পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর একটি মাল্টা। এর মোট আয়তন ৩১৬ বর্গ কিলোমিটার। ইতালির সিসিলি দ্বীপ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং জিব্রাল্টার প্রণালী থেকে ১,৮২৬ কিলোমিটার পূর্বে রিপাবলিক অব মাল্টার অবস্থান। মাত্র চার লক্ষ জনসংখ্যার এই দেশটি পাঁচটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। পাঁচটি দ্বীপের মধ্যে মূলত তিনটি বড় দ্বীপ- মাল্টা, গোজো ও কোমিনোতেই জনবসতি আছে। ভূমধ্যসাগরে এর অবস্থানের কারণে ঐতিহাসিকভাবে দেশটির রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। দেশটি অতীতের অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
ইতিহাসের সাক্ষী ভূমধ্যসাগরীয় রাষ্ট্র মাল্টা
প্রাচীনকাল থেকেই ভৌগলিক অবস্থানের কারণে মাল্টা সবসময় এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। দেশটি বহিঃশত্রু দ্বারা বারবার আক্রান্ত হয়েছে। ফিওনিশিয়ানস, রোমান, বাইজেন্টাইন, এমনকি আরবরাও দেশটিতে তাদের পদচিহ্ন রেখে গেছে। ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে ফিওনিশিয়ানস, ৪০০ খ্রিস্টপূর্বে কার্থেজেনীয়রা দেশটি দখল করে প্রায় আড়াইশো বছর শাসন করে। ২১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই অঞ্চলটি রোমানদের অধীনে চলে আসে। চতুর্থ শতকে রোমান সাম্রাজ্য মাল্টাকে পূর্ব ও পশ্চিমে দুই অংশে বিভক্ত করে। মাল্টার পূর্ব অংশ যে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, তা পরবর্তীকালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিতি পায়। ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মাল্টা আরবদের অধীনে আসে। আরবরা প্রায় ২০০ বছরের বেশি দেশটি শাসন করে।
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমের নাইটস অব সেন্ট জনের যোদ্ধারা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এ দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। নিজেদের সুরক্ষার জন্য তারা এ স্থানে প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গ তৈরি করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। ১৫৬৫ সালে নাইটস অব সেন্ট জনের যোদ্ধাদের সাথে অটোম্যানের ৪০,০০০ তুর্কিবাহিনীর বড় ধরনের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে তুর্কিবাহিনীর পরাজয় ঘটে। এরপর ১৮১৪ সালে ইংরেজরা দেশটি দখল করে এবং মাল্টা ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রায় দেড়শো বছর মাল্টা ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালীয় ও জার্মান বাহিনী দেশটির ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোতেও মাল্টিজ জনসাধারণ ভয় পেয়ে পালায়নি। নির্ভীক, অটল, অনড় হয়ে দ্বীপকে রক্ষা করেছে। নিরস্ত্র মাল্টিজদের অসাধারণ দুঃসাহসিকতার জন্য মাল্টার জনগণকে ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জ ১৯৪২ সালে ‘জর্জ ক্রস’ সম্মানে ভূষিত করেন।
১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে মাল্টার স্বাধীনতা বিল পাস হয়। স্বাধীনতা লাভের পর দেশটি ‘স্টেট অব মাল্টা’ নামে পরিচিতি পায়। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন রাষ্ট্রটির প্রধান। ১৯৭৪ সালে দেশটি ‘রিপাবলিক অব মাল্টা’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৪ সালে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়।
সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যমন্ডিত এক দেশ মাল্টা। পর্যটন শিল্পে বড় ধরনের এক স্থান দখল করে রয়েছে দেশটি। উষ্ণ আবহাওয়া, ঐতিহাসিক নানা স্থাপনা, নান্দনিক স্থাপত্যশিল্প, বিনোদনের নানা সুযোগ-সুবিধা থাকায় দেশটি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
ভাল্লেট্টা
