দক্ষিণ ভারতের এক অপূর্ব ছোট্ট শহর পুদুচেরি। শহরটি ছিমছাম হলেও বেশ বৈচিত্র্যময়। বহু প্রাচীন সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে এই অনন্য শহরটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও কৃষ্টির যেন এক অনবদ্য মেলবন্ধন। চেন্নাই থেকে প্রায় ১৫০ কি.মি. দূরে অবস্থিত পুদুচেরি। শহরের জীবনধারা ভারতের অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় বেশ বৈশিষ্ট্যময় এবং আকর্ষণীয়। শহরের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ফরাসি সভ্যতার নানা নির্দশন। চলুন তাহলে বেরিয়ে পড়ি শহরটির অলিগলিতে ছড়িয়ে থাকা নানা বৈচিত্র্যময়তার সন্ধানে।
নামকরণ
পুদুচেরি শহরটির মূল নাম ছিল ‘পুতুসিরি’, যা তামিল শব্দ ‘পুতু’ (যার অর্থ ‘নতুন’) এবং ‘সিরি’ (যার অর্থ ‘গ্রাম’) এই দুটি শব্দ থেকে উদ্ভূত। ফরাসিরা যখন শহরটিতে উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন তাদের উচ্চারণের সুবিধার্থে শহরটি নামকরণ করে ‘পুন্ডিচারি’ বা ‘পন্ডিচেরি’। ভারতের স্বাধীনতার পরও পন্ডিচেরি হিসেবেই পরিচিত ছিল শহরটি। ২০০৬ সালে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শহরটির নাম পরিবর্তন করে ‘পুদুচেরি’ নামকরণ করে।
কীভাবে গোড়াপত্তন ঘটলো এই শহরের?
ফরাসিদের দ্বারা পুদুচেরি শহরটির গোড়াপত্তন ঘটে। তবে শুরুতে শহর হিসেবে তেমন পরিচিতি ছিল না পুদুচেরির। কাছেই সমুদ্র থাকায় অনেক মৎস্যজীবীর বসবাস ছিল এখানে। মৎস্যজীবীদের গ্রাম হিসেবেই ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে থাকে অঞ্চলটি।
১৬৭৪ সালের পুদুচেরিতে ফরাসি উপনিবেশ গড়ে ওঠে। ফরাসিদের চোখে দৃশ্যত ভালো লেগে যায় অঞ্চলটি। তারা শহরটির নামকরণ করে পুন্ডিচারি বা পন্ডিচেরি। ফ্রান্স ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক ফ্রাঙ্কো মার্টিন এই পন্ডিচেরিকে ভারতের ফরাসি উপনিবেশগুলোর রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। এর ফলে শহরটির অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ফরাসি কর্মকর্তাদের থাকার জন্য, তাদের দাপ্তরিক কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য শহরটি নতুন করে সাজতে থাকে। এর ফলে পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ফরাসি সভ্যতার দৃষ্টিনন্দন আভিজাত্য। আর এই সময়ে এসেও সেসব ফরাসি ভাবধারার ছাপ অবিকৃত অবস্থায় এখনো রয়ে গেছে।
১৯৫৪ সালের ১ নভেম্বর ফরাসি সরকার ভারতে প্রতিষ্ঠিত তাদের উপনিবেশগুলো ভারতের কাছে বিনাশর্তে সমর্পণ করলে পুদুচেরি ভারতের অধীনে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তখন থেকেই ১ নভেম্বরকে পুদুচেরির স্থানীয় অধিবাসীরা স্থানীয় স্বাধীনতা দিবস বা De Facto Merger Day হিসেবে পালন করে আসছে।
ভৌগোলিক মানচিত্রে পুদুচেরির অবস্থান
