মহাকাব্যিক ফ্লোরেন্সে কিছু সময়

হোটেল রুমের আরামের বিছানাটা বরাবরই আকর্ষণ করে আমাকে। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। রয়েছি কেস্তেলো দেল নেরোতে। ফ্লোরেন্স, ইতালি। সকাল থেকেই শীত শীত করছে। এই শীতেও যেন আনন্দ রয়েছে। শান্তির শহরে শান্ত শীত! কাল রাতেই মিলানের মালপেন্সা এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লোরেন্সে এসে পৌঁছেছি। খুব ইচ্ছে ছিল ফিরেঞ্জ সান্তা মারিয়া নোভেলা স্ট্যাশনটা দেখব। ট্রেনে করে আসলেই দেখতে পেতাম। কিন্তু হঠাৎ শরীরটা অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই তথাকথিত লুফথান্সা এয়ারলাইন্সের বিমানেই ভ্রমণ করতে হলো।

বিছানা থেকে উঠেই নাস্তা দেখে মনটা প্রসন্ন হয়ে গেল। খুব ক্ষুধা পেয়েছিল। ক্যাভিয়ার, অমলেট আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। এরা ক্যাভিয়ারটা খুব ভালো বানায়। আজকে সারাদিন বাইরে কাটাতে হবে। মানিব্যাগে কিছু ইতালিয়ান লিরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ফ্লোরেন্সে এসে ট্যাক্সিতে চড়াটা খুবই উদ্ভট দেখায়। এখানে প্রায় সবাই হেঁটে চলাচল করে। তবে আমার মতো কিছু অলস প্রকৃতির লোকের জন্য রয়েছে মনোমুগ্ধকর ঘোড়ার গাড়ি। গাড়ির কোচম্যান, ঘোড়া সওয়ার এসব শুধু সিন্ড্রেলার গল্পে পড়েছি ছোটো থাকতে। কিন্তু এখানে যেন স্বপ্নগুলোই বাস্তবতা হয়ে ধরা দেয়। এগুলোকে আগে ওয়াগন বলা হতো। এখনো এখানকার অনেক কোচম্যান তাই বলে। ফ্লোরেন্সের রাস্তায় দুলে দুলে যাচ্ছি। চারদিকে তাকালেই মনে হচ্ছে এটা দান্তে, মাচিয়েভেল্লি, নিকোলাঞ্জোর শহর। এটা সেই শহর যেখানে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি ছবি আঁকা শিখেছিলেন।

florence 1

Source: discovertuscany.com

রোমের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত এই ফ্লোরেন্স হচ্ছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনার কেন্দ্রস্থল। চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে একাগ্রচিত্তে এর মোহনীয়তা উপভোগ করলে সত্যি মনে হয় যেন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গিয়েছি।

ফ্লোরেন্সের স্থাপনার কথা ভাবলে ফিরে যেতে হয় ৬৫১ খৃষ্টপূর্বে, যখন জুলিয়াস সিজার তার সেনাদল নিয়ে ফ্লোরেন্সের আরনো নদীর তীরে ক্যাম্প করেছিলেন। তার সময়ের সেই স্থাপনাগুলো এখন রোমান যুগের অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা, যা এখন ব্যবহৃত হয় ইতালির বিখ্যাত লেদারের জুতো এবং ব্যাগের অন্যতম বিপণীকেন্দ্র হিসেবে। ক্যারেজ থামিয়ে সেই চেন্তোস্তোরিগো থেকে এক জুড়ো জুতো কিনলাম আমি। এখানে আসার আরেকটি কারণ হচ্ছে এই জায়গার হাতের বাম দিকে অবস্থিত একটা প্রাণীর ভাস্কর্য। এই প্রাণী দেখতে অনেকটা সিংহের মতো। অনেকটা শেয়াল আবার কিছুটা চিতার মতোই। মনে করা হয় এর মুখে কয়েন দিলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। আমি এসবে বিশ্বাস না করলেও মূর্তিটা দেখার ইচ্ছে ছিল।

