প্রতিটি ঋতুরই রয়েছে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য। শীতকালও এ বিষয়ে ব্যতিক্রম নয়। গাছে গাছে পাতা না থাকলেও অনেক ফুল গাছে শোভা পায় মৌসুমী ফুল। চারিদিকে রুক্ষতা শুষ্কতার মাঝেও যেন কুয়াশা, বরফ আর হাড় কাঁপানো শীতকেই মনে হয় সুন্দরের দিশারী। সব সুন্দরের মাঝেও পৃথিবীর এমন কিছু জায়গা আছে যেগুলো প্রাকৃতিকভাবে শীতকালে হয়ে ওঠে দারুণ আকর্ষণীয়। চলুন জানা যাক সেই জায়গাগুলো সম্পর্কে।
শিকাগো, যুক্তরাষ্ট্র
ঝড়ো হাওয়ার শহর হিসেবে সুপরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের এই শহরটি। যদিও শীতকালে রূপ আরো বহুগুণে বেড়ে যায় যখন এই শহর পরিণত হয় বরফের রাজ্যে। সেখানকার সর্বোচ্চ হিমশীতল আবহাওয়া উপভোগ করতে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানে যাওয়া দরকার। তাপমাত্রা এতটাই নিচে নেমে যায় যে মিশিগান হ্রদ আংশিকভাবে জমে যায়। আর সেই সৌন্দর্য হয় চোখ জুড়ানো।
তালিন, এস্তোনিয়া
তালিনের মধ্যযুগীয় পুরাতন শহর বছর জুড়েই থাকে মনোরম ও আকর্ষণীয়। কিন্তু এস্তোনিয়ার (উত্তর ইউরোপের একটি দেশ) দীর্ঘ শীতের মাস চলার সময়টাতে এই জায়গাটি এক আশ্চর্য সৌন্দর্যে সেজে ওঠে। মোট কথা, সেই সময়ে সেখানে গেলে মনে হবে যেন রূপকথার রাজ্যে চলে গিয়েছেন আপনি। জায়গায় জায়গায় স্নোম্যান (তুষারমানব) বানানো বরফ খেলায় যেন মেতে ওঠে পুরো তালিন শহর। তালিনের সুন্দর সেই সময়টাতে জায়গাটিকে বিভিন্ন সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্যও বেছে নেয়া হয়।
প্লিটভিস ন্যাশনাল পার্ক, ক্রোয়েশিয়া
কল্পনা করুন তো, একাধারে ১৬টি নীলকান্তমণির হ্রদের রাশি একটি অন্যটির জলপ্রপাতের সাথে মিলেমিশে পানির শক্তি ও মহিমার এক অবিস্মরণীয় প্রদর্শন করে। এখন ঠিক এই একই দৃশ্য কল্পনা করুন, কিন্তু বরফে জমে থাকা অবস্থায়! প্লিটভিস ন্যাশনাল পার্ক হলো পর্যটকদের জন্য ক্রোয়েশিয়ার অন্যতম আকর্ষণ। শীতকালে এর চারপাশ যেন মরুভূমির মতো দেখায়। তবে ঝর্ণাগুলো যে বরফে জমে যায়, সেই অপূর্ব দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো সম্ভব নয়।
জিগোকুদানি মাঙ্কি পার্ক, জাপান
জিগোকুদানি হয়তবা শীতকালে জাপানের সবচাইতে চমকপ্রদ প্রাকৃতিক দৃশ্যে সাজে না, তবে একটি দৃশ্য তো না দেখলেই নয়! যা মূলত এর বৈশিষ্ট্য বা অন্য সব সৌন্দর্য থেকে একে ভিন্নতা দেয়। কারণ তখন সেখানে জাপানে বসবাসকারী ম্যাকাক (বানর জাতীয় প্রাণী বিশেষ) অথবা স্নো মাঙ্কি বা তুষার বানরেরা ঝর্ণার ধোঁয়া ওঠানো গরম পানিতে স্নান করে। সেখানকার কনকনে শীতে গরম পানিতে বানরদের স্নান করা দেখে যে আপনার একেবারে ভিন্ন রকম এক অভিজ্ঞতা হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বানফ্ ন্যাশনাল পার্ক, কানাডা
কানাডার বানফ্ পার্কের মূল আকর্ষণ যে মোরেন হ্রদ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই! লুইস হ্রদ (এটিও বানফ্ ন্যাশনাল পার্কের ভেতর রয়েছে) থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই হ্রদের স্বচ্ছ টলটলে পানিতে দশটি পর্বত শৃঙ্গের চূড়ার তুষারাবৃত উপত্যকার প্রতিফলন ঘটে। এই দৃশ্যটি এতটাই সুন্দর যে, ১৯৭০ সালের দিকে কানাডার ২০ ডলারের ব্যাংক নোটে এই ছবিটি ছাপা হতো।
হালস্টাট, অস্ট্রিয়া
ছবিটি দেখে নিশ্চয়ই চোখ ধাঁধিয়ে গেলো, তাই না? অস্ট্রিয়ার এই জায়গাটি আসলেই ঠিক এতটাই সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হালস্টাট হলো হ্রদের পাশে অবস্থিত অস্ট্রিয়ার ছোট্ট একটি গ্রাম, যা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে জায়গা করে নিয়েছে। এই মাধুর্য আরো অনেক গুণে বাড়িয়ে দেয় যখন হালস্টাটের কাছাকাছি থাকা সালয্বার্গ পাহাড় বরফে ঢেকে যায়। প্রায়ই হালস্টাট পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর গ্রাম হিসেবে সর্বাধিক ভোটে জয়ী হয়। এত সুন্দর জায়গার এই প্রাপ্তি সত্যিই অনস্বীকার্য।
রিচমন্ড পার্ক, যুক্তরাজ্য
লন্ডনের সবচেয়ে বড় এই পার্কটি যেন শীতকালে সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। ২,৫০০ একরের এই পার্কটি নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের তুলনায় তিন গুণ বড়। আর সেখানে বন্য হরিণদের ছুটোছুটি দেখে আপনার মনে হবে যেন মনোরম এক গ্রামাঞ্চলের মাঝে আপনি হারিয়ে গিয়েছেন। লন্ডনে বরফ পড়া দিনগুলোতে রিচমন্ড পার্কের সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে না দেখলেই নয়!
