ফ্রান্সের টুলুস থেকে ফ্লিক্সবাসের ২০ ইউরোর টিকিটে মাধারি মানের আরামদায়ক বাসে আধাশোয়া হয়ে নির্ঘুম রাত ভ্রমণ করে বার্সেলোনায় এসেছি। শরীর যতটা না ক্লান্ত তার চেয়ে মন বেশি ভারাক্রান্ত। কারণ রাতে বাসে একটু ঘুমিয়েছিলাম। সেই সময় বুক পকেটে রাখা ১৬০ ইউরো অর্থাৎ ১৬,০০০ টাকা দিয়ে সদ্য কেনা রোদচশমাটি বাসেই কোথাও পড়ে গেছে, আমি সেটা টের পেয়েছি বাস থেকে নেমে চলে আসার পর। বোকাসোকা বাঙালি প্রথমবার ইউরোপে গিয়ে রাতের বাসে কেন যে রোদচশমা পকেটে রাখতে গেল? সম্ভবত ১৬০ ইউরো মূল্যের রোদচশমার আভিজাত্য গরীব (!) ইউরোপীয়দের মাঝরাতে দর্শন করানোর খায়েশ হয়েছিল।
ভগ্ন হৃদয়ে ভোরের শহর দেখতে দেখতে হেঁটে হেঁটে পৌঁছালাম সিটি সেন্টারের কাছেই আগের দিন বুকিং দেওয়া সেইন্ট ক্রিস্টোফার ইনে। জ্বি, এটা কোনো ক্যাথেড্রাল বা চার্চ নয়, এটা একটা স্বল্প ব্যয়ের হোস্টেল। আমার ভ্রমণ জীবনের প্রথম হোস্টেল এই সেইন্ট ক্রিস্টোফার ইন। এখনও বুকিং.কম এর পরিদর্শন তালিকায় এতে অবস্থানের তারিখ, খরচ সহ সব তথ্য লিপিবদ্ধ আছে।
মানুষ ভ্রমণে সচরাচর যেটা করে আমি করি তার উল্টো। সবাই সারারাত ভ্রমণ করলে হোটেল বা হোস্টেলে এসে বিশ্রাম নেয়, কিন্তু আমি সেই দলের লোক নই। জীবনে অনেক ঘুমানো যাবে, কিন্তু ভ্রমণে আমি যতটা বেশি সম্ভব ঘুরে পয়সা উসুল করার পক্ষে। কোনোমতে হোস্টেলে রেজিস্ট্রার খাতায় নাম লিখিয়ে, ব্যাগ রাখার স্থানে ব্যাকপ্যাক রেখে ছোট একটা ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে বের হয়ে পড়লাম শহর দেখতে।
ভোরবেলার শহর দেখার অন্যরকম একটা মজা আছে। নিরিবিলি পরিবেশে এসময় শহরটা দেখা যায়। কোথাও ঘুরতে গেলে আসলে সেই স্থানের শান্ত-অশান্ত সব রূপ দেখতে হয়। এজন্যই আমি রাতের উৎসবমুখর শহরের পাশাপাশি ভোরের শহর দেখার সুযোগটা কখনোই ছাড়ি না। যা-ই হোক, এই সকালে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম গুগল ম্যাপ বন্ধ করে ঘুরবো। ভোরের বার্সেলোনায় আমি হারিয়ে যাব নিজের মতো।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি যেদিকে দু’চোখ যায়, মন যেদিকে চায় সেদিকে হাঁটি, এভাবে ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা হেঁটে বেড়ালাম। নিজ চোখে দেখলাম শান্ত বার্সেলোনা শহরের প্রকৃত চেহারা। শহরের অলিতে-গলিতে মনমতো ঘুরে আবার হোস্টেলে ফিরলাম। এবার নাস্তা করার পালা। হাত-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাস্তা খেতে বসলাম। এই হোস্টেলে সকালে সীমাহীন নাস্তাসহ প্রতিরাতের ভাড়া ১০ ইউরো।
আমি নাস্তা খেতে বসেছি, সকালের দিকে আমি একটু বেশি খাই। আমার উল্টোপাশে বসেছে এক চীনা মেয়ে। আমি ঠেসে ঠেসে আমার পেট ভরছি, এ সময় খেয়াল করে দেখলাম সেই চীনা মেয়েটি হোস্টেলের নাস্তা দিয়ে পেট ভরার পাশাপাশি ব্যাগও ভরছে। আমি বেশ অবাক হলাম, যদিও কারণটা আমি বুঝিনি। এর কারণটা গল্পের পরে আসবে।
