অপরুপ সৌন্দর্য্যে ভরপুর আমাদের এ পৃথিবী। আমাদের এ পৃথিবী যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার ঠিক তেমনি মানব সৃষ্ট সৌন্দর্য্যও কম নেই এতে। প্রাচীন মানুষদের তৈরি করা কত শত দর্শনীয় স্থানে পরিপূর্ণ আমাদের এই বসুন্ধরা। এমনই এক প্রাচীন, মানবসৃষ্ট কিন্তু অসাধারণ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি হল পেরুর মাচু পিচু শহর।
স্পেনীয় উচ্চারণে শহরটির নাম মাচু পিচু হলেও অনেকেই এর নাম উচ্চাররণ করেন মাচু পিকচু হিসেবে, যার অর্থ “পুরানো চূড়া”। আসলেই বেশ প্রাচিন শহর এটি। এমনকি কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারেরও আগের শহর এই মাচু পিচু। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই শহরটির উচ্চতা প্রায় ২৪০০ মিটার বা, ৭,৮৭৫ ফিট। এটি পেরুর উরুবাম্বা নামক এক উপত্যকার ওপরে পর্বত চূড়ায় অবস্থিত। বিশ্বাস করা হয় যে মাচু পিচু ইনকা শাসকদের রাজকীয় শহর অথবা, ইনকাদের খুবই পবিত্র এক শহর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বেশিরভাগ পুরাতত্ববিদ বিশ্বাস করেন যে, মাচু পিচুকে পাচাকুতিক (১৪৩৮-১৪৭২) নামক ইনকা রাজার শাসন আমলে গড়ে তোলা হয়েছিল।
১৬শ শতাব্দীতে স্প্যানিশরা ইনকা সভ্যতা আক্রমণ করলে কাকতালীয়ভাবে এই শহরটি জন মানব শূন্য হয়ে পড়ে। স্পেনীয়রা কখনই এ শহরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অবগত ছিল না। স্পেনীয়দের এ আক্রমণের পর কেটে যায় আরো চারশ বছর। চারশ বছর যাবৎ এই ধ্বংশ হয়ে যাওয়া শহরটি লুকিয়ে ছিল বাইরের পৃথিবীর মানুষদের কাছে থেকে। অবশেষে ১৯১১ সালে আমেরিকান আর্কিওলজিস্ট বা, পুরাতত্ববিদ হিরাম বিংহাম এটির প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। এখানকার অসাধারণ দুর্গগুলোর অস্তিত্ব তখন শুধু সেই এলাকার আশে পাশে বাস করা কিছু কৃষকই জানতেন।
বর্তমানে এই মাচু পিচু শহরটিই ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত শহর। ১৯৮১ সালে এই এলাকাকে পেরুর সংরক্ষিত ঐতিহাসিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় স্থান দেয়। বর্তমানে এটি বিশ্বের সাতটি নতুন বিস্ময়েরও একটি।
ইতিহাস
১৪৫০ সাল। তখন ইনকা সভ্যতার স্বর্ণযুগ চলছিল। এমনই এক সময় মাচুপিচু শহরটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, ১০০ বছরের মাঝেই এ শহরটি কার্যত পরিত্যাক্ত হয়ে যায়। ধারণা করা হয় এ শহরের প্রায় সকল মানুষ গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল।
অনেকের মতে মাচুপিচু ছিল ধর্মীয়ভাবে পবিত্র এক জায়গা। তবে এমন অনেকেই আছেন যারা মনে করেন এটি আসলে ইনকা রাজাদের নির্মিত এক জেলখানা ছিল। এখানে রাখা হতো ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদের। ইনকাদের এই শহর নিয়ে অনেক গবেষকই অনেক রকম গবেষণা করেছেন। তাদের মাঝে জন রো এবং রিচার্ড বার্গার তাদের প্রাপ্ত তথ্য থেকে কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। তাদের মতে এটি ছিল তৎকালীন ইনকা রাজার অবকাশ যাপন কেন্দ্র। বেশিরভাগ পুরাতত্ববিদই আবার তাদের এই মতবাদকেই সমর্থন করে থাকেন।
সে সময় ইনকাদের রাজধানী ছিল কোস্কো। রাজধানী কোস্কো থেকে মাত্র ৮০ কি.মি. দূরেই অবস্থিত ছিল এই মাচুপিচু শহরটি। স্পেনীয়রা যখন ইনকা রাজ্য আক্রমণ করে তখন তারা এ শহরের কথা জানত না। ফলে অন্যান্য ইনকা নগরীর মত এ শহরটি তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল না। ফলাফল স্বরুপ এ শহরে লুটপাটের কোন ঘটনাও ঘটেনি। এরপর অনেক বছর এ শহর জন মানবহীন ছিল। ফলে শহরটি ধীরে ধীরে ঘন জঙ্গলে পরিণত হয় এবং ঢেকে যায়।
পুনরাবিষ্কার
