প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা তুললে বোধহয় এক বসায় ফুরোবে না। আছে কত জানা-অজানা বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক স্থান। কতক ইতোমধ্যে স্থান করে নিয়েছে আমাদের মনোজগতে স্বপ্নের ঠিকানার মতো, আবার এমনও আছে- সৌন্দর্য সাজিয়ে বসে আছে, কিন্তু অনেকেরই জানা নেই হদিস! তেমনি এক শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতির কোল প্রান্তিক লেক।
চট্টগ্রাম থেকে কেরাণীহাট হয়ে বান্দরবান যাওয়ার পথে হলুদিয়া নামক একটি বাজার পড়ে, যা বান্দরবানের প্রবেশমুখে অবস্থিত। সেই হলুদিয়া বাজার থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরত্বে এবং বান্দরবান সদর থেকে আসলে ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে প্রান্তিক লেকের অবস্থান। লোকাল বাসে আসলে হলুদিয়া বাজারে নেমে সিএনজি কিংবা মাহিন্দ্রা যোগে প্রান্তিক লেকে যাওয়া যায়। ২০০-২৫০ টাকা ভাড়ায় রিজার্ভ নেওয়া ভাল, কারণ আসার সময় কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না। আমরা অবশ্য কেরানিহাট থেকে রিজার্ভ নিয়ে গিয়েছিলাম। এছাড়াও, বান্দরবান সদর থেকে জীপ, চান্দের গাড়ি, অটোরিকশা নিয়েও যাওয়া যায়।
হলুদিয়া বাজার থেকে প্রান্তিক লেক সড়কে ঢুকতেই অন্যরকম এক অনুভূতি হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই পাকা সড়কটি তৈরি করেছে যা দিয়ে একেবারে লামা পর্যন্ত যাওয়া যায়। জায়গাটি অনেকটা ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ এর মতো। চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী হওয়ায় উভয় জেলা এই জায়গাটি নিজেদের বলে দাবি করে। ফলে প্রশাসনিক জটিলতা থাকায় এখানে খুব একটা জনবসতি গড়ে উঠেনি। কিছুদূর পর পর দুয়েকটা বাড়ি-ঘর চোখে পড়ে। জনমানবহীন বিরান পথ, দু’পাশের পাহাড় আর সবুজ গাছগাছালি পর্যটকের যাত্রায় অন্যরকম মাত্রা যোগ করবে। হলুদিয়া বাজার থেকে ১০ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যাবে প্রান্তিক লেকে।
প্রান্তিক লেক পার্বত্য জেলা বান্দরবানের একেবারে প্রান্তে সুয়ালক ইউনিয়নে পড়েছে। এ কারণে এ লেকের নাম হয়েছে প্রান্তিক লেক। আগে এটি উন্মুক্ত থাকলেও ২০১৬ সাল থেকে জেলা প্রশাসন এখানে টিকেট চালু করে। বর্তমানে প্রান্তিক লেকের প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা এবং বোটভাড়া ৫০-১০০ টাকা। বোটভাড়া প্রবেশের সময় একসাথেই নেয়। ২০১৮ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব দিলীপ কুমার বণিক প্রান্তিক লেকে প্রচুর সংস্কার কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে বৃক্ষরোপণ এবং বাগান সৃজনের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন কর্মসূচি, মহুয়া বন, রেস্ট হাউজ, আরসিসি ওয়াকওয়ে, গোলঘর সংস্কার করার মাধ্যমে প্রান্তিত লেককে এক নৈসর্গিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
প্রান্তিক লেকে প্রবেশমাত্রই মনে হলো— যেন এক ভিন্ন এক জগতে চলে আসলাম। প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে এখানে মেলে ধরেছে সৌন্দর্যের মায়াজাল। নানা প্রজাতির সবুজ গাছগাছালি, ইটের সড়ক, শুনশান নীরবতা, হরেক রকম পাখির কলকাকলি, কোলাহলমুক্ত, এবং প্রায় পর্যটকশূন্য প্রান্তিক লেক আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে এটি একটি আদর্শ জায়গা। আমরা ঠিক দুপুরবেলায় যাওয়ায় টিকেট কাউন্টারে একজন এবং বোটম্যান ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাইনি, তবে বিকেলের দিকে এখানে কিছু দর্শনার্থী আসেন বলে জানতে পারলাম।