নাস্তা করে ছোট ব্যাগটি আবার পিঠে ঝুলিয়ে বের হয়ে গেলাম। এবার ইচ্ছা প্ল্যান মোতাবেক ঘুরব। বার্সেলোনায় আমার ২ দিন থাকার ইচ্ছা। ইউরোপীয় প্রতিটি শহরেই ঘোরার জন্য পর্যটক বাস আছে। ১/২ দিনের প্যাকেজ টিকেট পাওয়া যায়। সীমাহীনভাবে ঘোরা যায় এগুলোতে। সাধারণত এই বাসগুলো প্রধান প্রধান পর্যটন স্থানগুলোকে কেন্দ্র করে সারাদিন একের পর এক ঘুরতে থাকে। এক টিকিটেই সারাদিন যেকোনো বাসে যতবার ইচ্ছা চড়া যায়।
সিটি সেন্টারের কাছেই পর্যটক বাসের একটি কাউন্টার দেখে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম ততক্ষণে অনেকেই টিকেট কিনে ফেলেছে এবং বাসে উঠছে। আমি কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা মেয়েটির কাছ থেকে বার্সেলোনা শহরের একটা পর্যটক মানচিত্র চেয়ে নিলাম। ভালোভাবে মানচিত্র পড়ে যা বুঝলাম সেটি হলো সমগ্র বার্সেলোনা শহরের পর্যটন স্থানগুলো ২টি জোনে বিভক্ত- রেড জোন ও ব্লু জোন। বাসগুলো সারাদিন এই বৃত্তাকার জোন ধরে সকল পর্যটন স্থানের পাশ দিয়ে ঘুরতে থাকে, টিকিটধারী পর্যটক বহন করে একস্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যায়। চাইলে দুই দিনের জন্য টিকেট কেনা যায়, আবার চাইলে একদিনেই সব ভ্রমণ করে শেষ করা যায়। আমি ভেবে দেখলাম, যেভাবে ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজিয়ে এসেছি তাতে দুই দিনের জন্য ৩৫ ইউরো দিয়ে টিকেট কিনে লাভ নেই। একদিনে আগে সব হালকা করে ঘুরে দেখি। যেগুলো ভালো লাগবে আগামীকাল সেগুলো আলাদা আলাদাভাবে পাতালরেলে চড়ে গিয়ে ভালোমতো ঘুরে দেখব। চিন্তামতো টিকেট বিক্রয়ের স্থান থেকে একদিনের টিকেট কিনলাম ২০ ইউরো দিয়ে। তারপর বাসে চড়ে বসলাম।
আমি প্রথমেই গেলাম বার্সেলোনা বন্দর এলাকায়। খুব গোছানো এলাকা, আর সিনেমাতে আমরা যেমন দেখি ছোট ছোট ব্যক্তিগত প্রমোদতরী, সেরকম নানা রঙের প্রমোদতরী এখানে নোঙর করে রাখা আছে। কোনোটা বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে, কোনোটা নোঙর করতেছে। অনেকক্ষণ বসে বসে এগুলো দেখলাম। এখানে একটা বেঞ্চে বসে আছি, এসময় দেখা হয়ে গেল সকালে একসাথে নাস্তা করা চীনা মেয়েটির সঙ্গে। ভদ্রতা সম্ভাষন করে পরিচয় দিলাম যে, সকালে তোমার সাথে এক টেবিলে নাস্তা করেছি, আমরা একই হোস্টেলের অধিবাসী।
এ কথায় সেকথায় একটু কথা জমে গেল আর আমরা দুজনে বন্দরটি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। এক ফাঁকে মেয়েটির কাছে প্রশ্ন করলাম সকালে কেন সে নাস্তা হতে শুকনা খাবার দাবার তার ব্যাগে ভরেছিল। মেয়েটি হাসল এবং আমি পরবর্তী ৫ মিনিট ধরে একটা জাতির ভ্রমণ পিপাসা, জানার ইচ্ছা পূরণের কাহিনী শুনলাম। সেই সাথে উপলব্ধি করলাম চীনারা কীভাবে তাহলে এতটা ঘুরে বেড়াতে পারে।
মেয়েটির কথার সারমর্ম ছিল,