গোবি মরুভূমি, মঙ্গোলিয়া
আপনি যদি এমনই ভ্রমণপিপাসু হন যে তীব্র শীতেও সারি সারি পশমি উট দেখার জন্য গভীরতম মঙ্গোলিয়ায় নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারেন, তাহলে এই জায়গাটিতে যেতে ভুলবেন না! হাজার হাজার উটের উৎসব উদযাপনকালে, স্থানীয় উট পালকেরা পোলো প্রতিযোগিতা এবং ঘোড়দৌড়ে অংশ নেয়। এছাড়াও সেখানকার সবাই যে কাউকেই উট সওয়ারি হিসেবে স্বাগত জানায় এবং উদ্বোধনী প্যারেডে অংশগ্রহণেরও সুযোগ দেয়।
শ্লোস নেউশভ্যানস্টাইন, জার্মানি
ডিজনিল্যান্ডের ঘুমন্ত রাজকুমারীর সেই অদ্ভুত সুন্দর দুর্গটির কথা মনে আছে? কিন্তু বাস্তবেই যে ঠিক এমনই একটি দুর্গ রয়েছে, তা কি জানতেন? কল্পকথার সেই দুর্গটি আসলে বাস্তবের এই দুর্গটির অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিলো। পার্থক্য এই যে, দানবাকৃতির কোনো পশুকে চলাফেরা করতে দেখবেন না। বাভারিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত হোহাংশওয়াংগাউ গ্রামের পাহাড়ে দেখা মিলবে এই শ্লোস নেউশভ্যানস্টাইন দুর্গটির। শীতকালে যখন সেখানকার আশেপাশের বনজঙ্গল বরফে ছেয়ে যায়, তখন এর দৃশ্য হয় আরও মনোমুগ্ধকর।
ট্রাকাই ক্যাসেল, লিথুয়ানিয়া
রূপকথার রাজ্যের প্রাসাদ- শুনতেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে জাঁকালো এক দুর্গ! লিথুয়ানিয়ার ত্রাকাই দুর্গটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সেটা কল্পরাজ্য নাকি বাস্তবের দুর্গ। ভিলনিয়াস (লিথুয়ানিয়ার রাজধানী) থেকে সতেরো মাইল দূরে অবস্থিত এই দুর্গটিতে শীতকালে যেন একেবারে ভিন্নতা চলে আসে। আশেপাশে থাকা হ্রদগুলো বরফে জমে যায় এবং কমলার বুর্জগুলো তুষারাবৃত হয়ে যায়।
কুইন্স টাউন, নিউজিল্যান্ড
পুরো বছর জুড়েই ঘোরার জন্য কুইন্স টাউন বেশ সুন্দর একটি জায়গা। কিন্তু শীতকালে (মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস) এই জায়গাটি অভূতপূর্ব সৌন্দর্যে সেজে ওঠে। এর কাছাকাছি দ্য রিমার্কেবলস্ ও করোনেট পিক-এ (স্কি করার জন্য বাণিজ্যিক এলাকা) চলে রমরমা স্কি আনন্দ! বিশেষ করে জুন ও জুলাই মাসে যখন কুইন্স টাউনে শীতকালীন উৎসব হয়, তখন এই শহরটি অপূর্বভাবে সাজে আর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় করে পর্যটকেরা।
ল্যাপল্যান্ড, ফিনল্যান্ড
গ্রীষ্মের সময় এই জায়গাটিতে ২৪ ঘণ্টাই থাকে সূর্যের প্রতাপ। কিন্তু দীর্ঘ শীতকালের সময়টাতে ল্যাপল্যান্ড যেন পুরো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। সেখানকার জগদ্বিখ্যাত জাদুকরী নর্দার্ন লাইট বা অরোরা বোরিয়ালিস পৃথিবীর আকাশে যেন প্রাকৃতিক আলো প্রদর্শনীর মেলা বসায়। এছাড়াও হাস্কি সাফারি, বল্গাহরিণে টানা স্লেজ গাড়ি এবং আইস হোটেলে থেকে রাতের আকাশে অরোরা বোরিয়ালিস উপভোগ করতে পারেন। তবে অরোরা বোরিয়ালিস সবসময় দেখা যায় না। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ হলো এটি দেখার উপযুক্ত সময়।
হারবিন, চায়না
পর্যটকদের জন্য হারবিনে যাওয়ার যথার্থ সময় হলো জানুয়ারি মাস। কারণ সে সময়ে বরফ ও তুষারের ভাস্কর্য নিয়ে এই শহরটিতে আয়োজন করা হয় সবচাইতে বড় উৎসব। বিশ্বের নানা দেশ থেকে অংশগ্রহণকারীরা দৃষ্টিনন্দন ও প্রকাণ্ড সব বরফের নকশা নিয়ে হাজির হন সেখানে। চীনের উত্তর-পূর্ব দিকের এই অংশে শীতকালে তাপমাত্রা -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে নেমে যাওয়ারও রেকর্ড আছে।
ফিচার ইমেজ: PChome下载- 电脑之家