নদীমাতৃক বাংলাদেশ। বেশ ছোটবেলা থেকেই এই দেশের প্রধান দুইটি নদী আমার জীবনের সাথে আজীবনের মত জুড়ে আছে- পদ্মা আর যমুনা। কলেজ জীবন থেকেই মেঘনা নদীও একইভাবে জুড়ে গেল, কারণ তখন থেকেই শুধুমাত্র স্কুলের ছুটির সময়ে বেড়ানোর সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে পুরোদমে ভ্রমণ করতে শুরু করি। এভাবেই দেশের অসংখ্য নদীর সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়। কিন্তু একসাথে ৩৫০ কিমি দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিব, তাও আবার একই যাত্রায়, একটানা ২০ ঘণ্টায়?
বলছি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নৌযান প্যাডেল স্টিমারে ভ্রমণের কথা। ১৯২৯ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনামলে যাত্রা শুরু হয় এই নৌযানের, যা সেসময়ে পানিপথের সবচেয়ে দ্রুতগামী পরিবহন হিসেবে খ্যাত ছিল। বাংলাদেশে পিএস মাহসুদ, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস লেপচা ও পিএস টার্ন এই চারটি প্যাডেল স্টিমার যথাক্রম ১৯২৯, ১৯২৯, ১৯৩৭ ও ১৯৪৮ সাল থেকে চলাচল শুরু করে। প্রাথমিকভাবে স্টিমার অর্থাৎ স্টিম ইঞ্জিনের মাধ্যমে চালিত হলেও, ১৯৯৫ সাল থেকে ডিজেল ইঞ্জিনের ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন এর ‘রকেট‘ সার্ভিসের অধীনে সপ্তাহে চারদিন ঢাকার সদরঘাট থেকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ পর্যন্ত এই স্টিমার যাতায়াত করে। যখন প্রথমবার এই যাত্রার সম্পর্কে জানতে পারি তখন থেকেই অপেক্ষার দিন গুণতে শুরু করি। সেই অপেক্ষার অবসান হয় ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসের ১২ তারিখে।
গত বছর থেকে এই যাত্রাটি ৭ ঘণ্টা সংক্ষেপিত করে দেওয়া হয়। এর আগে ২৭ ঘণ্টার দীর্ঘ সফরটি খুলনায় গিয়ে শেষ হত। কিন্তু এর মধ্যেই একটি স্টিমার সম্পূর্ণরূপে বিকল হয়ে পড়ায়, এখন সেটিকে ভাসমান রেস্তোরাঁয় রূপান্তরিত করে দেওয়া হয়েছে। আর বাকিগুলোর অবস্থাও খুব একটা সুবিধাজনক নয়। এই জন্যই যাত্রার সময় ৭ ঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়েছে। এমনও শোনা যায় যে, যেকোনো সময়ে প্যাডেল স্টিমারের যাতায়াত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই কথা শোনার পর থেকে মনে মনে অস্থির হয়ে উঠতে শুরু করি। যদিও আমি একা ভ্রমণেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করি, কিন্তু এই যাত্রায় একা গেলে খুবই বাজে সময় কাটবে- এরকম কথাই বেশি শুনেছিলাম। তাই অপেক্ষায় থাকি উপযুক্ত সফর সঙ্গীর।
আট জনের একটি ছোট দলে আমাদের যাত্রা শুরু হয় ১২ তারিখ সন্ধ্যা ঠিক ৬:৩০ এ। এখানে বলে রাখা ভাল যে, প্যাডেল স্টিমারে তিন শ্রেণীর যাত্রী যাতায়াত করে থাকে- প্রথম শ্রেণীর কেবিন, দ্বিতীয় শ্রেণীর কেবিন ও তৃতীয় শ্রেণী তথা ডেক। এই যাত্রাপথের বেশিরভাগ গন্তব্য স্থানের জন্যই নদীপথে যাতায়াত নিকটস্থ শহরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। আর প্যাডেল স্টিমার ছাড়া সেখান অন্য কোনো লঞ্চ যাতায়াত করে না। এরকম প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও চাঁদপুর, বরিশালের মত বন্দরেও প্যাডেল স্টিমার নৌপথে যাতায়াতের একটি প্রধান মাধ্যম। যেসকল যাত্রী মোটামুটি নিয়মিতভাবে এই স্টিমারে যাতায়াত করে, যাদের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণ, তারা সাধারণত ডেকেই যাতায়াত করে থাকে।