আমরা চীনারা চাই একদিন পুরো পৃথিবী শাসন করব, এজন্য আমাদের পুরো পৃথিবীর মানুষদের সম্পর্কে, তাদের জীবনাচার, খাদ্যাভ্যাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি সবই জানতে হবে। তোমরা যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে একটা শহর ঘুরে দেখবে, আমরা সেই পরিমাণ ব্যয়ে দুটো শহর দেখবো। তোমাদের চেয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়বে। তুমি মনে করে দেখো, সকালে আমি সিদ্ধ ডিম, রুটি, মধু, ফলের রস এগুলো সচরাচর যতটুকু মানুষ খায় আমি নিয়েছি দ্বিগুণ। খাবারের অর্ধেকটা খেয়েছি আর বাকি অর্ধেক ব্যাগে করে নিয়ে বেড়াচ্ছি। সারাদিন এগুলো খেয়ে আমার দিন চলে যাবে, এগুলো সবই পুষ্টিকর খাবার, শরীর ভালো থাকবে, খরচও নেই।
রাতে আমি এখানকার চীনা অভিবাসীদের থাকার জায়গা, যেটাকে তোমরা ‘চায়না টাউন’ বলে জানো, সেখানে গিয়ে খুব অল্প ব্যয়ে চীনা খাবার দিয়ে রাতের খাবার সেরে নেব। তাহলে সারাদিনে আমার থাকার খরচ আর একবেলা স্বল্পমূল্যে খাওয়া হয়ে গেল। এভাবেই আমরা সুস্থ থেকে কম ব্যয়ে বেশি ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছি সারা পৃথিবীতে।
আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা সারাবছর পড়াশোনার পাশাপাশি টাকা জমায় আর ছুটিতে দলবেধে পরিকল্পনামতো সারা বিশ্বে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে।
মেয়েটির কথায় আমি বেশ চমৎকৃত হলাম। আমিও ভেবে দেখলাম তাইতো আমিও সকালের নাস্তা বাদ দিলেও দুপুরের আর রাতের খাবারে প্রায় ২৫ ইউরো ব্যয় করি। সেখানে সারাদিনে মেয়েটির ব্যয় মাত্র ৫ ইউরো মত। অর্থাৎ আমার ব্যয়ের ৫ ভাগের ১ ভাগ। আমি যদি ওর মতো করে ঘুরতে পারি তবে প্রায় অর্ধেক খরচে ঘুরতে পারব। মেয়েটির সাথে সেদিন আরো ৩০ মিনিট মতো কথা হয়েছিল। ভ্রমণ সম্পর্কে আমার ধারনা বদলে দিয়েছিলো মেয়েটি। ভ্রমণে আসলেই যে বেশি অর্থ লাগেনা সেটা উপলব্ধি করেছিলাম মেয়েটির সাথে কথা বলে। এরপর রাতে হোস্টেলে দেখা হলে আরো আড্ডা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েটি বিদায় নিলো। আমি চড়ে বসলাম পর্যটক বাসে।
সকালের দিকে আমার আগ্রহ বার্সেলোনার সমুদ্র সৈকতগুলো ঘুরে দেখার। আগেই ইন্টারনেটে পড়ে নিয়েছি- বার্সেলোনায় মোট নয়টি সমুদ্র সৈকত আছে। আমার ইচ্ছা অন্তত পাঁচটি আজ ঘুরে দেখব। পাঠক হয়তো হাসছেন এই ভেবে যে, কীভাবে একদিনে সম্ভব! হ্যাঁ, সম্ভব। ইউরোপের বেশিরভাগ সমুদ্র সৈকতগুলোর দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটারেরও কম। আমরা যারা জীবনের প্রথম সমুদ্র সৈকত হিসেবে কক্সবাজার দেখেছি, আমাদের কাছে ইউরোপের এসব সমুদ্র সৈকত দেখলে বেশ হাসিও পায়। তবে এসব সমুদ্র সৈকতের মূল আকর্ষণ হলো এগুলো খুব গোছানো আর পর্যটকবান্ধব।
সৈকতগুলো বেশ কাছাকাছি অবস্থিত এবং পর্যটক বাসেই কয়েক মিনিটের দূরত্বে। কাজেই দুই ঘন্টায় আমার ৫টি সৈকত ঘোরা হয়ে গেল। প্রতিটি সৈকত খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন আর সুন্দরভাবে সাজানো। কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। যে যার মতো সৈকতে শুয়ে-বসে উপভোগ করছে। সেখানে ভ্রমণ শেষ করে বাসে উঠে আমি আবার ফিরে আসলাম সিটি সেন্টারে।