জুলিয়াস সিজারের সেই রোমানিয়ান মধ্যস্থতার প্রায় ১৪০০ বছর পর অনেক পাদ্রি ও ধণী বণিকগোষ্ঠী এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। ফ্লোরেন্সের আকর্ষণীয় সব দালানের দেয়ালে সেসব চিত্র আর খোদাই করা ফলকে সেই ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে নিপূণভাবে। এত ভাস্কর্য একসাথে আমি আগে কখনোই দেখিনি। সেই আমলের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, প্রকৌশলীদের হাতেই তৈরি ইউরোপের সর্বাধিক সংস্কৃতিমণ্ডিত এই নগরী। হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে অনেক কিছুই নজরে পড়লো। টং দিয়ে যেতে যেতে বায়ে তাকাতেই মুগ্ধ হয়ে দেখলাম বাজিলিকা দি সানলোরাইন্সো। প্রাচীন রেনেসাঁস যুগের নিদর্শন।

bassilica

Source: Wikimedia Commons

ছাদের দিকটায় বেশ কিছু গম্বুজ। অনেকটা আমাদের বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের মতো। গায়ের রং এখন বাদামি হয়ে গিয়েছে। হয়ত এই রংই স্থাপনার ইতিহাসকে আরো ফলাও করে তুলছে দর্শকের নজরে। আকাশে সূর্য তাপ দিচ্ছে। কিন্তু চারদিকে ছড়িয়ে পড়া কমলা রংয়ের আভায় দুপুরের আভাস দিল। সত্যি বলতে ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে পরায় যেন ক্ষুধার মাত্রাটা আরো বেড়ে গেল। কোচম্যানকে বললাম ভালো দেখে একটা রেঁস্তোরায় যেতে।

লা সুসিনা ডেল গারগা। ৩৩ নম্বার জানোবি সড়কের এক ধার জুড়ে থাকা দারুণ এক রেঁস্তোরা। ভেতরে বসেছি। আরামদায়ক একটা অনুভূতি। চার দেয়ালে লাল রংকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বলা হয় লাল রং ক্ষুধা জাগিয়ে তুলতে খুব কার্যকর আর তাই প্রায় হোটেলেই লাল রং ব্যবহার করা হয়। রাজকীয় টেবিলের উপর মোমগুলো রূপোর মোমদানিতে রাখা। অনেক টুরিস্টই এখানে এসেছে খেতে। বেশিরভাগই মারঘেরিতা নামক পিজ্জা খাচ্ছেন। এখানে এর খুব নাম। কাল রাতে ডিনারে খেয়েছিলাম।

লা সুসিনা ডেল গারগা; Source: yelp.com

ওয়েটার আসলে অর্ডার দিলাম স্পাঘেতি আল্লে ভংগলি আর মিষ্টান্ন হিসেবে অবশ্যই তিরামিসু। খুব অদ্ভুত নাম খাদ্যের। কিন্তু তার চেয়েও অদ্ভুত এর স্বাদ। ভংগলি হচ্ছে এক প্রকার পাস্তা। দেখতে অন্যান্য পাস্তার মতো হলেও শামুকের মাংস আর হোয়াইট ওয়াইনের মিশ্রণ এর পরিচিতিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। তিরামিসু মিষ্টান্ন হিসেবে দারুণ বটে। কোকো পাউডার, কফি, ফিংগার বিস্কুট এরকম আরো নানা উপাদান দিয়ে বানানো হয়। এর আবার ইতিহাসও রয়েছে। আমাকে যিনি লাঞ্চ সার্ভ করছিলেন উনার কাছে জানলাম, ১৯৬০ সালের দিকে নাকি একজন রাঁধুনি এর উদ্ভাবন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন! খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে দেখি কোচম্যানকে যেভাবে ক্যারিজে রেখে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনই আছেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমার দেশের মানুষ ব্যতীত আর কোনো দেশের মানুষই আরামকে দু’চোখে দেখতে পারেন না। ঘোড়া যখন শ্বাস টেনে যাত্রা শুরু করল। চারদিকে সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

বিকেলের এই সময়টা খুব ভালো লাগে আমার। চারদিকের অসংখ্য ভাস্কর্য, প্রাচীন স্থাপনা, লণ্ঠনের মতো ল্যাম্পপোস্ট আর অদ্ভুত এক রাশ আবেগী অনুভূতি নিয়ে ফ্লোরেন্সের সড়কে এগিয়ে চলছি আমি। গন্তব্য চার্চ সান্তা মারিয়া নোভেলা। আমার মতো যারা দুনিয়া ভ্রমণের অভিযানকে আগলে ধরেই বেঁচে আছে তাদের কাছে এই চার্চ এক অদ্ভুত নিদর্শন। এমন কোনো পর্যটকের সাথে আজ অবধি আমার দেখা হয়নি যিনি ফ্লোরেন্স ভ্রমণের পর বলেননি সান্তা মারিয়া নোভেলা তার দেখা জীবনের শ্রেষ্ঠ চার্চ।