প্রায় ১৯০ বর্গ মাইল (৪৯২ বর্গ কি.মি.) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত পুদুচেরি শহরটি। কেন্দ্রশাসিত এক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত পাওয়া পুদুচেরির ভৌগোলিক মানচিত্রের সাথে জড়িয়ে রয়েছে চারটি জেলা। পুদুচেরি, কারিকাল, ইয়ানাম ও মাহে- এই চারটি জেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে কেন্দ্রশাসিত এই অঞ্চল। আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম এলাকা পুদুচেরি ও কারিকাল। ইয়ানাম ও মাহের একটি অংশ অন্ধ্রপ্রদেশ ও কেরালা রাজ্যের সাথেও যুক্ত রয়েছে। পুদুচেরি ২৯৩ বর্গ কি.মি., করিকাল ১৬০ বর্গ কি.মি., মাহে ৯ বর্গ কি.মি. এবং ইয়ানাম ৩০ বর্গ কি.মি. নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পুদুচেরির মোট জনসংখ্যা ১২,৪৪,৪৬৪।
মায়াময় নাগরিকতা আর ফরাসি সভ্যতায় লালিত প্রাচীন এক শহর
পুদুচেরি শহরের জীবনধারা ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় বেশ বৈচিত্র্যময়। হোম কুকড ফ্রেঞ্চ ফুড, বাগরু প্রিন্টের ডিজাইন আর কমিউনিটি লিভিংয়ের নিস্তব্ধতা- এই নিয়ে পুদুচেরি। শহরের প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি অলিগলি, বাড়ির দেয়াল কাঠামো- সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে ফরাসি সভ্যতার নানা নির্দশন। ঝকঝকে রাস্তা, ধবধবে সাদা আর হলুদের সম্মিলনে নির্মিত বাড়ির স্থাপত্যকৌশল দেখে পর্যটকেরা মুগ্ধ হয়ে পড়েন। অভিজাত এলাকার বাড়িগুলো বেশ চোখে পড়ার মতো।
সারা শহর জুড়েই যেন ফরাসি একটা গন্ধ। রাস্তার নাম থেকে শুরু করে বাড়ির গঠন, রাস্তার খাওয়া-দাওয়ায় আর পোশাক-আশাকে প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে ফরাসি মাদকতা। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই যেন পুদুচেরি এক অনন্য স্বকীয়তা নিয়ে পর্যটকদের সামনে উপস্থিত হয়। পুদুচেরি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা স্বাদের বেকারি, ক্যাফে। বিভিন্ন দোকানে সাজিয়ে রাখা আছে নানা ফ্যাশনেবল পোশাক-আশাক, যাতে ফরাসি ছাপ বেশ চোখে পড়ার মতো।
সারা শহর জুড়ে এক মায়াময় নাগরিকতা ঝলমল করছে, কিন্তু কখনোই তা চড়া সুরে বাঁধা নয়, তাই দৃষ্টিকটুও মনে হয় না। এ যেন শান্ত, স্নিগ্ধ ও কোমল গান্ধারের সুরে মজে থাকা। এটিই পুদুচেরির মূল আকর্ষণ। মন্দির, বিচ, বোটানিক্যাল গার্ডেন, স্থাপত্যে সমৃদ্ধ দর্শনীয় চার্চ, অ্যাকুরিয়াম- দেখার অনেক কিছুই রয়েছে এই পুদুচেরি শহরে। এখানকার চামড়ার তৈরী জিনিসের বেশ সুনাম রয়েছে।
শহরের দর্শনীয় যত স্থান
শহরের অন্যতম আকর্ষণ অরোভিল। অরোভিলের ভেতরে ঢুকলে যেকোনো পর্যটকই অবাক হয়ে যান। অরোভিলের ভেতরে এত ঐশ্বর্য সাজানো রয়েছে, যা দেখে তাড়াতাড়ি বের হওয়া খুবই মুশকিল। শহরের এক বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থিত অরোভিল। অরোভিলে কী নেই? খাওয়া-দাওয়ার রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে থাকার ব্যবস্থা, নানা রকম দোকান- সবকিছুর সমাহার যেন এই অরোভিল। অরোভিলের মধ্যে সে এক অন্য দুনিয়া। অনন্য এক ইউনিভার্সাল টাউন, কমিউনিটি লিভিংয়ের আশ্চর্য নিদর্শন এই অরোভিল।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর মানুষ এক সাথে থাকছেন, কাজ করছেন সবাই মিলে, যেন সমন্বয়ের এক অনবদ্য সুর ঝংকার নিয়ত বেজে চলছে পুরো অরোভিল জুড়ে। হরেক রকমের দোকানের সম্ভার অরোভিলের ভেতরে। যেমন সুন্দর তাদের অন্দর সাজ, তেমন সুন্দর সব জিনিসপত্র। এখানে এক অদ্ভুত ভালোলাগা আছে। তাতে মগ্ন হয়ে পড়েন অনেকেই। দর্শনে আপ্লুত হতে হলে এখানে একদিন অবশ্যই থাকা উচিত। তবে অরোভিলের মধ্যে থাকতে হলে খাওয়া-দাওয়ার নিয়ম আছে, সময়ের কড়াকড়িও আছে, আবার এই নিয়মের মধ্যেও একধরনের শান্তি আছে, প্রাণের স্পন্দন আছে।
