যেকোনো বস্তু, মানুষ বা জায়গার ক্ষেত্রে প্রথম আকর্ষণ তৈরির ক্ষেত্রে নাম বেশ বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এই জায়গার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম না। নামটাই প্রথমে আগ্রহ তৈরি করে মনে, আসলে জায়গাটা কেমন? জঙ্গলের দেখা পাবো আসলেই? আর গরম আবহাওয়ায় “জল” শুনলেই যে কারো ছুটে যেতে ইচ্ছে হবে। কিন্তু নামের মতোই কি কাব্যিক জায়গাটা? এই কৌতূহল থেকেই বেড়িয়ে আসা জল জঙ্গলের কাব্য থেকে।
ঢাকার বাসিন্দারা একদিনের ছুটি কাজে লাগানোর জন্য প্রায়ই ঘুরে আসেন গাজীপুরের বিভিন্ন রিসোর্ট থেকে। তবে সেসব রিসোর্টে প্রতিদিনে প্রতিজনের জন্য একটু ভালো পরিমাণ টাকাই খরচ করতে হয়। কারণ রিসোর্টগুলোতে থাকে সুইমিং পুল, এসি সুবিধাসহ কটেজ বা রুম, যাতে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোর ক্লান্তি ভুলতে পারে মানুষ। তবে সাধারণ ‘রিসোর্ট’ এর ধারণা থেকে বেশ ভিন্ন জল ও জঙ্গলের কাব্য, যে কারণে খরচটাও বেশ আয়ত্ত্বের মধ্যেই। সবকিছু মিলিয়েই একদিনের ছোট একটা ঘুরোঘুরির জায়গা হিসেবে তাই একেই বাছাই করা হল।
জল ও জঙ্গলের কাব্যে হুট করে রওনা দিয়ে চলে গেলেই কিন্তু হবে না। প্রথমে একটু ফোন করে খোঁজ নিতে হবে যে সময়ে যেতে চাচ্ছেন সে সময়ে খালি আছে কিনা। যদি খালি থাকে তাহলে ২০% অগ্রীম টাকা বিকাশ করে পাঠিয়ে বুকিং দিতে হবে। মাথাপিছু পনেরশো টাকা একদিনের জন্য, যার মধ্যে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার আর আনলিমিটেড চা-কফি থাকবে। আর রাতে থাকতে চাইলে তিন হাজার টাকা মাথাপিছু। যেহেতু রাতে থাকার পরিকল্পনা ছিল না, তাই সে ব্যাপারে আর বেশি কিছু জানা হয়নি।
যাওয়ার উপায় খুব জটিল না। মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে পূবাইলের বাসে উঠে যাওয়া। জ্যাম না থাকলে এক থেকে দের ঘন্টা পর বাস পূবাইল রেলগেটের কাছে নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে অটো নিয়ে একদম গেটের সামনে। আর নিজের গাড়ি থাকলে তো কথাই নেই।
অন্যান্য রিসোর্টের মতো খুব পরিপাটি, ঝা-চকচকে না হলেও ঢুকতেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। কারণ এখানে সবকিছুই খুব প্রাকৃতিক। কৃত্রিম উপায়ে বানানো গ্রাম গ্রাম পরিবেশ না, আসলেই যেন ছোট্ট এক টুকরো গ্রাম। অনেক গাছপালার শান্ত ছায়া, শীতল বাতাস। সুইমিং পুল নেই, আছে বড়সড় এক পুকুর। আপনি যদি সবুজ ভালোবাসেন, এই জায়গা আপনার ভালো না লেগেই পারে না।
ঢুকতেই লেবুর শরবত দিয়ে স্বাগত জানানো হল, যাতে ভ্রমণের ক্লান্তি অনেকটাই কমে গেল শুরুতে। এরপর নিয়ে যাওয়া হল আমাদের জন্য নির্ধারিত কটেজে। কটেজটা মূলত কুঁড়েঘরের মতো, বাঁশের বেড়া দিয়ে বানানো। চারিদিক খোলা, শুয়ে বা বসে প্রকৃতি দেখা যায়।
সবারই খুব পছন্দ হলো, কেননা আশেপাশে অদ্ভুত এক শান্তি ছিল। সামনে বিশাল বড় এক বিল, অনেকটা জায়গা জুড়ে শাপলা ফুটে আছে। ওখানেও ছোট একটি ছাউনি ঘেরা জায়গা আছে বসার জন্য।
চারিদিকে চোখ বুলাতে বুলাতেই নাস্তা চলে এল। সকাল সকাল বের হবার কারণে কারো পেটেই কিছু পড়েনি, নাস্তা দেখে সবাই আরেকটু খুশি হয়ে গেল। নাস্তায় বেশ সুস্বাদু খাবার দাবার ছিল- পরটা, চালের গুঁড়ার রুটি, চিতই পিঠা, সবজি, ডাল, ভর্তা, মুরগির মাংস আর সুজির হালুয়া।
খাওয়াদাওয়ার পর জায়গাটা সরেজমিনে দেখতে বের হলাম। কটেজের একটু দূরেই তিনজন লোক বসে গান গাইছিল। ওরকম পরিবেশে গানগুলো বেশ মানিয়ে যাচ্ছিল। বাউল গান, পল্লীগীতি, মারফতি গান। তার কিছু দূরেই তাদের বিশাল রান্নাঘর। সবই মাটির চুলায় রান্না হয়, যার কারণেই সম্ভবত স্বাদ আরো বেড়ে যায়। রান্নাঘরের পাশেই চা-ঘর; যতবার, যতগুলো ইচ্ছে চা বা কফি নেয়া যায়। খুব যত্ন সহকারে একজন চা বানান। চা-ঘরেই আছে একটা ঢেঁকি। অনেকদিন পর ঢেঁকি দেখতে পেয়ে বেশ মজা লাগছিল, কারণ আজকাল গ্রামেও ঢেঁকির দেখা পাওয়া মুশকিল। সুযোগ পেয়ে ঢেঁকিতে পার দিয়ে নিলাম। এই ঢেঁকিতে গুড়ো করা চালের রুটি পিঠাই সকালে খেয়েছি।
