সিলফ্রা ফিশার: জলের নিচে বিস্ময়কর সৌন্দর্যের লীলাভূমি

জলভাগ মানুষের কাছে প্রচণ্ড বিস্ময়ের এক জায়গা। অনেক অজানা, অদেখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে পানির তলদেশে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসুরা সবসময় অনুসন্ধান করে চলেন নতুন কিছু জল-সৌন্দর্য উপভোগের আশায়।
যদি হয় এমনটা যে, পানির নিচে দাঁড়িয়ে আপনি একসাথে ছুঁয়ে দেখতে পারবেন দুই মহাদেশকে, সাঁতার কাটতে পারবেন অনায়াসে! এতটুকু পড়ে নিশ্চয়ই নড়েচড়ে বসেছেন অনেকে। চলুন আজকে জেনে নেই এমন এক জায়গার কথা।

সিলফ্রা ফিশার

আইসল্যান্ডের থিংভিল লেকে অবস্থিত একটি ডাইভিং সাইট সিলফ্রা ফিশার। সিলফ্রা নামে পরিচিত জলের মোট এলাকাটি মাত্র ১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে।

সিলফ্রা ফিশার, দুটি প্রধান কারণের জন্য বিশ্বের শীর্ষ ডাইভ সাইটগুলির একটি হিসাবে পরিচিত।

প্রথমত, সিলফ্রা ফিশার আসলে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে একটি ফাটল, যার মানে আপনি ডাইভ করবেন এমন এক জায়গায় ঠিক যেখানে মহাদেশীয় প্লেটগুলি মিলিত হয় এবং প্রতি বছর প্রায় ২ সে.মি. করে দূরে চলে যায়। সিলফ্রা একমাত্র স্থান যেখানে মহাদেশীয় প্লেটগুলির ফাটলের মধ্যে সরাসরি সাঁতার কাটতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, সিলফ্রা ফিশারের পানির দৃশ্যমানতা ১০০ মিটারেরও বেশি, এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করে যা কদাচিৎ দেখা যায়। এ বিস্ময়কর জল স্পষ্টতার কারণ দুটি: এখানে পানির তাপমাত্রা থাকে প্রায় ২° – ৪° সেলসিয়াসের  মধ্যে এবং এই পানি ৩০ – ১০০ বছর ধরে পোরাস ভূগর্ভস্থ লাভা্র মাধ্যমে ফিল্টার হয়ে থাকে। এই পানি ভূগর্ভস্থ কূপ থেকে প্রবাহিত হয়ে থিংভেলির লেকে এসে পৌঁছায়। সিলফ্রা ফিশারের পানি পানযোগ্য পানির মতোই পাওয়া যায় এবং আপনি সাঁতার কাটার সময় যেকোনো সময়ে এটি পান করতে পারেন।

আন্তরিক্ষীয় দৃশ্য অনুযায়ী, ছবিতে যে ধূসর রঙের লম্বা লাইনটি দেখা যাচ্ছে, এটাই হচ্ছে আইসল্যান্ডের, থিংভেলির সিলফ্রা ফিশার। এর ডানদিকে হচ্ছে উত্তর আমেরিকা এবং বাম দিকে ইউরোপ।

ভ্রমণের শুরুতেই প্রথম যে এলাকাটি আপনি দেখতে পারবেন সে জায়গাকে বলা হয়ে থাকে ‘টয়লেট বোল’, কারণ এ জায়গা দিয়েই ডুবুরিদের সিলফ্রা ফিশারের প্রধান অংশে প্রবেশ করতে হয়। সুড়ঙ্গের অস্থিতিশীলতার কারণে এই পথ দিয়ে প্রবেশের এখন আর অনুমতি দেওয়া হয় না। তবে বোলটি এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, যা সিলফ্রা দ্বারা সংযুক্ত। কারণ এটি সিলফ্রা ফিশারের প্রবেশদ্বারটি ধারণ করে।