আর কেবিনের যাত্রী তিন ধরনের হয়ে থাকে- সরকারি কর্মকর্তা ও অন্যান্য বিশেষ ব্যক্তিবর্গ, আর্থিকভাবে সচ্ছল যাত্রী, আর ভ্রমণকারী। এই তৃতীয় ও শেষ দলটির মধ্যে দেশি, বিদেশি দুই ধরনের যাত্রীই দেখা যায়- এমনকি শীতকালে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা দেশি পর্যটকের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। এই বিদেশিদের বেশিরভাগই ইউরোপ, আমেরিকার কোনো পাশ্চাত্য দেশ থেকে আসা। এদের বাংলাদেশে আসার অন্যতম প্রধান কারণ এই প্যাডেল স্টিমার। আর যারা এই যাত্রাটিকে উপভোগ করতে চান, প্রথম শ্রেণীর কেবিন কিছুটা চড়া মূল্যের হলেও, এই কেবিনই নেওয়া উচিৎ। কেবিনের ভাড়া ৩,৭০০/-। এই মূল্যের সাথে ভ্যাট যোগ হবে। তবে এই ভাড়া ফ্যামিলি কেবিনের জন্য নয়। এরকম মোট ৮ টি কেবিন রয়েছে। আর এই স্টিমারের টিকেট পাওয়াটাও সহজ কাজ নয়। নৌপরিবহন সংস্থার অফিসে গিয়ে অগ্রিম বুকিং এর মাধ্যমে এই টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। আমার সৌভাগ্য ছিল যে, আমার দলের অন্য একজন সদস্য এই কষ্টদায়ক কাজে নিয়োজিত ছিল। আমি মূলত: প্রাণভরে ভ্রমণ উপভোগ করার আর ইচ্ছামত ছবি তোলার কাজেই ব্যস্ত ছিলাম।
আমাদের আয়োজক সবাইকে জানিয়ে দেন যে, যাত্রা শুরুর সময় বিকাল ৫:৩০; যদিও আমি জানতাম যে, সন্ধ্যা ৬:৩০ এ এই যাত্রা শুরু হয়। আর বাড়ি থেকে বের হয়ে লালকুঠি ঘাট পৌঁছানো পর্যন্ত সময়টিতে নি:শ্বাস প্রায় বন্ধ করে রিক্সায় বসেছিলাম। একটা পর্যায়ে রিক্সা থেকে নেমে পায়ে হেঁটেই এগিয়ে যাই। প্রায় দৌড়ে, ৬ টার একটু আগে আমি ঘাটে পৌঁছাই। পড়ন্ত বিকালে চোখের সামনে প্রথমবার প্যাডেল স্টিমারকে দেখে যে আনন্দ সেই মুহূর্তে হয়েছিল, সেরকম আনন্দ আল্লাহর রহমতে জীবনে বেশ কয়েকবার পেলেও, এই অনুভূতি প্রতিবারই অসাধারণ মনে হয়।
স্টিমার পৌঁছে প্রথমেই দোতলায় আমাদের প্রথম শ্রেণীর কেবিনে চলে যাই। এই একটি জায়গায় ‘প্রথম শ্রেণী‘ মানে, সব অর্থেই প্রথম শ্রেণী। ঘর থেকে বের হয়েই সামনে একেবারে খোলা বারান্দা (যা ফ্রন্ট ডেক নামেও পরিচিত)- সেদিন ছিল বছরের সবচেয়ে বড় পূর্ণিমার রাত, আর চাঁদের আলোয় নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চা খাওয়ার মজাটা, এক কথায়, অন্যরকম! যদিও কেবিনে দুইটি বেড, বৈদ্যুতিক পাখা, এসি (যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করে না) আর হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ও আয়না সহ একটি ছোট বেসিনও ছিল, আমরা পুরো রাতটিই ঐ ডেকে চাদর বিছিয়ে চাঁদের আলোয় কাটিয়েছিলাম।