আশেপাশে আরো কিছু কটেজ বা ছাউনি দেখতে পেলাম, আমাদের মতোই আরো কিছু মানুষ ঘুরতে এসেছে। তবে জায়গাটা বেশ বড় হওয়ায় খুব বেশি আওয়াজ বা চেঁচামেচি শোনা যায় না। সামনে উঠোনে বেশ কিছু ছাতা রাখা। রোদ বা বৃষ্টি যা-ই হোক, আপনি সাথে করে ছাতা না আনলেও কোনো সমস্যা নেই।
গরম যা পড়েছিল, পুকুরে একটু না নামলেই না। চা-ঘরের চালে দেখলাম লাইফ জ্যাকেট। দেরি না করে লাইফ জ্যাকেট পরে পুকুরে নেমে পড়লাম। কী করব, সাঁতার তো পারি না! আর লাইফ জ্যাকেটের আরেকটা সুবিধা হচ্ছে যতক্ষণ ইচ্ছা পানিতে ভেসে ভেসে পানির আনন্দ নেয়া যায়। প্রায় দু’ঘন্টা চললো পানিতে হৈ-হুল্লোড়।
পুকুর থেকে উঠে একটু শুকিয়ে নিতে নিতেই কানে এল “শুয়া চান পাখি…আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইসো নাকি…” ঠিক ঐ মুহূর্তে যেন ঐ গানটাই অবচেতন মনে শুনতে চাইছিলাম! এই ডাক উপেক্ষা করা যায় না, তাই গান শুনতে বসে গেলাম। একটার পর একটা গান করছেন তারা আর আমার মনে হচ্ছে অনন্তকাল এভাবেই চলুক…।
পানিতে বেশিক্ষণ ঝাপাঝাপি করার একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে ওঠার পর প্রচন্ড ক্ষুধা পায়। সেই সময়েই চোখের সামনে খাবার চলে এলে কার না ভালো লাগে? তা-ও যে সে খাবার না, একদম বাঙালি কায়দায় বুফে! ভাত, পোলাও, হরেক রকম ভর্তা, ডাল, ভাজি, তরকারি, সালাদ। আর খাবারের স্বাদের ব্যাপারে তো একবার বলেছি, এবারো তার ব্যতিক্রম না।
বেশ ভরপেট খেয়ে একটু জিরোবার পালা। এই সময়ে মেঘ কালো করে বৃষ্টি নামল। বিলের উপর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এতো সুন্দর দেখাচ্ছিল! বিলের উপরের ছাউনিটায় বসে বৃষ্টি দেখা, গান শোনা চলল। এরকম সুন্দর বৃষ্টিতে না ভিজলেও তো চলে না! আহ্, কতদিন পর বৃষ্টিতে ভিজে চা খাওয়া হলো! প্রকৃতি যেন নিজ হাতে আমাদের সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে দিচ্ছে। দূরে এক বাঁশের উপর পানকৌড়ি ডানা মেলে বৃষ্টি উপভোগ করছে। বিলের মাঝামাঝি একটা চরের মতো, ওটায় যেতেও ইচ্ছা করছে।
বৃষ্টিটা একটু থামতেই নৌকায় চলে গেলাম চরে। সেখানেও ছাউনি বানানো, আর যতদূর চোখ যায় টলটলে পানি। অস্তগামী সূর্যের লালচে আলো মেঘের সাথে পানির সাথে মাখামাখি হয়ে ঠিক যেন অসাধারণ একটা তৈলচিত্র সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষেরও কবি হয়ে যেতে ইচ্ছে হবে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখে।
নৌকা-ভ্রমণ থেকে ফিরতেই হাজির হয়ে গেল তালের পিঠা আর চা। আয়েস করে খেয়েদেয়ে ফেরার জন্য প্রস্তুত হলো সবাই। ওখানকার লোকজনই বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়ার জন্য টেম্পু ঠিক করে দিল। বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম ঢাকার পথে।
পুরো ভ্রমণের সবকিছুই যে অনেক আরামদায়ক তা কিন্তু না। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে পূবাইলের রাস্তাটা। একে তো পর্যাপ্ত চওড়া না, তার উপর প্রচুর ভাঙাচোরা। ওদিকটাতে বেশ কিছু ফ্যাক্টরি থাকায় মাল বোঝাই ভারি গাড়িগুলোর রোজ চলাচল, বৃষ্টি, হেলাফেলায় বানানো রাস্তাগুলোকে একদম ধসিয়ে দিয়েছে। এই একটা ব্যাপার ঠিক থাকলে পুরো ভ্রমণটাকে নিখুঁত বলা যেত। তবে রাস্তা যেমনই হোক না কেন, সাথে যখন অসাধারণ কিছু সঙ্গী থাকে, যেকোন কষ্টকর রাস্তাই উপভোগ্য হয়ে যায়।
ফিচার ইমেজ- amit24.blogspot.com