চায়না বাঁধ ও রবীন্দ্র কাছারি বাড়িতে একদিন

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ির কথা জানা থাকলেও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে তার যে একটি কাছারি বাড়ি আছে তা জানা ছিল না। একদিন ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে হঠাতই দেখতে পেলাম সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কাছারি বাড়ি রয়েছে, যেখানে বসে তিনি লিখেছিলেন গল্প কবিতা। নিউজটা দেখেই বেশ আগ্রহ জন্মালো। এছাড়াও সিরাজগঞ্জ এর যমুনাতীরের চায়না বাঁধ দেখারও ইচ্ছা ছিল বহুদিনের। হাতে ছুটি থাকায় ভাবলাম ঘুরেই আসি। ফোন করে দুজন বন্ধুকে বলতেই তারা রাজি হয়ে গেল। ব্যস! ঝটপট তৈরি হয়ে রাত ১০ঃ৩০ এ বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে। গন্তব্য এয়ারপোর্ট স্টেশন।

প্রথমেই পাঠকদের রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি নিয়ে কিছু তথ্য দেয়ার প্রয়োজনবোধ করছি। এসব তথ্য কাছারি বাড়ির আঙিনায় টাঙানো বোর্ড থেকেই নেয়া হয়েছে। তিন তৌজার অন্তর্গত তিহি শাহাজাদপুরের জমিদারি একদা নাটোরের রানী ভাবানীর জমিদারির একটি অংশ ছিল। ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় এ জমিদারি কিনে নেন।

জমিদারির সাথে সাথে শাহজাদপুরের কাছাড়ি বাড়িটিও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এর আগে এ বাড়ির মালিক ছিলেন নীলকর সাহেবরা। ১৮৯০ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ৮ বছর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাঝে মাঝে শাহজাদপুরে জমিদারি দেখতে আসতেন এবং সাময়িকভাবে বসবাস করতেন। তবে তিনি স্থায়ীভাবে থাকতেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। সম্ভবত এ কারণেই কুষ্টিয়ার বাড়িটিকে কুঠিবাড়ি এবং শাহজাদপুরের বাড়িটিকে কাছারি বাড়ি বলা হয়। এ বাড়িটি মূলত ইন্দো-ইউরোপিয় স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে নির্মিত একটি দ্বিতল ভবন।

১৯৬৯ সালে অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় এ ভবনটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। অতঃপর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে রবীন্দ্র জীবনীভিত্তিক আলোকচিত্র ও বাড়িতে প্রাপ্ত আসবাবপত্র নিয়ে একটি স্মৃতি জাদুঘর এ রুপ দেয়া হয়। এ কাছারি বাড়িটি দর্শনার্থীদের জন্য সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে দুপুর ১টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতি থাকে। রবিবার পুরো দিন এবং সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে কাছারি বাড়িটি। এখানে প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা।

ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জের দুরত্ব মাত্র ১১৯ কিলোমিটার হলেও সাভার, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে প্রায়শই জ্যাম থাকার কারণে বাসে যেতে যেতে প্রায় ৪-৫ ঘন্টা লেগে যায়। ফলে সকালে রওনা হয়ে সিরাজগঞ্জ, শাহাজাদপুর ঘুরে ঢাকায় ফিরে আসাটা একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যায় বলে আমরা রাতের ট্রেনে সিরাজগঞ্জ রওনা হওয়ার প্ল্যান করি। আর তাই আমরা রাজশাহীগামী পদ্মা এক্সপ্রেসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, যা প্রতিদিন ঢাকার কমলাপুর ষ্টেশন থেকে রাত ১১ঃ০৫ এবং এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে ১১ঃ৪৫ এ রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

তবে পথিমধ্যে এটি বেশ কয়েকটি স্টেশনে যাত্রাবিরতি দিয়ে থাকে, যার মধ্যে অন্যতম একটি হলো শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন। এটি সিরাজগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। যেমন পরিকল্পনা তেমন কাজ। এয়ারপোর্ট স্টেশনে পৌঁছালাম রাত ১১ঃ২০ এ। গিয়ে টিকেট বুক করে অপেক্ষা করতে লাগলাম পদ্মা এক্সপ্রেসের জন্য। সেদিন ট্রেন কিছুটা দেরিতে এসেছিলো। রাত সোয়া ১২টায় এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু হয় আমাদের। প্রায় মিনিট ত্রিশেক পরে ট্রেন জয়দেবপুর স্টেশন পৌঁছালে বাকি দুজন সেখান থেকে আমার সাথে যোগ দেয়।