santa

Source: Wikimedia Commons

সত্যি বলতে কী, প্রায় আধো অন্ধকার সন্ধ্যের মাথায় টং যখন চার্চের সামনে থামল আমিও এর প্রশংসা না করে পারলাম নাহ। ভেনিসে মেডোনা দেল অরতো দেখার পর ভেবেছিলাম এটাই বোধহয় সবচেয়ে সুন্দর। কিন্তু আমাদের পৃথিবী যে সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি তা ভ্রমণেই একমাত্র বোঝা যায়। সুউচ্চ প্রান্তরে অপরূপ অপরূপ রেনেসাঁস যুগের শিল্পকর্ম। ১০ লিরা দান করে ভেতরে ঢুকলাম। পুরো স্থাপনা জুড়ে অসাধারণ সব শিল্পকলা। চোখ ধাঁধানো সব চিত্র। সেখানে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে গড জেসাসের কাহিনী। রয়েছে মাতার কোলে তার চিত্র। তখনকার রাজদরবার ইত্যাদি অনেক কিছু। সামনের বিশাল মঞ্চে যীশুর মূর্তি। মোমবাতিগুলো পরিবেশের মোহনীয়তাকে বরাবরই মুগ্ধ করছে। চার্চ থেকে বেরিয়ে গেলাটো খেতে খেতে চললাম।

রাস্তায় পড়লো গিয়েত্তো কোম্পানিলা। ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে উঁচু বেল টাওয়ার। খুব ইচ্ছে ছিল টাওয়ারে চড়ে পুরো শহর দেখার কিন্তু আফসোস সকালে ফ্লাইট। যা দেখার এখনই দেখতে হবে।

কোচম্যান প্যালাটাইন গ্যালারি, বাবোলি গার্ডেন, বারডিনি গার্ডেন এর কথা বললেন। লোভ জাগানো জায়গাই বটে। কিন্তু কী করি। সময় জিনিসটার বড়ই অভাব। রাতে আরনো নদীর তীরে জেগে ওঠা প্রাচীন এই নগরী যেন তার পূর্ণ সৌন্দর্য নিয়ে জেগে উঠেছে। আরটিজিয়ান আর্ট গ্যালারি দেখে হোটেলে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। কোচম্যানকে হাজার লিরা দিয়ে উঠে এলাম রুমে। সারাদিন আশ্চর্য প্রশান্তিময় এক ক্লান্তি গিয়েছে। গোসল সেরে শরীর এলিয়ে দেওয়ার আগে ফাগিওলি পাস্তা আর মাইন্সট্রোনের সুস্বাদু সুগন্ধ ঘুম কেড়ে নিল। ডিনার শেষে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম আকাশের দিকে।

ফাগিওলি পাস্তা; Source: Creme de la Crumb

সূর্য এখনো পরিষ্কার করে ফোটেনি। অসংখ্য ইতিহাস বয়ে বেড়ানো পালাজ্জো স্ট্রোজি জাদুঘরটাকেও খুব নিঃসঙ্ঘ লাগছিল। এসে পড়লাম। আরনো নদীর তীরে। খুব সুন্দর জায়গাটা। নির্মল বাতাস। ঢেউয়ের গর্জন। কি আজব ব্যাপার না! রেনেসাঁস যুগ। বারবারিয়ান, গ্ল্যাডিয়েটরদের কাহিনী যে শহরে ছিল, সেই শহরই আজ এত সুন্দর এত প্রশান্তিময়। দান্তের কবিতা, জুলিয়াস সিজারের বীরত্ব এসবই এখন ইতিহাস। শুধু রয়ে গিয়েছে স্থাপনা, ভাস্কর্য আর চিত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক নির্জীব বাস্তবতা। যে দেশে মানুষ খুন ছিল এক খেলা। সে দেশকেই মানুষ এখন করেছে অবসর যাপনের এক অনন্য স্থান। সত্যি স্রষ্টার লীলা অসীম। সূর্যের আলোর রেখা ফুটে উঠছে। ফ্লোরেন্সে আজ শেষ দিন….

কিছুক্ষণের মাঝেই শহর জেগে উঠবে কিন্তু থাকব না আমি আর এই শহরের মাঝে। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা খুব মনে পড়ল,

গিয়াছে সেদিন যেদিন হৃদয় রূপেরই মোহনে আছিল মাতি,
প্রাণের স্বপন আছিল যখন— ‘প্রেম’ ‘প্রেম’ শুধু দিবস-রাতি।
শান্তিময়ী আশা ফুটেছে এখন হৃদয়-আকাশপটে,
জীবন আমার কোমল বিভায় বিমল হয়েছে বটে,
বালককালের প্রেমের স্বপন মধুর যেমন উজল যেমন
তেমন কিছুই আসিবে না—
তেমন কিছুই আসিবে না॥

 

The following article is basically a travelogue, about days passed in Florence, Italy.

Featured image: Lonely planet

Related Articles

Exit mobile version