Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লোকতাক হ্রদ: যেখানে পানির সাথে ভেসে চলে ঘরবাড়িও

ভারতের উত্তর-পূর্বের ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর এক সিস্টার হলো মণিপুর। এ রাজ্যে মৈতিই, বিষ্ণুপ্রিয়া, পাঙন, নাগা ও কুকিসহ আরো অনেক নৃগোষ্ঠীর বাস। শুধু নৃতাত্ত্বিকই নয়, ভাষার দিক থেকেও এদের মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। মণিপুর রাজ্যের পূর্বে মায়ানমার, পশ্চিমে আসাম, উত্তরে নাগাল্যান্ড এবং দক্ষিণে মিজোরাম। ইম্ফাল শহরটি হলো মণিপুরের রাজধানী।

মণিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফাল; Image Source: e-pao.net

মণিপুর রাজ্যটি অনেক প্রাচীন বলে এখানকার জীবনব্যবস্থাতেও কিছুটা আদিম ব্যবস্থার ছাপ লক্ষ করা যায়। তবে আধুনিকতার প্রাচুর্য না থাকলেও এখানে রয়েছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। নদ-নদীর বিভিন্ন অববাহিকায় এই সৌন্দর্য যেন নিত্য এঁকেবেঁকে চলেছে। তারই নিদর্শন খুঁজতে আমাদের যেতে হবে রাজধানী ইম্ফাল শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পশ্চিমে টিডিম রোডে প্রাচীন মৌরাং রাজ্যে। সেখানেই দেখা মিলবে প্রায় ২৮৭ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এক লেক বা হ্রদের। রাজ্যের বিভিন্ন নদীর পানি যুক্ত হয়েছে এই হ্রদের পানিতে।

লোকতাক হ্রদে যাওয়ার পথে; Image Source: incredible-northeastindia.com

তবে এই প্রাকৃতিক হ্রদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর ওপর ভেসে বেড়ানো জৈব পদার্থ আর ঘাস জাতীয় বিভিন্ন গাছপালা। এই সকল গাছপালা একত্র হয়ে এখানে সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন আকারের ছোট বড় দ্বীপভূমি। এসব দ্বীপভূমির কোনো কোনোটিতে রয়েছে মানুষের বাস। এসব ভাসমান দ্বীপ বা দ্বীপের বিভিন্ন অংশগুলোকে বলা হয় ফুমদি। এই ফুমদিগুলোর কিছু কিছু গোলাকার, আবার কিছু অনায়তাকার। ফুমদিতে ছোট ছোট চালাঘর তৈরি করে মানুষ বসবাস করে। অনেককাল আগে থেকেই মানুষ এই সকল দ্বীপভূমিতে বসবাস করে আসছে। মৈরং হয়ে লোকতাকের মধ্যে একটি সরু ভূখণ্ড প্রবেশ করেছে, যাতে গড়ে উঠেছে একটি গ্রাম, নাম ‘থাঙ্গা’। 

লোকতাক হ্রদে ভেসে থাকা ফুমদি; Image Source: youtube.com

গ্রামের বাড়িঘরগুলোর মধ্যে একধরনের সামঞ্জস্য দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি বাড়ির আকার আকৃতি একই রকম। টিনের চালে ঘেরা রয়েছে বাঁধানো উঠোন। সেই উঠোনের মাঝখানে রয়েছে তুলসীমঞ্চ। আর অধিকাংশ বাড়ির উঠোনের সাথে টিনের ঘরে রয়েছে এক বা একাধিক তাঁত। তরুণীদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় চলতে থাকে এসব তাঁত, আর তৈরি হতে থাকে অপরূপ সৌন্দর্যের বস্ত্রখণ্ড। এক একটি সুতার বুননে আর তাঁতের সুরেলা ছন্দে, তৈরি হতে থাকে কারুকার্যময় মেখলা।  