সিলফ্রা ফিসারের সবচেয়ে গভীরতম বিন্দুটি ধারণ করে ৬৩ মিটারে। তবে এটি খালি পাথর ও পতনের ঝুঁকির কারণে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যদিও গুহাটি ১৯৯৮ সালে আমেরিকান গুহা ডুবুরিদের একটি গ্রুপ দ্বারা ম্যাপ করা হয়েছিল, তবে এটি অজানা যে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ফলে কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কিনা।

সিলফ্রার পাঁচটি বিভাগের প্রথম যে অংশে ডুবুরিরা পৌঁছায় তা বড় ক্র্যাক হিসাবে পরিচিত। এই অংশটির দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার এবং প্রধান ফিশারের গভীরতম অংশ এটি।

দ্বিতীয় অংশটি সিলফ্রা হল নামে পরিচিত।  এই জায়গাটিতেই ফিশারটি প্রথম প্রশারিত হয়। এখানকার গভীরতা ১০ মি., দৈর্ঘ্য ৫০ মি. এবং প্রস্থ ৮ মি.।

এরপর আপনি পৌঁছে যাবেন ক্যাথিড্রালে। ক্যাথিড্রালে প্রবেশ করার পর আপনি ১০০ মিটারের বেশি দৃশ্যমানতার প্রমাণ পেয়ে যাবেন, যা পৃথিবীর যে কোনো স্থানে রেকর্ড করা দীর্ঘতম দৃশ্যমানতা।

ক্যাথিড্রালের শেষে ডুবুরিরা পৌঁছে যাবেন একটি বিপজ্জনক স্থানে যেখানে প্রবাহের উপরের দিকে ঠেলে দেয়ার প্রবণতার কারণে আপনাকে পানির নিচ থেকে উপরের দিকে ঠেলে দিতে চাইবে। আর এ কারণে এখানে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ জায়গায় আসার সাথে সাথেই আপনাকে বাম দিকে ঘুরে যেতে হবে এবং সিলফ্রা ফিশারের শেষ অংশে এসে আপনি পৌঁছাবেন।

সিলফ্রা ল্যাঙ্গুন আপনাকে প্রায় ১২০ মিটার পর্যন্ত দৃশ্যমানতা সহ আরো অসাধারণ কিছু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দিবে। এখানে ল্যাঙ্গুনের পানি ফিশারের গভীর নীল পরিবর্তিত হয়ে ফিরোজা রঙে রুপান্তরিত হয়। এ অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য।

স্কুবা ডুবুরিদের জন্য এটি একটি দর্শনীয় স্থান। স্বচ্ছ জলের নিচে সাঁতার কাটার জন্য একটি অসাধারণ জায়গা। বিশেষ করে পরিষ্কার, তাজা জল, ভূতাত্ত্বিক তাৎপর্য এবং মহাদেশীয় প্লেটের মধ্যে সাঁতারের বিরল সুযোগের কারণেই ডুবুরিরা আকৃষ্ট হয়। প্রাকৃতিক এবং ভূতাত্ত্বিক স্বতন্ত্রতার জন্য থিংভেলিরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। পৃথিবীর শীর্ষ ৫০টি ডাইভিং সাইটের মধ্যে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

যদিও থিংভেরিল লেকের মাছ প্রজাতির একটি প্রাচুর্য রয়েছে এবং হ্রদটি খুব জনপ্রিয়, কিন্তু মাছ সাধারণত সিলফ্রা ফিশারে খুব একটা দেখা যায় না। গ্রীষ্মকালে পাথরের  বুকে উজ্জ্বল সবুজ শ্যাওলা সিলফ্রা ফিশারে এক অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে।

সিলফ্রা ফিশারে রয়েছে প্রচুর ফাটল, উপত্যকা, আগ্নেয়গিরি এবং উষ্ণ প্রস্রবণ। এখানে অবস্থিত দুই মহাদেশীয় প্লেটগুলি প্রতি বছরে প্রায় ২ সে.মি. করে দূরে সরে যাচ্ছে।