বার্সেলোনার সিটি সেন্টারটি দিন-রাত সবসময় জমজমাট থাকে। আমি গুগলে ঘাটাঘাটি করে এক ভারতীয় রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করলাম। রেস্টুরেন্টটি এক গলির ভেতর এবং খাবারদাবার বেশ মানসম্মত। একজনের হায়দরাবাদী বিরিয়ানি খেতে খরচ পড়ল ১৫ ইউরো। এমনকি এটা ইউরোপীয় হিসেবেও বেশ ব্যয়বহুল, যেখানে বিভিন্ন চেইন ফুডের দাম ৫-৭ ইউরোর মধ্যে। খেয়ে রেস্টুরেন্টে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে এবার রওয়ানা দিলাম ন্যূ ক্যাম্পে।
ন্যূ ক্যাম্প হলো বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের মাঠ । এখানেই হোম ভেন্যু, প্রশিক্ষণ, যুবদলের প্রশিক্ষণসহ সব হয়। বাস থেকে নেমে ২০ ইউরো দিয়ে টিকেট কিনে ঢুকে পড়লাম। ন্যূ ক্যাম্প অনেক বড় এবং ঘুরতে যথেষ্ট সময় নিয়ে আসতে হয়। চাইলে এখানেই একটা দিন ঘুরে কাটানো সম্ভব। এখানে ওদের খেলোয়াড়দের সংখ্যাখচিত পোশাক, জুতা, ফুটবলসহ নানা জিনিসের দোকান আছে। ক্লাবের একটি জাদুঘর আছে। একটি রুম আছে যেখানে দলের জেতা সমস্ত ট্রফি সাজিয়ে রাখা আছে। আমার হাতে যেহেতু সময় কম, তাই আমি ঘন্টাখানেকের ভেতরে ঘুরে শেষ করলাম। এরপর রওয়ানা দিলাম লা সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া দেখতে।
শুধু স্পেন বা বার্সেলোনা নয়, লা সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া সারা পৃথিবীর মধ্যেই দেখার মতো স্থান, এটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মতো স্থান। রোমান গথিক স্টাইলে এই ব্যাসিলিকাটির নির্মাণ শুরু হয় ১৮৮২ সালে, যার নির্মাণকাজ এখনও চলছে। ধারণা করা হয়, এর নির্মাণকাজ এর স্থপতি এর মৃত্যুবরণ করার ১০০ বছর পর অর্থাৎ ২০২৬ সালে শেষ হতে পারে। পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট ২০১০ সালে এই স্থাপনাটিকে একটি ব্যাসিলিকা বলে ঘোষণা দেন। বর্তমানে এটি ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ।
মূলত স্থাপনাটির স্থপতি এর নক্সাটি তৈরি করেছেন অত্যন্ত জটিলভাবে, সেজন্য এর নির্মাণ শেষ হতে এত সময় লাগছে। প্রতিবছর ৪৫ লাখের বেশি পর্যটক স্থাপনাটি ভ্রমণ করে। আমিও তাদের একজন হয়ে টিকেট কেটে ঢুকে গেলাম। ভেতরে স্থাপনাটি আসলেই অত্যন্ত মনোরম এবং খুবই জটিল প্রকৃতির। আমি বেশ সময় নিয়ে ভবনটির প্রতিটি তলা ঘুরলাম। এর নক্সা ও স্থাপত্যশৈলী সত্যি অসাধারণ। বিভিন্ন মর্মর পাথর, কাচ দিয়ে এর প্রতিটি কোণ নির্মিত। দর্শনাথীদের জন্য দর্শনের পাশাপাশি নির্মাণকাজও চলছে। প্রায় ২ ঘন্টা ধরে স্থাপনাটি ঘুরে দেখলাম।
এখান থেকে বের হয়ে এদিন সারা দিনে আরো বেশ কিছু পর্যটন স্থাপনা বাইরে থেকে দেখে এসেছি, যেগুলোর ভেতর থেকে কিছু নির্বাচিত করলাম দ্বিতীয় দিনে ঘুরে দেখব বলে। এছাড়া দ্বিতীয় দিনে যথাসম্ভব পায়ে হেঁটে ঘুরে এই শহরের মানুষের জীবনযাত্রা বোঝার চেষ্টা করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