লোকতাকের গ্রামে তাঁত; Image Source: deskgram.net

লোকতাকের দৃশ্যপট দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বিচিত্রতায় লোকতাকের শোভা পরিবর্তিত হতে থাকে। লোকতাকের বাসিন্দাদের জীবনযাপন শুরু হয় কাকডাকা ভোরে। ঘর ঝাড়ু দিয়ে তুলসীমঞ্চে পূজা-অর্চনা করে শুরু হয় তাদের জীবন। ভোরের আলোয় লোকতাকের চারপাশ অনেকটাই শান্ত, নীরব; হিমেল বাতাস শরীরে জাগায় এক অন্যরকম শিহরণ। মেঘের আনাগোনার ওপর নির্ভর করে যে কত দূর পর্যন্ত দৃষ্টি বিস্তৃত হতে পারে। মেঘমুক্ত আকাশে নজরে পড়বে দূরে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের সারি। সেই পাহাড়ের গায়ে গায়ে চাদর বিছিয়ে রেখেছে শৈল্পিক মেঘ। এখানে আকাশ যেন অনেক বেশিই নীল। ভোরের স্নিগ্ধ পরশে সেই নীলে যেন প্রাণ ঢেলে দিয়েছে পাখিদের কলরব। 

ভোরের লোকতাক; Image Source: travelshoebum.com

তবে বৃষ্টির সময় লোকতাক যেন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়। বৃষ্টিস্নাত লোকতাকে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। তবে বর্ষাকালে জীবনযাত্রা অনেক বেশি দুর্বিষহ। মিষ্টি পানির হ্রদ হওয়াতে লোকতাকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। লোকতাকের অধিবাসীদের জীবনযাপন অনেকাংশই নির্ভর করে মৎস্য-প্রাচুর্যের ওপর। স্থানীয় বাসিন্দাদের লোকতাক কখনো নিরাশ করে না। তাই অনেক বছর ধরে বংশ পরম্পরায় বিভিন্ন পরিবারের লোকতাকে বসবাস। 

সাঁঝের বেলা লোকতাকের দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়ে এক ভিন্নরূপে নিজেকে সাজিয়ে তোলে। প্রতিটি ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে সৌর-লণ্ঠন। সেই আলোয় পুরো লোকতাককে মনে হয় আকাশের প্রতিবিম্ব, যেখানে তারার আলো মিটমিট করে জ্বলতে থাকে। নারী-পুরুষের দল কর্মব্যস্ত দিন শেষ করে গল্প করতে করতে নিজেদের ঘরের দিকে ফিরতে থাকে। বিভিন্ন ঘরের সামনে ভিড়তে থাকে ডিঙ্গি নৌকাগুলো। দূরের পাহাড়গুলো যেন ক্রমশ অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে থাকে। রাতের বেলা নৌকায় চড়ে লোকতাকের নীরবতা উপভোগ করা এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। খোলা আকাশের নিচে নিজেকে মনে হতে পারে এক ক্ষুদ্র বিন্দু।  

রাতের অন্ধকারে লোকতাক; Image Source: Kangla Online 

এ এক অন্যরকম জীবনব্যবস্থা, যেখানে স্থায়ী বসবাস বলে কিছু নেই। কোনো এক দমকা হাওয়া, ঘূর্ণিঝড় বা কালবৈশাখীতে ভেঙে যেতে পারে ঘরবাড়ি। লোকতাকের জনজীবনও এমন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত। তাদের ঘরবাড়িও সেভাবেই তৈরি করা। তবে লোকতাকের মজার বিষয় হলো, হ্রদের সীমানা নির্দিষ্ট হলেও লোকতাকের মধ্যে অবস্থিত ফুমদিগুলোর ওপর থাকা চালার ঘরবাড়িগুলোর অবস্থান মোটেও স্থায়ী নয়। পানির সাথে ভেসে ভেসে বাড়িগুলো বিভিন্ন জায়গায় দিক পরিবর্তন করতে থাকে প্রতিনিয়ত। 

লোকতাকের ভাসমান ঘরবাড়ি; Image Source: tripadvisor.in

লোকতাকের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম হলো নৌকা। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সাথে একটি করে ডিঙি নৌকা বাঁধানো থাকে। নৌকা ছাড়া এখানে জনজীবন প্রায় কল্পনাতীত। 

