দূর-দূরান্ত থেকে ঘুরতে আসলে থাকতেও পারবেন রিসোর্টের ভিতর। কিন্তু ভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি লাগবে। তাই ধনবাড়ী কিংবা পার্শ্ববর্তী উপজেলা মধুপুরের আবাসিক হোটেলেও তুলনামূলক কম খরচে নিরাপদে থাকতে পারবেন। সুতরাং এই ঈদেই না হয় পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবরা মিলে নবাবদের স্মৃতিচিহ্নের মাঝে হারিয়ে যেতে ঘুরে আসতে পারেন ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি বা নওয়াব আলী হাসান আলী রয়েল রিসোর্ট থেকে।
ফিচার ইমেজ – © লেখক