আমি শুধু চাঁদের আলো উপভোগ করতেই তো যাইনি, পুরো স্টিমারের একটা পূর্ণাঙ্গ পরিদর্শন আর ছবি তোলা ও ভিডিও করা ছিল আমার প্রধান উদ্দেশ্য। তাই কিছুক্ষণ রুমে বসে দলের সবার সাথে পরিচিত হয়েই, চলে যাই ছাদে। সেখানেও কয়েকজন মিলে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করি। তখনও ৬:৩০ বাজেনি। ঠিক ৬:৩০ টায় স্টিমার যাত্রা আরম্ভ করে। আমাদের ধারণা ছিল, সরকারি পরিবহন, সময় হয়তো সেভাবে মেনে চলবে না। কিন্তু প্রতিটি গন্তব্যেই স্টিমারটি এর নির্দিষ্ট সময় সম্পূর্ণভাবে মেনে চলেছিল। ছাদ থেকে নেমেই ক্যামেরা হাতে চলে যাই সোজা নিচতলায়। একেবারে প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে স্টিমারের প্রতিটি অংশ যথাসম্ভব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি। সেই সাথে চলতে থাকে বিচিত্র রকমের মানুষের জীবনের ২০ ঘণ্টার বিভিন্ন দৃশ্য অবলোকন করা, বিভিন্ন শ্রেণীর বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সাথে কথা বলা, ছবি তোলা আর ভিডিও করা।
রকেট সার্ভিসের এই স্টিমারে কত যে বিচিত্র ধরনের জিনিসপত্র পরিবহন হয়ে থাকে, সেটা স্বচক্ষে না দেখলে কেবলই গল্প মনে হবে। আজকের যুগে ইতিহাস হয়ে যাওয়া সিআরটি মনিটর বিশিষ্ট টেলিভিশনকে সাইকেলের পিছনে বেঁধে নিয়ে পারাপার হতেও দেখেছি এখানে। জীবন্ত পশুপাখি তো ছিলই। সেই সাথে ছিল কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের বিশাল সমাহার, যা বরিশাল বন্দরে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে নামিয়ে রাখা হচ্ছিল। অনেকেই বরিশাল নেমে এক দফা নাস্তার পর্বও সেরে নেয়। প্যাডেল স্টিমারের খাবারের সুনাম সকলেই করে থাকে। এই খাবারও যাত্রীভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। ডেকের যাত্রীরা সাধারণত নিজেরাই বাড়ি থেকে খাবারের ব্যবস্থা করে আনে। সেই সাথে কম দামী খাবারের ব্যবস্থাও থাকে একেবারে স্বকীয়ভাবে পরিচালিত একটি ছোট্ট হোটেলে, যেটা স্টিমারের দোতলায় অবস্থিত। আর ডেকের ঠিক মাঝখানে একটা বেশ বড় আকারের চায়ের দোকানে প্রায় সব ধরনের শুকনো খাবার যেমন চানাচুর, বিস্কিট, চিপস, পাউরুটি, বানরুটি, কোমল পানীয়, চা-কফি, কলা ইত্যাদির বিশাল সরবরাহ রয়েছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর খাবারের ব্যবস্থা হয় নিচতলার ইতিহাসের সাক্ষী রান্নাঘরে, কাঠের খড়িও ব্যবহার হয় এই রান্নায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর খাবার সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। তাই শুধু প্রথম শ্রেণীর খাবারের গল্পই করব এখানে। যদিও স্টিমারের মেন্যু থেকে নিজেদের পছন্দমত খাবার বেছে নিতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ যাত্রীই রাতের খাবারে ভুনা খিচুড়ির সাথে আলু-মুরগির ঝোল, ডিম ভুনা আর আঁচার খেয়ে থাকে। সকালের নাস্তায় চাইলে খিচুড়ি, আবার চাইলে আধুনিক ব্রেড-বাটার-জ্যাম খাওয়া যায়। দুপুরের খাবারে ভাত-ডাল-মাছ-সবজি ছিল আমাদের মেন্যুতে। তবে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই স্টিমারের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ খাবার হল ‘ফিশ এন্ড চিপস‘- কিন্তু এজন্য আগে থেকেই বলে রাখতে হবে। আর খাবার পরিবেশনের জন্য প্রথম শ্রেণীতে রয়েছে দুইটি বড় আকারের খাবার-টেবিল সহ ডাইনিং হল। তবে, খাবারের মূল্য উল্লেখিত কেবিনের মূল্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। খাবারের ব্যবস্থার মত, এই তিন শ্রেণীর শৌচাগারের ব্যবস্থাও ভিন্ন ভিন্ন।