ডক্টর আলেকজান্ডার মাস্টার্ড, তিনি একজন ডুবো ফটোগ্রাফার, সামুদ্রিক অণুজীব বিজ্ঞানী এবং লেখক। তিনি থিংভেলির সিলফ্রা ফিশারে প্রায় ৮০ মিটার নিচে ভ্রমণ করেছিলেন এবং অসাধারণ কিছু ছবি তুলেছেন।

ডক্টর আলেকজান্ডার মাস্টার্ড সিলফ্রা ফিশারে

তার মতে, “আমি পৃথিবীর অনেক জায়গায় সাঁতার কেটেছি, কিন্তু আমার দেখা মতে এটি হচ্ছে সব থেকে পরিস্কার জলের লেক।” তার এলবাম থেকে সংগৃহীত কিছু ছবি-

ডক্টর আলেকজান্ডার মাস্টার্ড এবং তার সহযাত্রীরা , এই ছবিটি তুলেছেন, আইসল্যান্ডের কাছাকাছি উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ এর দুই প্লেট এর মাঝামাঝি জায়গায় প্রায় ৮০ ফুট পানির গভীরে গিয়ে

সিলফ্রা ফিশারে অবস্থিত কিছু আগ্নেয়গিরি সম্বলিত এলাকা

সিলফ্রা ফিশার থিংভেলির ন্যাশনাল পার্কের আইন দ্বারা সুরক্ষিত, যা শুধুমাত্র স্থানীয় সংস্থাগুলির সাথে ডুবুরিদের প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। আপনি এখানে দিনের বেলা ট্যুরে যেতে পারেন এবং অনেক সময় সন্ধ্যায় ভ্রমণেরও সুযোগ দিয়ে থাকে। ডুবুরিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু জিনিসপত্র হচ্ছে থার্মাল আন্ডার স্যুট, ড্রাই স্যুট, ডাইভিং সরঞ্জাম এবং সাথে থাকা প্রয়োজন একজন সার্টিফাইড গাইড। ডাইভিং এর সময় একটি সেট রুট অনুসরণ করা হয় যা আপনাকে সিলফ্রা ফিশারের সমস্ত প্রধান বিভাগ দেখার সুযোগ করে দেবে। ডুবুরিদের গতির উপর নির্ভর করে ৩৫ থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া এবং এটি সত্যিই উপভোগ্য অভিজ্ঞতা।

সারা বছর ধরে, সিলফ্রা ফিশার তার সৌন্দর্য এবং  বিভিন্ন জলস্তরে নানান রকম রঙ ধারণ করে রাখে। গ্রীষ্মের সময় যখন সূর্যের আলোকরশ্মি স্বচ্ছ পানির বুক চিরে গভীরে প্রবেশ করে, তখন এটি বিভিন্ন রং তৈরি করে। এটা ঘটে থাকে, কেননা ক্রিস্টাল যেভাবে আলোক রশ্মিকে বিকিরণ করে রংধনু তৈরি করে, স্বচ্ছ আলোও এক্ষেত্রে একই কাজ করে থাকে।

শৈবালগুলো উজ্জ্বল আলোক বস্তুর মতোই পানির তলদেশে উজ্জ্বলতার আলোক বর্ধিত করে এবং নানান রং-এর আলোকচ্ছটা সৃষ্টি করে। আর শীতকালে, দেখে মনে হয় যেন স্বচ্ছ পানির উপরে তুষারকণা ভাসছে। আর এত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কারণেই, আইসল্যান্ড সফরটা সম্পূর্ণ হয়ে উঠে না যদি আপনি সিলফ্রা ফিশারের এই অনবদ্য রুপ না দেখেই ফিরে আসেন।

Video:

তথ্যসুত্র

১) dive.is/dive-sites/silfra/

২) metro.co.uk/2015/12/17/diver-swims-between-europe-and-north-america-sort-of-5570820/

৩) dailymail.co.uk/sciencetech/article-1385589/The-growing-gap-Eurasia-North-American-tectonic-plates.html

 

Related Articles

Exit mobile version