ট্রেন এগিয়ে চলছিলো চাঁদ মামাকে সাথে নিয়ে। তবে কিছুক্ষণ পর পরই চাঁদ মামা হারিয়ে যাচ্ছিলো গজারি বনের গাছেদের আড়ালে। মৃদু ঠান্ডা বাতাসের দল শীতল পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিলো মুখমন্ডলে। কানে হেডফোনে বাজছিলো প্রিয় কিছু গান। দেখতে দেখতে একসময় চলে এলাম যমুনা সেতুতে। সেতুর সোডিয়াম আলোগুলো বেঁকেছে পথের সাথে সাথে। তবে দিনে বঙ্গবন্ধু সেতুর সৌন্দর্য আর রাতের সৌন্দর্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক। দিনের হলদে আলোয় চেনা সেতুটাকেই বড্ড বেশি মোহনীয় মনে হচ্ছিল। কী এক অদ্ভুত মন কাড়া আকর্ষণ! তাছাড়া সেতু দিয়ে বাসগুলো দ্রুতবেগে ছুটলেও ট্রেনগুলো খুবই ধীরে ধীরে চলে। ফলে সেতুর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় পুরোপুরি।

রাতের বঙ্গবন্ধু সেতু © লেখক

সেতু পার হয়ে পদ্মা এক্সপ্রেস আবার তার পুরনো গতিতে ছুটতে আরম্ভ করলো। রাত ২ঃ৪৫ নাগাদ ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিলো শহীদ এম মনসুর আলী রেল স্টেশনে। আক্ষরিক অর্থেই স্টেশনটিকে জনশূন্য মনে হচ্ছিল। কোথাও কেউ নেই। শুধু একা একা দাঁড়িয়ে আছে ল্যাম্পপোস্টগুলো। স্টেশনে কিছুক্ষণ এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে পায়ে হেঁটেই চলে গেলাম কড্ডার মোড়।

কড্ডার মোড় মূলত ঢাকা রাজশাহী হাইওয়ের একটি চৌরাস্তা এবং বাজার। এখানে প্রায় সারারাত দোকানপাট খোলা থাকে এবং মানুষ থাকে। আর যেহেতু আমরা ঘোরাঘুরি শুরু করবো ফজরের পর আর জনশূন্য স্টেশনে বসে থাকাটাও বিপদজনক, তাই আমরা কড্ডার মোড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। রাত গভীর হলেও অল্প কিছু রিকশা, সিএনজি পাওয়া যায় স্টেশনের বাইরে। তবে ভাড়া বড্ড বেশি চায় তারা। তাছাড়া কড্ডার মোড় নামক জায়গাটিও খুব একটা দূরে না বলে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই আমরা।

মধ্যরাতে কড্ডার মোড়ে গিয়ে ভূনা খিচুড়ি দিয়ে রাতের খাবারটা খেয়ে নিলাম। খাবার শেষে ধূমায়িত চা হাতে নিতে নিতেই গল্প জমে উঠলো দোকানদার চাচার সাথে। কতশত গল্প! শৈশবের গল্প, সিরাজগঞ্জের গল্প, নদী তীরে তার দুরন্ত বেড়ে ওঠার গল্প। মনে হলো মানুষটা বহুদিন পর কথা বলার মানুষ খুঁজে পেয়েছেন। আর তাই উগড়ে দিয়েছেন তার ভেতরকার জমে থাকা গল্পগুলো। গল্প শুনতে শুনতেই মসজিদে হতে সুমিষ্ট কন্ঠে ফজরের আজান শুনতে পেলাম।

দোকানদার চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে নিলাম। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে চারদিকে। সেই সাথে শুরু হলো নতুন একটি দিনের, নতুন কিছু গল্পের। কড্ডার মোড় থেকেই একটি সিএনজি নিয়ে নিলাম। গন্তব্য চায়না বাঁধ। এই বাঁধটির নাম ক্রসবাঁধ-৩ হলেও তা অধিকাংশ মানুষ চায়না বাঁধ হিসাবেই চেনে। যমুনা নদীর তীর ভাঙন রোধে বানানো হয়েছিল এই বাঁধ।

বহুদূর বিস্তৃত যমুনা নদী © লেখক

ফাঁকা রাস্তা ধরে ছুটে চলছে আমাদের সিএনজি। শীত শীত ভাব লাগছিলো। বেশ খানিকটা সময় পর সিএনজি গিয়ে থামলো চায়না বাঁধের গেটে। গেটে ঢুকতেই চোখে পড়লো নানা বয়সের নারী-পুরুষ, যারা সকালে হাঁটতে এসেছেন বাঁধে। বাঁধের গেট থেকে নদী পর্যন্ত প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার দূরত্ব। তবে এই পথটুকু হেঁটে যেতে বিন্দুমাত্র ক্লান্ত অনুভব হয় না। কারণ বহুদূর থেকে ছুটে আসা বাতাসেরা পরশ বুলিয়ে দেয় পুরো শরীরে। এছাড়াও বাঁধের ডান এবং বাম উভয় দিকেই ছল ছল শব্দে পানির খেলা চলছে অবিরাম। আকাশে মেঘ থাকায় বাঁধ ও যমুনা নদীর সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। অনেকখানি হাঁটার কারণে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম বাঁধের ব্লকগুলোর উপর।