প্রতিটি জেলার একেকটি গন্তব্যে খুব বেশি হলে ৭-১০ মিনিটের মত থেমেছিল স্টিমার, শুধুমাত্র বরিশালেই ১ ঘণ্টার মত থেমেছিল। সেই সাথে বরিশালে কীর্তনখোলা নদীর ওপরে সূর্যোদয়ের দৃশ্যটি রীতিমত অতিরিক্ত পাওনা। এই থামার সময়েই অসংখ্য মানুষ স্টিমারে উঠেছিল, আবার নেমেওে গিয়েছিল। অসংখ্য মানুষের সেই পারাপারের দৃশ্যের মাঝেও যে দেখার মত কিছু থাকতে পারে, তা আগে কখনো চিন্তাই করিনি। কোথাও কোথাও স্টিমার থামার সাথে সাথে স্থানীয় কৃষকেরা নিজেদের উৎপাদিত শাক-সবজি, ফল- এক কথায় পানির দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে স্টিমারের যাত্রীদের সামনে উপস্থিত করে।
আমি প্রতিটি গন্তব্যেই স্টিমার থেকে বেরিয়ে, হেঁটে আশপাশটা ঘুরে দেখি। আর এটা করতে গিয়ে, স্টিমারের টিকেট চেকার মামার সাথে বেশ একটা বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমার। সকালের নাস্তার সময়ে স্টিমার বিখ্যাত গাবখান চ্যানেলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে। নদীর দুই ধার এর আগেও বহুবার দেখেছি, কিন্তু এবারে কী যেন বিশেষ ছিল। সেই সাথে মিঠা পানির ডলফিনও বেশ কয়েকবার আমাদের দেখা দেয়। কিন্তু ক্যামেরা হাতে একেবারে প্রস্তুত থাকলেও একবারের জন্যও তাকে ক্যামেরাবন্দী করার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই স্টিমারের পূর্ণ মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করলেও, শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এই স্টিমারে কোনো ধরনের পরিবর্তনই আসেনি- শুধু সময়ের সাথে তাল রেখে জিনিসপত্রের দাম একটু বেড়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী মেরামতের কাজও করানো হয়েছে, কিন্তু ব্রিটিশ আমলের কেতাদুরস্ত, সাহেবি আচার-ব্যবহার আজও একই নিয়মে পালিত হচ্ছে। সেই সাথে ভোর থেকে মোটামুটি মাঝ রাত পর্যন্ত যতবার খুশি চা-কফি অর্ডার করে, নিজের পছন্দ অনুযায়ী কেবিনে বা ফ্রন্ট ডেকে উপভোগ করার সুযোগ তো রয়েছে। কিন্তু এই সাহেবি কেতার সেবা পেতে হলে অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর কেবিনেই এই যাত্রা সম্পন্ন করতে হবে।
বেলা ঠিক ৩ টার সময়ে পিএস (প্যাডেল স্টিমার) স্টার্ন আমাদেরকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে আমরা আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাই। কিন্তু সেটা আরেক গল্প। যাদের কাছে মনে হচ্ছে যে ২০ ঘণ্টার এই যাত্রা অত্যন্ত নিরানন্দের, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, যদি আপনার একটি ভ্রমণপিপাসু মন থেকে থাকে, তাহলে নদীর দুই ধারের সৌন্দর্য ও বিচিত্র মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা দেখতে দেখতে আপনি এতটাই মুগ্ধ হয়ে যাবেন যে, মনে হবে- সাধ মেটেনি, আবার আসতে হবে!