লোকতাকে চলাচলে ব্যবহৃত হয় নৌকা; Image Source:lostwithpurpose.com

লোকতাকের বেশ কাছেই অবস্থিত কৈবুল লামজো ন্যাশনাল পার্ক। এটি বিশ্বের একমাত্র ভাসমান জলাভূমি তথা জাতীয় উদ্যান, যেখানে মণিপুরের জাতীয় পশু সাঙ্গাই হরিণ বা নাচুনে হরিণ (Brow-antlered deer)। দুই থেকে চার ফুট পর্যন্ত সবুজ আর হলুদ লম্বা লম্বা ঘাসে ঘুরে বেড়ায় এ ধরনের হরিণ। এখানে রয়েছে পর্যটক বাংলো এবং ওয়াচ টাওয়ার। এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখা যায় দিগন্তবিস্তৃত উজ্জ্বল সবুজ ভাসমান ঘাসজমি। 

কৈবুল লামজো ন্যাশনাল পার্ক; Image Source: bp.blogspot.com

শীতের সময় লোকতাকে বসে ভিনদেশি পাখিদের মেলা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লোকতাকে ভিড় করে নানান জাতের অতিথি পাখি। পাখির কিচিরমিচির এবং হ্রদের ওপর উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁকের দৃশ্য মনোরম এক অনুভূতি জাগায়। এসব পাখি নিধন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং প্রাকৃতিক এই ভারসাম্য রক্ষা করতে স্থানীয়রাও খুব সচেতন। 

লোকতাককে ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৫০টিরও বেশি গ্রাম আর ৩০টির মতো বাজার। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এই লোকতাকের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। মণিপুর রাজ্যের অর্থনীতিতেও এই লোকতাকের আছে অসামান্য অবদান। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে পর্যটকের সংখ্যাও। 

তবে লোকতাকে নির্মিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে কিছুটা শ্রী হারিয়েছে লোকতাক। এর জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ভারসাম্য অনেকটাই বিঘ্নিত হয়েছে এই কারণে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে আশার সঞ্চার করলেও অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত এই লোকতাককে করেছে হুমকির সম্মুখীন। 

অপার সৌন্দর্যের ছোঁয়ায় লোকতাক; Image Source: neetasatam.com

বিমান, ট্রেন বা সড়ক পথে ইম্ফাল হয়ে লোকতাকে পৌঁছানো যায়। থাকার জন্যে এখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রিসোর্ট বা হোম স্টে। স্বল্প মূল্যেই এসব জায়গায় থাকা বা খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে থাকে। নৌকাভ্রমণ লোকতাকের প্রধান ও মূল আকর্ষণ। এখানে ঘোরার শ্রেষ্ঠ সময় বিবেচনা করা হয় শীতকালকে। সৌন্দর্যমণ্ডিত পরিবেশের পাশাপাশি প্রতিকূল পরিবেশে উপজাতি অধিবাসীদের কঠিন জীবনযাপন দেখতে পাওয়াও যেন এই লোকতাক ভ্রমণের অন্যতম আবেদন। 

লোকতাকের অসাধারণ চিত্রকল্প বর্ণনা করতে গিয়ে মনে পড়ে যায় আমাদের দেশের সুনামগঞ্জ বা নেত্রকোনার হাওর বা বিলগুলোর কথা। এসব স্থানেও ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। কিন্তু আমাদের অবহেলা এবং পর্যটনবান্ধব পরিবেশের অভাবে বিশ্বদরবারে এ স্থানগুলোকে তুলে ধরতে পারছি না আমরা। যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া গেলে হয়তো, আমাদের অপরূপ হাওরের গল্পও আমরা অহরহ শুনতে বা দেখতে পাবো অন্য কোনো মুগ্ধ বিদেশির বয়ানে, কিংবা এমন কোনো ভিনদেশি লেখার সাইটে!  

This article is a Bengali article. This story is about a beatiful lake of Monipur in India named Loktak.  

All the sources are hyperlinked inside the article.

Featured Image: earthobservatory.nasa.gov

Related Articles