বাঁধে প্রাতঃভ্রমণে আগত মানুষজন © লেখক

ডান দিকে তাকালেই বহুদূরের যমুনা সেতু দেখা যাচ্ছিলো। মাঝ নদীতে যাতায়াত করছিলো নানান সাইজের নৌকা। কিছুটা দূরেই মাছ ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত দুজন জেলে। মন চাচ্ছিলো অনন্তকাল শুয়ে থাকি এই ভাঙা-গড়ার কারিগর যমুনার তীরে। শুয়ে শুয়ে চারদিকে চোখ বুলাচ্ছিলাম আর গল্প করছিলাম নিজেদের মধ্যে।

হঠাৎই আমাদের মধ্যে একজন আচমকা ধাক্কা মেরে উঠিয়ে দিয়ে বললো, সামনে দেখ ওটা কী। চমকে উঠলাম বেশ। উঠে সামনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দেখতে পেলাম বেশ বড় সাইজের একটা মাছ পানির মধ্য থেকে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে উঠছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এটা শুশুক। এরা বাংলাদেশের নানা নদীতে ঘুরে বেড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ শুশুকের লাফালাফি দেখে উঠে দাঁড়ালাম। আমাদের এবার চায়না বাঁধ থেকে ফিরতে হবে। যেতে হবে শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়িতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি ঘর © লেখক

চায়না বাঁধ থেকে বেরিয়ে আবার সিএনজি নিয়ে ফিরে আসলাম কড্ডার মোড়ে। কড্ডার মোড়ে এসে হাইওয়ে পেরিয়ে আবার অন্য একটি সিএনজি রিজার্ভ নিয়ে নিলাম। হাইওয়েতে সিএনজি চলাচল নিষিদ্ধ বলে সিএনজি ছুটে চললো গ্রামের মধ্য দিয়ে। এই দ্বীপের সবুজ শ্যামল গ্রামীণ সৌন্দর্য আকৃষ্ট করেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। কখনো সবুজ ধানক্ষেত, কখনো বা ঘরবাড়ি, আবার কখনো বা নদীর পার দিয়ে ছুটে চলছে আমাদের সিএনজি। অনেকক্ষণ পর আমরা পৌঁছালাম শাহজাদপুরে। শাহজাদপুর পৌঁছানো মাত্রই দেখতে পেলাম চার রাস্তার মাঝখানে সাদা শুভ্র বেশভূষায় দাঁড়িয়ে আছে রবি ঠাকুরের মূর্তি।

শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুর্তি © লেখক

সিএনজি আমাদের নামিয়ে দিলো একদম কাছারির মূল ফটকে। টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম ভেতরে। চারদিক সাজানো গোছানো বেশ পরিপাটি। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু ফলের গাছ। কাছারি বাড়ির সামনের অংশে রয়েছে অনেক রকম ফুল গাছ। কাছারি বাড়ির একটি দালান ব্যবহার করা হয় মিলনায়তন হিসেবে। মিলনায়তন ভবনটিতে বেশ রাজকীয় রাজকীয় ভাব রয়েছে। এছাড়া মিলনায়তনের পেছনের দিকে রয়েছে বেশ কিছু ঘর, যা একসময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে মূল ভবনটিকে অবিকৃত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ভবনটিতে থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খোঁজখবর নিতেন চারদিকের। দেখাশোনা করতেন জমিদারি।

ভবনটির সামনের বেশ খানিকটা অংশ ঘাসে আচ্ছাদিত। তাছাড়া চারপাশ একদম পরিষ্কার, ফকফকা। কোথাও কোনো ময়লা আবর্জনা নেই। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ফিরতে হবে আমাদের। কাছারি বাড়ির সুবিশাল গাছের ছায়ায় বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আমাদেরকে শহীদ মনসুর আলী স্টেশনে পৌঁছাতে হবে বিকালের মধ্যেই। কেননা রাজশাহী থেকে ঢাকামুখী ট্রেনটি বিকেলে এই স্টেশনে দাঁড়ায়। সেটাতেই আমরা ঢাকায় ফিরবো।

কড্ডার মোড়ে এসে শেষ বিকেলে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম সবাই। দুপুরের খাবার শেষে স্টেশনে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো ট্রেন। আমরা রওনা হলাম যান্ত্রিক নগরীর দিকে। যে নগরীতে আমাদের ছুটতে হয় জীবনের প্রয়োজনে।

This article is about a day tour in Sirajganj. The visited places were Rabindranath Tagore's house, Kachari bari and a dam named China dam at Shahzadpur.

Feature image © Sadat Mostafa Sadaf

Related Articles

Exit mobile version