সন্ধ্যার পর আবার ফিরে আসলাম সিটি সেন্টারে। যারা থাইল্যান্ডের পাতায়ার ওয়াকিং স্ট্রিট, ফুকেটের বাংলা স্ট্রিট বা ব্যাংককের খাওসান রোডে হেঁটেছেন, তাদের কাছে মনে হবে এটা ওয়াকিং স্টিটের বড়দাদা। থাইল্যান্ডের স্ট্রিটগুলোর মতো বিশটা স্ট্রিট এক করলে বার্সেলোনা সিটি সেন্টারের ওয়াকিং স্ট্রিটের মতো হবে।
হাজার হাজার লোক স্রোতের মতো হাঁটছে, খাচ্ছে, আড্ডা দিচ্ছে। আমি যখন ভ্রমণ করছিলাম সে সময়ে স্পেন থেকে কাতালোনিয়া আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র করার আন্দোলন চলছিল, যেটার কেন্দ্রবিন্দু বার্সেলোনা, অথচ আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম বললে যা বুঝি এখানে তার বিন্দুমাত্র নমুনা নেই। মনে হচ্ছে কোনো উৎসব হচ্ছে। এমনকি বার্সেলোনার সমস্ত বড় বড় ব্র্যান্ড শপ, কেনাকাটার বাজারগুলোও এখানেই অবস্থিত।
আমি একটার পর একটা দোকানে ঢুঁ দিতে লাগলাম । কাপড়, জুতা এসবের দাম দেখি আর পকেটের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে মন ভারাক্রান্ত হয়। একটা দোকান থেকে সবচেয়ে কম দামে লিওনেল মেসির একটি জার্সি কিনলাম, তা-ও সেটার দাম নিলো ২০ ইউরো। এক ঘনিষ্ট বন্ধুর জন্য বার্সেলোনা দলের একটা পানির বোতল কিনলাম ৫ ইউরো দিয়ে। এরকম আরো টুকটাক কিছু স্যুভেনির কিনলাম। প্রায় ৩ ঘন্টা ঘুরে-ফিরে ক্ষুধার্ত হয়ে ঢুকে গেলাম এক তুর্কি খাবারের দোকানে। এদের দোকানের খাবারের তালিকায় সবচেয়ে সস্তা খাবারটির দাম ছিল ২০ ইউরো। সেটাও কাবাব। তুর্কিরা কাবাবের উচ্চারণ করে কেবাব। তুর্কি কাবাব সারা বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের যেখানে তুর্কি খাবারের দোকানে গিয়েছি, দেখেছি তুর্কি কাবাবের জনপ্রিয়তা। খেতেও সুস্বাদু আর পরিমাণে অনেক দেয়। সাধারণত একজন একা এক প্লেট কাবাব খেয়ে শেষ করা সম্ভব না। খাবার শেষ করে আরো এক ঘন্টা ঘুরে-ফিরে হোস্টেলে ফিরে আসলাম।
হোস্টেলের বসার ঘরেই দেখা হয়ে গেল চীনা মেয়েটির সাথে। শুরু হলো আমাদের ভ্রমণ আড্ডা। মেয়েটির কাছেই প্রথম জানলাম- ভ্রমণ আসলে একটা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, একে মনে-মননে লালন করতে হয়। এটা নিয়ে পর্যাপ্ত লেখাপড়া করতে হয়।
ভ্রমণ করতে হয় পরিকল্পনা করে। ভ্রমণের স্থানে গিয়ে স্থানীয় মানুষের সাথে মিশে তাদের জীবনাচার, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি এসব কাছ থেকে গভীরভাবে দেখতে হয়। আরো জানলাম- ভ্রমণ মানুষকে জ্ঞানী করে, বিনয়ী করে, সামাজিক জীব হিসেবে বাঁচতে শেখায়। জীবনে যখনই সুযোগ আসে ভ্রমণ করা উচিত। পৃথিবীটা বহুস্তর বিশিষ্ট স্থান। এর প্রতিটি স্তর সম্পর্কে জানতে হলে একমাত্র উপায় ভ্রমণ।
মেয়েটি আমাকে হাতে-কলমে একাকী ভ্রমণের অনেক কলাকৌশল শেখাল। কীভাবে হোস্টেল নির্বাচন করতে হবে, ভ্রমণ ব্যয় ঠিক করতে হবে, ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে হবে, কম খরচে কীভাবে ভ্রমণ করতে হবে এসবের প্রাথমিক দীক্ষা পেয়েছিলাম সেইন্ট ক্রিস্টোফার ইনের সেই চীনা মেয়েটির কাছে। ভ্রমণ জীবনকে বদলে দিয়েছিল প্রথমদিনের সেই বার্সেলোনা ভ্রমণ আর সেইন্ট ক্রিস্টোফার ইনের চীনা মেয়েটি।