ভাল্লেট্টা মাল্টার রাজধানী। প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে এই নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে। গ্র্যান্ডমাস্টার জ্যঁ প্যারিজো দে লা ভালেট্টার নামানুসারে নগরীর নামকরণ করা হয়। এই শহরের প্রধান আকর্ষণ দ্য গ্রান্ড মাস্টার্স প্যালেস। নগরীর সবচেয়ে পুরনো ও সুন্দর প্রাসাদগুলোর একটি। বর্তমানে প্রাসাদটির একটি অংশ রাষ্ট্রপতির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর প্রাসাদের বাকি অংশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এই প্রাসাদের খুব কাছেই রয়েছে রিপাবলিক স্কয়ার। কিছু সময়ের জন্য ঘুরে বেড়াতে, ক্যাফে আর রেস্তোরাঁয় সুস্বাদ্য খাবারের স্বাদ নিতে পর্যটকরা এখানে ভিড় করেন।
ভাল্লেট্টায় প্রায় তিনশোর বেশি নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা, যেমন- দুর্গ, গির্জা, প্রাসাদ রয়েছে। আর এ কারণে ইউনেস্কো এই শহরকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শহরে পথের ধারের বাড়িগুলো চুনাপাথরের তৈরি। শহরের পুরনো বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঠির তৈরি রঙিন ব্যালকনি দেখে পর্যটকদের চোখ আটকে যায়। এসব ব্যালকনিতে পুরানো ঐতিহ্যের স্পর্শ অনুভব করা যায়। ভাল্লেট্টায় আছে অনেকগুলো গির্জা। তার মধ্যে শিল্পমন্ডিত কারুকার্যের জন্য সেন্ট জনস কো-ক্যাথেড্রাল বিখ্যাত।
গোজো
মাল্টার উপকূলে ছোট্ট এক দ্বীপ গোজো। দ্বীপ মাল্টা হতে ফেরি যোগে যেতে হয় দ্বীপ গোজোতে। গোজোয় রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান। ৩,৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে স্থাপিত মাল্টার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গগন্তিজার মন্দির, প্রিন্সটিন বিচ, ইনল্যান্ড সী ছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় দুর্গ, গির্জা আর দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। আর রয়েছে প্রাকৃতিক চুনাপাথরের খিলান দর্শনীয় আজুরে উইন্ডো, যা দ্বীপ গোজোর পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। এছাড়া শহর জুড়ে মধ্যযুগের অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে।
দ্বীপের ছোট এক পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে অনেক প্রাচীন গ্রাম। গ্রামের অধিবাসীরা অধিকাংশই মৎস্য সম্প্রদায়ের মানুষ। মূলত সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। দ্বীপটিতে তেমন বিকাশ না ঘটলেও প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্যের চমৎকার সব নিদর্শন পর্যটকরা উপভোগ করেন। শান্ত, নিরিবিলি ছুটি কাটানোর জন্য অনেকেই দ্বীপটিকে পছন্দ করেন। এখানকার রামলা সমুদ্রে সাঁতার কাটা, সার্ফিং করা অনেকেই পছন্দ করেন।
রাবাত
মাল্টার এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রাবাত। অতীতে এটি ছিল রোমান ‘সিটি অব মেলটা’। এখন এটি শহরের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানে রয়েছে সেন্ট পলস শিপরেক চার্চ নামে এক ঐতিহাসিক গির্জা। ৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোম থেকে ধর্মপ্রচার করতে বেরিয়ে সেন্ট পলের জাহাজ সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল। তিনি ভাসতে ভাসতে এখানকার এক দ্বীপে আশ্রয় নেন। জাহাজডুবির স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই নির্মিত হয় এই গির্জা। বড় সুন্দর আর মনোরম এই গির্জা। গির্জার চারপাশে সবুজ বাগান, ফুল গাছে ঘেরা সাজানো গির্জার পথ। একপাশে ছোট এক ঝর্ণা থেকে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। যেন এ স্থানে ঐশ্বরিক কোনো দৃশ্য চিত্রায়িত হচ্ছে।