লেকে নামার জন্য রাস্তা থেকে প্রায় শতাধিক ধাপবিশিষ্ট একটি লম্বা সিঁড়ি আছে। সেই সিঁড়ি দিয়ে নামতেই একটি দোতলাবিশিষ্ট ওয়াচ টাওয়ার বা গোলঘর যেখান থেকে পুরো লেক এবং লেকের চারপাশের সৌন্দর্য দারুণভাবে উপভোগ করা যায়। প্রান্তিক লেক নামটির মধ্যে যেমন একটা কাব্যিক ছোঁয়া আছে, তেমনি এর কাব্যিক আর মায়াময় রূপের জালে সর্বদাই আটকা পড়ে ভ্রমণপিপাসুরা। পাহাড়-অরণ্যঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এই লেকের আয়তন প্রায় ২৫ একর এবং পুরো কমপ্লেক্স ৬৫ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। ২০১৩ সালে সরকার একে পর্যটন সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে।
চারপাশে নানারকম গাছগাছালিতে ভরপুর প্রান্তিক লেকের এক পাড়ে আছে সবুজ ঘাস বিছানো মাটির উন্মুক্ত বিছানা। লেকে আগত দর্শনার্থীদের যেন প্রকৃতির পক্ষ থেকে সবুজ গালিচা সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে। বিশাল আকাশের নিচে মাটির সবুজ বিছানায় বসে লেকের স্বচ্ছ জলের খেলা আর চারপাশের সবুজ বনানী দেখার অনুভূতি বর্ণনাতীত। গাছের শীতল ছায়া, নির্মল বাতাস, পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ অনায়াসে সৃষ্টি করে মোহ। সাধারণত এই জায়গাটি পিকনিক কিংবা কোনো অনুষ্ঠানের জন্য অন্যতম লোভনীয় স্থান। কেউ চাইলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে এখানে বসে লেকের পানিতে মাছ শিকারে মেতে উঠতে পারেন। রাতে ক্যাম্পিংয়ের জন্য এটি আদর্শ জায়গা, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডিসি অফিস থেকে অনুমতি নিতে হবে।
প্রান্তিক লেকে গিয়ে লেকের স্বচ্ছ জলে ঘোরাঘুরি না করে ফিরে আসা মানে অনেক বড় কিছু ফেলে আসা। এ লেকের মূল আকর্ষণই হচ্ছে নৌকা নিয়ে লেকের পানিতে ঘুরে বেড়ানো আর চারপাশের প্রকৃতি নিজের মতো উপভোগ করা। লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এখানে দুটি বোট দেখতে পেলাম। আরো কিছু বোট বিকল অবস্থায় লেকের পাড়ে এদিক-ওদিক পড়ে আছে। সম্প্রতি জেলা পরিষদ থেকে পর্যটকদের জন্য সৌরবিদ্যুৎ-চালিত ছয় আসনবিশিষ্ট খুবই সুন্দর একটি বোট সরবরাহ করা হয়েছে। আমরা সেটিতে উঠে বসলাম এবং লেকের বুক চিরে এগোতে থাকলাম।
লেকের পানিতে ভাসমান শাপলা ফুল, হাতে স্বচ্ছ জলের ছোঁয়া, পাশের পাহাড় থেকে আসা হরেক রকম পাখির কলকাকলি আমাদের অন্য এক জগতে নিয়ে গেল। যান্ত্রিক জীবনের সমস্ত ব্যস্ততা, ব্যর্থতা ভুলে আমরা ডুবে গেলাম স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের এক মায়ারাজ্যে। লেকের মাঝখানে পৌঁছে শরতের স্বচ্ছ আকাশ, চারপাশের সবুজ বনানী আর লেকের স্বচ্ছ জলপ্রবাহের অভূতপূর্ব মেলবন্ধন দেখে মনে হলো যেন নৈসর্গিক পরিবেশের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই প্রান্তিক লেকে। লেকের চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠা অরণ্যে রয়েছে নানা প্রজাতির পশুপাখির বিচরণ এবং জানা-অজানা হরেক রকমের উদ্ভিদ। স্থানীয় জনগণ ছাড়া এ পাহাড়গুলোতে সাধারণত কেউ যেতে পারেন না। প্রায় আধঘণ্টা নৌবিহার শেষে আমরা উঠে এলাম লেকের সুনীল জলের মায়া ত্যাগ করে। অবশেষে প্রাকৃতিক সুধা পান করতে করতে বুক ভরা তৃপ্তি আর প্রাপ্তি নিয়ে বিদায় জানালাম নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, আগামীর সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট, বান্দরবানের একপ্রান্তে পড়ে থাকা পাহাড় অরণ্য ঘেরা, শান্তস্নিগ্ধ প্রান্তিক লেককে।