অরোভিল থেকে ঘুরে এসে পর্যটকেরা ঘুরে বেড়ান প্যারাডাইস বিচ, চার্চ অফ দ্য সিক্রেট হার্ট অফ জিসাস, সি-সাইড প্রমেনাদ, ফ্রেঞ্চ ওয়ার মেমোরিয়াল, নানা আকর্ষণীয় মন্দির, বোটানিক্যাল গার্ডেন, অ্যাকুরিয়াম- অনেক কিছু্ই দেখার মতো জায়গা রয়েছে। শহরটা তেমন একটা বড় নয়, একটা অটো রিক্সা ভাড়া করে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুরো শহরই একবার দেখে আসা যায়।
এছাড়াও শহরটির আরেকটি প্রধান আকর্ষণ ঋষি অরবিন্দ আশ্রম। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আশ্রমটি ভারি সুন্দর। আশ্রম চত্বরের শান্ত পরিবেশ আর ফুলের সাজ দেখে পর্যটকেরা মোহিত হয়ে পড়েন।
বিদেশী পর্যটকদের আরেক আকর্ষণ এখানকার গির্জাগুলো, যেখানে ফরাসি সভ্যতা ও স্থাপত্যের প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। শহরের দক্ষিণে অবস্থিত ক্যাথলিকদের অন্যতম গির্জা ব্যাসিলিকা অফ দ্য সিক্রেট হার্ট অব জিসাস। ১৯০৭ সালে নির্মিত হয় এই গির্জা। গির্জার গঠনশৈলীতে রয়েছে ৫০ মিটার লম্বা, ৪৮ মিটার চওড়া ও ১৮ মিটার উচ্চতা এবং ২৪টি কলামের এক অপূর্ব সমন্বয়। গির্জার অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী দেখে যেকোনো পর্যটকই আবিষ্ট হয়ে পড়েন।
মনমাতানো খাবার আর সমুদ্রতটে সময় কাটানো
শহরের খুব কাছেই রয়েছে দিগন্তবিস্তৃত বেশ কয়েকটি সমুদ্রতট। প্যারাডাইস বিচ, প্রমেনাদ বিচ এগুলোর মধ্যে অন্যতম। অরোভিল থেকে ফিরে এসে অনেক পর্যটকই নিজেদের নির্জন কিছু সময় কাটানোর জন্য সৈকতের বেলাভূমিতে আশ্রয় নেন।
এই দৃষ্টিনন্দন সি-বিচে স্কুবা ডাইভিংয়ের রয়েছে চমৎকার ব্যবস্থা। পায়ে হাঁটা রাস্তায় চলতে চলতে একটু জিরোনের জন্য পর্যটকেরা ঢুকে পড়েন যেকোনো কফি শপে। চেখে দেখেন দোকানে সাজিয়ে রাখা লোভনীয় সব অসাধারণ স্থানীয় খাবার। পুদুচেরি শহর জুড়ে বেকারি, ক্যাফে আর নানা ধরনের পোশাকের দোকানের ছড়াছড়ি। রাস্তার পাশের ছোট ছোট দোকানে সাজানো টি-কেকের বেকিংয়ের গন্ধে যেকোনো পর্যটকেরই মন ভালো হয়ে যাবে।
পুদুচেরিতে ঘুরে বেড়ানোর আদর্শ সময়
এখানকার আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র। শীতের সময়ে তেমন জাঁকিয়ে শীত বসে না এখানে। তাই শীতের পোশাকের তেমন দরকার হয় না। পুদুচেরিতে যাওয়ার জন্য অক্টোবর থেকে মার্চ হচ্ছে আদর্শ সময়। জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে সেপ্টেম্বর আর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি– বছরে এখানে দুবার বৃষ্টি হয়। তাই যারা বর্ষা ভালোবাসেন, তারা এই সময়ে ঘুরে আসতে পারেন পুদুচেরি। তাই আর দেরি না করে চলুন বেরিয়ে পড়ি নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরা অজানা এক শহর পুদুচেরির উদ্দেশ্যে।
ফিচার ইমেজ: travelnews2014.wordpress.com