রাবাতের আরও একটি প্রধান আকর্ষণ সেন্ট পলস কাটাকম্ব। এটি পাঁচশ বছরের এক পুরনো কবরস্থান। তবে মধ্যযুগে এটি উপসনাস্থল হিসেবেও পরিচিত ছিল। এছাড়া রাবাতে আর যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে মাল্টা অ্যাভিয়েশন মিউজিয়াম, প্রাচীন স্থাপত্যে নিদর্শন বহন করা দমাস রোমানা এবং ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত প্রাসাদ কাসা বার্নার্ড প্রভৃতি অন্যতম। রাস্তার একদিকে সাগর, অন্যদিকে সারি সারি বাড়ি। প্রত্যেক বাড়ির নকশায় যেমন অভিনবত্ব, তেমনি রঙের বৈচিত্র। শহরটাকে সাজাবার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি নেই।
কোমিনো দ্বীপ
ছোট দ্বীপ হলেও ব্লু লেগুন দ্বীপটির প্রধান আকর্ষণ। মাল্টার সেরা সমুদ্র সৈকতগুলোর একটি এই ব্লু লেগুন। কোমিনো এবং কমিনটোটো দ্বীপের মাঝে এই ব্লু লেগুন অবস্থিত। লেগুনের চারদিকে শিলাবেষ্টিত থাকায় দেখতে মনে হয় যেন একটির প্রাকৃতিক সুইমিং পুল।
কোমিনো দ্বীপ
বালুময় বীচ আর স্বচ্ছ নীল জলের সমুদ্র সৈকতে সার্ফিং এবং স্কুবা ডাইভিং করার এক আদর্শ স্থান। সেজন্য এখানে ভ্রমণার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। এখানে রয়েছে পাখিদের জন্য সংরক্ষিত এক অভয়ারণ্য। প্রকৃতির সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য এ অঞ্চলটিকে ন্যাচারাল রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এই দ্বীপে গাড়ি চলাচলের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তাই কোথাও রাস্তাও নেই। পায়ে হেঁটেই দ্বীপটিতে ঘুরে বেড়াতে হয়।
ব্লু গ্রাটো
কোমিনো দ্বীপের আরও একটি আকর্ষণীয় স্থান ব্লু গ্রাটো। চুনাপাথরের এক পাহাড়। হলুদ মাখানো সাদা পাথরের পাহড়ে হালকা নীল সমু্দ্রের জল আছড়ে পড়ছে। অনন্তকাল ধরে জলের ঢেউয়ে নরম চুনাপাথর ক্ষয় হয়ে পাহাড়ের মধ্যে তৈরি করেছে বেশ কয়েকটি ছোট বড় গুহা। উজ্জ্বল সূর্য কিরণে জলের ঘন নীল রং প্রতিফলিত হচ্ছে গুহার মধ্যে, আবার সেই হলদে আবীর মাখা সাদা পাথরে আলো সমুদ্রের নীল জলের ওপর প্রতিবিম্ব তৈরি করছে।
পাহাড়ের গুহা রক থ্রাশ পাখিদের আবাসস্থল। সেই পাখি দেখার আশায় কত পর্যটক ছোট ছোট নৌকোয় চড়ে সেই পাহাড়ের কাছে পৌঁছোয়। ব্লু গ্রাট্টোর পর জু্রে-রী আয়ে নামে বেশ প্রাচীন এক গ্রাম রয়েছে। তারপর আবার পাহাড়। গোটা দক্ষিণ উপকূল অনুচ্চ পাহাড় দিয়ে ঘেরা।
চার্চ অব সেন্ট মেরি
১৮৬০ সালে নির্মিত হয় এই গম্বুজওয়ালা গির্জা। বিশ্বের বৃহত্তম গম্বুজওয়ালা গির্জাগুলোর মধ্যে এটি তৃতীয়। গির্জার মাথাটি গম্বুজ আকারের। বিরাট আকারের গম্বুজ। এত বড় গম্বুজের জন্যই এই গির্জা ‘মোস্তা দোম’ নামেও খ্যাত। ১২২ ফুট ব্যাসের ঝুলন্ত গম্বুজ, মাঝখানে কোনো পিলার নেই। খিলানের স্তম্ভগুলো এবং ত্রিকোণাকৃতির কার্নিশগুলো রোমের প্যানথিয়ানের নকশায় তৈরি। গির্জাটিকে বহু মূল্যবান জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। দেওয়ালের নকশাগুলো সব সোনা দিয়ে মোড়া। মেঝের পাথরগুলো জটিল জ্যামিতিক নকশা দিয়ে তৈরি।
এই গির্জা নিয়ে অনেক কিংবদন্তী রয়েছে। শোনা যায়, ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই গির্জার ওপর তিনবার বোমা বর্ষণ হয়েছিল। তার মধ্যে দুটো গম্বুজের ওপর পড়ে অন্যদিকে ছিটকে যায়। আর তৃতীয় বোমাটি যখন পড়ে তখন গির্জার মধ্যে ৩০০ যাজক উপস্থিত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বোমাটি যখন গম্বুজের ওপর পড়ে তা থেকে কোনো বিস্ফোরণ ঘটলো না। গির্জার বাইরের একটি ঘরে বোমাটির একটি প্রতিকৃতি তৈরি করে রাখা আছে।
মাল্টা দেশটি ছোট হলে কী হবে? দেশটিতে দেখার আছে অনেক কিছুই। মানোয়েল দ্বীপের পাশে গ্র্যান্ডমাস্টার মানোয়েল দে ভিলহেনার দুর্গ, বাগানের সৌন্দর্য দেখে কিছু সময় কাটাতে চাইলে আপার বারাক্কা গার্ডেনস কিংবা মাল্টার ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে একাবার ঢুঁ মেরে আসা যায়। আর নিরিবিলিতে শপিং করা আর রাস্তায় প্রিয়জনকে নিয়ে নিরিবিলি হেঁটে বেড়ানোর জন্য শহর মদিনা তো রয়েছেই।