২৪ জুলাই, ১৯১১ ইনকা সভ্যতার বিখ্যাত মাচুপিচু শহর আবিষ্কার করা হয়। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিরাম বিংহাম এটি আবিষ্কার করেন। যদিও হিরাম বিংহামকেই এর আবিষ্কর্তা মনে করা হয়, কিন্তু কোস্কো শহরের গবেষক সিমন ওয়েসবার্ড বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। অনেকেই দাবী করে থাকেন আগেই মাচুপিচুতে গিয়েছেন এমন কয়েকজন স্থানীয় তাকে সেখানে নিয়ে যান। যদিও হাইরাম বিংহাম কখনই স্থানীয় সেসব লোকদের কথা কোথাও উল্লেখ করেননি। এমনকি এ শহর আবিষ্কারে তাদের কোন রকম কৃতিত্বও তিনি দেন নি। ১৯১১ সালে এ শহর আবিষ্কারের পর সেখানে কিছু প্রাচীন মমিও পাওয়া গিয়েছিল।
মাচুপিচু
মাচুপিচু অনেক প্রাচীন স্থাপত্যবিদ্যার স্বাক্ষর বহন করে। এখানকার স্থাপনাগুলোর দেয়াল পাথর নির্মিত। মজার বিষয় হল পাথরগুলো একে অপরের সাথে জোড়া দেয়ার জন্য কোন রকম সিমেন্ট বা, চুন-সুরকির মিশ্রণ ব্যবহৃত হয়নি। তাদের এই নির্মাণ কৌশলকে বলা হয় অ্যাশলার। এ কৌশলে তারা বেশ দক্ষ ছিল। এই পদ্ধতিতে পাথরের খন্ড কাটা হত খুব নিখুঁতভাবে। তারপর তাদের খাঁজে খাঁজে বসিয়ে দেয়া হত। ফলে সংযোগকারী সিমেন্টের কোন প্রয়োজন ছিল না। তাদের এই পদ্ধতিতে ইনকারা অত্যন্ত দক্ষ ছিল। তাদের নির্মিত পাথর এতই সুনিপুণ হতো যে একটা পাতলা ছুরির ফলাও দুই পাথরের মধ্যবর্তি ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করানো কার্যত অসম্ভব।
পেরু বেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। সাধারণ সিমেন্টের জোড়া হলে এই ভূমিকম্পে স্থাপনাগুলো টিকত না। কিন্তু পাথরের খাঁজে খাঁজে বসিয়ে তৈরি করা বলে মাচুপিচুর এই স্থাপনাগুলো বেশ ভূমিকম্পপ্রতিরোধী। এ কারণেই ইনকাদের এই শহর গত ৪০০ বছরে অসংখ্য ভূমিকম্প সহ্য করেও বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে।
আশ্চর্যের বিষয় ইনকা সভ্যতায় চাকার দেখা পাওয়া যায় না। তারা কখনই তাদের ব্যবহারিক কাজে চাকার ব্যবহার করেননি। কিন্তু তাহলে কিভাবে ইনকারা এত বিশাল বিশাল আকৃতির পাথর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেছেন তা এক বিশাল রহস্য। যদিও মনে করা হয় এই পাথরগুলো পাহাড়ের সমতল ঢাল দিয়ে ঠেলে ঠেলে ওপরে তোলা হয়েছিল। আর এ কাজে তারা ব্যবহার করেছিল শত শত শ্রমিক। কিছু কিছু পাথরের গায়ে হাতলের মতো গাঁট দেখতে পাওয়া যায়। এমন হয়ে থাকতে পারে যে, এ গাঁটগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল পাথরগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে বসাতে। পাথরগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে বসানোর পর হয়ত হাতলগুলোকে গুড়িয়ে সমান করে দেয়া হয়েছিল।
শহরটিতে মোটামুটিভাবে ১৪০ টি স্থাপনা দেখতে পাওয়া যায়। এর কিছু মন্দির আর কিছু আবাসিক ভবন। এখানে ১০০ টিরও বেশি সিঁড়ি রয়েছে যার মাত্র একটি গ্রানাইট পাথরে তৈরি। রয়েছে পাহাড় কেটে তৈরি করা প্রচুর পরিমাণে ঝরনা। এখানে ইনকাদের দেবতা সূর্যের জন্য সূর্য মন্দিরও ছিল।
সড়ক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ইনকারা মাচু পিচু পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি করে রেখেছিল। বর্তমানে হাজার হাজার লোক এই পথেই পায়ে হেঁটে মাচু পিচু ভ্রমণ করে থাকেন। ২০০০ সালের মাঝেই প্রায় চার লাখ পর্যটক মাচু পিচু ভ্রমণ করে ফেলেছিল। বর্তমানে এটি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। বর্তমানে অতিরিক্ত পর্যটকের সমাগমের কারণে অনেকেই এ শহরের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে থাকেন। তাই সবার উচিত এই বিশ্ব ঐতিহ্যগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের দিকে নজর দেয়া।